Sridip Bhattacharya Cover

Red November: A Historic Lesson For Todays Struggle

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য

মানবসভ্যতার ইতিহাসে নভেম্বর বিপ্লব এক নতুন দিশা উপস্থিত করেছিল। এই বিপ্লব ছিল এক ঐতিহাসিক পর্যায়। ইতিহাসে এমন কতিপয় উদাহরণ আছে যা সমাজ-সভ্যতার প্রগতির বিচারে দিকনির্দেশকারী ঘটনা বলে সমাজবিজ্ঞানে বিবেচিত হয়, নিঃসন্দেহে বলা যায় নভেম্বর বিপ্লব সেই তালিকাভুক্ত। ১৯১৭ সালে ৭ই নভেম্বর থেকে দশ দিনের এই বিপ্লবী সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পত্তন ঘটাল। এই বিপ্লব রুশ দেশের বুকে সংগঠিত হলেও এর তাৎপর্য আন্তর্জাতিক। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম ক্ষমতা থেকে শোষকশ্রেণীকে হটিয়ে দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল।

নভেম্বর বিপ্লব পরবর্তী একশো পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মানবসভ্যতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছিল তার প্রভাব পরবর্তীকালের সমগ্র দুনিয়ায় শুধু লক্ষিতই হচ্ছে এমনটা না, এর প্রভাব মানবসমাজে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিও পাচ্ছে। নভেম্বর বিপ্লব বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের যে মতবাদ অর্থাৎ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঠিক প্রয়োগ করেছিল। গড়ে তুলেছিল সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব বিপ্লবী পার্টি। সেই পার্টিই হল কমিউনিস্ট পার্টি। সেই পার্টি গড়ে তুলেই সমস্ত শোষিত বঞ্চিত মেহনতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা হয়। রাশিয়ার কৃষক সমাজকে টেনে আনা হয় শ্রমিক-সর্বহারাদের পাশে- শোষক হয়ে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন। এর দ্বারাই বিপ্লবী সংগ্রাম সাফল্য অর্জন করেছিল। এই কাজ আসলে নির্দিষ্ট দেশে মার্কসবাদের সুনির্দিষ্ট ও সঠিক প্রয়োগ, সেই প্রয়োগেরই চুড়ান্ত নিদর্শন হল নভেম্বর বিপ্লব।

নভেম্বর বিপ্লবের আগেও সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখলের প্রয়াস গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় সর্বহারার রাষ্ট্র, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। আর তাই বিশেষ করে মনে রাখতে হয় নভেম্বর বিপ্লব মানেই শুধু দীর্ঘস্থায়ী এক সংগ্রামের ইতিহাস মাত্র নয়। ভবিষ্যতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে কাজে লাগে এমন বহুবিধ উপাদানও এই সংগ্রাম আমাদের সামনে এনে হাজির করে।

নভেম্বর বিপ্লব থেকে সারা দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণীর জন্য এক ঐতিহাসিক শিক্ষাক্রমও বটে। এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই ফিরে দেখতে হবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রাশিয়া কেমন অবস্থায় ছিল। জারের শাসনে থাকা রুশ দেশ। জারের ভয়ংকর অত্যাচারের শিকার ছিলেন রুশি জনগন। পরবর্তীকালে রাশিয়াতে পুঁজিবাদ গড়ে উঠতে শুরু করলে তার প্রভাবেই আবির্ভাব ঘটলো রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর। এরাও জারের অত্যাচারের বাইরে ছিল না। অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, জারের শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই রুশদেশে অনেক আগে থেকেই ছিল। সেই সময়কার রাশিয়ায় এমন লড়াই সংগ্রামের জন্য কিছু রাজনৈতিক সংগঠন ও গড়ে উঠেছিল (যেমন নারোদনিক) যারা ব্যক্তি হত্যার রাজনীতির পথ গ্রহণ করেছিল। এরা মানুষকে সংগঠিত করার বদলে তাদের ক্ষোভকে ব্যবহার করার এক ভ্রান্ত রাজনীতির পথই ছিল এদের কর্মসূচি। সমাজের তরুণ ও যুব অংশের মধ্যে এই সংগঠনের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে লেনিনের নিজের বড় ভাই আলকজন্ডার অবধি এই নারোদনিক দের পক্ষ নিয়ে জারকে হত্যার প্রয়াসে যুক্ত ছিলেন। এই কাজের জন্য জারের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। শেষ পর্যন্ত তার ফাঁসি হয়। উল্লেখযোগ্য হল এই যে দাদার ফাঁসিতে মৃত্যুবরণের ঘটনাতে লেনিন দুঃখিত হন, ব্যথিত হন – কিন্তু তিনি ভীত হননি বরং অত্যাচারী জার শাসনের অবসানের লক্ষ্যে তার বিপ্লবী জেদ ক্রমান্বয়ে বেড়েছিল। এই শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রামের পথ ধরে এগোবার জন্য তিনি মনস্থির করেন।

ততদিনে রুশ দেশে মার্কসবাদের প্রভাব শুরু হয়েছে। প্লেখানভ প্রমুখদের ভূমিকায় সেই দেশে মার্কসবাদের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লেনিন মার্কসবাদ অধ্যয়ন শুরু করলেন, নিজেকে প্রকৃত মার্কসবাদী হিসাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। মার্কসবাদ শুধু অধ্যয়নের বিষয় না, একে প্রয়োগ করতে হয়, তাই একে প্র্যাকসিস বলে। লেনিন প্রথম থেকেই এই সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন। শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলে দেশের শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগনকে ঐক্যবদ্ধ করে সফল বিপ্লবের লক্ষ্যে সংগ্রামের পথে মার্কসবাদের প্রয়োগ ঘটাতে হবে এই ছিল তার উপলব্ধির সারকথা। এই লক্ষ্যে এগোতে গেলে প্রয়োজন ছিল শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব পার্টি। সেই পার্টি গড়ে তোলার প্রয়াসে তিনি নিজেকে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত করলেন। লেনিন এবং প্লেখানভের যৌথ উদ্যোগে আটের দশকের শেষভাগে (১৮৯৮) রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবর পার্টি গড়ে উঠল। লক্ষ্য ছিল শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে সর্বহারা বিপ্লব। এতে শুধু যে জার শাসনের অবসান ঘটবে তাই নয়, রুশদেশের মাটিতে শোষণের ও অবসান ঘটানো হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতন্ত্র। কিন্তু পার্টি গড়ে তুলেই সমস্যার শেষ হল এমনটা না। পার্টির অভ্যন্তরে রাজনীতি, সংগঠন এমনকি বিপ্লবী মতবাদকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও গুরুতর বিতর্ক শুরু হল। একটা সময় সেই বিতর্কে প্লেখানভের বিরুদ্ধেও লেনিনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই বিতর্কের সমাধান করতে গিয়ে পার্টিতে কিছু বিভাজনও ঘটে।

লেনিন বিপ্লবী লক্ষ্যে, মতাদর্শগত বিষয়ে একনিষ্ঠ ছিলেন।  তিনি একদিকে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করেছেন, আরেকদিকে বিপ্লবী লক্ষ্যে সংগঠন ও সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব ও পালন করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির কাঠামো সম্পর্কিত ধারণা সারা পৃথিবীর সাথে রাশিয়তে ও বিকশিত হচ্ছিল। সংগঠনের লক্ষ্য, কর্মসূচি ও পরিচালনার ধারা এই সমস্ত প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে তাকে ব্যখ্যা করলেন লেনিন। ১৯০২ সালে তার লেখা ‘কি করিতে হইবে’ প্রকাশিত হল। এর পরে ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হল আরেকটি অসামান্য রচনা ‘এক পা আগে দুই পা পিছে’। শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রনী বাহিনী হিসাবে পার্টি, শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী সংগঠন হিসাবে পার্টি, শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠিত ও সর্বোচ্চ বাহিনী হল কমিউনিস্ট পার্টি যা হবে সম্মিলিত ইচ্ছার এক মূর্ত প্রতীক – এইসমস্ত যা কিছু আজ আমরা কমিউনিস্ট পার্টি বলতে বুঝি সেই সমস্ত ভাবনারই এক সুসংহত সুত্রায়ন ঘটেছিল এই দুটি রচনায়। কমিউনিস্ট পার্টির মর্মবস্তু হিসাবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ধারণাও বিস্তারিতভাবে এই সময়েই ব্যখ্যা করেছিলেন তিনি। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না, শুধু রুশদেশে না, সারা পৃথিবীতেই কমিউনিস্ট পার্টির রুপ কি হবে, তার পদ্ধতি কি হবে, কিভাবে সেই পার্টি গড়ে উঠবে এসমস্ত ধারণাই লেনিনের থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা। একে ভিত্তি করেই রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি এগিয়ে চলতে শুরু করে। আমরা জানি ১৯০৫’র বিপ্লবের কথা। সেই বিপ্লব ব্যার্থ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই ব্যার্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই লেনিনের নেতৃত্বে রুশদেশের পার্টি (তখনকার নাম ছিল আরএসডিএলপি বা রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবর পার্টি) সক্রিয় থাকে। সেই পর্বে তাদের বহুবিধ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বাইরের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করার পাশাপাশি পার্টির ভিতরেও মতপার্থক্য নতুন করে বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিভাজন ঘটেছিল রাজনীতির প্রশ্নে, মতাদর্শের প্রশ্নে এমনকি সংগঠনের প্রশ্নেও। পার্টির সদস্য কারা হবে, এই নিয়ে বিতর্ক হলে একটি অংশের যুক্তি ছিল পার্টির মতাদর্শ, রাজনীতি ও বিপ্লবী কর্মসূচী যারা মেনে নেবেন এমন সকলেই পার্টির সদস্য হতে পারবেন। পার্টি সদস্য হওয়ার পূর্বশর্ত হিসাবে মতাদর্শ, রাজনীতি ও কর্মসূচী গ্রহনের সাথে লেনিন বিশেষভাবে যুক্ত করলেন সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহনের শৃঙ্খলার বিষয়টিকে। লেনিনের বক্তব্য ছিল পার্টির সদস্যকে পার্টির বিপ্লবী কর্মসূচিতে নিরন্তর অংশগ্রহণ করতে হবে, তা নাহলে পার্টি শুধু বচনবাগীশ বুদ্ধিজীবীদের পার্টিতে পরিণত হবে। আজও এই উপলব্ধি আমাদের মাথায় রেখেই এগিয়ে চলতে হয়। ১৯০৫ পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল স্তলিপিনের পর্বটি। স্তলিপিন ছিলেন জারেরই প্রতিনিধি। ১৯০৫ সালে বিপ্লবী প্রচেষ্টা ব্যার্থ হলে তিনি রুশদেশে কমিউনিস্ট পার্টির উপরে ভয়ানক নিপীড়ন নামিয়ে আনেন। পার্টি কর্মীদের হত্যা করা শুরু হয়, বিনা বিচারে কারাগারে আটক সহ নানাবিধ নির্যাতন চলে। রাশিয়ার মাটিতে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামকে তো বটেই, কমিউনিস্ট পার্টিকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন স্তলিপিন।   

এই পর্বে বলশেভিকরা প্রকাশ্য ও গোপন দুই পন্থাতেই সক্রিয় থেকে বিপ্লবী পার্টি ও বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লড়াই চালিয়ে গেছেন। বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে রাশিয়া সহ সারা পৃথিবীতে পুঁজিবাদ কিভাবে সাম্রাজ্যবাদের স্তরে উন্নীত হয়েছে, রুশ দেশে সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব ব্যখ্যা করেছিলেন লেনিন। তার আরেক অসামান্য তাত্ত্বিক রচনা ‘সাম্রাজ্যবাদঃ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ বইতে তিনি সাম্রাজ্যবাদকে শুধু পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ হিসাবেই বর্ণনা করেননি, পুঁজিবাদের মুমূর্ষু রূপ হিসাবেও তাকেই তুলে ধরেছেন। এখানেই লেনিনের শিক্ষার বৈশিষ্ট। সাম্রাজ্যবাদের যুগে বিপ্লবী সম্ভাবনার সামনেও যে নতুন সুযোগ উপস্থিত হয়েছে তাও তিনি চিহ্নিত করলেন। একটা সময় মার্কসবাদীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা ছিল যে সমাজতন্ত্র বোধহয় শুধুমাত্র উন্নত পুঁজিবাদী দেশেই সম্ভবপর হবে। লেনিন দেখালেন সাম্রাজ্যবাদের যুগে গোটা পৃথিবী এমন এক শৃঙ্খলে জড়িয়ে রাখা হচ্ছে যার মূলগত চরিত্র একটাই – মুমূর্ষু পুঁজিবাদ। বিশ্বজোড়া সেই শৃংখলে এমনও কিছু অংশ থাকবে যা কার্যত সেই বাঁধনের দুর্বলতম গ্রন্থি- সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সেখানে উপযুক্ত আঘাত হানতে পারলে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরনো যাবে। এমনকি সেই দুর্বল অংশটি যদি কোন পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী দেশও হয় তাহলে সেই দেশ থেকেই সর্বহারা বিপ্লব প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল দুনিয়ার বাজার দখলের লক্ষ্যে  সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যে কার লড়াই। এই লড়াইতে জার শাসিত রুশ দেশ ও ছিল একটি শিবিরে। বিশ্ব যুদ্ধকে সামনে রেখে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক (৩ য় আন্তর্জাতিক) এর বাসলে কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল এই যুদ্ধের সাথে সর্বহারার কোনও সম্পর্ক নেই। তাই এই যুদ্ধে পিতৃভূমি রক্ষার নামে শ্রমিকরা নিজেদের দেশের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করবে না। ঐ কংগ্রেসই সিদ্ধান্ত নিল এই যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগকে কাজ লাগিয়ে দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে বিপ্লবী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পরে দেখা গেল রাশিয়া ও জার্মানির পার্টি ব্যতীত বাকি সকলেই নিজেদের দেশের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করল। রুশ দেশে সেই যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েই সর্বহারা বিপ্লবের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্বের দিকে এগিয়ে চলল। ১৯১৭ সালে সেই পরিস্থিতি তুঙ্গে পৌঁছাল। ঐ বছরের শুরুর দিকেই (মার্চ মাসে) বিপ্লবী লক্ষ্যের প্রথম পর্যায় সংগঠিত হল। একে ইতিহাসে মার্চ বিপ্লব বলা হয়। এতে জারের অপসারণ ঘটল ঠিকই কিন্তু ক্ষমতায় যারা এলেন তারাও শ্রমিক, কৃষক কিংবা জনগণের প্রতিনিধি ছিলেন না। প্রকৃত অর্থে আপোষকামী এক গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হল, একেই কেরেনস্কি সরকার বলে আমরা চিনি। এই সময় আশু কর্তব্য সম্পর্কে বলশেভিকদের প্রথমদিকে কিছুটা দ্বিধা ছিল। দীর্ঘদিন অন্তরীণ থাকার পরে লেনিন রাশিয়ায় প্রবেশ করলেন। সেই মুহূর্তে রাশিয়াতে বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তাকে সঠিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে গেলে কি করণীয় প্রকাশ করলেন তিনি। তার সেই বক্তব্যই হল এপ্রিল থিসিস। এই থিসিসে একদিকে যেমন আত্মসমর্পণ কারী, আপোষকামী দের ভ্রান্ত নীতির মুখোশ খুলে দিল তেমনই আরেকদিকে সর্বহারা বিপ্লবকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দিশাও দেখালো। সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে ( All Power To The Soviets) স্লোগানের জন্ম হয় তখনই। এই সময় থেকেই বলশেভিক পার্টি বিপ্লবের লক্ষ্যে চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল।

যত সময় এগিয়েছে সারা দেশ জুড়ে শ্রমিক, কৃষক, অন্যান্য অংশের মানুষ এমনকি কষাক বাহিনীর মধ্যেও পার্টির প্রচার এমন কার্যকরী হয় যে সর্বত্র বলশেভিক সংগঠনের প্রসার ঘটতে থাকে। জার শাসনে বিভিন্ন ছোটবড় জাতি গোষ্ঠী গুলির কারাগার ছিল রাশিয়া, সেইসব জাতি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও বিপ্লবী সংগঠন ক্রমশ প্রসারিত হতে থাকে। তারাও প্রায় সবাই বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত হলেন।

৭ই নভেম্বর অরোরা যুদ্ধজাহাজ থেকে কামান গর্জে উঠল। বিপ্লবী যুদ্ধ শুরুর সংকেত ঘোষণা করা হয়েছিল এভাবেই। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিপ্লবী সংগঠনের কার্যধারা অসামান্য দক্ষতায় পরিচালিত হয়েছিল বলেই অতি দ্রুত রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণীর সর্বহারা বিপ্লবের কাজ সম্পন্ন হল, একথা মনে রাখা উচিত। সেই সংগঠনে যুক্ত ছিল রুশদেশের কৃষকদের প্রায় ৯০ শতাংশ, অন্যান্য শোষিত বঞ্চিত মানুষদের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ এমনকি শশস্ত্র কসাক বাহিনীরও প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ। এদের সবাইকে বিপ্লবের পক্ষে বলশেভিকরা সংগঠিত করতে পেরেছিলেন বলেই সেদেশে বিপ্লব সফল হয়।

রুশ বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই একে অল্প কয়েকদিনের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মসূচির ফলাফল হিসাবে বিবেচনা করেন। ১৯২০ সালে, তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসের জবাবী বক্তব্য পেশ করার সময় লেনিন এই বিষয়ে জরুরী একটি মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর সেই কথা দিয়েই নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষার সারাংশ লেখা যায়। তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক টেরাসেলির বক্তব্যের জবাবে লেনিন বলেছিলেন- শুধু কমরেড টেরাসেলি নন, অনেকেই এখনও রুশ বিপ্লবের থেকে প্রকৃত শিক্ষাকে গ্রহণ করতে পারেননি। এটাই দুঃখের। প্রকৃত অর্থে রুশ বিপ্লবকে বুঝতে হলে দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা মার্কসবাদের প্রচার ও প্রসার, সর্বহারার প্রকৃত সংগঠন গড়ে তোলা, তীব্র আন্ত:পার্টি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী সংগঠন হিসাবে পার্টিকে মজবুত করা, অগণিত শোষিত বঞ্চিত মানুষের সাথে নানাদিক থেকে এক শক্তিশালী যোগাযোগ নির্মাণ- সবকিছুকেই উপলব্ধি করতে হবে। এইসব বিষয়গুলিকে পিছনে ফেলে রেখে যারা রুশ বিপ্লব প্রসঙ্গে আলোচনা করেন, আমি সবিনয়ে বলতে চাই, তারা রুশ বিপ্লবের প্রকৃত শিক্ষা আদৌ গ্রহণ করেননি।

Spread the word

Leave a Reply