ভারতে সাধারণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে
২৬শে জানুয়ারি,২০২১ দেশের সাধারণতন্ত্র দিবসের দিনে সারা ভারত এবং গোটা পৃথিবী সাক্ষী রইল এক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের। মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবীতে সারা দেশের কৃষকেরা ষাট দিনেরও বেশী সময় ধরে দিল্লীর সীমান্তে আন্দোলন করে চলেছেন। সারা ভারত সংযুক্ত কিষান মোর্চার নামে সারা দেশের কৃষক সংগঠনগুলি একজোট হয়েছে – তাদের পূর্বঘোষণা ছিল এইবছর ২৬শে জানুয়ারি তারা দিল্লিতে ট্র্যাক্টর র্যালি করবেন। সেই আন্দোলন দেশের মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক গড়েছে। এই বিষয়েই সিপিআই(এম) ডিজিটালের পক্ষ থেকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি, পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য কমরেড মহম্মদ সেলিম, সাংসদ কমরেড বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য-কে একসাথে নিয়ে একটি অনলাইন আলোচনা সভার আয়োজন করে ২৬শে জানুয়ারি সন্ধ্যায়। আলোচনার উপস্থাপনা এবং সঞ্চালনা করেন কমরেড শমীক লাহিড়ী।
আলোচনার সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ কয়েকটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশিত হবে
দ্বিতীয় পর্ব
কথোপকথন বোঝার স্বার্থে অনুবাদের সময় তিনজন আলোচকের বক্তব্যকে মোট তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে প্রকাশিত আলোচনায় কমরেড শমিক লাহিড়ীর সাথে কথা বলেছেন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। তারপরের কথাবার্তা কমরেড বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের এবং শেষ অংশে কমরেড মহম্মদ সেলিমের আলোচনা রয়েছে। কৃষকদের আন্দোলনের প্রসঙ্গেই ইউনাইটেড কিংডমে আয়োজিত একটি অনলাইন আলোচনায় যুক্ত হতে হয় বলে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি এই আলোচনার শেষ অবধি থাকতে পারেন নি।
৫) একদিকে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে আক্রমণ আরেকদিকে ধর্ম, জাতি, ভাষার ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি চলছে। এই পরিস্থিতিতে জীবন জীবিকা রক্ষার স্বার্থে কিভাবে জনসাধারনকে একজোট করা যায়?
জীবন জীবিকা রক্ষার স্বার্থে আন্দোলনই হল একমাত্র পথ যে রাস্তায় ঐক্যবদ্ধ জনগন লড়াই করতে পারবেন। শেষ কয়েকটা বছর আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? দেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় প্রশ্নগুলিকে ধর্মের নামে, জাতির নামে আবার কখনো ভাষার নামে ঘুরিয়ে দিতে, দুর্বল করে দিতে শাসকদল সফল হয়েছে। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের বছর দুয়েক আগে থেকেই সারা দেশের শ্রমিক – মেহনতি জনতা এবং কৃষকরা বড় বড় আন্দোলন পরিচালনা করেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে পুলওয়ামা এবং বালাকোটের ঘটনা সামনে চলে এলো এবং অন্য সবকিছু পিছনে ঠেলে দেওয়া হল। এখন রিপাবলিক টিভির টি আর পি সংক্রান্ত দুর্নীতি এবং হামলার ঘটনা নিয়ে হোয়াটস্যাপের কথোপকথন সামনে এসেছে। এটা পরিস্কার যে জনজীবনের প্রকৃত সমস্যার কথা চেপে দিতেই এইসব ভুয়ো খবরের ব্যাবহার করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা আন্দোলনেও জনগন কোন কোন প্রশ্নকে সামনে রেখে একজোট হয়েছিলেন। তৎকালীন কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত করেছিল গ্রামীণ শাসকগোষ্ঠীকে ( জমিদার এবং সামন্ত রাজাদের) এবং আমরা, কমিউনিস্টরা জনগণের শোষিত অংশকে (শ্রমিক – কৃষক – মেহনতি জনতা) টেনে এনেছিলাম আন্দোলনের প্রাঙ্গনে। সেই সময় আমরা যে স্লোগান হাজির করেছিলাম সেগুলি যথার্থই জনজীবনের সমস্যার সাথে সম্পৃক্ত ছিল, সেই কারনেই আন্দোলনে জনগনকে যুক্ত করার কাজে আমরা সফল হয়েছিলাম। পরে সেই দাবীসমুহই স্বাধীন ভারতের সংবিধানে নাগরিক অধিকার হিসাবে যুক্ত হয়েছে। তেভাগা, তেলেঙ্গানা থেকে শুরু করে পুনাপ্রা ভায়ালার লড়াই এমনকি আসাম উপত্যকার তৎকালীন আন্দোলন অবধি একথা সতত প্রযোজ্য। এই ধারাতেই আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আজকের কৃষক আন্দোলন শাসক শ্রেণীর মধ্যেকার নতুন নতুন দ্বন্দ্বকে সামনে এনেছে। বৃহৎ এবং অবৃহৎ বুর্জোয়াদের ভিতরকার দ্বন্দ্ব, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের সাথে বৃহৎ কর্পোরেট শিল্পের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং এইসবের বিপরীতে সারা ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর সাথে কৃষক জনতার সংগ্রামী শ্রেণী ঐক্য – এটাই আজকের দিনে লড়াইয়ের ভিত্তি। এই লরাইকেই আরও শাণিত করতে হবে।
৬) ভারতে শেষ তিরিশ বছর ধরে বামেরা বা বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বলা যায় লাল ঝান্ডার পক্ষ থেকে নয়া উদারবাদের বিপদ সম্পর্কে বহুবিধ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে সেই বিপদকে মানুষ উপলব্ধি করেছেন। আজকের দিনে সকলেই সেই আক্রমনের শিকার। এই আন্দোলনকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে দেশের জনসাধারনের বিরাট অংশ হিসাবে শিক্ষার্থী, কর্মপ্রার্থী যুব সমাজ এবং মধ্যবিত্ত জনগণকে কিভাবে যুক্ত করা যাবে?
আজকের ট্র্যাক্টর প্যারেডেই এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। যা দেখা যাচ্ছে কৃষকদের আন্দোলনে, ট্র্যাক্টর প্যারেডে ক্রমশই মহিলারা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন – কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারাও লড়াই করছেন। প্রতিদিন এই আন্দোলনের সাথে ছাত্র-ছাত্রীরা যুক্ত হচ্ছেন, কৃষকদের লড়াইতে উৎসাহ দিচ্ছেন, তাদের পায়ে পা মেলাচ্ছেন। ট্র্যাক্টর প্যারেডকে জনসাধারণ ফুল ছুঁড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। সারা দেশ থেকেই শিক্ষক-শিক্ষিকা, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারীবৃন্দ কৃষকদের আন্দোলনের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানিয়েছেন। সারা দেশের সংগঠিত শ্রমিক ক্ষেত্র এমনকি ব্যংক কর্মচারীরাও এই লড়াইতে সংহতি জানাচ্ছেন। আজকের পরিস্থিতি দেখে বলাই যায় সারা দেশ কৃষকদের আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর তরফেও এই আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো হয়েছে। মনে রাখতে হবে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত জওয়ানেরা বেশিরভাগই কৃষক পরিবারের সন্তান। জয় জওয়ান – জয় কিষাণ স্লোগানের অর্থও তাই। আজ কৃষকদের এই লড়াই আর শুধু কৃষি আইন বাতিলের দাবীতে সীমাবদ্ধ নেই, আন্দোলনের পরিধি জমি – ফসল এসবের উর্ধে উঠে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সাধারণতান্ত্রিক কাঠামোর ভারতকে রক্ষা করার প্রশ্নে সংঘবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই লড়াই এখন সারা দেশের লড়াইতে পরিনত হয়েছে।
কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির সম্পূর্ণ বক্তব্য এখানেই শেষ
১) আজকের ট্র্যাক্টর প্যারেড চলাকালীন পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ করেছে, কাঁদানে গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করেছে। সেই গ্যাসের সেলে আপনি নিজেও আহত হয়েছেন। বলা যায় আজ কৃষকদের মেজাজ ‘অক্যুপাই দিল্লী’র চেহারা নেয়। এমন হল কেন? আরএসএস এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে লাল কেল্লায় জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলে সেখানে খালিস্তানের পতাকা তোলা হয়েছে। আপনি নিজে আজকের লড়াই দেখেছেন। ঠিক কি হয়েছিল?
আজকে কৃষকেরা যে মিছিল করেছে তা পূর্বঘোষিত ছিল। গত দুমাস ভয়ানক শীতকে উপেক্ষা করে তারা দিল্লীর সীমান্তে রাস্তায় বসে কাটিয়েছে। এই আন্দোলনে গোটা ভারত এসে জড় হয়েছে। এখানে কোন হিন্দু মুসলমান নেই, সারা দেশ থেকে সব ধর্মের, সব জাতির সব ভাষার কৃষক এসেছে এই শান্তিপূর্ণ লড়াইতে হাজির হতে। এখানে আন্দোলনকারীদের পরিচয় একটাই, তারা সবাই ভভারতের কৃষক। আইনি পরিভাষায় বললে আমরা একটা প্রজাতান্ত্রিক দেশে বাস করছি, এই ব্যবস্থায় সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বই হল আইন তৈরিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং যারা সেই আইনি পরিষেবা পেতে পারে তাদের মতামত গ্রহণ করা। এখানে আমরা কি দেখলাম? সরকার একের পরে এক প্রায় দশবার আলোচনা করলেন, তারপরে অত্যন্ত বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে সরকারের তরফে কৃষকদের সুপ্রিম কোর্টে যাবার কথা বলা হল। এমন ঘটনা বিরল, দেশের নাগরিকদের দাবী মেটাতে না পেরে সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হল। তখনই আমি বলেছিলাম, মনে হচ্ছে সরকারের সাথে সুপ্রিম কোর্টের এই বিষয়ে কোন বোঝাপড়া হয়ে গেছে। আর সেটাই ঘটলো।
আলোচনার প্রথমেই সরকারের তরফে যে প্রস্তাব আসা উচিত ছিল সেই প্রস্তাব এল সুপ্রিম কোর্টের তরফে থেকে। সেই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য স্পষ্ট, যাতে কৃষকদের এই আন্দোলনের মেজাজ কিছুটা দমে যায়, তাদের ঐক্যে ফাটল ধরে। অন্যান্য অনেকের মতোই আমি এই ব্যাপারে খুশি যে কৃষকরা সেই প্রস্তাবের ফাঁদে পা দেন নি। মনে রাখতে হবে আর এস এস এবং বি জে পি প্রথম দিন থেকেই এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার করেছেন, আন্দোলনকারীদের প্রথমে খালিস্তানি, পরে মাওবাদী এবং সবশেষে বাম্পন্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচী বলেছেন। তারা এমন একটা ভাব দেখাতে ব্যাস্ত ছিলেন যেন কৃষকদের সমস্যার কথা কৃষকদের থেকেও তারা বেশি বোঝেন। এরা মনে করেন সংকটের সময়তেই সবচেয়ে সহজে নিপীড়নমূলক আইন প্রনয়ন করা যায়। নীতি আয়োগের একজন তো বলেই দিয়েছেন এই সংকটকালেই (করোনা অতিমারি) আমাদের যাবতীয় সংস্কারের কাজ সেরে ফেলতে হবে।
প্রথমে অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) করা হয়েছিল। অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) করা হয় যখন সরকার কোন নির্দিষ্ট দুর্যোগের সময়ে দেশ পরিচালনার বাধা দূর করতে আইনসভা ব্যাতিরেকেই আপদকালীন সিদ্ধান্ত নেয়, পরে ছয় মাসের মধ্যে সেই আইনকে সংসদে পাশ করাতে হবে এটাই সংবিধানের নিয়ম। কৃষি আইন এমন কি জরুরী ব্যাপার ছিল যে অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) করতে হল? এর জন্য সরকার পরিচালনায় এমন কি বাধা হচ্ছিল যা কৃষকরাও বুঝতে পারছেন না, কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারছেন না শুধু কয়েকজন মন্ত্রী বুঝেছেন! এমন কি তাড়া ছিল যে সংসদে আলোচনার সময়টুকুও দেওয়া হল না!
প্রজাতন্ত্র দিবস মানে শুধু সরকারের সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াচ নয়, এর অর্থ জনগণের সক্রিয়তা। এখানেই এই কৃষক আন্দোলনের সার্থকতা। আজ কৃষকদের ট্র্যাক্টর মার্চে আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। মহিলারা ট্র্যক্তর চালিয়ে আসছেন, আবালবৃদ্ধবনীতা সকলেই যুক্ত হয়েছেন আজকের আন্দোলনে। তারা সকলেই নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন এই আইন বলবৎ হলে গোটা দেশের জন্য খাদ্য সংকট তৈরি হবে। ক্ষুধার সূচকে ভারত এমনিতেই অনেকটা নিচে রয়েছে, কৃষকরা আসলে কী চাইছেন? তারা চাইছেন ভারত খাদ্যে স্বনির্ভর হোক, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবীর আসল অর্থ সরকারের কাছ থেকে জনগণের জন্য খাদ্যশস্য কেনার নিশ্চয়তা আদায় করা। আজকের ট্র্যাক্টর প্যারেডের দৃশ্য আপনারা টিভির পর্দায় দেখেছেন বা হয়ত শুনেছেন, আমি সেখানে ছিলাম, আমি সেই র্যালি দেখেছি। র্যালির মেজাজ ছিল অসাধারণ।
সরকার এবং পুলিশ কি করেছে আজ? যেভাবে রাস্তা আটকানো হয়েছিল মনে হচ্ছিল যেন বিদেশী সৈন্য আসছে। কৃষকরা তাদের পরাক্রম দেখিয়ে ব্যারিকেড সরিয়ে দেন, ব্যারিকেড সরানর সময়ে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল অথচ যেই কৃষকেরা এগিয়ে গেলেন তখন পিছন দিক থেকে তাদের উপরে আক্রমন করা হল। লাল কেল্লায় আদৌ জাতীয় পতাকা সরানো হয় নি, যারা এটা বলছেন তারা আসলে আরএসএস-এর আইটি সেলের প্রচারকেই না জেনে বুঝে ছড়িয়ে ফেলছেন। জাতীয় পতাকা অক্ষত ছিল। আসলে লাল কেল্লাকে যারা বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিল তাদের থেকে লাল কেল্লা নিয়ে দেশের প্রতি ভালবাসা শিখতে হবে? যে পতাকা তারা তুলেছেন তা সেনাবাহিনীতে শিখ রেজিমেন্ট ব্যবহার করে। আজ গুটিকয়েক পুঁজিপতিদের স্বার্থে এরা সেনাবাহিনিকেও অপমান করতে ছাড়ছে না। আজকের দিনে ভারতে প্রধান রাজনৈতিক লড়াইতে একদিকে রয়েছে গুটিকয়েক পুঁজিপতি আরেকদিকে গোটা দেশের জনগন। আজ যা হয়েছে তাকে আমি প্রকৃত প্রজাতন্ত্র পাওলন হিসাবে দেখি, এতদিন যা হতো তা হল প্রজাতন্ত্রের নামে সরকারী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। সেই গড্ডালিকা ভেঙ্গে দিয়ে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে বলেই আমি মনে করি।
২) কৃষকদের আন্দোলন আজ সারা দেশের সব অংশের জনগণের আন্দোলনের চেহারা নিয়েছে। জনগণকে সুরক্ষা দেবার দায় যে সংবিধানের তার উপরেও আক্রমন নামিয়ে আনা হয়েছে। এই আক্রমণকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
এই সরকারের আমলে সংবিধান আক্রান্ত হচ্ছে এই কথা আমরা অনেকদিন আগে থেকেই বলে আসছি। ২০১৪ সালেই একটি আলোচনা সভায় আমি বলেছিলাম মোদী কি ভারতের সংবিধান রক্ষা করতে পারবেন? মোদী সরকার পরিচালিত হয় আরএসএস দ্বারা। বিজেপি সম্পুর্ন আরএসএস মুখাপেক্ষী, এদের কর্মসূচি অনুযায়ী এরা মানুষের মধ্যে ধর্মীয় এমনকি বর্ণভেদের বিভাজন করতে চায় এবং রাজাকে সেবা করতে চায়। স্বাধীনতার পরে যে সংবিধান সভা তৈরি হয়েছিল সেখানে দক্ষিণপন্থী আরএসএস’র লোকেরাও ছিলেন, ধর্মীয় এবং বর্ণগত বিভাজনের কথা তারা সেদিনও বলেছিলেন। সংবিধান গৃহীত হবার সময় তাদের সেইসব যুক্তি নাকচ হয়, সকলের মতানুসারেই এমন হয়েছিল।
আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার দিকে খেয়াল করলেই সংবিধানের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই প্রস্তাবনা কি? আমরা যে প্রজাতন্ত্র গড়ে তুল্লাম তার লক্ষ্য কি? দেশে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা, সেই লক্ষ্যেই স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, স্বাধীনভাবে দর্শন এবং বিজ্ঞানকে গ্রহণ করা এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিস্বাধীনতা এবং ব্যাক্তি মর্যাদা রক্ষা করা। ব্যাক্তি মানুষের ন্যূনতম অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠিত না হলে ব্যাক্তি মর্যাদার প্রতিষ্ঠা হয় না। এই জন্যেই মুক্ত চিন্তা এবং মুক্ত মতামতের চর্চা প্রয়োজন। ক্ষমতায় বসেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে আক্রমন করেছিল, যেমন আমাদের রাজ্যে তৃনমূল সরকারের আমলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিশানা করা হয়েছিল। আসলে এইভাবে সংবিধানের মূল প্রশ্নকেই আক্রমন করা হল। স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন গনেশের মাথা প্ল্যাস্টিক সার্জারির উদাহরণ, এর ফলে কি হল – এখন সরকারী দফতর ঘোষণা করছে গোমূত্র নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। এইসব বলে জনমানসে বিজ্ঞান চিন্তাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে এবং কুসংস্কারকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দেওয়া চলছে।
ভারতের সংবিধান বলছে নাগরিকদের ধর্মীয় আচরণের অধিকার রয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নেই। অথচ রামমন্দির উদ্বোধনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাজির হচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতে হলে ব্যাক্তি আচরণের উর্ধে উঠতে হয়, এটাই দস্তুর। আমাদের দেশের মূল চরিত্রই হল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য – একে ভাঙতেই এসব পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং এইসব পরিকল্পনা হঠাৎ হচ্ছে না, অনেকদিন ধরে চলছে। কাশ্মীরকে যেভাবে ভাঙ্গা হল, সেখানকার সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের গৃহবন্দী করে রেখে। উত্তরপ্রদেশে লাভ জিহাদের নামে কি করা হচ্ছে, কে কাকে বিয়ে করবে তা সরকার ঠিক করে দেবে? খেয়াল করবেন কেউ যদি মুসলমান ধর্মপরিচয় পাল্টে হিন্দু হতে চায় সেক্ষেত্রে সরকার কিছু করছে না, কিন্তু এর বিপরীত কিছু হলেই তাদের প্রবল আপত্তি। আসলে মানুষকে ভয় আপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মেয়েদের উপরে আক্রমন করা হচ্ছে। ওরা পরিকল্পিত ভাবে ধর্ষণকে উৎসাহ দেয়, যাতে মেয়েদের ঘরে বন্দী করে ফেলা যায়। এভাবেই ওরা মনুসংহিতার নির্দেশ পালন করছে।
নির্বাচন কমিশনকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, বিচারব্যবস্থাকে আক্রমন করা হচ্ছে। একথা সত্যি যে গণআন্দোলন দুর্বল হলেই বিচারব্যবস্থা সরকারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। লকডাউন চলাকালীন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক যখন রাস্তায়, তাদের কয়েকজনকে ট্রেনের ধাকাক্য প্রান হারাতে হল সেই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য সরকারী সাফাইয়েরই পুনরুক্তি মাত্র ছিল। তারপরে যখন দেশজুড়ে এই নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হল তখন সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করেলেন এবং কিছু নির্দেশিকা জারী করলেন। অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরাও এই সমাজেরই মানুষ, জনমানসে হিন্দোল উঠলে তার দ্বারা তার প্রভাবিত হন। কেউ একে আদালত অবমাননা বলতেই পারেন, কিন্তু খেয়াল রাখবেন কৃষকদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট শুরুতে সরকারের পক্ষে থেকে সমঝোতার চেষ্টা করেছে, পরে স্বীকার করেছে এধরণের গণআন্দোলনের বিষয়ে কোর্টের কিছু বলার নেই। এটা গণআন্দোলনের চাপেই হয়েছে। রামমন্দির নিয়ে যে রায় হল তাকে মনে রাখতেই হবে, সিবিআই আদালতের জজ বললেন কে মসজিদ ভেঙ্গেছে তা নাকি জানা যায় নি। গোটা পৃথিবীর সামনে আমরা হাস্যস্পদ হলাম। আসলে এটা হল দক্ষিনপন্থার পক্ষ থেকে সামাজিক নিরাপত্তার চাপ। সরাসরি নাহলেও স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে চলা তাদের সামাজিক জীবন সম্পর্কে চেতনায় একটা ভয় কাজ করেই। সংবিধান আক্রান্ত হবার চেহারা এতেই স্পষ্ট হয়।
তৃতীয় পর্বে এই ধারাবাহিক শেষ হবে
প্রথম পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ – বর্তমান কৃষক আন্দোলন এই শিক্ষাই দেয় (পর্ব ১)
ওয়েবডেস্কের পক্ষে বাংলা অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ