নিখিল মুখার্জী
শাল, পলাশ, মহুয়ায় মনমাতানো পুরুলিয়া। ছৌ, ঝুমুর, ভাদু, টুসু, করম, নাটুয়ার পুরুলিয়া। পাহাড়, টিলা, নদী- নালা, বন বনানীতে প্রাকৃতিক সোন্দর্যে শোভিত পুরুলিয়া। মাদলের বোলে আর আদিবাসী রমনীর নৃত্যের তালে আবেশ জড়ানো পুরুলিয়া। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম পুরুলিয়া। আবার দধীচি পুরুলিয়া- জেলার দুই প্রান্তে কংসাবতী ও দামোদর জলাধার সেচ প্রকল্পে জেলার হাজার হাজার মানুষ ছিন্নমূল হলেও এক ইঞ্চিও সেচ কিংবা অন্য কোন সুবিধা পায়নি, তবু বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত পুরুলিয়া।
১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর পুরুলিয়া জেলার জন্ম। ভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকে পুরুলিয়া জেলার সৃষ্টি। পূর্বতন মানভূম জেলার খন্ডিত অংশ পুরুলিয়া জেলা হিসাবে পশ্চিমবাংলায় অন্তর্ভুক্ত হয়। পুরুলিয়া জেলা তথা পূর্বতন মানভূম জেলার একটি বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামী অতীত আছে। চুয়াড় বিদ্রোহ সহ একটার পর একটা বিদ্রোহে ব্রিটিশ নাজেহাল অবস্থায় পড়ে এবং এই এলাকা বিশেষ আইনবলে শাসন করার ব্যবস্থা নেয়। এই এলাকার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটিশরা ফরমান জারি করে ১৯১২ সাল থেকে মানভূম জেলাকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত যার গতি স্বাধীনতার পর অনেক বেশী বেগবতী হয়। মূলতঃ লোকসেবক সংঘের নেতৃত্বে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। কিন্তু তৎকালীন সময়ে বামপন্থীরাও সাধ্যমতো সহযোগিতা করে। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত লোকসেবক সংঘের রাজনৈতিক প্রাধান্য ছিল পুরুলিয়া জেলাতে। তার পরেই তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটায় এবং বিকাশমান বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার এবং দক্ষিনপন্থী শক্তিগুলির পক্ষ নিতে থাকেন। ফলে তারা জনসমর্থন হারায় এবং ক্রমশ অবলুপ্তির দিকে চলে যায়। কিন্তু এই সময়ই বাম, শক্তি তথা সি.পি.আই (এম) এর শক্তির বিকাশ ঘটতে থাকে। জমির লড়াই, বর্গার লড়াই, মজুরির আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। ১৯৭৭ সালের পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বামপন্থীদেরই নিরঙ্কুশ প্রাধান্য ছিল। ক্ষমতায় আসার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস সবরকম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরে শিল্প গড়তে বাধা দেয়, বামফ্রন্ট সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মাওবাদীদের সাথে যোগসাজশ করে বামপন্থীদের শক্তিশালী এলাকা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরে ব্যাপক খুন ও সন্ত্রাস চালায়। পার্টি নেতা তথা প্রাক্তন সভাধিপতি কমরেড রবীন্দ্রনাথ কর সহ প্রায় ষাট জনের মতো সি.পি.আই (এম) এর নেতা কর্মী শহীদ হন। ২০১১ সালে পালাবদলের পর তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা। তারপর তৃণমূলের হাত ধরেই বিজেপির জেঁকে বসা। দুঃখের হলেও এটাই সত্য যে, এইরকম একটা দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাসের ধারা যে স্থানের সেখানে গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফল করে। বামপন্থী আন্দোলন বা সংগঠনের দুর্বলতা তথা মানুষের কাছে আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা মানুষকে অতি দক্ষিনপন্থার উপর নির্ভরশী করে তোলে। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে বামপন্থীদের ক্রমোন্নতি ঘটেছে কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এবার লোকসভা নির্বাচনে যে পরিস্থিতি ও পরিবেশ তৈরী হয়েছে, যেভাবে মিছিল, মিটিং, সমাবেশে মানুষের অংশগ্রহনে উৎসাহ ও আবেগ লক্ষ্য করা গেছে, কর্মীদের মধ্যে যে জেদ এবং মেজাজ পরিলক্ষিত হয়েছে তাতে এবার হিসেব ওলোট পালট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বামপন্থী এবং কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী সংগ্রামে থাকার ফলে মানুষের মনে এবং সামগ্রিক পরিস্থিতিতে একটা ইতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
পুরুলিয়া জেলায় নয়টি বিধানসভা কেন্দ্র। সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্র নিয়ে পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্র আর দুইটি বিধানসভা ক্ষেত্র রঘুনাথপুর এবং বান্দোয়ান যথাক্রমে বাঁকুড়া এবং ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের সাথে যুক্ত। পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে বামফ্রন্ট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাত, বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্টের সি.পি.আই (এম) প্রার্থী কমরেড নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত এবং অনুরূপভাবে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে সি.পি.আই (এম) এর প্রার্থী এ জেলারই বান্দোয়ান থানারই মেয়ে কমরেড সোনামনি টুডু। যোগ্যতা ও গুণগত দিক দিয়ে বিচার করলে এই তিনজন প্রার্থীই অন্যদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে। এরা প্রত্যেকেই আন্দোলন সাংগ্রামের মধ্য দিয়ে উঠে আসা এবং মানুষের জন্য কাজ করায় উৎসর্গীকৃত। মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্যতার দিক থেকেও এরা এগিয়ে। মানুষ বিশ্বাস করছেন যে এরা সংসদের ভেতরেও জনগণের দাবী, মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে মানুষের লড়াইয়ে থাকবেন। আগের নির্বাচনে জেতার পর বিজেপি সাংসদ এলাকায় কোন কাজ করেন নি, মানুষের পাশে থাকেন নি। সংসদেও মুখ খোলেননি বা কোন ভূমিকা পালন করেননি। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। উল্টে পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ যেন ‘নেপোয় মারে দই’। বিড়ি শ্রমিকদের হাসপাতালটি নির্মানের জন্য তাঁর বা তার দলের কোন ভূমিকাই নেই বরং প্রকারান্তরে বিরোধিতাই করেছেন। জেলার বিড়ি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং বাসুদেব আচারিয়ার সক্রিয় সহযোগিতায় হাসপাতালটি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের উদ্যোগের অভাবে এটি এখনও চালু করা যায়নি। এ ব্যাপারে বিজেপি সাংসদ নিষ্ক্রিয় এবং নিশ্চুপ ছিলেন। হঠাৎ ভোটের কিছুদিন আগে কয়েকজন লোক
জমায়েত করে এমন ভাব দেখালেন যেন ওটি চালু করা হচ্ছে এবং অনেককেই চাকরী দেওয়া হবে। পরে সবাই বুঝতে পারলো যে ওটা ‘জুমলা’। পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে একসময় পুরনো এরোড্রামটি যাতে বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে
প্রশ্নে নেপাল মাহাত সহ বামপন্থী বিধায়করা বিধানসভায় বারে বারে দাবী তুলেছেন। কিন্তু বর্তমান সাংসদ সংসদে টু শব্দটি করেন নি। অথচ পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে। একইভাবে রেল ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রশ্নেও সাংসদ কোন ভুমিকা পালন করেননি। বাসুদেব আচারিয়া যতদিন বেঁচে ছিলেন সাংসদ না হয়েও রেল ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রশ্নে আশাতীত দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পুরুলিয়া থেকে ঝাড়গ্রাম রেলপথ চালু করার প্রশ্নে একবার সার্ভে পর্যন্ত হল কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার উদ্যোগে কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিজেপি সরকার এই প্রশ্নে নীরব। অথচ এ জেলার মানবাজার মহকুমাতে এক ইঞ্চিও রেলপথ নেই। যদিও বিস্তীর্ণ এলাকায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন।
পুরুলিয়া জেলায় প্রকৃত সংগঠিত, পরিকল্পিত ও মৌলিক উন্নয়নের কাজ শুরু হয় বামফ্রন্ট সরকারের সময় থেকে। তার আগে দীর্ঘ সময় ছিল অবিচার, উপেক্ষা আর অবহেলার শিকার। এটা একটা নিষ্ঠুর সত্য যে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পুরুলিয়া জেলায় প্রত্যাশিত শিল্প বিকাশ ঘটেনি। এটা অনিবার্য ছিল না। বরং কেন হল না এটাই একটা বিস্ময় মিশ্রিত প্রশ্ন। বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে জেলায় ভজুডি কোল ওয়াশারী, সাঁওতালডি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, ২/৩ টি কোলিয়ারী, অল্প কিছু ছোট কারখানা ছিল। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের সময় বেশ কিছু শিল্প গড়ে ওঠে। বাগমুন্ডীতে ৯০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প (পি.পি.এস.পি), রঘুনাথপুরে ডি.ভি.সি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, ১৩/১৪ টি মাঝারী ইস্পাত কারখানা, কয়েকটি সিমেন্ট কারখানা, কুশল পলিস্যাঙ্ক (ঝালদা) সহ কয়েকটি হলদিয়া ডাউনস্ট্রীমের কারখানা ও বিভিন্ন ধরনের ছোট মাঝারী কারখানা গড়ে ওঠে। বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন সময়েই শিল্পায়নের একগুচ্ছ প্রস্তাব সরকারের নিকট আসে এবং শিল্পায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। অন্যত্র শিল্পায়ন জমি জটে যখন আটকে যাচ্ছে তখন এখানে রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যমতের ভিত্তিতেই জমি অধিগ্রহনে সেই অর্থে কোন সমস্যা হয়নি। জয় বালাজী, আধুনিক, শ্যাম ইস্পাত ইত্যাদি ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহন সহ শিল্প গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
ইতোমধ্যে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে শিল্পায়নে বাধা দেওয়া হয় এবং পরে টাটার তৈরী হওয়া কারখানা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কার প্রস্তাবিত শিল্পগুলির ক্ষেত্রে সরকার অসহযোগিতামূলক আচরন করতে থাকলো। ফলে তৃণমূল সরকার শিল্পবিরোধী এটা প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হল। পুরুলিয়া জেলা কেন আর কোথাও শিল্প গড়ে উঠলো না তৃণমূলী জমানায়। অথচ কৃষিতে লাভ হচ্ছে না, কৃষক মার খাচ্ছে। ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। সহায়ক মূল্য যা সরকার স্থির করছে তা অপ্রতুল। ফসল কেনার উপযুক্ত ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো নেই। কৃষক বাধ্য হচ্ছে সস্তায় ফড়েদের কাছে ফসল বিক্রী করতে। জেলায় বেশিরভাগ জমি এক ফসলি এবং তুলনায় কম উর্বর। কাজের সুযোগও কম, তাই বিকল্প জীবিকা অনিবার্যভাবেই প্রয়োজন। এখানে শিল্পায়ন হলে তা হবে কৃষক পরিবারদের স্বার্থেই। এই কারনেই কৃষকরা শিল্পের জন্য জমি দিয়েছিলেন। এখন শিল্পও হল না, জমিও নেই। তাই প্রস্তাবিত শিল্পগুলির বাস্তবায়নের দাবী একটা বড় ইস্যু যা সম্পর্কে তৃণমূল ও বিজেপি উভয় দলই উদাসীন।
মাটির নীচে কয়লা মজুত থাকা সত্ত্বেও একটার পর একটা কোলিয়ারী বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বৎসরে শালতোড়, রানীপুর, ভামুরিয়া কোলিয়ারী বন্ধ হয়ে গেছে, পারবেলিয়া ধুকছে, একমাত্র দুবেশ্বরী চলছে। ঢাঙ্গাজোড় এবং পুয়াপুর প্রকল্প হাতে নিয়েও বাস্তবায়িত হয়নি। বেআইনী খাদানকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য, কয়লা মাফিয়াদের লুঠের সুবিধে করে দেওয়ার জন্য এবং সর্বোপরি মাটির নীচে অফুরন্ত উন্নতমানের কয়লা মজুত রয়েছে তা আদানীর মতো কোন প্রিয়জনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এই পদক্ষেপগুলি নেওয়া হচ্ছে।
লক্ষাধিক বিড়ি শ্রমিক রয়েছে এই জেলায়। তাদের ন্যয্য মজুরি, পি.এফ এর সুব্যবস্থা এবং চিকিৎসা সহ শ্রমিক কল্যানের যাবতীয় ব্যবস্থা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। এখন বিড়িতে উচ্চহারে জি.এস.টি লাগু হয়েছে, কিন্তু শ্রমিক কল্যানে কোন অর্থ ব্যয় হয়না। আগে শ্রমিক কল্যানে সেস্ নেওয়া হত। তা থেকেই শ্রমিক কল্যানে ব্যয় হত। সংসদে ভেতরে শ্রমিকের কন্ঠস্বরের প্রতিফলন ঘটানো চাই। তাই বাম কংগ্রেসকে জেতানো অবশ্যই প্রয়োজন এটা জেলার শ্রমজীবিরা উপলব্ধি করছেন।
একসময় জেলায় লাক্ষা শিল্প ছিল রমরমা। হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতেন যারা মূলত: আদিবাসী।
এখন সে শিল্প ধুকছে। লাক্ষা নির্ভর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই শিল্পকে বাঁচানোর জন্য দুই সরকারের কোন হেলদোল নেই। বাবুই চাষ এখন বান্দোয়ান এবং মানবাজার ২নং ব্লকের ৫/৬টি অঞ্চলে সীমিত হয়ে গেছে। এদের বাজারও সঙ্কুচিত হয়েছে। ল্যাম্পগুলি জেলায় কার্যত অকেজো। ফলে বাবুই চাষীরা কোন সহযোগিতা পাচ্ছে না। যেমন পাচ্ছে না কেন্দু পাতা সংগ্রহকারীরা। তারা ফড়েদের শিকারে পরিণত সঠিক দাম পায়না। জেলায় অর্থকরী ফসল হিসেবে যে সবজি চাষ হয় সেখানেও বেঁধেছে অনর্থ। চাষীরা সবজির দাম পাচ্ছেন না। সবজি সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা নেই। বাইরে থেকে মহাজন বা ফড়েরা এসে ট্রাকের পর ট্রাক সস্তায় সবজি নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বিক্রী করছে। একদিকে চাষী অন্যদিকে ক্রেতা উভয়ই মার খাচ্ছে। জেলায় সেচ সেবিত এলাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। পুরনো যে ড্যাম বা জলাধারগুলি সেগুলির সংস্কার এই সরকার না করার ফলে পলি জমে জলধারনের ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে।
পুরুলিয়া জেলায় পর্যটন শিল্পকে আরো উন্নত ও বিকশিত করার সুযোগ রয়েছে। অযোধ্যা, পাঞ্চেত, দুয়ারসিনী এইসব পরিচিত স্থান ছাড়াও আরো অনেক অপূর্ব স্থান রয়েছে যেগুলিতে পর্যটন ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো উন্নত করা গেলে জেলায় পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। জেলার পরিবহন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূণর ইস্যু হল মধুকুন্ডা রেল ব্রীজের সমান্তরাল একটি রোড ব্রীজ নির্মান করা। পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে শিমুলিয়ার পশ্চিম দিকে বাইপাস রোড নির্মিত হচ্ছে, অনুরূপভাবে পূর্বদিক থেকে কলকাতাগামী মূল রাস্তার সাথে সংযোগ ঘটানোর জন্য বাইপাস রোড করা জরুরী। এগুলি নিয়েও আগামীদিনে সাংসদকে সোচ্চার হতে হবে।
হাতে কোন কাজ নেই। কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা নেই। ১০০ দিনের কাজও বছর তিনেক বন্ধ। ফলে জেলার গ্রামের পর গ্রাম কর্মক্ষম যুবকেরা উজাড় করে সবরকম ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে কাজের সন্ধানে, বাঁচার তাগিদে, সংসারের মুখে হাঁসি ফোটানোর আশায়। এদের জন্য কোন আইন নেই, সুরক্ষা নেই। উচ্চ শিক্ষিতরাও নিম্নমানের কাজে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কি কেন্দ্রীয় কি রাজ্য সরকারগুলি এদের ব্যাপারে উদাসীন। কোভিডের সময় ব্য অন্য সময়েও এদের পাশে থাকে সেই বামপন্থীরাই। এদের কথা সংসদে তুলে ধরার জন্য চায় তাদেরই। এটা পরিযায়ী শ্রমিকেরা জীবনের অভিজ্ঞাতা দিয়ে বুঝতে পারছেন।
জেলার যুব সমাজের সামনে কোন আলো নেই। কলকারাখানা হচ্ছে না, সরকারী নিয়োগ বন্ধ, শিক্ষক- কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না, যে সামান্য হয়েছে তার দুর্নীতির বহর দেখে দেশবাসী স্তম্ভিত। কেন্দ্র ও রাজ্য উভর সরকারই কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রশ্নে চরম উদাসীন। বামফ্রন্ট সরকার যুব সমাজের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য যে আলো দেখিয়েছিল এরা তা নিভিয়ে দিয়েছে। জেলার কর্মক্ষম যুবকেরা কাজ না পেলে যাবে কোথায়? খাবে কি? নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি তো হয়ইনি উলটে এই সময়কালে বহু কলকারাখানা বন্ধ হয়ে হাজার হাজার শ্রমিক বেরোজগার হয়েছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অবস্থা আর সব জেলার মতো একইরকম। ক্রমশ বেসরকারী হাতে চলে যাচ্ছে। নতুন স্কুল কলেজ হচ্ছে না, শিক্ষকের অভাবে অনেক স্কুলে বহু বিষয় তুলে দেওয়া হচ্ছে, বহু স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, বহু স্কুল বন্ধ হওয়ার মুখে, ব্যাপক ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ছুট হচ্ছে, গ্রন্থাগারগুলি মৃত্যুর প্রহর গুনছে, শিক্ষায় চরম নৈরাজ্য ও আক্রমন। একাধিক প্রজন্মের সর্বনাশ হয়ে গেল। মগজাস্ত্রকে ভোঁতা করার জন্য এটা শাসকের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। স্কুলে যেমন শিক্ষকের অভাব, হাসপাতালে তেমনি ডাক্তার নেই, প্রয়োজনীয় স্টাফ নেই, পরিকাঠামো নেই। সব মিলিয়ে বেসরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রোৎসাহিত করা হচ্ছে। অথচ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এই দুটিই মানুষের মৌলিক অধিকার। তা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই নির্বাচনে মানুষ এর জবাব দেবে।
ধর্ম এবং রাজনীতির মিশ্রনে যেমন সাম্প্রদায়িকতার বিষ তৈরী হয় তেমনই পশ্চাদপদ জনজাতির সামাজিক উন্নয়নের আন্দোলনকে রাজনীতির সাথে মেশালেও ইতিবাচক কিছু সৃষ্টি হয়না। একটি সামাজিক আন্দোলনে নানান দলমতের মানুষ সামিল হতে পারেন কিন্তু সামাজিক সংগঠণ নিজেই যদি দল বা মত হয়ে যায় তখন বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়। পুরুলিয়া লোকসভায় প্রার্থী কুড়মি সমাজের সংগঠনের প্রধান নেতা। তাঁর বক্তব্যে শুধু বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার। অথচ দেশে প্রধানমন্ত্রী যখন অটলবিহারী বাজপেয়ী তখনই বাসুদেব আচারিয়া সাংসদ হিসাবে কুড়মি সমাজের দাবী বিবেচনার জন্য আবেদন করে চিঠি দেন। সম্প্রতি যখন কুড়মি সমাজের নেতৃত্বে রেল অবরোধ চলছিল তখনও প্রেস বিবৃতি দিয়ে সি.পি.আই (এম) এর রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিম রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবীর মীমাংসার জন্য আলোচনায় বসার দাবী জানান। খুবই আশঙ্কা হচ্ছে ভুল নেতৃত্বের জন্য মূল দাবীর আন্দোলনটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের সরকার শুধু একটি নির্দিষ্ট অংশের নির্দিষ্ট সমস্যার জন্য নয়, সমগ্র জনগণের সার্বিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন-জীবিকা ও অধিকার সবকিছু নিয়েই। ফলে বৃহত্তর ক্ষেত্রের সংগ্রামের কথা বিবেচনা করে বাম-কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে জয়ী করবার জন্য মানুষ ঘরে ঘরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অতীতে এ জেলায় আদিবাসী ও তপশিলী জাতি সম্প্রদায়ের মানুষ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন।
আদিবাসীদের জমি ও জঙ্গলের অধিকার বিপর্যস্ত। তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি নানাভাবে আক্রান্ত। আদিবাসীদের জমি অন্যরা ক্রয় করতে পারেনা কিন্তু এদের জমির উপর হোটেল, রিসর্ট গড়ে উঠছে। ঘুরপথে জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে তৃণমূলী সহযোগিতায়। যেমন কয়লা, বালি লুঠ হচ্ছে তেমনি জমিও লুঠ হয়ে যাচ্ছে। এদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া অনিশ্চিত, হোস্টেল বন্ধ, স্টাইফেন অনিয়মিত। সর্বগ্রাসী সঙ্কটে এদের অবস্থা তুলনামূলক বেশী সঙ্কটগ্রস্ত। বিগত নির্বাচনে যারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, অভিজ্ঞতার নিরিখে তারা এটা বুঝেছেন জীবন-জীবিকার সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও অধিকারের লড়াইয়ে বামপন্থাই সাথে থাকে, নির্বাচনেও তাদের সাথেই থাকতে হবে।
এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দেশে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশে গণতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, সংবিধান তথা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শাসক দলের ও সরকারের বহুমুখী আক্রমনে বিশ্বস্ত এবং বিপর্যস্ত। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করে এককেন্দ্রীক শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছে। মানুষের রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকা ও অধিকার শোচনীয়ভাবে বিপন্ন। নজিরবিহীন বেকারী ও বেলাগাম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। পুঁজির সীমাহীন শোষন এবং দেশে স্বৈরশাসন যাতে নির্বাধায় চলতে পারে সেই লক্ষ্যেই সাম্প্রদায়িক শক্তি মেরুকরনের রাজনীতির বিষ ছড়াচ্ছে এবং দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও কর্পোরেট পুঁজিপতিদের একটি অশুভ আঁতাত তৈরী হয়েছে। মানুষের ন্যয়সঙ্গত গণতান্ত্রিক আন্দোলন কুচলে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবাদী, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাভাবনা এসবের প্রতি নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিয়ে কারারুদ্ধ করা বা হত্যা করার ঘটনা ঘটে চলেছে। এক কথায় আমাদের দেশে ফ্যাসীবাদের পদধুনী শোনা যাচ্ছে তাকে রুখে দিতে হবে। দেশ আজ বিপন্ন, সমস্ত দেশপ্রেমিক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে রক্ষা করতে হবে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে এটাই দেশের মানুষের কাছে চ্যালেঞ্জ। টি.এম.সি দলটি দুষ্কৃতী ও সমাজ বিরোধীদের দিয়েই তৈরী। দলে ও সরকারে তারাই আছে। নজিরবিহীন চুরি, দুর্নীতি ও তোলাবাজি তৃণমূলের অঙ্গের ভূষণ। প্রতি পদে গণতন্ত্র ধর্ষিত হচ্ছে। ভোট লুঠ, বুথ দখল, খুন- সন্ত্রাসে এরা সিদ্ধহস্ত। বিজেপির সাথে এদের নীতিগত কোন পার্থক্য নেই। সংসদে পরোক্ষে এরা বিজেপিকেই সমর্থন করে এসেছে। আসলে টি.এম.সি সরকার হল বিজেপি বা আরএসএস যা করতে চায় তা কার্যকরী করার জন্য পশ্চিমবাংলায় এজেন্ট। তাই বিজেপিকে পরাস্ত করার পাশাপাশি স্বৈরাচারী তৃণমূলকেও পরাস্ত করতে হবে।
এবার নির্বাচনে ধর্ম বা জাতের লড়াই নয়। সাম্প্রদায়িক বিজেপি ও স্বৈরাচারী টি.এম.সিকে পরাস্ত করার লড়াই। এবার নির্বাচন ক্ষমতা আর অর্থের বড়াই চূর্ণ করার লড়াই। এবার মাড় ভাতের লড়াই, জীবন-জীবিকা তথা বাঁচার লড়াই, সংবিধান ও অধিকার রক্ষার লড়াই, দেশ বাঁচানোর লড়াই।
জেলার সর্বত্র ব্যাপক স্বতস্ফুর্ততার সাথে জেলার শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা, শিক্ষক কর্মচারী সহ সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক মানুষ ব্যাপকভাবে সামিল হচ্ছেন, প্রাণ ঢালা ভালোবাসা দিয়ে কাজ করছেন সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি ও স্বৈরাচারী টি.এম.সি কে পরাস্ত করার জন্য। গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় মানুষ জোটবদ্ধ হচ্ছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাম ও কংগ্রেস প্রার্থীকে জয়যুক্ত করার জন্য।