Brecht Cover

Political Brecht: A Retrospect

প্রাককথন

পলিটিক্যাল ব্রেখট বলা মানেই মাথায় আসা স্বাভাবিক যে তাহলে কি অ্যাপলিটিক্যাল ব্রেখট বলেও কিছু একটা রয়েছে? ঋত্বিক ঘটক তো সেই কবেই বলে গেছেন ‘অ্যাপলিটিক্যাল বলে কিছু হয় না’। তবে এমন শিরোনাম কেন? বের্টোল্ট ব্রেখট’কে রাজনীতির বাইরে রেখে বিবেচনা করার, নতুন প্রজন্মকে তেমন কিছু করতে শেখানোর পিছনে যা থাকে সেও তো আসলে রাজনীতিই। তাই পলিটিক্যাল লেফট। সাধারণভাবে কিছুটা অজানা ব্রেখট’কে কিছুটা সামনে আনাই রাজ্য ওয়েবডেস্কের প্রাথমিক ভাবনায় ছিল। বাজার সম্পর্কিত রুচি-সংস্কৃতির বিকল্প হিসাবে যে কৃষ্টির ঐতিহ্য জনসাধারণের উত্তরাধিকার তাকে তুলে ধরাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। এই সময়ের অন্যতম একজন নাট্যকার জয়রাজ ভট্টাচার্যের সাথে আমরা যোগাযোগ করি। জয়রাজ আমাদের মনে করিয়ে দেন গত ২৮শে জানুয়ারি হাওড়ার শিবপুরে, প্রিয়নাথ মান্না বস্তি কমিউনিটি কিচেনের সাথে যে বিকল্প আর্ট স্পেশ তারা গড়ে তুলেছেন সেখানেই ব্রেখট ও তাঁর রাজনীতি প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন শমিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বক্তৃতাটিই লিখিত আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়।

শমিক বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনা করেন প্রায় দেড় ঘন্টা। আমাদের ইচ্ছা ছিল অনুলিখনের কাজ মিটলে লেখাটি সরাসরি তাকে একবার দেখিয়ে নেওয়া। কিন্তু সময়াভাবে সে কাজ করা গেল না। তাই কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে আমরা তার বলা কথাকে লেখার ভাষায় প্রকাশ করছি। এমন বক্তৃতার আয়োজনে বিকল্প আর্ট স্পেশ কিভাবে কার্যকরী হয় সে প্রশ্ন আমরা জয়রাজ’কে করেছিলাম। উত্তরে তিনি যা বলেছেন সেই কথাগুলি আমরা প্রাককথনের শেষ অংশে যুক্ত করে নিলাম। পিপলস আর্ট, সেই আর্টের চর্চা বলতে যা বোঝায় এবং বের্টোল্ট ব্রেখট প্রসঙ্গে শমিক বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন তাতে একে অন্যের সাথে অমন যুক্ত হয়ে যাওয়ার কথাই বারে বারে উঠে আসে। কারণ ব্যাপারটা ‘আর্ট, আর্টিস্ট বনাম সাধারণ মানুষ’ না, আসল কথাটা ‘আর্ট, আর্টিস্ট ও জনসাধারণ’।

ইন্ডিপেন্ডেন্স শব্দটা ডিপেণ্ডেন্সের বিপরীত শব্দ নয়। ইন্ডিপেন্ডেন্সের জন্য যাঁরা প্রাণপণ সংগ্রাম করেছেন, তাঁরা জানেন, তাঁদের একে অপরের ওপর ডিপেণ্ড করতে হয়েছে। দেশের মানুষের পারস্পরিক বৈপ্লবিক ডিপেণ্ডেন্সিই ইণ্ডিপেন্ডেন্সির প্রধান শর্ত। ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্টের ক্ষেত্রেও তাই বড় প্রশ্ন, কার থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট? আজকের পৃথিবীতে কর্পোরেট পুঁজি যখন ঘোষণা করছে ❝টিনা❞ (দেয়ার ইজ নো অল্টারনেটিভ) তখন আমাদের বয়ান- ❝টিয়া❞ (দেয়ার ইজ অল্টারনেটিভ)। এই অল্টারনেটিভ বা বিকল্প হচ্ছে- কর্পোরেট পুঁজির তাঁবেদারি থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ে ওঠা। আর তার জন্য আর্টকে এসে দাঁড়াতে হবে জনগণের মাঝে। ডিপেণ্ড করতে হবে জনগণের ওপর। এটা একটা সমবায়ী বিকল্প।

কেন লোচ তার সাম্প্রতিকতম ছবিতে বারবার একটা সংলাপ ফিরিয়ে আনেন- ❝হোয়েন উই ইট টুগেদার, উই স্টিক টুগেদার❞, এই বোধ থেকেই আমরা শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালাই। ক্যান্টিনের আর্ট স্পেসও এর থেকে কিছু আলাদা নয়।

শমিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সংস্কৃতি আর সমবায় একে অন্যের সাথে জড়িয়ে থাকা চর্চা। একথা ঠিক আমরা যাকে সংস্কৃতি চর্চা বলি তা সাধারণ অর্থে যে কোনও এক ব্যক্তির চেতনাপ্রসুত হিসাবেই প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর অর্থ এমন না যে সেই কীর্তি নির্মিত হওয়ার কৃতিত্ব ঐ একজনেরই, সংস্কৃতি কখনোই একা কারোর বিষয় না।

কিছুদিন হল আলিপুরে প্রেসিডেন্সী জেলে একটি মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠা করা হল। রীতিমত জাঁকজমক করে এমন আয়োজন সম্পন্ন করার পরে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ সাজগোজ সমেত সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে তা প্রচার হচ্ছে। এমন একটা গা ঘিনগিন করে ওঠার মত ঘটনা কলকাতায় ঘটছে। ঐ জায়গার যে ইতিহাস তা তো এই যে এদেশের মানুষকে মুক্তি দিতে বিপ্লবীদের অনেকেই সেখানে ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হয়েছিলেন। তারা অন্ধকারের রাজত্ব ঘুচিয়ে আলো জ্বালানোর ঐতিহাসিক কর্তব্য সমাপনে ব্রতী হন, অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী হিসাবে অত্যাচার সহ্য করেন, শাসকের হাতে খুন হন। মুক্তি দিতে বিপ্লবী চেতনার সেই আলো আর সেলফি তুলে ছবি পোস্ট করার রঙিন উজ্জ্বলতা তো এক না। এমনটা করা যায় না, এমন অসভ্য, অশালীন, বর্বর আচরণ মেনে নেওয়া যায় না অথচ প্রতিদিন ঠিক সেটাই ঘটছে। আমরাও প্রতিদিন সেই অবনমন প্রত্যক্ষ করে চলেছি।

আমরা হয়ত ভুলতে বসেছি সংস্কৃতি আসলে ইতিহাসের একটা গোটা পর্যায় জুড়ে শিক্ষা, রুচি সবকিছুর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সমাহার।  

বের্টোল্ট ব্রেখট আদতে ছোট, মফঃস্বল এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। পরে মিউনিখ শহরে আসেন। এই সময়কার ব্রেখট-কে এক অদ্ভুত কাহিনী আছে। মিউনিখে এসেই তিনি থিয়েটারের দলের সাথে মিশতে শুরু করেন। ভালো গান করতেন, গান লিখতেন- সে দলের সাথেই ঘুরে বেড়াতেন। এভাবেই তার পরিচয় হয় এক প্রবীণ নাট্যকারের। বের্টোল্ট ব্রেখট সেই প্রবীণ মানুষটির স্নেহের সান্নিধ্য পান। তিনি একটি নাটক লেখেন, ব্রেখট সহযোগী ছিলেন। এই নাটকের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারন নাটকটির বিষয় কলকাতা। কলকাতার ৪ঠা মে নামে সেই নাটকের বাংলা অনুবাদও পাওয়া যায়। আমরা আরেকটি ঘটনার কথা মনে রাখতে চাইছি।   

সেই প্রবীণ নাট্যকার একদিন পরিবারের সাথে একটি ক্যাফের বারান্দায় বসে রয়েছেন। দুটি তরুণ তাদের সাথে এসে আলাপ করে। তাদের মধ্যে একজন নাট্যকারকে বলে ‘এখানে তো আপনাকে সকলেই চেনে, আমিও নাটক খুবই পছন্দ করি, থিয়েটারর সিন পেন্টিংও করি। এই আমার কার্ড।’ বলে তারা চলে যায়। বোঝাই যায় ঐ তরুণটি প্রবীণ শিল্পীর সান্নিধ্য পেতে বিশেষ আগ্রহী ছিল, হয়তো শিক্ষার্থী হওয়ার ইচ্ছাও তার ছিল। যদিও পরবর্তীকালে তেমন কিছু ঘটেনি। ঐ নাট্যকারের স্ত্রী নিজের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, ‘সেদিন ঐ কার্ডটি যদি আমার স্বামী গুছিয়ে রাখতেন তাহলে হয়তো পৃথিবীর ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো’। কেন এমন উপলব্ধি? কারন ঐ কার্ডে সেই তরুণটি নিজের নাম লিখেছিল অ্যাডলফ হিটলার।

ঠিক এই কারণেই সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

আমরা তো জানি ঐ পরিচিতি পর্বের পরিণতি যাই হোক না কেন, ইতিহাস তো এই পরবর্তীকালে ঐ একই নাট্যকারের সামনে উপস্থিত হওয়া দুই শিক্ষার্থী সুলভ বন্ধুর একজন ব্রেখট, আরেকজন হিটলার। এ হল ইতিহাসের একটি দিক, যার বিবেচনায় কিছুতেই রাজনীতিকে বাদ দিয়ে রাখা চলে না। আরেকটি দিকও  রয়েছে। তখনও ব্রেখট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত নন, তবু তিনি যেসব নাটক লেখেন তাও জনমানসে ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিল। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানি পরাজিত হয়, আবার একইসাথে সেদেশের রাজতন্ত্রও শেষ হয়ে যায়। বার্লিনে প্রতিষ্ঠিত হয় ভাইমার রিপাবলিক। কেন ভাইমার? জার্মানিতে ঐ নাম, ঐ শব্দের একটা জাদু ছিল, তাই ব্যবহৃত হয়েছিল। আসলে সে প্রদেশের রাজার অনুরোধে ভাইমার থিয়েটার নির্মিতই হয়েছিল সুবিখ্যাত জার্মান কবি গ্যেটের হাতে। কার্যত ভাইমারের যাবতীয় সংস্কৃতি গ্যেটেকে আশ্রয় করে, তার শিল্পবোধকে জড়িয়ে ধরে গড়ে ওঠে। তাই রাজতন্ত্র শেষ হওয়ার পরে প্রথম রিপাবলিক ঐ সময়কার সংস্কৃতির অনুভবকে বুকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল।

এই সরকারের নেতৃত্বে ছিল আজকের ভাষায় যাকে বলে অনেকটা লিবারাল সমাজতন্ত্রী জোট। যদিও ইতিহাসের শিক্ষা হল ঐ জোটের কাজকর্মের মধ্যে থেকেই ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদী শাসনের বীজ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯১৯ সাল নাগাদ দুই প্রখ্যাত মার্কসবাদী বিপ্লবী, রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিবনেখটের কর্মকাণ্ডও ঐ জার্মানিতেই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ভাইমার রিপাবলিক নড়বড়ে হয়ে গেলে তারা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে এক বিরাট মিছিল সংগঠিত করেন। উঠতি ফ্যাসিস্ট গুন্ডারা সেই মিছিলে হামলা চালায়, আক্রমণ করে। রোজা এবং কার্ল দুজনকেই ঐ মিছিল থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে ওখানেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বার্লিনের মধ্যে দিয়ে যে নদী প্রবাহিত হয় তার জলেই তাদের দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পরে পরেই ধীরে ধীরে ব্রেখট সরাসরি রাজনীতির একজন হয়ে ওঠেন। তখন হিটলার আর নাটক-থিয়েটারের স্বপ্ন দেখেন না, ছবি আঁকেন না, তখন তিনি বিরাট নেতা। ক্ষমতা দখলের সময় তার দলের নামটি বিশেষভাবে মনে রাখতে হয়-  জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল, ন্যাশনাল সোশ্যালিজম- নাৎসি পার্টি। কেন এমন নাম? তৎকালীন পৃথিবীর সম্যক অবস্থার কথাটি মনে রাখতে হয়। একদিকে জাতিয়তাবাদের উত্থান, আরেকদিকে সমাজতন্ত্র- মার্কসবাদী রাজনীতির হাতে রাশিয়ায় সর্বহারা বিপ্লবের সাফল্য। সমাজতন্ত্রের স্লোগানের অভিঘাতে গোটা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের দু-চোখে তখন স্বপ্ন, আরেকদিকে আমি, আমার, আমাদের জাতিই হল দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ এমন অনুভবকে পুঁজি করে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ক্রমশ উগ্র-দক্ষিনপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া। হিটলার দুটি স্লোগানকেই নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলেন, প্রতিষ্ঠিত হল ফ্যাসিবাদ।

আরেকটি কারনেও ঐ সময় আমাদের জন্য মনে রাখার বিষয়। ১৮৯৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যরাত্রে, বিংশ শতাব্দীর সূচনা মুহূর্তে বসে রবীন্দ্রনাথ সেই কবিতা লিখেছিলেন।

‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে

অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে

অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিণী

ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতা-নাগিনী

তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমিষে

গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।

স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে

ঘটেছে সংগ্রাম – প্রলয়-মন্থন-ক্ষোভে

ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি

পঙ্কশয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি

জাতিপ্রেম নাম ধরি, প্রচণ্ড অন্যায়

ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।

কবিদল চীৎকারিছে জাগাইয়া ভীতি

শ্মশানকুক্কুরদের কাড়াকাড়ি-গীতি।’

ছোট্ট চতুর্দশপদী কবিতা, কিন্তু সমকালীন দুনিয়ার কি অসামান্য ব্যখ্যা! তার বিভিন্ন লেখার অন্তঃসারে রয়েছে জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ধারণার ভিতরে লুকিয়ে রাখা আগ্রাসন, বিদ্বেষ, অন্যের প্রতি ঘৃনা। তাই ইউরোপে যেতে চাইলে তিনি সেখানে গিয়েও ঐসব বলে ভাষণ দেবেন এমন আশঙ্কায় সে আবেদন নাকচ করা হয়। পরে তার চারটি ভাষণ একত্র করে জাতীয়তাবাদ (ন্যাশনালিজম) শিরোনামে একটি ছোট বই প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ের শেষে পোঁছে উপরে উল্লিখিত কবিতাটি ছাড়াও আরও একটি কবিতা তিনি ব্যবহার করেছিলেন।

১৯৩৩ সালে ব্রেখট যখন জার্মানি ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন তখন সেদেশে তার সমস্ত বই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কবে ছেড়ে যান? ঐ বছরের ১০ই মে জার্মানিতে নব্য প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিস্ত সরকার তাদের প্রথম জাতীয় ঘোষনাকে সারা দেশে একযোগে পালন করার নির্দেশ জারি করে। সেই ঘোষণাটি কার্যত এক নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই আদেশনামায় নির্দিষ্ট কিছু বই যেখানে যত আছে সব বড় রাস্তার মোড়ে জড় করে এনে জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলা হল। গোটা জার্মানি জুড়ে সেই পোড়ানোর যজ্ঞ পালিত হয়েছিল। ব্রেখট জার্মানি ত্যাগ করেছিলেন ঠিক ঐদিনেই। এর ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে ১৯৮৩ সালে, আমার বার্লিনে থাকার সুযোগ হয়। সে বছর সেখানে এক বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল। প্রদর্শনীর বিষয় ছিল একটাই, ‘বই পুড়ছে, বই জ্বলছে’।

ব্রেখট একাই দেশত্যাগ করেছিলেন এমন না। আরও অনেকেই ছিলেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধারাও ততদিনে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সম্পর্কে একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে। এর দুটি অনুবাদ রয়েছে। কবিতার নাম বই পোড়ানো উৎসব।

সরকার থেকে যখন হুকুম এলো যে

বিপজ্জনক কথায় ভরা বইগুলিকে

পোড়াতে হবে প্রকাশ্যে

আর সমস্ত জায়গায় বই বোঝাই গাড়ি টানতে টানতে

বলদ গুলি চলল চিতার দিকে

নির্বাসিত এক কবি প্রথম সামিল একজন

পোড়ানো বইয়ের তালিকা দেখে কেঁপে গেলেন

কেননা, তাঁর বইগুলিকে এরা ভুলে গেছে

রাগের ডানা ঝাপটে দৌড়লেন তিনি

আর কর্তাদের কাছে লিখলেন এক চিঠি

আমাকে পোড়াও

ঝড়ের বেগে লিখলেন তিনি, পোড়াও আমাকে

একি ব্যবহার আমার সঙ্গে

ছেড়ে দিও না আমায়

আমি কি সবসময় সত্যই বলিনি আমার লেখায়

আর এখন তোমরা আমাকে বানিয়ে তুলছ মিথ্যাবাদী

হুকুম করছি পোড়াও আমায়

ইংরেজি থেকে বাংলায় এই অনুবাদটি করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এ কবিতারই আরেকটি অনুবাদ করেছিলেন উৎপল দত্ত। ইংরেজি না, সরাসরি জার্মান থেকেই। এই প্রসঙ্গ জরুরী কেন? ফ্যাসিবাদের একেবারে প্রথম পদক্ষেপই হল বই পোড়াও। সেই জন্যেই শিক্ষার প্রসঙ্গ আসে, মনে রাখতে হয় সাংঘাতিক শিক্ষা রয়েছে এমন বই পোড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। কারা ছিলেন সেই বইয়ের লেখক তালিকায়? মার্কস, এঙ্গেলস, এরিখ মারিয়া রেমার্ক, টমাস মান, বের্টোল্ট ব্রেখট, রোমা রঁল্যা, টলস্টয়, দস্ত্যেভস্কি অবধি প্রায় সকলেই।

১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ অবধি ইতিহাসের যে অভিজ্ঞতা এখান থেকেই ব্রেখটের রাজনীতি চর্চার শুরু। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে তাঁর, তাঁর মতোদের অভিজ্ঞতাই আমাদের অন্যতম সম্বল। তাই আজকের পরিস্থিতিতে আমাদের সচেতন থাকতে হয়। বই পড়া শুধু না, বইয়ের শিক্ষা সহ যাবতীয় মানবিক ঐতিহ্যের রক্ষায় আমাদের চিন্তা ও কাজকে মিলিয়ে চলতে হয়, তাই একে প্র্যাক্সিস বলে।

ফ্যাসিবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্রেখটের আর্ট, তাঁর সৃষ্টি আসলে কি? চিরায়ত মানবিক ন্যায়ের যে ধারণা তা তো আসলে ভিত্তি, তাকে গতি দেয় যে আবেগ, যে তাড়না সেই অনুভবই ব্রেখটের শিল্পচর্চার অন্যতম উপাদান। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে আমাদের কর্তব্য কি বলে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কি ব্রেখটের অভিজ্ঞতার শিক্ষাকেই সামনের দিকে আরও একেই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি না? অন্য অনেক কিছুর সাথে এও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ, অন্তত যারা আজকের দুনিয়ায় জনসাধারণের জন্য আর্ট, শিল্পের চর্চা করছেন তাদের জন্য তো নিশ্চয়ই।   

বের্টোল্ট ব্রেখটের নীতি, মতাদর্শ, পথ বলে কোনওকিছুকে চিহ্নিত করতে গিয়ে যেন তেন প্রকারেণ পুরানোকে ভাঙ্গার কথাই শুধু যেন আমরা না তুলে ধরি। ব্রেখট যেমন নতুন সময়ের জন্য নতুন নির্মাণ, নতুন সৃষ্টির কথা বলেছেন তেমনই নতুনকে গড়তে গিয়ে যে পুরানোকে ভুলে যেতে নেই, হারিয়ে যেতে দিতে নেই একথাও শিখিয়েছেন। প্রাক্সিস মানে প্রয়োগ, আবার এর আরেক মানে অভ্যাসও। ‘অভ্যাস’ অর্থে যা পুরানো, তাকেই ভেঙ্গেচুরে নতুন করে ‘প্রয়োগ’ করতে হয়, হবে। সংস্কৃতির অর্থ এক গতিময় কৃতি, এক অবিরত ক্রিয়া। সেটাই ইতিহাসের শিক্ষা, বের্টোল্ট  ব্রেখটের রাজনীতিও ঠিক তাই।

প্রাককথন ও বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিখন – সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply