চন্দন দাস
লাউড স্পিকারে সেদিন বাজছিল, ‘বহুদিন মনে ছিল আশা ধরণীর এক কোণে/ রহিব আপন মনে।’ গায়কের মরদেহ সলিল চৌধুরীর সামনে চলে যাচ্ছিল। কলকাতা ভেঙে পড়েছিল সেদিন সেই মরদেহবাহী শকটকে ঘিরে।
সেদিন ৭ই আগস্ট ছিল। ১৯৪১। বাংলা ক্যালেন্ডারে? ২২শে শ্রাবণ।
আর সলিল চৌধুরী? তখন ১৭। বঙ্গবাসী কলেজের সেকেন্ড ইয়ার আইএসসি-র ছাত্র। সেদিন একটি বাড়ির রকে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। তাঁর কথায়, “সেই আমার সচেতন জীবনের প্রথম আত্মীয় বিয়োগ! কাউকে না বলে এক মাসের অশৌচ নিলাম। তখনও দাড়ি গোঁফ ভালো করে ওঠেনি–কামাবার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু খালি পায়ে কলেজে আসতাম। মাছ-মাংস খেতাম না।”
তার অনেক বছর পর তাঁর একটি গান কাল জয়ী হয়ে ওঠে – – ‘ধরনীর পথে পথে ধুলি হয়ে রয়ে যাবো…”। কোথাও কী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ যাত্রার অনুভব থেকে গেছিল?
সেই সলিল চৌধুরী আর এক কলকাতার বর্ণনা লিখেছেন। যা তাঁর জীবনকে বদলে দিয়েছিল।
মনুমেন্টে ফর্দ টাঙিয়ে যেত পুলিশ!
মনুমেন্ট তখনও ‘শহীদ মিনার’ হয়নি। সময়কাল — ১৯৪৬-’৪৮।
কমিউনিস্ট পার্টি সভা ডাকত মনুমেন্টের নিচে। সভার আগে পুলিশের প্রথম কাজ হত একটি তালিকা মনুমেন্টের গায়ে সাঁটিয়ে দিয়ে যাওয়া। সেই তালিকায় থাকত কতগুলি গানের প্রথম বাক্য। নির্দেশ লেখা থাকত — এই গানগুলি সভায় গাওয়া যাবে না!
শাসক গান ভয় পেত।
সেই শাসককে ভয় পাওয়ানো গানগুলির বেশ কয়েকটি হত সলিল চৌধুরীর গান।
শাসক কমিউনিস্টদের গান ভয় পেত কেন? ১৯৪৪-র একটি পার্টি চিঠিতে যাবো। পার্টি চিঠিটির বিষয় বস্তু ছিল ‘কালচার ও কমিউনিস্ট।’ লেখা হল,‘‘…আমরা তো জানি সভ্যতা আজ বানচাল হয়ে পড়েছে, তার হাল ধরে রাখতে পারে ধনিকদের এমন শক্তি নেই। সেই হাল এ যুগের শক্তি তারাই, যারা উৎপাদক। এ যুগে উৎপাদনের শক্তি শ্রমিকদের হাতে, কৃষকদের হাতে,কারুবিদদের হাতে, শিল্পীদের হাতে। আর সেই শক্তিকেই মূলত চাপা দিতেচায়, শাসকশ্রেণী ও শোষকশ্রেণী; কারন তা নইলে তাদের কায়েমী স্বার্থ টিকে থাকবেনা।…সংস্কৃতিও তাদের একটা মুনাফার পণ্য। তারা সংবাদপত্র,মুদ্রাযন্ত্র, নাট্যশালা, সিনেমা, চিত্র,ভাষ্কর্য্য,স্থাপত্য সব মুনাফার বাজার হিসাবে চালায়।…ধনিকরা আসলে শিল্পী ও লেখকদেরও শ্রেণীশত্রু। কাজেই মূলত শিল্পী ও লেখকদের সঙ্গে শ্রমিকদের ও কৃষকদের বন্ধুত্বই থাকা উচিত। আর এই বন্ধুত্ব এ যুগে হচ্ছে স্বাভাবিক ও অনিবার্য্য। কারন, কালচারের আসল উত্তরাধিকারী আজ শ্রমিক কৃষক তা আমরা জেনেছি, সভ্যতার ক্ষেত্রে আজ তারাই স্রষ্টা।’’
সংস্কৃতি কী এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন বিকশিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ে সেই সময়ে বিস্তর চর্চা চলে। আবার সময়কাল ছিল উত্তাল। সলিল চৌধুরীর কথায়,‘‘সে একটা যুগ গেছে, যেন একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে দিয়ে দিনরাত্রিগুলি কেটে যেত — মাথায় খালি নতুন নতুন গানের ভাবনা, পকেটে রুমাল বাঁধা ভিজে ছোলার রেশন নিয়ে দিনের পর দিন অর্ধাহারে অনাহারে কেটে যেত, গায়েই লাগত না। ‘বিপ্লব’ ওই দিগন্তের ওপারেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে — আরও কিছু সংগ্রাম, আরও কিছু আত্মত্যাগ করলেই তার প্লাবন এসে অত্যাচার অনাচারকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে মুক্তির সূর্যের দ্বারোদ্ঘাটন করে দেবে, এমনটাই ছিল আমাদের বিশ্বাস আর প্রত্যয়। তিন তিনটে ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে কখনও কৃষকের ঘরের মাচায়, কখনও রেলের খালি ওয়াগনে, কখনও বা নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে, হেঁটে হেঁটে বাদা ভেঙে ভেঙে চাষির পল্লিতে পৌঁছে মিটিং হত।’’
সময় গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আর গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সেনানীদের উপলব্ধি। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র,যুব আন্দোলনে জোর দেওয়ার পাশাপাশি সাহিত্য, গান, ছবির জগতেও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বিকশিত করে তোলার এক উদ্যোগ সেই সময় নির্দিষ্ট ভাবে গৃহীত হয়েছিল।
অনেক উদাহরণ আছে এই প্রসঙ্গে। সলিল চৌধুরীর জীবনেই আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন,‘‘কমরেড বীরেশ মিশ্র আমায় ডেকে পাঠালেন। গোটা উত্তরবঙ্গ থেকে সারা আসাম উনি পরিক্রমা করবেন বিভিন্ন স্টেশনে রেলশ্রমিকদের মিটিং করে করে। আমাকে সঙ্গী হতে বললেন, প্রত্যেক মিটিং-এর আগে রেলশ্রমিকদের সংগ্রামের ওপর গান লিখে আমায় গাইতে হবে। একটা ইঞ্জিনের লাগোয়া বগিতে চেপে শুরু হল বীরেশদার সঙ্গে আমার যাত্রা। সাথী শুধু আমার সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম।’’
প্রত্যেক স্টেশনে সেই ‘সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম’ কাঁধে নিজের লেখা গান গেয়েছেন সলিল চৌধুরী। তাঁর কথায়,‘‘সেসবও কোথায় লুপ্ত হয়ে গেছে, বেঁচে আছে শুধু একটি গান। চলন্ত রেলগাড়ির চাকার শব্দের ছন্দে রচিত…’’
কোন্ সে গান, যা রেলের চাকার শব্দের ছন্দ থেকে জনকল্লোলে পরিণত হয়েছে? হয়েছে কালান্তর?
‘ঢেউ উঠছে/কারা টুটছে/ আলো ফুটছে/ প্রাণ জাগছে, জাগছে, জাগছে’ — হল সেই গানটি।
১৯৪৬-র ২৯ জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘটের ঠিক আগের দিন ময়দানে বিশাল সমাবেশে গানটি গাওয়া হয়েছিল — ‘‘শোষণের চাকা আর ঘুরবে না ঘুরবে না/ চিমনিতে কালো ধোঁয়া উঠবে না উঠবে না/ বয়লারে চিতা আর জ্বলবে না জ্বলবে না…./ আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধ..’’
গান ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী সংগঠক। হ্যাঁ, সংগঠক। সেই সূত্রেই সলিল চৌধুরীর কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা।
১৯৪০-’৪১-এ সলিল চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। রংপুরে ছাত্র আন্দোলনের সম্মেলনে গান গেয়েছেন তিনি। সে গানেও লড়াইয়ের কথা। কিন্তু তার বেশ কিছুদিন আগে সলিলের সঙ্গে একজনের পরিচয় হয়। তিনি বেশ ভালোবাসতেন সলিলকে। সেই ব্যক্তি বলেছিলেন,‘‘সলিল তুমি শুধু গান লিখে যাও — যা মনে আসবে তাই নিয়ে গান গান লেখো, সুর করো।’’ অর্থাৎ সবসময়েই লড়াইয়ের গান, যন্ত্রণার গান লিখতে হবে — তা নয়। যা মনে আসবে লেখো, সুর করো, গাও। একজন শিল্পীকে চেনা এবং তাঁকে সৃজনশীলতায় অনুপ্রাণিত করার এর থেকে সঠিক এবং প্রসারিত ভাবনা হয় না।
কিন্তু স্বাভাবিক প্রশ্ন — লোকটি কে?
তিনি মন্বন্তরে আছেন রিলিফের কাজে। বন্যায় আছেন উদ্ধারকার্যে। আবার কুষ্ঠিয়ার মোহিনী কটন মিল থেকে মেটিয়াবুরুজের কারখানার গেটেও তিনি হাজির। সেই তাঁকে দেখা যাচ্ছে পায়ে ঘুঙুর বাঁধা। পাঞ্জাবীটা কোমরে ধুতির শক্ত গাঁটে বাঁধা। কারখানাগুলি থেকে শ্রমিকরা বেরোচ্ছেন। শুরু হচ্ছে তাঁর প্রায় নেচে নেচে গান। ক্লান্ত, রিক্ত শ্রমিকরা জড়ো হচ্ছেন তাঁর কাছে। একসময় গান থামছে। পা স্থির। ঘুঙুর বিশ্রাম নিচ্ছে। শুরু হচ্ছে বক্তব্য — শ্রেণী সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার লড়াই মিশে যাচ্ছে তাঁর বাক্যে বাক্যে।
কে তিনি? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষকদের সংগঠিত আন্দোলনের ধারায় অবিচল স্বাধীনতা সংগ্রামী কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরী।
তিনি সলিল চৌধুরীকে গান বাঁধতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বলেছিলেন,‘‘সলিল তুমি শুধু গান লিখে যাও — যা মনে আসবে তাই নিয়ে গান গান লেখো, সুর করো।’’
সংগঠনে এবং সংগ্রামে গান, নাটক, কবিতার অসামান্য ভূমিকা প্রমাণ করেছিল কমিউনিস্ট পার্টিই। এগুলি ছাড়া লড়াই হবে না।
হতে পারে না।
সেই সময়কালের প্রভাব সলিল চৌধুরীর জীবনে অক্ষয় হয়েছিল। একাধিক জায়গায় তিনি জানিয়েছেন সে কথা – – ‘১৯৪৬ থেকে ১৯৫২—এই সাত বছরে আমার মানসিক, সাংস্কৃতিক, সাঙ্গীতিক এবং রাজনৈতিক চেতনা যেভাবে গড়ে উঠেছে, তারই ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আমার জীবনের দিগনির্ণয় এবং পথনির্দেশ ঘটেছে।”