MM Akash Interview Cover

Our Tasks: The Interview

সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম এম আকাশ। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা তার সাথে কিছু আলোচনা করি। কমরেড আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অন্যতম কৃতি প্রাক্তনী এবং অধ্যাপক। বিভিন্ন দেশে কর্তব্যরত কমিউনিস্টদের মধ্যে নানা প্রসঙ্গে পারস্পরিক আলোচনা, মতবিনিময় একটি অসাধারণ ঐতিহ্য। ওয়ান-লাইনার হিসাবে কূটকৌশল জেনে নেওয়ার শর্টকার্ট নয়, এহেন আদান প্রদান আসলে দুনিয়াজুড়ে বিদ্যমান এক সাধারণ সত্যকে উপলব্ধি করতে বস্তুগত সহায়তা যোগায়। পার্টিতে যুক্ত হওয়া নতুন প্রজন্মের কমরেডদের জন্য এহেন মতবিনিময় কার্যত শেখার বিষয়, চর্চারও বিষয়। কমরেড আকাশের সাথে আলাপচারিতার বাড়তি সুবিধা এই যে আমরা উভয়েই বাংলায় কথা বলেছিলাম।

সিপিআই(এম) রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে সেই আলোচনার মূল প্রসঙ্গগুলিকেই একটি সাক্ষাৎকারের চেহারায় প্রকাশ করা হল।

ওয়েবডেস্কঃ

বিশ্বপরিস্থিতি হিসাবে দক্ষিণপন্থার স্পষ্ট উত্থান দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশেও তারই প্রতিফলন স্পষ্ট। সদ্য সমাপ্ত সাধারণ নির্বাচনে যেমন কায়দায় বিপুল অর্থের ব্যবহার দেখা গেল আমাদের দেশে এমন নজির নেই। নির্বাচকমণ্ডলী অর্থাৎ দেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক মতামতকে প্রভাবিত করতে দক্ষিণপন্থার এমন কৌশল সম্পর্কে মার্কসবাদীদের পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গী কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

কমরেড আকাশঃ

এমন কৌশলের অবশ্যই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থের জোরে কি সকলের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া যাচ্ছে? একেবারেই না। জনসাধারণের কিছু অংশের উপরে অবশ্যই এর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে, কিন্তু তার মানে এমন না যে সকলেই টাকা-পয়সার সামনে নিজেদের অধিকার বন্ধক রাখছেন কিংবা রাখতে চাইছেন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় আসলে জনসাধারণ অর্থ শক্তির সামনে মাথা নামিয়ে ফেলেন না, আগেও তাই আজও তাই। টাকা পয়সার বিনিময়ে মূলত যাদের উপরে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চলে তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের নেতা বিশেষ। দক্ষিণপন্থা আসলে লোভ দেখিয়ে তাদেরই কিনে নিতে চায় যাতে ঘুরপথে জনগনকে ধোঁকা দেওয়া যায়। সবার হাতে যদি প্রচুর পরিমানে টাকা তুলেই দেওয়া হয় তাহলে তো দক্ষিণপন্থা নিজের মৌলিক আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থানটিই হারিয়ে ফেলবে! দুনিয়াজোড়া সম্পদের উপরে সকলের অধিকার, গরীব মানুষের অধিকারকে কি দক্ষিণপন্থা ও তার রাজনীতি এভাবেই ফিরিয়ে দেবে? কোনওদিনই নয়। এখানেই আমাদের আলোচনার মূল প্রসঙ্গ বলে আমি মনে করি। প্রকৃত সমস্যাটি সম্ভবত এমন না যে অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক মতামত চাপা পড়ছে, আসল কথাটা হল যাদের উপরে নানা সময়ে বিভিন্ন কারণে জনসাধারণের ভরসা জন্মাচ্ছে তারা অর্থশক্তির সামনে নিজেদের অবস্থান কতদূর স্বচ্ছ ও দৃঢ় রাখতে পারছেন। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে মগজে রেখে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, শেষ অবধি তাদের দেউলিয়াপনা প্রকাশ হয়েই পড়ে, অর্থের কারণেই এমনটা ঘটে। সেই অভিমুখে জনসাধারণকে কতদূর সচেতন করা যেতে পারে সেটাই বোধহয় আমাদের চিন্তাভাবনার অন্যতম বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করতে হবে।

ওয়েবডেস্কঃ

আমরা যখন বলি আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি, আজকের দুনিয়ায় তার প্রভাব ইত্যাদি- দেখা যায় জনসাধারণের সামনে এই উপলব্ধি হাতে কলমে অনুভব করার সুযোগ খুব একটা নেই। অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অ্যাকাডেমিক কিংবা কিছুটা সচেতন চর্চায় যারা রয়েছে তারা যত সহজে ঐ শব্দবন্ধের সাথে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাপনকে বিবেচনা করতে পারেন অন্যদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। এই একই অভিজ্ঞতা কি আপনাদের কাজের বেলাতেও ঘটে? সাধারনভাবে কমিউনিস্টরা সংগঠন ও সাংগঠনিক মজবুতির উপরে ভিত্তি করেই এমন যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে চায়। আজকের সময় কি তার চাইতে আরও বেশি কিছুর দাবী সামনে নিয়ে আসছে?

কমরেড আকাশঃ

কমিউনিস্টদের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে, আমাদের মূল রাজনীতি ‘ম্যাক্রো’ বৈশিষ্টের। একেই প্রত্যেকের সামনে উপস্থিত করতে হয়, অর্থাৎ ম্যাক্রো বা সমষ্টি পর্যায়ের সাধারণ সত্যকে সকলের নিজস্ব উপলব্ধিতে নিজস্ব সত্যরূপেও প্রমাণিত করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই যে বিভিন্ন ব্যক্তি ধরে ধরে ‘মাইক্রো’ বাস্তবতার প্রসঙ্গ সামনে এলো এটাই আজকের দিনে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের পাশাপাশি প্রতিটি অংশের মানুষের নিজস্ব উপলব্ধি রয়েছে। সেই উপলব্ধিতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে, তবু ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণে তার বিশেষ প্রভাব রয়ে যায়। অতীতের তুলনায় আজকের সময়ে সেই প্রভাব অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগঠনের কাজ বলে যা বলা হয় তার প্রধান উদ্দেশ্য সেটিই। এই কাজের অর্থ কি? ম্যাক্রো বলতে আমি আইডিওলজি বা মতাদর্শের কথাই বলতে চাইছি। সাংগঠনিক দায়িত্ব হিসাবে যে বা যারা সেই মতাদর্শকে মানুষের সামনে নিয়ে যায় তাকে জনসাধারণের যে নির্দিষ্ট অংশের কাছে সে বা তারা নিয়ে যাবে তাদের ব্যক্তি চাহিদা সম্পর্কে যথেষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠরূপে অবহিত হতেই হবে। তা নাহলে উপর থেকে রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধমে অনেক দুরের লক্ষ্য বা সম্ভাবনাকেই কিছুটা চাপিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। সেই দুরের লক্ষ্য যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন এহেন বক্তব্যে গরীব মানুষের তরফে কিছুটা দুশ্চিন্তার উদ্রেক হওয়া তো স্বাভাবিক কারণ তাদের বাস্তবতা প্রতিটি দিন যেভাবেই হোক বেঁচে থাকা, টিকে থাকার লড়াইতে নিহিত রয়েছে। তাই আমি বলতে চাইছি আমাদের রাজনৈতিক বক্তৃতার ধরনকে নিছক মতাদর্শগত বয়ান অর্থাৎ ‘ইডিওলজিক্যাল ইন্টারপ্রিটেশন অফ দ্য ইডিওলজি ইটসেলফ’ হলে চলবে না। রাজনীতির বাস্তব মাটিতে মতাদর্শ চর্চাকে কার্যকর করে তুলতে হবে।

এখানেই প্র্যাকটিকাল রাজনীতির কথা পুনরায় সামনে এসে যায়, যাবে।

ওয়েবডেস্কঃ

কিভাবে সেই প্রসঙ্গ সামনে আসছে?

কমরেড আকাশঃ

ধরা যাক বর্গা-রেকর্ড থাকা সত্বেও একটি গরীব পরিবার জমির অধিকার পাচ্ছে না। ঐ মুহূর্তে পরিবারটির বাস্তব সমস্যার মূল সেই অধিকারের প্রতিষ্ঠা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য কমিউনিস্ট রাজনীতির মতাদর্শ যদি সরাসরি সেই পরিবারের জন্য সম্ভাবনাময় অর্থাৎ ‘ফিজিবল’ হয়ে ওঠে তাহলে তারা নিশ্চিন্তে তাকেই নিজেদের বক্তব্য হিসাবে স্বীকার করবে এবং তখনই একটি মতাদর্শগত বয়ান জীবনযাপনের বাস্তবতায় শক্তি সঞ্চয় করবে। কিছুটা মজা করেই বলা যায়, জমির অধিকার হারিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসা গরীব পরিবারে সামনে বর্গা সম্পর্কিত আইন-কানুন সম্পর্কে যত জোরের সাথেই বলা হোক না কেন, ব্যাপারটা তাদের চেতনায় ‘কাজের বিষয়’ বলে প্রতিভাত হবে না। একেই আমি মাইক্রো বাস্তবতায় ইডিওলজিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার কাজ বলতে চেয়েছি। এখানেই একজন কমিউনিস্ট কর্মীর দুটি পরীক্ষাও হয়। প্রথমটি উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধানে মগজকে কাজে লাগানোর বিষয়, ক্রিয়েটিভ ইন্টেলিজেন্স। দ্বিতীয়টি হল সর্বহারা শ্রেণীর মানুষের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসাবে তার বা তাদের অন্তরঙ্গতা কতদূর আন্তরিক তার প্রশ্ন। এদুটিই দৈনন্দিন রাজনীতির অত্যন্ত জরুরী প্রসঙ্গ। এমনটা না হলে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে যা কিছু বলা হবে তাতে বেশ ‘রেটোরিক’ বজায় রইল ভেবে নিয়ে খানিকটা আত্মতুষ্টির ভাবনা আসতে পারে। গরীব, অসহায়, দুঃস্থ মানুষের সাথে যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্বেও কেন তারা ব্যবস্থা বদলের লড়াইতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন না তার বিচার-বিশ্লেষণ করার সময় আমাদের সচেতন থাকতে হয় মূলত এই কারণেই, দুনিয়াজুড়েই এ হল এক সাধারণ সত্য।

ওয়েবডেস্কঃ

অর্থাৎ আন্তরিকতা থাকলেই শুধু চলবে না, গরীব মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট রাজনীতিকে কার্যকরী সমাধানের সম্ভাবনাগুলিকেও যথাযথ কায়দায় ‘এক্সপ্লোর’ করতে হবে। একথা অবশ্য আমাদের পার্টির পক্ষেও বারে বারে বলা হচ্ছে।

কমরেড আকাশঃ

আমি সেই জন্যই বস্তুগত পরিস্থিতি বা ‘মেটিরিয়াল ইস্যুস’-এর প্রসঙ্গটি আলাদা করে উল্লেখ করলাম। অনেকসময় বাস্তব পরিস্থিতি বলতে শুধুই অর্থনৈতিক বাস্তবতা ভেবে নেওয়া হয়, আসলে এর প্রেক্ষিত আরও বিস্তৃত। সর্বহারা শ্রেণীর মানুষের নিজস্ব আর্থিক বাস্তবতা যেমন পরিস্থিতি তেমনই সত্য তাদের রুচি-সংস্কৃতির ইস্যু। সার্বিক বিচারে তাদের চিন্তা-চেতনার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি আমাদের পৌঁছাতে হবে, যাতে বোঝা যায় তারা আসলে কি ভাবছেন, কিভাবে ভাবছেন। অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনেকটাই পরিমাপযোগ্য- ‘মেজারেবল’, অন্যান্য ইস্যুগুলি তেমন করে উপলব্ধি করতে গেলে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু আর্থিক বাস্তবতার পাশাপশি অন্যান্য ইস্যুও একইরকম জরুরী বলেই আমি মনে করছি।

ওয়েবডেস্কঃ

আমাদের দেশের বাস্তবতায় প্রতি দশ কি পনেরো কিলোমিটারে মানুষের বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি, অভ্যাস, ভাষা ইত্যাদি বদলে যায়। এক্ষেত্রে আপনি যেভাবে আইডিওলজি’কে ‘ম্যাক্রো’ স্তর থেকে ‘মাইক্রো’ স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন তা কিছুটা স্থানীয় বৈশিষ্টের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দাবী করেই। আপনাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এমন সমস্যার কিধরণের সমাধান হতে পারে বলে মনে করেন?

কমরেড আকাশঃ

আধুনিক পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট অনুসারেই আজকের বাস্তবতা। একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেও বিভিন্ন প্রান্তে বস্তুগত পরিস্থিতি বিভিন্ন হচ্ছে। তাই সেগুলিকেই প্রাথমিক লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করতে হবে। আবার এও মনে রাখতে হয় যে ইতিহাসের শিক্ষা এই যে বিভিন্ন ইস্যুতে গড়ে ওঠা বিবিধ সংগ্রামগুলি একদিন একজায়গায় এসে মিলে যায়। কার্যত ইতিহাসের গতিপথে এগুলি একেকটি গাঁট বলা যায়, ইংরেজিতে যাকে ‘নট’ বলে। মানুষের সংগ্রাম একবার সেই পর্যায়ে পৌঁছালে বিভিন্ন ‘মাইক্রো’ ইস্যু একসাথে মিলে একটি ‘ম্যাক্রো’ সমাধানের অভিমুখে একনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর আলাদা করে আইডিওলজি ও দৈনন্দিন লড়াইকে বিবেচনা করতে হয় না। সেটাই আজকের সংগ্রামে বিভিন্ন লড়াইয়ের সাধারণ লক্ষ্য। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা যায় ঠিকই, কিন্তু কোথায় গিয়ে বহুবিধ লড়াই-আন্দোলন-সংগ্রামগুলি একে অন্যের সাথে মিলে যাবে সেই সম্পর্কে উপলব্ধিটি ঐতিহাসিক সত্য হিসাবে আগাম আঁচ করতে হবে এবং সঠিকভাবেই করতে হবে। মোটের উপরে যেকোনো কমিউনিস্ট পার্টির জন্য এই হল তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার গোড়ার কথা।

ওয়েবডেস্কঃ

বিভিন্ন লড়াই-সংগ্রামকে একসুত্রে, একটি সাধারণ লক্ষ্যের দিকে টেনে আনার যে প্রসঙ্গ, এমন পরিকল্পনা পার্টি সংগঠন ও তার কাজ সম্পর্কে লেনিনের বোঝাপড়াকেই তুলে ধরে। কিন্তু এহেন ‘থিওরিটিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ থাকা সত্বেও দুনিয়াজুড়ে দক্ষিণপন্থার যে কায়দায় উত্থান ঘটছে তা যথেষ্ট আগ্রাসী। মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসাবে একে প্রতিহত করতে হলে বিভিন্ন ছোটবড় লড়াইকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন। আপনাদের অভিজ্ঞতায় এমন ‘মাইক্রো’ পর্যায়ের সাংগঠনিক কাজ থেকে লড়াই-সংগ্রামের বৃহত্তর (ম্যাক্রো) ময়দানে উঠে আসার কোনও উদাহরণ কি রয়েছে?

কমরেড আকাশঃ

হ্যাঁ, রয়েছে। গাইবান্দা নামের যে এলাকা তার ঘটনার কথা এখুনি উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি। সাম্প্রতিক নির্বাচনে ঐ অঞ্চল থেকে আমাদের পার্টির প্রার্থী বেশ ভালো ভোট পেয়েছেন। তিনি শুধু প্রার্থী ছিলেন না, তিনি ঐ এলাকায় আমাদের পার্টির অন্যতম নেতৃত্ব ও সংগঠক। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায় নির্বাচনী ফলাফলের এমন ইতিবাচক বাস্তবতা কিন্তু হঠাৎ তৈরি হয়নি, এক দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল। ঐ কমরেড এক লম্বা সময় জুড়ে গাইবান্দা এলাকার গরীব মানুষকে সংগঠিত করার কাজ করেছেন। আজ যদি গাইবান্দার কোনও স্থানীয় বাসিন্দা ঢাকায় আসেন তবে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে এসেই কমরেড মীরের খোঁজ করেন এবং  নিজের রোজগারের একটি অংশ তার হাতে তুলে দেন।

এমন পরিস্থিতি কি করে গড়ে উঠল?

কমরেড মীর যে কাজটি শুরু করেছিলেন তার মূল কথা স্থানীয় হাটে পৌঁছে হাট তোলার আন্দোলন গড়ে তোলা। হাটে উপস্থিত ক্ষুদ্র গরীব কারবারিদের থেকে জবরদস্তি যে তোলা আদায় করা চলত এবং প্রায় একটি পাকাপাকি বন্দোবস্ত গড়ে উঠেছিল সেই পরিস্থিতির বদল ঘটিয়েছিল ঐ আন্দোলন। অর্থাৎ এই আন্দোলন একদিকে স্থানীয় ইস্যুর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা লড়াই ছিল, আবার গরীব মানুষের অধিকার পেতে সাধারণ সংগ্রামেরও অনুভব তাতে যুক্ত ছিল।

ওয়েবডেস্কঃ

এমন লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যদি বিতর্ক তোলা হয় যে এ তো কিছুটা সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার কৌশল। একসময় যে রীতিনীতিকে সংস্কারবাদী পন্থা বলা হত এ কি কিছুটা তেমনই কৌশল না? স্থানীয় ইস্যুর লড়াই কি সর্বদাই জয়ী হবে?

কমরেড আকাশঃ

আমি আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছি মাত্র। আমি মনে করছি এহেন ছোটবড় লড়াই মূল লক্ষ্যের লড়াইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে, সেই অভিমুখে সংগঠিত করতে সাহস যোগায়। যদি সেই মূল লক্ষ্যকে চিন্তা-ভাবনার বাইরে রেখে যদি কেবলই স্থানীয় লড়াইয়ের গন্ডিতে আটকে থাকা হয় তবে সেটি নিশ্চয়ই সংস্কারবাদী আন্দোলনে পর্যবসিত হবে। কিন্তু সংগঠকদের চেতনায় যদি নিজেদের দেশের বাস্তবতা অনুসারে পরিস্থিতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকে এবং ধিরে ধিরে আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত মানুষের চেতনায় যদি সেই সত্য ফুটে উঠতে থাকে তবে এ ধরণের লড়াই শেষ অবধি আমাদের কিছুটা হলেও সামনের দিকে এগিয়ে দেবে, এই আমার মূল কথা।

ওয়েবডেস্কঃ

পরিস্থিতির বৈপ্লবিক বদল সম্পর্কে সচেতন থাকা বলতে কি বোঝাচ্ছেন? রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কারণেই জনসাধারণের চেতনায় যেমন আধিপত্য কায়েম হয়ে থাকে তাকে বিবেচনায় রেখেই কি এমন পরিকল্পনা হবে?

কমরেড আকাশঃ

রাষ্ট্র অবশ্যই জনসাধারণের উপরে আধিপত্য কায়েম করে, সেটা নাহলে পুঁজিবাদ কিছুতেই চলতে পারে না। কিন্তু সত্যি তো এই যে শাসক শ্রেণীর পক্ষে নিপীড়িত জনসাধারণের কোনও বাড়তি সমর্থন থাকে না। কাজেই জনসাধারন যদি পরিস্থিতির বদল ঘটানো সম্পর্কে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন তাহলে বাস্তবতা বদলাতে অসুবিধা হয় না। দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তেই এমনটি সম্ভব। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে এমনটা ঘটার বস্তুগত (অবজেক্টিভ) ও চেতনাগত (সাবজেক্টিভ) শর্ত রয়েছে। কিন্তু শেষ অবধি তো কাজ ওটাই।

আমি বলতে চাইছি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে জনসাধারণের উপরে প্রভাব বিস্তারের কৌশলগুলি অনেকটাই গভীর অবধি প্রসারিত হয়েছে। একথাও ঠিক যে সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে অসত্য, অর্ধসত্য ইত্যাদির বিপদও বেড়েছে। কিন্তু এতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ যেমন শাসকের পক্ষে বেড়েছে তেমনই মানুষের জানা, বোঝার পরিসরটিও বৃদ্ধি পেয়েছে। একেই সফলভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ আজকের দিনে জনসাধারণের লড়াইয়ের সাথে কমিউনিস্টদের বাস্তবিক বিচক্ষণতার প্রসঙ্গটি আরও বেশি বেশি করে সামনে চলে আসছে। এগোনোর পথে মূল বাধা আজও মূলত দুটি, একদিকে শাসক বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে ভীতি। অর্থনৈতিক সংকট বাড়লে গরীব মানুষের মধ্যে সেই ভয় ক্রমশ বাড়ে, সেটাই স্বাভাবিক। আরেকদিকে এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় লড়াই-আন্দোলন-সংগ্রামকে মূল লড়াইয়ের সাথে ক্রমাগত সম্পর্কযুক্ত করে যেতে সংগঠকরূপে কমিউনিস্টদের সচেতন প্রয়াস। এখানেই মতাদর্শ ‘আইডিওলজি’ ও সংগ্রাম একে অন্যের হাত ধরে থাকে। এখানেই রাজনীতির দুটি অভিমুখ, একটি নির্দিষ্ট আরেকটি সাধারণ।

ওয়েবডেস্কঃ

বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি নিপীড়িত মানুষের উদ্দীপনাকে জাগিয়ে তুলতে কি কোনও সাধারণ বক্তব্য রয়েছে? অর্থাৎ দুনিয়াজুড়ে লড়াইয়ের কোনও সাধারণ সুত্র কি আজও বাস্তব?

কমরেড আকাশঃ

গরীব, নিপীড়িত মানুষ ও তাদের উপর ঘটে চলা অন্যায়, অবিচার ও শোষণই সেই সাধারণ বাস্তবতা। বাকি সবটাই নির্ধারিত হয় বিভিন্ন দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনার উপরে নির্ভর করেই। সাধারনভাবে বলতে গেলে একদিকে কমিউনিস্টদের সাধারণ লক্ষ্য আজও একই রয়েছে, শোষণ বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে নতুন সমাজব্যবস্থার নির্মাণ। আরেকদিকে সেই লক্ষ্যে চলার পথে একেকটি দেশের নিজস্ব বাস্তবতা, নিজস্ব পরিস্থিতি, নিজস্ব বাধাসমূহ। এসমস্ত বাধা ও তার অতিক্রম সম্পর্কে কিছু অসামান্য রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি আমাদের স্কলের সামনেই রয়েছে, সেগুলিই ইতিহাসের শিক্ষা। আজকের পরিস্থিতিতে আমরা মাও সে তুং’র একটি কথা স্মরণে রাখতে পারি- জনগণের থেকেই শিক্ষা নিতে হবে, লার্ন ফ্রম দ্য পিপল।

Spread the word

Leave a Reply