Arun Singh Cover

Niendarthals, Darwin And India: A Report

ডঃ অরুণ সিং

ডঃ সাভান্তে পাবো’র গবেষণালব্ধ ফল চিকিৎসা ও শারীরবিজ্ঞান বিভাগে এই বছর নোবেল পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। অক্টোবর মাসের গত ৩ তারিখ সেই ঘোষণা হয়েছে। নোবেল পুরষ্কার আউটরিচের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার অ্যাডাম স্মিথ নিজেই ডঃ সাভান্তে পাবো’কে সেই বার্তা দেন। স্মিথের সাথে নিজের জীবন ও কাজ সম্পর্কে আলোচনার সময় ডঃ পাবো নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত তার পিতা সুনে বার্গস্টর্ম ও মা’য়ের প্রভাবের উল্লেখ করেন। তার সাথেই বলেন নিজের দীর্ঘ গবেষণার কাজে জরুরী আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কাহিনীটিও। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নোবেল ল’রেট পিতার কাছে শেখা এক গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধির কথা স্মরণ করেন – ‘বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন ব্যাক্তিবর্গের প্রত্যেকেই আর পাঁচজনের মতোই স্বাভাবিক মানুষ’।

নোবেল পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত হওয়ার খবর পাওয়ার পরেই স্মিথের সাথে তার এই কথোপকথন চলে। একে কিছুটা আলাপচারিতা বা আড্ডাও বলা চলে। লুপ্ত হয়ে যাওয়া মানব প্রজাতি হোমিনিনদের সাথে আধুনিক মানুষের যোগসূত্রটিই নিজের গবেষণায় তুলে ধরেছেন ডঃ পাবো।  ১৮৫৬ সালের আগস্ট মাসে জার্মানির উত্তরাংশে রাইন-ওয়েস্টফেলিয়া অঞ্চলে বহমান ড্যুসেল নদীর পাশে নিয়ান্ডার্থ্যাল উপত্যকাতেই আদি মানবের (হোমো নিয়ান্ডার্থ্যালেনসিস) জীবাশ্মের প্রথম খোঁজ মেলে, তাই এদের নামকরণে ঐ এলাকার নামও জূড়ে দেওয়া হয়। জার্মান ভাষায় ঐ এলাকাটি নিয়ান্ডার্থ্যাল উপত্যকা বলে পরিচিত, আবিষ্কৃত প্রজাতিটিও নিয়ান্ডার্থ্যাল বলেই চিহ্নিত হয়।

‘নিয়ান্ডার্থ্যাল’-এর শব্দার্থ অসভ্য, রুচিহীন, চাষবাস না জানা বর্বর- ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হোমো নিয়ান্ডার্থ্যালেনসিসদেরও তেমনই ধরে নেওয়া হত। ঠিক এই জায়গাতেই ডঃ পাবো’র গবেষণার গুরুত্ব। আদি মানবের (হোমো নিয়ান্ডার্থ্যালেনসিস) সাথে আধুনিক মানুষের সম্পর্ক নির্ধারণই তার একনিষ্ঠ সাধনা। লুপ্ত হয়ে যাওয়া হোমিনিনদের তিনি পুনরাবিষ্কার করতে চেয়েছেন জেনেটিক্স সম্পর্কিত তথ্যতালাশের মধ্যে দিয়েই। পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী আজকের মানুষের শিকড় সন্ধান করতে চেয়েছেন, বুঝতে চেয়েছেন প্রকৃতিতে তাদের অস্তিত্বের গুরুত্ব। স্মিথের সাথে কথা বলতে গিয়েই তিনি জানান ‘আমি কল্পনা করি, কেমন হত যদি নিয়ান্ডার্থ্যালরা আরও চল্লিশ হাজার বছর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতো? তারা কিভাবে আমাদের প্রভাবিত করত? এমনটা হলে হয়ত আমরা জাতিবিদ্বেষের সবচেয়ে জঘন্য চেহারাটা দেখতে পেতাম। আমাদের তুলনায় তারা কিছুটা অন্যরকম – এটাই হয়ত তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট কারণ হতো, তাই নয় কি? আরেকটি সম্ভাবনাও রয়েছে- এই দুনিয়াতেই আরেকরকম মানুষের সাথে (যাদের সাথে আমাদের অনেকটা মিল থাকলেও কিছুটা অমিলও রয়েছে) সহাবস্থানের প্রভাবে আমরা নিজেদের নতুন করে খুঁজে পেতাম। আজ আমরা যতটা সহজে পশুদের থেকে নিজেদের আলাদা বিবেচনা করি তখন হয়ত সেভাবে করতাম না- আমি বলতে চাইছি হয়ত পশুদের তুলনায় নিয়ান্ডার্থ্যালদের সামান্য হলেও উন্নত বিবেচনা করতাম আমরা। যদিও বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে নিয়ান্ডার্থ্যালদের নিজস্ব সংস্কৃতি বলেও কিছু একটা ছিল, এমনকি সেই সংস্কৃতির বিকাশ অবধি ঘটেছিল। তাদের হাতে ছিল পাথরের হাতিয়ার। শিকার, বুনিয়াদি কৃষিকাজ (খোঁড়াখুঁড়ি ইত্যাদি) এবং শাকসবজি তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে হতে সেইসব হাতিয়ার ক্রমশ উন্নত-জটিল চেহারা নেয়। মানুষের অভিযোজনের ইতিহাসে দশ হাজার বছর ধরে চলা নিয়ান্ডার্থ্যালদের সেই জীবনসংগ্রাম এক অতি উল্লেখযোগ্য পর্যায়।

হোমো নিয়ান্ডার্থ্যালেনসিস ও হোমো নিয়ান্ডার্থ্যালদের একইসাথে কখনো নিয়ান্ডার্থ্যাল আবার কখনো নিয়েন্দর্টাল ও বলা হয়। এই গোত্রভুক্তেরা হল সেই আদিম জনগোষ্ঠী যারা আজ থেকে দু লক্ষ বছর আগেকার পৃথিবীতে বেঁচে ছিল। বলা যায় প্রায় চব্বিশ হাজার বছর আগে এরা আধুনিক মানুষের সাথে মিশে যেতে শুরু করে এবং একটা সময় বিলুপ্ত হয়। ইউরোপের অন্তর্গত অতলান্তিক অঞ্চলের ইউরেশিয়া থেকে নিয়ান্ডার্থ্যালরা চলতে শুরু করে। ক্রমশঃ পূর্বাভিমুখে চলতে চলতে সবশেষে এসে পৌঁছয় মধ্য এশিয়াতে। এখনকার ভূগোল অনুযায়ী সেই জায়গাটি বেলজিয়ামের উত্তর আর দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত একটি এলাকা। ততদিনে পূর্ব এশিয়ায় এবং আফ্রিকাতে আদিম জনগোষ্ঠীগুলি বসবাস করতই। সেইসব জনগোষ্ঠীগুলির তুলনায় নিয়ান্ডার্থ্যালদের সম্পর্কে আমরা কিছুটা বেশি তথ্য পাই কেন? কারণ নিয়ান্ডার্থ্যালরা চুনা পাথরের গুহাগুলিতে বসতি নির্মাণ করে থাকত। এইসব গুহাতেই তারা নিজেদের মৃত সদস্যদের কবর দিত, চুনাপাথরের কারণেই হাড়গোড় ভালোমত সংরক্ষিত থাকে। এই কারণে গুহাবাসী জনগোষ্ঠী বলতে এদেরই বোঝান হয়।

জিনগত, বংশগত এবং ব্যবহারগত বৈশিষ্টের ভিত্তিতে আধুনিক মানুষদের আদি জনগোষ্ঠীগুলির থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে আলাদা করে বিবেচনা করা শুরু হয় ।

হোমো স্যপিয়েন্স মানে ‘জ্ঞানী মানুষ’। ইংরেজিতে যা হিউম্যান ল্যাটিন ভাষায় হোমো মানেও তাই। একইভাবে বুদ্ধিমান বোঝাতেই স্যপিয়েনস শব্দের প্রয়োগ করা হয়। প্রখ্যাত সুইডিশ ক্ল্যাসিফায়ার (বিভিন্ন প্রাণীকে নির্দিষ্ট শ্রেণীভুক্ত করে চিহ্নিতকরণের কাজ করেন যারা ) কার্ল লাইনিউস ১৭৫৮ সালে আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেছিলেন। হোমো স্যাপিয়েন্সই হল সেই নাম।

তখনও জীববিজ্ঞানে বিবর্তনের ধারণা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন প্রজাতিকে বিভিন্ন স্বতন্ত্র গোত্রভুক্ত করেই চিহ্নিতকরণের কাজ করা হত। একরকম ধরেই নেওয়া হত এইসব স্বাতন্ত্র্যের কারণ হলেন ঈশ্বর স্বয়ং। বিভিন্ন জীবকে একেকটি গোত্রের অন্তর্গত প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিতকরণের কাজ করতে গিয়েই জীববিজ্ঞানীরা মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে মনোযোগী হলেন। এখনও কোনো একটি প্রজাতিকে চিহ্নিতকরণের কাজ সেই প্রজাতির নির্দিষ্ট বৈশিষ্টকে ভিত্তিতেই চলছে।

এভাবেই আমরা মানুষের চারটি প্রজাতির কথা জানতে পেরেছি। এরা কেমন ছিল?

শেষ দশ লক্ষ বছর ধরে চলা বিবর্তনের ইতিহাস মনে রাখলে দেখা যাবে চারটি প্রজাতি হল –

১) হোমো স্যাপিয়েনস ( আধুনিক মানুষ )

২) হোমো নিয়ান্ডার্থ্যালেনসিস ( অর্থাৎ নিয়ান্ডার্থ্যালরা)

৩) হোমো হাইডেলবার্গেনসিস ( আমাদেরই এক পূর্বপুরুষ বিশেষ )

৪) হোমো ইরেকটাস ( আধুনিক মানুষের আরো প্রাচীন এক পূর্বপুরুষ বিশেষ )

হোমো ইরেকটাসদের সাথে হোমো স্যাপিয়েনসদের পার্থক্য কি?

হোমো ইরেকটাস রা দুপায়ে খাড়া হয়ে চলতে পারত। বৈজ্ঞানিক দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মতটি হল এরাই আধুনিক মানুষের ( হোমো স্যাপিয়েনস ) প্রকৃত পূর্ব পুরুষ। আজ থেকে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকাতে এই প্রজাতির বিচরণ শুরু হয়। এরা প্রথমে মধ্য এশিয়ায় আসে, পরে সেখান থেকেই তাদের একটি অংশ ইউরোপে পৌঁছায়। ধীরে ধীরে এরা বিলুপ্ত হয়েছে, এই জন গোষ্ঠীর বিলুপ্ত হওয়ার সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়কালের ভিত্তিতেই তালিকায় এদের পিছনে রয়েছে হোমো হ্যাবিলিস জনগোষ্ঠী এবং সামনে আছি আমরা অর্থাৎ হোমো স্যপিয়েন্স রা। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে হোমো ইয়েরকটাসেরাই হল সেই প্রজাতি যারা প্রথম নিজেদের দু পায়ে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখে। আজকের মানুষের তুলনায় এদের মস্তিষ্কের আকৃতি সাধারণভাবে ছোট হলেও করো টির আকারটি ছিল অনেকটাই বড়। হোমো ইরেকটাসের মগজ ৮৫০ সিসি থেকে ১১০০ সিসি মতো। হোমো স্যপিয়েনজদের মগজের আকৃতি ১১০০ সিসি অবধি হয়। এই দুই প্রজাতির চোয়ালের গঠনেও ফারাক রয়েছে। হোমো স্যাপিয়েনস দের তুলনায় হোমো ইরেকটাসদের চোয়াল হত অনেক বড় ও প্রশস্ত, দাঁতের পার্থক্যও একইরকম। এই দুই প্রজাতির ভাব বিনিময় পদ্ধতিও আলাদা।

আজ থেকে এক লক্ষ পঞ্চাশ বছর আগে আফ্রিকার দক্ষিণ অংশই হয়ে ওঠে আধুনিক মানুষের আঁতুড়ঘর। মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা অস্ট্রোলোপিথেকাসদের দেহাবশেষ ( জীবাশ্ম ) প্রথম পাওয়া যায় এখানেই। এরাই বিবর্তিত হতে হতে হোমো ইরেকটাসে রূপান্তরিত হয়। সেই হোমো ইরেকটাসেরাই আরো পরে জন্য দেয় হোমো স্যাপিয়েনস’কে। ক্রমে এরাই আফ্রিকা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। শেষ অবধি শুধু হোমো স্যাপিয়েনসরাই টিকে রইল আর অন্যান্য প্রজাতিগুলো নিশ্চিহ্ন হল? এর কারণ সামনের দিকে এক বিরাট উল্লম্ফন। শরীরের বিকাশ, মগজের বিকাশই সেই উল্লম্ফন এর কারণ। আফ্রিকার পূর্ব ভাগ থেকে তারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পাথরের হাতিয়ারগুলিকে ক্রমশ উন্নতি করতে সমর্থ হয় তারা, মৃতদের কবর দেওয়া, পশুদেহের চামড়াকেই পোশাক ও তাঁবু নির্মাণের সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। শিকারের কৌশল ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রগুলির ক্রমাগত উন্নতিসাধন এর জোরেই তারা আফ্রিকা ছেড়ে পৃথিবীর অন্যত্র বসবাস শুরু করতে পেরেছিল। বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একটা সময় অবধি ধারণা ছিল হোমো ইরেকটাসেরা ছিল প্রায় মানুষেরই মতো কিন্তু একেবারেই ভিন্ন একটি প্রাণীবিশেষ।

এই ধারণা আজ আর নেই। আমরা এখন জানি হোমো স্যাপিয়েন্সরা সেই যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল সেই অভিযানই তাদের টিকে থাকার আসল কারণ। কিন্তু তারাই একমাত্র মানুষ এমনটা ভাবা একেবারেই ভুল। মধ্য প্রাচ্যে তখন নিয়ান্ডার্থ্যালরাও বসবাস করতো। আদি স্যাপিয়েনসরা আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে আরব দেশ পেরিয়েই আসে। মধ্যপ্রাচ্যে এসেই তাদের সাথে নিয়ান্ডার্থ্যালদের সাক্ষাৎ হয়, মেলামেশা থেকে শুরু করে বৈবাহিক সম্পর্ক অবধি ( তখনকার স্বাভাবিক রীতিনীতি মতোই ) স্থাপিত হয়। এভাবেই একটি নতুন ও একমাত্র প্রজাতি হিসাবে হোমো স্যাপিয়েনসরাই টিকে থাকে, বাকিরা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়। ইন্টারব্রিডিং সংক্রান্ত হারারে’র তত্ত্ব এটাই। নতুন প্রজাতি হোমো স্যাপিয়েনসরা পরে ইউরোপ এবং এশিয়ার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

হোমো স্যাপিয়েনস ও নিয়ান্ডার্থ্যালদের ফারাক কতটা?

মাথার আকৃতি এক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান একটি পার্থক্য।  স্যাপিয়েন্সদের করোটি ও শ্রোণী অঞ্চলটি আকারে ছোট, নিয়ান্ডার্থ্যালদের শরীরে এই দুটি অংশই তুলনামূলক বড় আকারের হয়। মাটি খুঁড়ে যে জীবাশ্ম পাওয়া গেছে তার থেকেই এমন সব পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়েছে। কানের ভিতরে থাকা ছোট্ট হাড়ের গঠনেও অনেকটা ফারাক আছে। এই হাড়টি শব্দ শোনার কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিম্পাঞ্জি ও গোরিলাদের মধ্যেও এমন সব ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।

আমরা কিভাবে এই পৃথিবীতে এলাম, কোথা থেকে এলাম – এসব প্রশ্নে মানুষের কৌতূহল চিরকাল। আমাদের আগে যারা এই পৃথিবীতে ছিল তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কই বা কেমন এই নিয়েও প্রভূত আগ্রহ রয়েছে। হোমিনিনদের সাথে আমাদের পার্থক্য ঠিক কোথায় – এই প্রশ্নটিও সেই আগ্রহেরই অন্তর্গত বিষয়।

নিজের গবেষণায় ডঃ সাভান্তে পাবো এক অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি নিয়ান্ডার্থ্যালদের জিনোম সিকোয়েন্স খুঁজে বের করেছেন। ‘ডেনিসোভান’ নামের আরেক প্রজাতির হোমিনিনদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন। ৭৮ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে যে হোমিনিনরা যাত্রা শুরু করেছিল তাদের শারীরগত জিন আধুনিক মানুষের শরীরেও প্রবাহিত হয়েছে – এই ঐতিহাসিক আবিষ্কার ও ডঃ পাবো’রই আবিষ্কার। আজকের দুনিয়ায় বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির মোকাবিলায় আধুনিক মানুষের শরীরে থাকা সেই জিনের ভূমিকা রয়েছে।

পাবো’র গবেষণায় জীববিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে একটি নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর নাম প্যালিও জিনোমিকস। বিলুপ্ত মানব প্রজাতিগুলির থেকে আধুনিক মানুষের চিহ্নিতকরণের কাজে ভিত্তি হিসাবে তিনি জিনগত পার্থক্যকেই মূল ধরেছেন। মানবকোষের দুটি ভিন্ন অংশে ডিএনএ থাকে। এদের মধ্যে নিউক্লিয় ডিএনএ’টিই উৎকৃষ্ট। মাইটোকন্ড্রিয়ায় আরেক ধরনের ডিএনএ পাওয়া যায়, যদিও তা যেমন সংখ্যায় কম তেমনই তাতে জিনগত বৈশিষ্টের তথ্যও থাকে তুলনামূলকভাবে অনেকটা কম। আকৃতিতেও ছোট হয়। মৃত্যুর পরে শবদেহে ডিএনএ ক্রমশ কমতে শুরু করে। একটা সময়ে খুবই কম হয়ে যায় (জীবাশ্ম ইত্যাদিতে)। যেটুকু যা পাওয়া যায় তাও অনেক সময় ব্যাকটিরিয়া এবং অন্যান্য জীবিত মানুষের ‘ডিএনএ’ দ্বারা সংক্রামিত হয়ে পড়ে।

১৯৯০ সাল নাগাদ ডঃ পাবো মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। সেখানেই তিনি নিজস্ব গবেষণা শুরু করেন। নিয়ান্ডার্থ্যালদের অবশেষ (জীবাশ্ম) থেকে মাইটোকন্ড্রিয়ায় ডিএনএ সংগ্রহ করে তাকেই গবেষণায় ব্যবহার করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। মাইটোকন্ড্রিয়াল ‘ডিএনএ’র কিছু সমস্যা ও ছিল। একে তো সংখ্যায় অল্প, দ্বিতীয়তঃ জিনের বৈশিষ্টগত তথ্যও এতে অনেকটা কম থাকে। কিন্তু এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র একটি সুবিধাও রয়েছে। এর হাজারে হাজারে কপি হয়ে থাকায় চিহ্নিতকরণের কাজে খানিকটা সুবিধাও থাকে। ডঃ পাবো ক্রমাগত অবশেষ (জীবাশ্ম) থেকে ডি এন এ সংগ্রহের সংগ্রহের পদ্ধতি প্রকরণকে আধুনিক ও শক্তিশালী করে তোলেন। নতুন ও শক্তিশালী সেইসব পদ্ধতি প্রকরণের জোরেই তিনি চল্লিশ হাজার বছর পুরনো একটি দেহাবশেষ (জীবাশ্ম) থেকে ‘ডিএনএ’ নিষ্কাশনে করতে সমর্থ হলেন।

এভাবেই লুপ্ত একটি প্রজাতির সাথে আধুনিক মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করা গেল। নিয়ান্ডার্থ্যালদের জিন আধুনিক মানুষ ও শিম্পাঞ্জিদের জিনের থেকে আলাদা বলে জানা গেল।

নিয়ান্ডার্থ্যালদের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ধারণ

যেহেতু মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’তে প্রাপ্ত তথ্য কম তাই পরবর্তীকালে ডঃ পাবো ঐ জীবাশ্ম থেকেই নিউক্লিয় ডিএনএ’ কেও সংগ্রহ করতে পরিকল্পনা করেন, সেই লক্ষ্যও ভেদ করা যায়। এই সময়েই তার জন্য কাজের আরেকটি নতুন সুযোগ আসে – লিপজিগে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইউনিট গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকেই। সেই নতুন গবেষণা কেন্দ্রের কর্মীদের সাথে নিয়েই তিনি জীবাশ্ম থেকে নিউক্লিয় ডিএনএ নিষ্কাশনের কাজে সাফল্য অর্জন করেন। এই কাজের জরুরী পদ্ধতিটি তাদেরই নিজস্ব আবিষ্কার। এর ফলেই তারা নিয়ান্ডার্থ্যালদের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ধারনে সফল হলেন। ২০১০ সালে তিনি প্রথম সেই গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।

এই সিকোয়েন্স নির্ধারণের ফলে কি জানা গেল?

এই গবেষণার ফলে আমরা জানতে পারলাম আধুনিক মানুষ ও নিয়ান্ডার্থ্যালরা- উভয়েরই পূর্বপুরুষ একই। তারা আজ থেকে ৮ লক্ষ বছর আগের পৃথিবীতে বেঁচে ছিল। ডিএনএ সংগ্রহের কাজে প্রথমে ডঃ পাবো নিয়ান্ডার্থ্যাল উপত্যকা থেকে প্রাপ্ত জীবাশ্মটিই ব্যবহার করেছিলেন। পরে তিনি দক্ষিণ সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহা থেকে প্রাপ্ত আঙ্গুলের হাড়ের জীবাশ্মটিকে ব্যবহার করেন। গুহার নামের কারণেই প্রাপ্ত জীবাশ্মের প্রজাতিটির নাম দেওয়া হয় ‘ডেনিসোভান’।

পাবো’র গবেষণা লব্ধ ফলাফল নিঃসন্দেহে সাড়া জাগানো। এর থেকেই আমরা জানতে পেরেছি আধুনিক মানুষের শরীরে প্রায় ২০% নিয়ান্ডার্থ্যাল জিন রয়েছে। এক একটি আধুনিক মানুষের শরীরকে বিবেচনা করলে গড়ে ২% থেকে প্রায় ৩% অবধি নিয়ান্ডার্থ্যাল জিন পাওয়া যাবে। বিভিন্ন দেশ, ভৌগলিক স্থান ভেদে এমন ফারাক রয়েছে। এও জানা যায় যে এই নিয়ান্ডার্থ্যাল জিনের কারণেই আজকের মানুষের শরীরে সংক্রামক রোগ ব্যাধির বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাটি কাজ করে। এই জিনের জোরেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেকটা উঁচুতে বসবাস করা জনগোষ্ঠী ( যেমন তিব্বতি জনজাতি ) রা অন্যান্য মানুষের তুলনায় (যারা কিছুটা সমতলে বসবাস করে) বিশেষ অসুবিধা বোধ করেনা। এর কারণ তাদের শরীরে (উঁচু জায়গায় বসবাসকারীদের) থাকা ডেনিসোভান ইপাস-১ জিনটিই।

ডঃ পাবো র গবেষণায় ভারতীয়দের জন্য বিশেষ কি আছে?

এক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট কে মনে রাখতে হবে। সেই প্রজেক্টের ফলাফলে আমরা নিশ্চিত হলাম পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা সমস্ত মানুষের শরীরে প্রাপ্ত জিনোমের ৯৯.৯% ই হুবহু এক! ফারাক মাত্র ০.১% র। অর্থাৎ কালো চামড়ার জনগোষ্ঠী ( যাদের একটা সময় অবধি নিগ্রো বলা চলতো ) থেকে শুরু করে নীল চক্ষু বিশিষ্ট আমেরিকান সবারই শরীরে যে জিন রয়েছে তার ফারাক মাত্র ০.১%র। এই ফারাকটুকুর জন্যই বাইরে থেকে বিভিন্ন মানুষের চেহারায় এতটা পার্থক্য তৈরি হয়। চোখের মণির রং, চামড়ার রং থেকে শুরু করে চুলের রং অবধি সবটাই সেই বাইরের ফারাক, মাথার ভিতরে থাকা মস্তিষ্কটির গঠন প্রায় পুরোটাই এক। বলা যায় কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজার জিন একত্রে জিনোম গঠন করে। মোটামুটি কুড়ি হাজার পাঁচশো জিন মিলে মানুষের জিনোম গঠিত হয়।

এই তথ্যেই আধুনিক মানুষের ইতিহাসে এক অমোঘ ও প্রায় সর্বাধিক বিতর্কিত প্রশ্নের সমাধান সূত্রটি মেলে। সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা যখন প্রায় ধ্বংস হতে চলেছে সেই সময়  ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলা একটি জনগোষ্ঠী (যাদের আর্য বলা হয় ) নিজেদের পৃথক সংস্কৃতি ও সংস্কৃত ভাষা নিয়ে এসে হাজির হয় সেইসময়কার ভারতে। এই কথা কি সত্য? ডঃ পাবো’র গবেষণা বলছে হ্যাঁ, এটাই সত্যি। আর্যরা কখনোই এদেশের আদি বাসিন্দা ছিল না, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বুকে চেপে ধরেই তারা বাইরে থেকে এদেশে এসেছিল। ইদানিং আমাদের দেশে গাজোয়ারি করে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে আর্যরাই নাকি এদেশের আদি বাসিন্দা – ডঃ পাবো’র গবেষণা আমাদের শিখিয়ে দিল এমনটা কল্পনা করাও একেবারেই ভুল কাজ হবে। কোনো কোনো ব্যক্তির বিশেষ কোনো বিশ্বাস থাকতেই পারে, কিন্তু তার জোরে বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক সত্যের অপলাপ ঘটানো যায় না। তথ্য বলছে বর্তমান ভারতীয়দের মধ্যে ৭৮%-রই শরীরে রয়েছে  ইন্দো-ইউরোপীয় জিন। বাকিরা কেউ তিব্বতি, কেউ বা দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত ( যদিও তারাও এখন মিশ্র জাতি বিশেষ, কৌলীন্য বলে তাদেরও আর প্রায় কিছুই নেই)  আবার একটি অংশ অস্ট্রো-এশিয়ান বর্গীয় (মূলত আদিবাসী জনজাতির মানুষেরা )।

আইজিভি বা ইন্ডিয়ান জিনোম ভ্যারিয়েশন প্রজেক্টের ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভারতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে বহু শতাব্দী ধরেই বৈবাহিক সম্পর্ক জারী রয়েছে – আজকের ভারতীয়রা সেই অনুযায়ী বহু রক্তের মিলনে জন্ম নেওয়া এক মিশ্র জাতিবিশেষ ব্যতীত আর কিছুই নন।

এই প্রজেক্টের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে কাশ্মীরী পণ্ডিত এবং কাশ্মীরী মুসলমান দুয়েরই জিনের সাথে দ্রাবিড় গোষ্ঠীর জিনের সাদৃশ্য রয়েছে। এমনকি আমাদের দেশের দক্ষিণভাগে বসবাসকারী দ্রাবিড় সংক্সৃতির অন্তর্গত কোন একটি ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত মানুষদেরও একটি অংশের শরীরে ইন্দো-ইউরোপীয় জিন রয়েছে! এর অর্থ আর কিছুই না- ভারতে বহু বছর ধরে ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর সাথে দ্রাবিড়, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, তিব্বতী এমনকি হিমালয়ান গোষ্ঠীগুলিরও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন চলেছে আর তাই আজকের ভারতীয়দের শরীরে এমন অসাধারণ বৈচিত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এই সমস্ত গোষ্ঠীই মধ্যভারতে বসবাসকারী ভারতীয়দের সম্মিলিত পূর্বপুরুষ বলা চলে।

এই পরিস্থিতিতে ইন্দো-ইউরোপীয়, দ্রাবিড় কিংবা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বংশকৌলীন্য গোছের পরিচিতির কারণে বাড়তি কোনো শ্লাঘার অনুভব আসলে মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই না। ভারতীয়দের কর্তব্য ‘সকলেই যে আসলে এক’ এই সহজ সত্যটিকে চেতনা ও অনুভবে প্রতিষ্ঠা করে একসাথে দেশের ভবিষ্যত নির্মাণে ব্রতী হত্তয়া।

লেখক- অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স (জয়পুর) এর নবজাতক বিভাগের অধ্যাপক ও চিকিৎসক এবং বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী।

Spread the word

Leave a Reply