আমি মনে করি, ফর্ম এবং বিষয়বস্তু উভয় ক্ষেত্রেই ঋত্বিক একজন অনন্য ফিল্ম নির্মাতা। তিনি সেলুলয়েডে তার সময়কার রাজনৈতিক পরিবর্তনের সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার শিল্পকর্মের সর্বত্র। আমার চোখে, তিনি একজন সত্যনিষ্ঠ নন-কনফর্মিস্ট এবং জনগণের শিল্পী। আমি তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটক এবং তাঁর বড় কন্যা সংহিতা ঘটকের কাছে কৃতজ্ঞ, তাঁদের ছাড়া আমার পক্ষে “মেঘে ঢাকা তারা”, ছবিটি নির্মাণ করা সম্ভব হত না।
ঋত্বিক ঘটক বিমল রায়ের মধুমতির গল্পকার হিসাবে ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। পরে মুম্বাই ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি নিজেকে বাজার-নিয়ন্ত্রিত চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি, যেখানে তাঁর সৃজনশীল স্বাধীনতা ছিল না।
চিত্রনাট্যকার বা পরিচালক হিসাবে ঋত্বিক কখনও জাতীয় পুরস্কার পাননি। তাঁর একমাত্র জাতীয় পুরষ্কার এসেছিল “যুক্তি তক্কো আর গল্প” সিনেমার গল্পের জন্য। “মেঘে ঢাকা তারা” হ’ল একমাত্র চলচ্চিত্র যা সেই সময়ে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
মৃত্যুর আগে তার তৈরি করা, স্ক্রিপ্ট হিসাবে প্রস্তুত ছিল “বেদেনি”, “সংসার সীমান্তে” – এগুলি ব্যবহার করে পরবর্তিতে অন্য পরিচালকরা ফিল্ম বানিয়েছিলেন। তাঁর অসমাপ্ত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে “বগলার বঙ্গদর্শন”, “রঙের গোলাম”-এর মতো চলচ্চিত্র এবং রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। ঋত্বিক ঘটক শঙ্কর-এর “কতো আজানারে” উপন্যাসটির অবলম্বনে একটি ছবির শুটিং করেছিলেন। ফিল্মটির একটি দিনের শুটিং বাকি ছিল। ছবিটি আজ অবধি অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। “কতো আজানারে” কাজ শেষ হলে ভারতীয় সিনেমাতে অন্য এক ইতিহাস তৈরি হতে পারত। ফ্রান্সোয়াস ত্রুফোর “দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ”-এর আগেই তিনি “বাড়ি থেকে পালিয়ে” তৈরি করেছিলেন। হলিউডের “ন্যাশভিল” ফিল্মের অনেক আগেই ঋত্বিক একটি গাড়ীকে ঘিরে এক মানুষের সহজ ভালবাসার গল্পকে কেন্দ্র করে “অযান্ত্রিক” নির্মাণ করেন।
১৯৯৯ সালে এশিয়ান চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন পরিচালিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের সমীক্ষায় তার তৈরি “সুবর্ণরেখা” ১১ নম্বরে স্থান পায়। তিনি ইম্পেরিয়াল টোব্যাকো কোম্পানির জন্য একটি টিভি কমার্শিয়াল তৈরি করেছিলেন। প্রযোজক চলে যাওয়ার পরে এই অর্থ তাকে “সুবর্ণরেখা” সম্পূর্ণ করতে সহায়তা করেছিল।
তিনি পুনে’তে এফটিআইআই’তে পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে “রঁদেভু” এবং “ফিয়ার” নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যর চলচ্চিত্রও তৈরি করেছিলেন। ৩৫ বছর বয়স অবধি ঋত্বিক ঘটক একজন টি টোটালার (চা প্রেমী) ছিলেন। পরে তিনি মদ্যপ হয়ে উঠলে অনেকেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। অনিয়ন্ত্রিত এই মদ্যপানের অভ্যাস তার দুর্দশার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
তাঁর প্রথম ছবি “নাগরিক” তাঁর মৃত্যুর পরেই মুক্তি পেয়েছিল। নাগরিক তৈরির কয়েক বছর আগে সত্যজিৎ রায়’র “পথের পাঁচালি” তৈরি হয়েছিল।
কেউ কেউ বলেন স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নাকি সত্যজিত রায় বলেছিলেন যে “নাগরিক”কে যদি সময়মতো মুক্তি দেওয়া হত, তবে ঋত্বিক ঘটক বাংলায় সিরিয়াস চলচ্চিত্র নির্মাণে একজন পথিকৃৎ চিহ্নিত হতেন।
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে লেখা।