Atanu Hui

Nationalism and Hindutwa: A Study

অতনু হুই

ভারতের জাতীয়তাবাদের ধারণা তৈরি হয়েছিল উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের সময়, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যা ছিল অভিনব এবং অনন্য। সবমিলিয়ে এক নতুন ফেনোমেনন, যা দুনিয়া অতীতে কখনও দেখেনি। ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির আগ্রাসী ইউরোপীয় রূপের বিপরীতে এটি অপরিহার্যভাবেই ছিল গণতান্ত্রিক ও সমমাত্রিক— সমস্ত মানুষই সমান, সবার জন্য সমান অধিকার ও সমান সুযোগ-কেন্দ্রিক।

ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল: প্রথমত, এটি কখনোই তাবৎ জনসংখ্যাকে একত্রে দেখেনি, এমনকি ‘জাতির’ পরিধির মধ্যে পর্যন্ত নয়। বরাবরই সওয়াল করেছিল ‘শত্রু ভিতরে’ (যেমন ছিলেন ইহুদীরা)। দ্বিতীয়ত, এটি অপরিহার্যভাবে ছিল সাম্রাজ্যবাদী। তৃতীয়ত, ‘জাতি’ তার নিজের স্বার্থে মহিমান্বিত করেছিল নিজেকে, আর এই ধারনার নেপথ্যে ছিল ‘জাতি’কে আরও শক্তিশালী করার এক এবং একমাত্র স্বার্থ। ‘জাতি’কে রাখা হয়েছিল ‘জনগণের’ ঊর্ধ্বে।

জাতি-রাষ্ট্রের গঠন থেকেই ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রকাশ। যেখানে ভারতে তা ছিল উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের ফসল। এবং অন্তত তিনটি প্রশ্নে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে ওয়েস্টফেলিয়া শান্তি চুক্তির পর ইউরোপে তৈরি হওয়া জাতীয়তাবাদ থেকে একেবারে বিপরীত।

প্রথমত, এতে ছিল না ‘শত্রু ভিতরের’ ধারণা, বরং ছিল সকলকে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে জড়িয়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, অপরের ভূখণ্ডকে যুক্ত করা, বা দখল করার মানসিকতা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠার ছিল না কোনও পরিকল্পনা। এবং তৃতীয়ত, এই ধারণা কখনও ‘মানুষের’ উপর স্থান দেয়নি ‘জাতি’কে, ‘জাতীয়’ উন্নয়নের কেন্দ্রে ছিল জনকল্যাণ।

বিপরীতে, হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ লালিত হয়েছে উত্তর-ওয়েস্টফেলিয়া ধারণার শর্তে। তারপর থেকে সমসাময়িক সময়ে সে নিজেকে সময়োপযোগী করেছে।

আমাদের দেশে জাতীয় জাগরণের পাশাপাশি গড়ে ওঠে একই সমান্তরালে এক হিন্দু পুনরুত্থানের প্রক্রিয়া। হিন্দু জাতীয়তাবাদ— হিন্দু পুনরুত্থানের গর্ভেই বেড়ে ওঠে। ক্রমশ তা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আর এস এস) আঁতুড়ঘর। হিন্দু পুনরুত্থানবাদের মূল ভাবাদর্শটি ছিল— হিন্দু সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক স্বার্থকে এক অভিন্ন হিন্দু আকাঙ্ক্ষায় বেঁধে রাখা। বিপরীতে হিন্দু বর্ণবাদী উচ্চস্তরের নির্মম ঘৃণ্য শোষণ-বঞ্চনার বিষয়টিকে সুকৌশলে আড়াল করা।

হিন্দু পুনরুত্থানবাদী ভাবধারার সঙ্গে প্রায় একই সময়ে জন্ম নেওয়া অঙ্কুরিত জাতীয়তাবাদী চেতনার মিলনেই গড়ে উঠেছিল ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’। সেক্ষেত্রে এমন এক প্রত্যাশা নির্মাণ করতে চাওয়া হয়েছিল যাতে হিন্দু সংস্কৃতি সম্পন্নতাবোধ, আচার- অভ্যাস সবকিছু জাতীয় রাজনৈতিক চেতনা ও চাহিদার সঙ্গে জুড়ে যায়। এটি করতে চাওয়া হয়েছিল সুকৌশলে, যাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং  স্বাধীনোত্তর ভারতে ‘হিন্দু’ প্রসঙ্গটিকে কেন্দ্রে রেখে প্রাধান্য তৈরি করা যায়। কাজেই ভারতীয় জাতীয়তা আগাগোড়া সর্বাত্মক ‘হিন্দুত্বে’র ধারণা সঞ্জাত প্রকট এক প্রতিক্রিয়া ভিন্ন কিছু নয়। যেখানে একমাত্রিক জাতীয়তার সুরে কেবল হিন্দু রাষ্ট্রের কল্পরুপটি ধ্বনিত করতে চাওয়া হয়েছিল।

অপরদিকে ঔপনিবেশিক শাসনে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পুরাতন ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত মূল্যবোধ কিছুটা ভাঙার চেষ্টা করলেও তা প্রাচীন শাস্ত্র ও জড়ত্বের সীমাকে অতিক্রম করতে পারেনি। পাশাপাশি সেসময় বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তি ছিল দুর্বল। এই পরিমণ্ডলে হিন্দু রক্ষণশীল পুনরুত্থানবাদ আরো শক্তিশালী  আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ‘হিন্দুত্বে’র ছাপ লাগে- কেশবচন্দ্র সেন, দয়ানন্দ সরস্বতী দের হাত ধরে। আবার বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ আসমুদ্র  হিমাচলকে হিন্দুত্বের ভাবনার সঞ্জাত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পুষ্ট করে। হিন্দু স্বার্থে গো রক্ষা আন্দোলন, শুদ্ধি আন্দোলন, উর্দু সরিয়ে হিন্দি ভাষাকে প্রতিষ্ঠা, এই সব যুক্তিবিনাশী আন্দোলনে হিন্দু ভাবাদর্শকে শক্তিশালী করতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তিলকের— ‘হিন্দু নেশন’ এর ধারণা। হিন্দু জাতীয়তাবাদের এইসব ক্রমসম্প্রসারণের পরিণতিতেই জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম থেকে আজকের ভারতে— সাভারকার-গোলওয়ালকার-গডসে-মোদীদের  রাজনৈতিক হিন্দুত্বের কার্যকলাপকে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

RSS_meeting

তাই এদেশে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামকে দুর্বল করতে সমান্তরালভাবে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ক্রিয়াশীল ছিল— উদীয়মান ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর দোদুল্যমান দ্বৈত চরিত্র প্রকট রূপ পরিগ্রহ করার কারণে। কাজেই জাতীয়তাবাদীদের কাছে ‘নেশন ‘ মানে হিন্দু, ভাষা মানে হিন্দি। সেই সূত্রেই হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারিত শব্দবন্ধ— ‘হিন্দু- হিন্দি- হিন্দুস্থান’কে জনপ্রিয় করা হয়।

হিন্দুত্ববাদী, সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনের ধারা- ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে হিন্দু ঐক্যের ভাবনা মুসলমান সমাজকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেয়।  ভারতের দীর্ঘ ইতিহাসে মুসলমান বিজয়ের পরে বিশাল ভারতীয় ভৌগোলিক অভিব্যক্তিপুষ্ট হিন্দু জনগোষ্ঠীকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের যুক্তিবিনাশী বিশ্লেষণে মুসলমান ধর্মের বিপরীতে হিন্দু ধর্মীয় পরিচয় গড়ে তোলা হয়। এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়েই আমাদের দেশে মুসলমান বিরোধী যুদ্ধে হিন্দু গৌরবগাথাকে(রানা প্রতাপ, শিবাজী) ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চরিত্র নির্মাণে ব্যবহার করা হয়।

কার্ল মার্কস ‘নিউইয়র্ক ট্রিবিউন’ পত্রিকায়  ভারত বিষয়ক যে প্রবন্ধমালা লিখেছিলেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘হিন্দুস্থান হলো এশিয়ার ইতালি’।  ইতালির ‘রিসজিমেন্টো’ বা পুনর্জন্মের মাধ্যমে একতাবদ্ধ হওয়ার ঘটনার সঙ্গে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে ভারতীয় একতাবদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে তুলনা করেছেন। গ্রামসি তাঁর ‘কারা রচনায়’, ফ্যাসিবাদের উৎস সন্ধানে ইতালির ‘ইউনিফিকেশনের’ ফাঁকগুলির ভূমিকা পর্যালোচনা করেছেন একইভাবে। দীর্ঘকালের হারিয়ে যাওয়া মানচিত্র ফিরে পাওয়া, পশ্চাৎপদ মানুষের ধর্মবোধ, আবেগ, মোহ  ইতালির মতো এদেশেও এক অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। মনে রাখতে হবে,  শোষিত মানুষের চিন্তার কাঠামোগত রূপান্তর ঘটনার দুর্বলতা, বৃহৎ পশ্চাত্পদ সমাজের ধর্মবিশ্বাস এদেশেও ইতালির মতো হুবহু না হলেও অন্যরকম এক ফ্যাসিবাদী উত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

১৯২৫ সালে নাগপুরে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে আরএসএসের প্রতিষ্ঠা করেন। রামরাজত্বের স্বপ্ন, তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ, হিন্দু জাগরণের নাম করে আসলে উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পনের যে নীতি নেওয়া হয়েছিল, আজও স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক রাখা হয়েছে। একই ভাবে আজকের মোদী জমানাতেও ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির ভিত্তিতে ‘কিস্যা কুর্শি কা’র লড়াই চলছে।

১৯১৩ সালের সাভারকার ব্রিটিশ এর কাছে যে মুচলেকা পত্র দিয়েছিলেন, তার ছত্রেছত্রে ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণের বর্ণনা রয়েছে। অথচ সেই সাভারকারই হিন্দু স্বার্থের সবথেকে দক্ষ ও বিশ্বাসী প্রবক্তা হিসেবে হিন্দু সংগঠকদের কাছে আজও পূজিত। আরএসএস প্রতিষ্ঠার পূর্বে ‘জনৈক মারাঠি’ ছদ্মনামে— ‘কে হিন্দু’ সাভারকারের পুস্তিকাটি হিন্দু-মুসলমান দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছিল হিন্দুত্ববাদীদের মানসপটে আজও তা বহমান।

বি এস মুঞ্জে ইতালির ফ্যাসিস্ত শাসকদের প্রতি গভীর আস্থা জানিয়ে মুসোলিনির সঙ্গে একদা সাক্ষাৎ  করেছিলেন। ইতালির ফ্যাসিস্ত ক্যাম্পগুলি পরিদর্শন করে এসে এখানে ঐরূপ হিন্দু জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। গোটা বিশ্ব যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে ফ্যাসিবিরোধী মুক্তিসংগ্রামের লিপ্ত, তখন আরএসএসের ফ্যাসিস্ট প্রীতি প্রমাণ করে তারা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিল।

জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে মদনমোহন মালব্য, কৃপালনি, বল্লভ ভাই প্যাটেল, এমনকি স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের আরএসএসের প্রতি দুর্বলতা ছিল প্রবল। গান্ধী এদের প্রতি মোহগ্রস্ত না হলেও স্বয়ংসেবক শিবিরগুলি পরিদর্শন করেছিলেন। মুক্তি সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনে বারেবারে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেই  হতাশার গর্ভে মুক্তিকামী মানুষের এক ছায়াবৃত্তে নিমজ্জিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে— পত্রে পুষ্পে পল্লবিত হয়- সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ। আর তখনই বর্ণবাদী হিন্দু বেনিয়া সম্প্রদায় ক্রমশ ঘৃণ্য রাজনীতিকে পুষ্ট করতে থাকে যাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে  হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগ্রামেই বৃহত্তর হিন্দু গোষ্ঠীর মুক্তি ঘটবে এই আশাবাদ সঞ্চারিত হয়।

গান্ধীহত্যার ঘটনায় নিষিদ্ধ হওয়া  আর এস এস- স্বাধীনতার পরেপরে এসব নিয়ে কিছুটা চাপে থাকলেও— বাবরি মসজিদ ধ্বংস সাধন করার  সমযকাল থেকে রাম মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া পর্যন্ত, বিগত তিনদশকে তার হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকে সফলভাবে এদেশে প্রয়োগ করতে পেরেছে। রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতরে দিয়ে করা তা আরো সহজোতর হয়েছে— বিগত এক দশকে কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি আসীন থাকার কারনে। এতে সহজে তারা হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শে ভারতীয় মিশ্র সাংস্কৃতিক বাতাবরণকে   নস্যাৎ করে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পেরেছে।

অপরদিকে উদার অর্থনীতির তিন দশক এবং রাজনৈতিক হিন্দুত্বের রণহুংকারের তিন দশক একসঙ্গে মিলেমিশে বর্তমানে ‘কর্পোরেট হিন্দুত্বে’র এক ক্লেদাক্ত, যন্ত্রনাময় আর্থ-রাজনৈতিক পরিমন্ডল তৈরি করেছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, কাশী বিশ্বনাথ গঙ্গা করিডোর নির্মান থেকে শুরু করে – নাগরিত্ব আইন, জনসংখ্যা পঞ্জীতে ধর্ম পরিচয় যুক্ত করার মধ্যে দিয়ে মুসলিম ধর্ম সম্প্রদায়কে টার্গেট করে কার্যত ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের চরিত্র পরিবর্তনের ধারাবাহিক প্রয়াস চলেছে।

ভারতীয় সংবিধানের প্রধান চার স্তম্ভ— ধর্মনিরপেক্ষ-গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সামাজিক ন্যায় এবং আর্থিক সার্বভৌমত্ব আজ ভীষণ ভাবে আক্রান্ত। অপরদিকে রাষ্ট্রের নীতির মধ্যে পিরামিডের মতো একাংশ বেনিয়াদের বিপুল আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অক্সফার্ম রিপোর্টে এদেশে  দশজন ধনী ব্যক্তির সম্পদের পরিমান দেশের মোট সম্পদের ৫৭ শতাংশ। আর তলার ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ সম্পদ। এই চিত্রই বুঝিয়ে দেয় পুঁজি যতদ্রুত কেন্দ্রীভূত হয়, ভূমিস্তরে বিভাজনের কারনে শ্রমজীবীদের পক্ষে ততো তারাতারি একতাবদ্ধ হওয়া  সম্ভব হয় না।

এই সময় বিশ্ব কর্পোরেট পুঁজি দেশে দেশে নব্য ফ্যাসিবাদকে মদত দিচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে জোট তৈরি করে শোষণ, লুন্ঠনের বহরকে নিশ্চিত করেছে। ভারতে এই হিন্দুত্ববাদীরাই তাদের পছন্দের শক্তি। ভারতীয় শাসক শ্রেণীর নেতৃত্ব দানকারী বৃহৎ পুঁজিপতিরা এভাবে আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজির জুনিয়র পার্টনার হওয়ার পূর্ণ সুযোগকে সর্বাত্মক ভাবে ব্যবহার করেছে।

উদারনীতি তার তিন দশকের পরিক্রমনে পরিনতিতে আজ সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতিতে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে  অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকে বিসর্জন দেওয়া চলেছে। একাজে তন্ত্র সাধকেরা ভূমিকা নিয়েছে আরএসএস এবং ভারতীয় জনতা পার্টি। ‘ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন” কর্মসূচি (এনএমপি) এদেশে তারই চূড়ান্ত পরিনতি। লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ব সকলকিছু এভাবে লুটের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে।

কাজেই আজ ভারতীয় অভিজ্ঞতায় ফ্যাসিবাদী প্রবনতার স্বপক্ষে সম্মতি নির্মানের চরিত্র হলো- ‘কর্পোরেট হিন্দুত্বের’। নয়াউদারবাদ প্রথমে কর্মহীন, পরে কর্মনাশা উন্নয়নের নামে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি মানুষের জীবনে যে সংকট নামিয়ে এনেছে সেই পটভূমিতে কর্পোরেট হিন্দুত্বের পরীক্ষাগারে পরিণত করা হয়েছে। উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি র চেতনা ও আচরণকে  বিপথগামী করার মাধ্যমে— রাজনৈতিক হিন্দুত্বের সম্মতি নির্মাণই এর প্রধান আদর্শ।

শেষ বিচারে সংকট বেষ্টিত এই উদারবাদ ফ্যাসিবাদের চেহারা নিয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে। দক্ষিণপন্থী এই আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে একমাত্র শ্রেণী চেতনায় ঋদ্ধ শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিক জনআন্দোলন। এটাই দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার একমাত্র রক্ষা কবচ।

বিশিষ্ট্য চিন্তাবিদ প্রভাত পট্টনায়ক বলেছেন, ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে। কিন্তু সেই ব্যক্তির জীবনধারা রাষ্ট্রের নিরিখে গুরুত্ব পায় না। কারন বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পৃথক সত্ত্বা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কাজেই গড়ে তুলতে চাওয়া হিন্দু রাষ্ট্র ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছা নিরপেক্ষ হযে দাঁড়ায়। সেখানে হিন্দু রাষ্ট্র শুধু একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। তা একটি কতৃত্ববাদী রাষ্ট্র। কাজেই হিন্দু শাসকদলের সমালোচনা তখন হয়ে যায় জাতীয়তা বিরোধী, তথা দেশ বিরোধী। 

সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্হ্য , মানবাধিকার, স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা, মিডিয়া, রাজনৈতিক সংগঠন সব কিছুকে হিন্দুত্বের আদলে গড়ে তোলা হয় সেই কারনেই। আজ জাতীয় প্রতীকের মধ্যে হিংস্রতার রুপদান তারই গভীর রসায়নে জারিত। যুক্তি, মুক্তচিন্তা সেখানে পদদলিত।  কাজেই রাজনৈতিক এই দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনৈতিক দুর্নীতির বৈধকরণের বিরুদ্ধে মানুষের বৃত্তটা বড় করতেই হবে। বৃহত্তর এই লড়াইয়ের পরিসরে বামপন্থীদের সামনে থাকতে হবে।

এটাই স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

Spread the word

Leave a Reply