টাকা-ডলার -নোবেল (১ম পর্ব) : শমীক লাহিড়ী….

২০ অক্টোবর, ২০২২ (বৃহস্পতি বার)

প্রথম পর্ব

টাকা কি?

টাকা বা মুদ্রা হ’ল পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম-এটা সবারই জানা। যার যত টাকা সে তত বেশি পণ্য বা পরিষেবা কিনতে পারবে। তবে মার্কস সাহেব আমাদের শিখিয়েছিলেন, দ্রব্য আর পণ্য এক নয়। যখন কোনও কিছু নিজের বা পরিবারের বা পরিচিত নিকটজনের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়, সেটা দ্রব্য। আর যদি সেটা বাজারে বিনিময় বা বিক্রির জন্য তৈরি করা হয়, সেটা পণ্য হয়ে যায়। এই পণ্য বিনিময় হয় পাড়ার হাটে-বাজারে বা বড় বড় আড়ৎ বা মান্ডিতে। এই পণ্য অনেক হাত ঘোরে চূড়ান্ত ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানোর আগে। এই যে উৎপাদক তার তৈরি পণ্য বিক্রি করে, তারপর বহু হাত ঘুরে চূড়ান্ত ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছায়, এই সমগ্র বিনিময়টাই সম্পাদিত হয় মুদ্রার মাধ্যমে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা কি?

আমাদের দেশে এই বিনিময় মাধ্যমের নাম টাকা-এটা তো সবারই জানা। দেশের মানুষ যা তৈরি করছে, তা বিক্রি হয় টাকার মাধ্যমেই। কিন্তু অনেক জিনিস আমাদের দেশে পাওয়া যায়না, অন্য দেশে থেকে আনতে হয়। একেক দেশের একেক রকম বিনিময় মাধ্যম বা মুদ্রা। তাহলে কি হবে সেক্ষেত্রে? অতীতে একসময়ে ধাতু ছিল বিনিময় মাধ্যম, ক্রমে ক্রমে তামা-রূপা-সোনা একে একে সেই জায়গা নেয়। এর থেকেই বিনিময়ের মাধ্যম মুদ্রার আর্বিভাব ঘটে নানান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বিকাশের মাধ্যমে।

মার্কিন ডলারের দাপট

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ স্টারলিং এর হাল খারাপ হয়ে পড়ে। সেই জায়গা নেয় মার্কিন ডলার। ১৯৪৪ সালে ‘ব্রেটন উডস চুক্তি’র মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান সহ ৪৪টা দেশ নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বিনিময় করার এক সাধারণ নিয়ম কানুন তৈরি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন ডলারকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করার সর্বস্বীকৃত মুদ্রা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। যদিও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অনেকগুলি সমাজতান্ত্রিক দেশ অস্বীকার করে। তারপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন পৃথিবীতে ঘটে গেছে। আজকের পৃথিবীতে মার্কিন ডলার’ই পণ্য বিনিময়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে।

টাকা-ডলার সম্পর্ক


ফলে আমাদের দেশে যে সব পণ্য বা পরিষেবা অন্য দেশ থেকে নিয়ে আসতে হয়, সেগুলি মার্কিন ডলার খরচ করেই কিনে আনতে হয়। তাই মার্কিন ডলার কিনতে যদি বেশি টাকা খরচ করতে হয়, তাহলে সেই পণ্য বা পরিষেবার মূল্যও বেড়ে যায়। আর যদি মার্কিন ডলার কিনতে কম খরচ হয় তাহলে একইভাবে বিদেশী পণ্য ও পরিষেবা কেনার খরচও কম হয়।

মুদ্রার শক্তি নির্ধারণ

কোন দেশের মুদ্রার মূল্য মার্কিন ডলারের তুলনায় কি হবে, তা নির্ধারণের জন্য কিছু জটিল অঙ্ক করা হয়। তবে সাধারণভাবে কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সেই দেশের মুদ্রার শক্তি কত। মুদ্রার শক্তি মানে, পণ্য কিনতে কত অর্থ খরচ হয়।

উদাহারণ স্বরূপ বলা যায় – ১০০ টাকায় ১০০টা লঙ্কা অথবা ১০টা বেগুন পাওয়া যায়। দুটো আলাদা পণ্যের আলাদা আলাদা বিনিময় মূল্য হয় কেন? মার্কস আমাদের শিখিয়েছিলেন পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় মূলত শ্রমের ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১০০টি লঙ্কা উৎপাদন করতে যে শ্রম লাগে, ১০টা বেগুন উৎপাদন করতে সমপরিমাণ শ্রম লাগে। তাই বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে অথবা পরিষেবা প্রদানে কতটা শ্রমের প্রয়োজন হচ্ছে, মূলত তার ওপর নির্ভর করে পণ্য বা পরিষেবার দাম কি হবে।

মুদ্রার শক্তি কতটা হবে এটা নির্ভর করে একটা দেশে – (১) মুদ্রাস্ফীতির হার, (২) সুদের হার, (৩) ঋণের পরিমান, (৪) রাজনৈতিক পরিস্থিতি, (৫) অর্থনীতির স্বাস্থ্য, (৬) আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ফারাক, (৭) চলতি হিসাব ঘাটতি (Current account dificit), (৮) মুদ্রার ওপর ব্যবসায়ীদের ভরসাবোধ, (৯) সরকারের তৎপরতা ইত্যাদি নানা বিষয়ের ওপর। এগুলো সব পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই নিয়ম।

তবে অর্থনীতির স্বাস্থ্য মূলত নির্ভর করে সেই দেশের সাধারণ মানুষের কেনবার ক্ষমতার ওপর। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের হাতে যদি বেশি অর্থ আসে তাহলে সে অতিরিক্ত পণ্য বা পরিষেবা কেনে, আর যদি তাদের রোজগার কমে তাহলে পণ্য-পরিষেবার বিক্রিও কমে যায়। যার ফলস্বরূপ উৎপাদন কমে যায় এবং অর্থনীতি সংকটে পড়ে। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার সংকটের অন্যতম প্রধাণ উৎস এটাই। অথচ এই সহজ সরল সত্যটা স্বীকার করতে রাজি নয় বিজেপি সরকার। সাধারণ মানুষের আয় বাড়াবার বদলে আদানি-আম্বানি সহ পেয়ারের কর্পোরেট কোম্পানির আয় বাড়াতেই তৎপর মোদিজি।

প্রবন্ধটি দুটি পর্বে প্রকাশিত…

দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক – ক্লিক করুন …

Spread the word

Leave a Reply