ভারতের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর মর্যাদা রক্ষাকারী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির মন্তব্যে হতবাক গোটা দেশ। গতকাল থেকে সুপ্রীম কোর্টের উদ্যোগে দিল্লিতে শুরু হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক বিচারবিভাগীয় সম্মেলন’। এই সম্মলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । সম্মেলনের সূচনায় ধন্যবাদ সূচক ভাষণ রাখার সময়ে সুপ্রীম কোর্টের তৃতীয় বরিষ্ঠ বিচারপতি অরুণ মিশ্র ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দেন নরেন্দ্র মোদিকে। মিশ্র মন্তব্য করেন‘‘ যিনি আন্তর্জাতিক মাপের চিন্তাভাবনা করেন, দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করেন, সেই বহুমুখী প্রতিভা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উদ্দীপক বক্তৃতার জন্য ধন্যবাদ জানাই।’’ সম্মেলনে তখন উপস্থিত সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদে, প্রধানমন্ত্রী মোদি, আইন মন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদ সহ সুপ্রীম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতিরা সহ ২০টি দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা। স্বাভাবিকভাবেই সুপ্রীম কোর্টের একজন বরিষ্ঠ বিচারপতির এহেন মন্তব্য নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
সংবিধানের ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ বাতিল করা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও রামমন্দির মামলার রায়, শবরীমালা মামলার শুনানি, সিএএ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সুপ্রীম কোর্টের একাধিক মন্তব্যে যখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেকের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে সেই মুহুর্তে বিচারপতি মিশ্রের এহেন মন্তব্য সেই বিতর্কেই আরো ইন্ধন জোগাবে বলে বিশষজ্ঞ মহলের একাংশ মনে করছেন। সুপ্রীম কোর্টের প্রাক্তন বিচারক অশোক কুমার গাঙ্গুলি বলেন ‘‘আমরা যখন সুপ্রিম কোর্টে ছিলাম, তখনও এই ধরনের বিচারবিভাগীয় সম্মেলন হত। বিদেশের বিচারপতিরা আসতেন। কিন্তু এ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আসতে দেখিনি। আগেও আসতেন বলে শুনিনি। এখন আসছেন। সুপ্রিম কোর্টে বড় বা গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অনেক ক্ষেত্রে পক্ষ হয় কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার বলতে প্রধানমন্ত্রীকে বোঝায়। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করা ঠিক বা বেঠিক কি না, তা বলছি না। কিন্তু সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের মনে সরকারের বিরুদ্ধে সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে এই ধরনের প্রশংসা সংশয়ের উদ্রেক করলেও করতে পারে। বিচার ব্যবস্থা মানুযের বিশ্বাসের উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল। ইংরেজিতে একটি কথা আছে — ‘জাস্টিস ইজ রুটেড ইন কনফিডেন্স’।’’ একটি সংবাদ ওয়েবসাইটকে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পি বি সবন্ত বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির এমন মন্তব্য অনভিপ্রেত।’’ একই মন্তব্য করেছেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ পি শাহ।
কোলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কের শিরোনামে ছিলেন। শোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যা মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন বর্তমানে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সহ একাধিক বিজেপি নেতৃত্ব। এই মামলার বিচারের দায়িত্বে থাকা বিশেষ আদালতের বিচারক ব্রিজগোপাল লোয়া নাগপুরে একটি বিয়ে বাড়িতে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা জান। সুপ্রীম কোর্টে বিচারক লোয়ার রহস্য মৃত্যু নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারের দায়িত্ব দেন অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ বিচারপতি অরুণ মিশ্রকে। এই ঘটনার পরেই ১২ জানুয়ারি ২০১৮ তে সেই সময়ে প্রধান বিচারপতির পরবর্তী চারজন প্রবীনতম বিচারপতি জাস্তি চেলামেশ্বর, রঞ্জন গগৈঁ, মদন বি লোকুর ও কুরিয়ান জোশেফ প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ উগরে দেন একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে। বিচারপতি দীপক মিশ্রকে লেখা চিঠিটিও তাঁরা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে “যদি বিচারবিভাগে নিরপেক্ষতা না থাকে, তা হলে গণতন্ত্রেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।” তাঁরা আরো অভিযোগ করেন যে সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসন ঠিকঠাক চলছে না। কোনও রকম নিয়ম না মেনেই গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল মামলাগুলো জুনিয়র বিচারপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। চেলামেশ্বর বলেন, “আদালতের প্রশাসনিক বিষয়টি জানাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তাঁকে জানানো হয়েছিল কোনও কিছুই ঠিকঠাক চলছে না। এর একটা বিহিত দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য এটাই যে, আমাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।”
“Supreme Court crisis: All not okay, democracy at stake, say four senior-most judges”
আশ্চর্য করার মত বিষয় হল যে তৎকালীন বিদ্রোহী ও পরবর্তীতে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়া রঞ্জন গগৈঁ -এর সময়েও অরুণ মিশ্রের গুরুত্ব কমেনি বরং বেড়েই গেছে। বিচারপতি মিশ্রের বেঞ্চে কেন আদানি গোষ্ঠীর মামলা পাঠানো হচ্ছে, তা নিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি গগৈঁকে চিঠি লেখেন প্রবীণ আইনজীবী দুশ্যন্ত দাভে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও ভি গোপাল গৌড়ার বেঞ্চ তৃণমূল সরকারের পক্ষে রায়দান করেছিলেন।
শুধু মোদির প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হননি বিচারপতি মিশ্র, আইনমন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। নেট নিরাপত্তার নামে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রক যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে নজরদারি করার ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে তুলে নিতে চাইছে, এনআইএ আইনে বদল সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর যেখানে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে সেই মুহুর্তে একজন বিদ্যমান সুপ্রীম কোর্ট বিচারপতির এহেন মন্তব্য দেশের বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে মানুষকে সন্দীহান করতে বাধ্য ।