বাবিন ঘোষ
ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প
ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা শিল্প স্থাপনে বিশেষ আগ্রহী কখনই ছিলনা বরং, উপনিবেশবাদের আর্থিক ব্যাকরণ মেনেই শুধুমাত্র কাঁচা মাল ব্রিটেনে রপ্তানির আড়ত হিসাবেই ভারতকে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল এবং সেই কাঁচা মাল থেকেই নির্মিত পণ্য ভারতবাসীকে কিনতে বাধ্য করা হয়েছিল। দুই মহাযুদ্ধের বেশ কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে এই দেশে বিগত শতকের প্রথম দিক থেকে কিছু কিছু শিল্প স্থাপিত করতে শুরু করে ইংরেজরা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে মিশ্র অর্থনীতির যে মডেল গৃহীত হয় সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রকেই অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হিসাবে স্বীকার করা হয়। স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের ধনাঢ্য শ্রেণী মূলতঃ ভূস্বামী এবং মুতসুদ্দি বেনিয়া সম্প্রদায় ছিল (কিছু ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে) যাদের সম্পদের উৎস ছিল হয় জমির মালিকানা নয়তো ব্রিটিশ পুঁজির স্থানীয় দালাল/মধ্যস্বত্ত্বভোগী হিসাবে এবং কিছু ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মিশ্রণে। কিছু ব্যাতিক্রম বাদে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবা উৎপাদনের ভিত্তি স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে ছিল না। যেটুকু ছিল’ তার বেশির ভাগই ছিল ইউরোপীয় মালিকানাধীন এবং দেশের মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অত্যল্প। সেই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এবং সোভিয়েত রাশিয়ার পরিকল্পিত অর্থনীতির সাফল্য দেখে ভারতেও (অন্যান্য বেশির ভাগ সদ্য স্বাধীন দেশেও) পরিকল্পিত অর্থনীতির পথ চলা শুরু হয় এবং যোজনা কমিশন গঠিত হয় এই পরিকল্পিত অর্থনীতির মূল দিকনির্দেশক হিসাবে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে স্বাধীন ভারতে পরিকল্পিত অর্থনীতির যাত্রা শুরুতেই ১৯৫৪ সালে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের সভায় প্রধানমন্ত্রী নেহরু যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে তিনি অর্থ ব্যবস্থার লক্ষ্য হিসাবে “সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ গঠনের” কথাই বলেছিলেন। ১৯৫৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের তদানীন্তন মাদ্রাজ শহরের অবধী অধিবেশনেও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে সমাজ গঠনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই অধিবেশনে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত যুগোস্লাভিয়ার বামপন্থী রাষ্ট্রপতি জোসিপ ব্রোজ টিটো। অর্থাৎ, বিশ্ব জুড়ে এবং ভারতেও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র এবং পরিকল্পিত অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক নীতির অংশ হিসাবেই শাসক শ্রেণী গণ্য করেছে চিরকাল। আবারো প্রমাণিত হয় যে পুঁজিবাদের যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপজ্জনক দিকগুলির মোকাবিলায় অথবা পুঁজিবাদী দুর্বলতার ক্ষেত্রগুলিতে ভূস্বামী-বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রিত সরকারগুলিও বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক নীতিকেই গ্রহণ করা জরুরি মনে করেছে, পুঁজিবাদের নিজস্ব কোনো কূট কৌশল কে নয়।
ভারতের সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদ অর্থাৎ রাষ্ট্রপরিচালনার নীতসমূহের আওতায় যোজনা কমিশনের জন্ম এবং দীর্ঘ প্রায় সাত দশক সময় ধরে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরে বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে তা বাতিল করে নীতি আয়োগ নামের এক নিধিরাম সরদার জন্ম দেওয়া হয়েছে যাদের কাজ ফাটকা লগ্নি পুঁজির দালালি করা এবং সরকারি দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য বিবিধ কৌশল বানানো। যোজনা কমিশন গঠনের একাধিক উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল উপরোক্ত চতুর্থ পরিচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্পদের এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার মালিকানা মুষ্টিমেয় ব্যাক্তিপুঁজির হাতে কেন্দ্রীভবন রোধ করে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করা। এমনটা অবশ্যই বলা চলে না যে পরিকল্পিত অর্থনীতি, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বা যোজনা কমিশনের যুগে ভারতে সমাজতন্ত্রের কোনো মডেল স্থাপিত হয়েছিল’। ভূস্বামী-বুর্জোয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষিজমি পুনর্বন্টনের কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি যার ফলে কৃষিতে সামন্তবাদকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। যোজনা কমিশন এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় ভারি শিল্পের কিছু ভিত্তি প্রস্তুত করা গেলেও সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থেই গোটা দেশ জুড়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন শিল্পায়নের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়নি এবং কিছু কিছু ভোগলিক অঞ্চলেই বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প সীমাবদ্ধ রয়ে গেছিল। ১৯৩০ এর শুরু থেকেই জাতীয় কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশ শক্তিশালী হতে শুরু করে। সুভাস চন্দ্র বসুর জাতীয় কংগ্রেস থেকে সদস্যপদ ত্যাগ করা (এবং পরবর্তীতে দেশে আর ফিরতে না পারা), জাতীয় কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থী ভাবধারার নেতৃত্বকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা এবং স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সাথে শেষ পর্যায়ের আপোস-আলোচনার সময় থেকেই দেশীয় পুঁজিপতিদের কংগ্রেসের নেতৃত্বস্থানে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পরেও সামগ্রিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের আমলাতান্ত্রিকতার বাইরে বেরতে দেয়নি এ দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। ফলতঃ পরিকল্পিত অর্থনীতির যুগেও সরকার পরিচালনায় রক্ষণশীল আমলাতন্ত্র বহাল রইল’ যারা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, অর্থাৎ দরিদ্র/ নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলনা, তাদের সাথে শ্রেণীগতভাবেই সমাজতন্ত্রের ও কোনো আত্মিকতা ছিলনা। ফলতঃ পরিকল্পিত অর্থনীতির মোড়কে বেড়ে চলেছিল cronyism এবং “লাইসেন্স পারমিট রাজের” ক্ষমতা প্রয়োগ করে সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধি।
সোভিয়েত ধাঁচের পরিকল্পিত অর্থনীতির নামে আদতে রাষ্ট্রীয় মদতে পুঁজিবাদকেই রসদ যোগানো হয়েছিল প্রাক-উদারীকরণ জমানাতেও। কৃষিজমি পুনর্বন্টন না করে, ভূমি সংস্কারের পক্ষে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে কোনো পদক্ষেপ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার নেয়নি। ফলতঃ দেশের আভ্যন্তরীণ বাজার দ্রুত এবং ব্যাপক শিল্পায়নের মাধ্যমে উৎপন্ন পণ্য বা পরিষেবা ক্রয় করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এর ফলে দেশীয় বাজারের এই বিরাট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক পুঁজির ওপর দেশীয় শিল্পায়ন কে অনেকখানি নির্ভরশীল করে দিয়েছিল’। আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ঋণের ওপরেই মূলতঃ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের চারটি দশক স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে অতিবাহিত হল’। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থেকে প্রাপ্ত ঋণের বেশিরভাগ-ই দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণী কুক্ষিগত করেছে এই সময়কালে। ভূমি সংস্কার না করে হরিৎ বিপ্লবের রূপায়নের ফলে রাষ্ট্রীয় মদতে কৃষি তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সুফল-ও উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের বৃহৎ ভূস্বামীদের স্বার্থেই গেল’। সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ানো সত্ত্বেও পরিকল্পিত অর্থনীতির শাঁসটুকু চলে গেল’ দেশীয় বৃগৎ ভূস্বামী-বুর্জোয়াদের স্বার্থসিদ্ধিতেই। এই প্রেক্ষিতে ১৯৮০ পরবর্তী সময়কালে বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে এবং তজ্জনিত কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ারে বিপজ্জনক অবনতি ঘটে। ফলতঃ আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার থেকে ঋণ নিতে হয় ভারত সরকারকে এবং সেই ঋণের শর্তানুসারে আর্থিক উদারীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হয় যেই নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশই ছিল অর্থনীতি থেকে রাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণ। ঠিক যেই বুর্জোয়া শ্রেণী চার দশকের “নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি”র সুফল ভোগ করেছে, তারাই সকলের আগে সেই সময়কালকে “লাইসেন্স পারমিট রাজের” তকমা দিয়ে, কালিমালিপ্ত করে উদারীকরণের ধ্বজাধারী হল’। পরবর্তী তিন দশকে এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের সংকোচন, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পকে জলের দরে বেসরকারি পুঁজির কাছে বিক্রি করে দেওয়ার এক দীর্ঘ ইতিহাস রচিত হয়েছে।
সকল সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প বেশ কয়েকটি কাজ করতে পেরেছিল’। কয়লা, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোলিয়াম জাতীয়করণ করে এবং ভারি শিল্প স্থাপন করে দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের জন্য একটি অনূকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তদানীন্তন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সহায়তায় নির্মিত অতি বৃহৎ পরিকাঠামো প্রকল্পগুলি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির ওপর ভারতের আর্থিক নির্ভরশীলতা কে অনেকখানি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পগুলিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নগরায়ন ঘটে যা আধুনিক নাগরিক অর্থনীতির এবং সাংস্কৃতিক নির্মাণে সাহায্য করে। ব্যাংক, বীমা এবং সামগ্রিকভাবে আর্থিক ক্ষেত্র রাষ্ট্রায়ত্ত্ব করার ফলে এই সব ক্ষেত্রের এক সময়ের বিশৃঙ্খলা এবং তজ্জনিত অস্থিরতা কাটিয়ে উঠে সংহত করেছে এবং এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতের আজকের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও গড়ে উঠতে বিপুল্ভাবে সাহায্য করেছে।
বেসরকারীকরণ, হিন্দুত্ববাদ ও বিজেপি সরকার
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেই উদারীকরণের পথচলা শুরু। প্রথম এনডিএ সরকারের আমলে সেই প্রক্রিয়াকেই খোলাখুলি সমর্থন করা হয়। বিলগ্নীকরণ দপ্তর নামে আস্ত একটি সরকারি বিভাগ সৃষ্টি করা হয় একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর অধীনে যাদের কাজ-ই দেওয়া হল’ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়াত্ত্ব শিল্পকে বেসরকারি হাতে বিক্রি করে দেওয়া, যা কিনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই শিল্পের বাজারদরের চাইতে অনেক কম দামে করা হয়েছিল (উদাহরণস্বরূপ, ছত্তিসগড় রাজ্যের কোরবা অঞ্চলে অবস্থিত ভারত এলুমিনিয়াম কোম্পানি “বালকো”র ৫১% শেয়ার তৎকালীন বাজার দরের চেয়ে কমে “বেদান্ত গ্রুপের” মালিকানাধীন স্ট্রারলাইট ঈণ্ডাস্ট্রি কে বিক্রি করে দেওয়া, অর্থাৎ সেই প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া)। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে বামপন্থীদের শক্তিশালী ভূমিকার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের বেসরকারীকরণ বাধাপ্রাপ্ত হলেও ২০০৮ সালে বামপন্থীদের সরকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার আবারো কিছু পদক্ষেপ নেয় এই লক্ষ্যে। তবে, সে সব ছাপিয়ে যায় ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখজ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরে। অর্থ মন্ত্রকের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালের মে’ মাস থেকে ২০২২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর অবধি এই সরকার ৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি উপার্জন করেছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানীতে সরকারের অংশ বিক্রি করে দিয়ে। ১৯৯১ সালে উদারীকরণের সূচনাপর্ব থেকে আজ অবধি তাবৎ বিলগ্নীকরণের ৭২% ঘটেছে বিগত ৯ বছরে বিজেপি সরকারের আমলে। এই ৩২ বছরের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ৬% করে ধরলেও দেখা যাবে যে মূল্যের হিসাবে ৫৭% এর কিছু বেশি পরিমাণ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের বিক্রিবাটা ২০১৪ থেকে ২০২২ এর মধ্যেই ঘটেছে।
“হিন্দুত্বের” রাজনৈতিক অর্থনীতির পক্ষে এই বেসরকারিকরণ জরুরি। বৃহৎ বুর্জয়া নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেসের “লিবারাল-ডেমোক্র্যাটিক” মধ্য-দক্ষিণপন্থার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের সংকোচন জরুরি ব্রেটন-উডস প্রতিষ্ঠান সমূহের নেকনজরে থেকে প্রয়োজনীয় পুঁজি আমদানি করা বিদেশ থেকে। সাথে সাথে দেশীয় এবং বিদেশী পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক মদত পাওয়ার উদ্দেশ্য’ও রয়েছে। এই সকল উদ্ধেশ্য সঙ্ঘ পরিবারের ও রয়েছে। কিন্তু, তা আরো অনেক বেশি মাত্রায় এবং আরো অনেক দ্রুতগতিতে করার প্রয়োজন রয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকে গড়ে ওঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং তার থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও আর্থিক স্বনির্ভরতার যে মূল নীতিতে কংগ্রেসের সাথে বামপন্থীরাও বেশ খানিকটা ঐক্যমতে থেকেছিল’, সেই বুনিয়াদি বোঝাপড়ার বিপ্রতীপে সঙ্ঘ পরিবারের অবস্থান। ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত সঙ্ঘ পরিবারের রাজনীতির প্রয়োজন এ দেশের সরকার কে বৃহৎ পুঁজির সম্পূর্ণ তল্পিবাহকে পরিণত করা; যেই দেশ গোটা দুনিয়ার সর্ববৃহৎ বাজারগুলির মধ্যে অন্যতম। সংক্ষেপে, ভারতবর্ষকে একটি অতিবৃহৎ “ব্যনানা রিপাব্লিকে” পরিণত করার উদ্দেশ্য সঙ্ঘ পরিবারের, যার সমস্ত সম্পদ এবং সামরিক শক্তি পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হবে। ফ্যাসিস্ত রাজনীতির অন্যতম মতাদর্শগত বোঝাপড়াই হল’ জনগণের প্রতি অবিশ্বাস এবং ক্ষুদ্র চক্রের হাতে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, যার মাথায় এক “সর্বশক্তিমান” নেতা থাকবে। প্রসঙ্গতঃ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আভ্যন্তরীণ গঠনতন্ত্রে “একচালক অনুবর্তিতা” এক অলঙ্ঘনীয় নীতি। অর্থাৎ সঙ্ঘের প্রধান “সরসঙ্ঘচালকের” একক নির্দেশে সংগঠন পরিচালিত হবে, যেখানে কোনো বিষয়ে আভ্যন্তরীণ মতবিরোধ হলে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিরসন না করে স্রেফ সরসঙ্ঘচালকের ফরমানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এই একই মনোভাব প্রকাশ পায় যখন দেখা যায় যে উপরোক্ত প্রায় সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকার বিলগ্নীকরণের সিদ্ধান্ত সংসদে কোনোরকম বিতর্ক/ আলোচনা বাদেই সেরে ফেলা হয়েছে মন্ত্রীসভার বৈঠকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি মানে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের পরিবর্তে জনগণের নিত্যদিনের বেঁচে থাকাটাই কিছু বেসরকারি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর মর্জির ওপর ছেড়ে দেওয়া। কোভিড অতিমারির সময় দেখা গেছে যে কোভিডের টিকা বানানোর জন্য এ দেশের মানুষকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়েছে কিছু ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানীর। পরিবর্তে সেই সকল ফার্মা কোম্পানীর মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্কার গতিতে (যা প্রত্যক্ষ করা গেছে সংস্লিষ্ট কোম্পানীগুলির শেয়ারের দাম অতিমারির সময় অকল্পনীয় গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায়)। যে কোন ফ্যাসিবাদী রাজনীতির নিজস্ব চরিত্রের কারণেই প্রয়োজন হয় তার সংঠনের জন্য বিপুল পরিমাণের টাকার নিয়মিত যোগান। জনগণকে আদতে পদানত করে রেখে একটি ক্ষুদ্র চক্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন করতে গেলে এবং তা বজায় রাখতে গেলে সাংগঠনিকভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থের নিয়মিত যোগান লাগে এই exclusivist রাজনীতির স্বপক্ষে সমর্থন নির্মাণের জন্য। সেই বিপুল অর্থের যোগান দিতে পারে যে সকল বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তাদের হাতে দেশের অর্থনীতির প্রতিটা অংশ তুলে দেওয়া প্রয়োজন এমন রাজনৈতিক দলের পক্ষে। অভাবনীয় পরিমাণে গত ৯ বছরে উপরোক্ত যে বিলগ্নীকরণ ঘটেছে, তার সাথেই সাযুয্য রেখে নীতিহীনতার চরম নিদর্শন হিসাবে “ইলেক্টোরাল বন্ডের” মাধ্যমে অভূতপূর্ব টাকার যোগান বিজেপি পেয়েছে বিভিন্ন দেশি বিদেশি কর্পোরেট হাউসের তরফে। আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে এই বল্গাহীন বেসরকারিকরণের পেছনে। বেসরকারিকরণের ফলে সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলিতে শ্রমিক কর্মচারিদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করার অধিকার খর্ব করা অনেকখানি সহজ হয়ে যায় তাদের চাকরির নিশ্চয়তা কেড়ে নিয়ে। বহু ক্ষেত্রেই বেসরকারিকরণের অনতিবিলম্বেই সেই শিল্পের শ্রমিক কর্মচারীদের চাকরি চুক্তিভিত্তিক করা হয় যা ইচ্ছামত ছাঁটাই এর সুবিধা করে দেয় মালিকপক্ষকে। বেসরকারিকরণের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক অংশের শ্রমিক কর্মচারীদের আর্থিক অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগিয়ে সংঠিত শ্রেণী রাজনীতির থেকে তাদের সরিয়ে দিয়ে পরিচিতিসত্ত্বাভিত্তিক রাজনীতির পথে ঠেলে দেওয়া সুবিধাজনক হয়ে পড়ে। এবং এই পরিচিতিসত্ত্বাভিত্তিক রাজনীতিই সঙ্ঘ পরিবারের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে সোভিয়েত-পরবর্তী পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক mobilization এর অন্যতম কর্মসূচিই হল’ পরিচিতিসত্ত্বা উস্কে দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে কায়েমী স্বার্থ রক্ষা করা। ঠিক এই মডেল সঙ্ঘ পরিবার ১৯৮৫ সাল থেকে গুজরাটে চর্চা করে চলেছে।
এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক প্রচার চালানো হয় বুর্জোয়াদের তরফে যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্র আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় এবং তার ফলে বাণিজ্যিক দক্ষতা অর্জন করতে না পেরে সেগুলি কেবলমাত্র করদাতাদের প্রদত্ত করের টাকা নষ্ট করে। অতি সম্প্রতি খোদ এ দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে তাঁর ভাসনে বুর্জোয়াদের সেই চটুল মন্তব্য পুনরাবৃত্তি করেছেন যে “the government has no business in doing business”. কিন্তু এইসব চটুল প্রচারের বাইরে গেলে, গোটা দুনিয়ায় কী দেখা যাবে? পেট্রলিয়াম শিল্পে ১৩ টি অতিবৃহৎ কোম্পানী যাদের হাতে তিন-চতুর্থাংশ তেলের ভান্ডারের মালিকানা রয়েছে, তারা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা। OECD এবং Fortune Global 500 Companies List এর তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের ভাগ বিশ্বের এই সর্ববৃহৎ ৫০০টি কোম্পানীর তালিকায় ২০০৫ সালে ছিল ৯% এবং ২০১৪ সালে তা ছিল ২৩%। ৯ বছরে এই তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের এই চমকপ্রদ উত্থানের পেছনে অনেকখানি অবদান সমাজতান্ত্রিক চীনের। কিন্তু এই তালিকায় যেহেতু স্টক এক্সচেঞ্জে লিস্ট করা কোম্পানীগুলিকেই শুধুমাত্র ধার্য করা হয়, শতাংশের হিসাবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ৫০০টি কোম্পানীর তালিকায় আরো অনেক বেশি অংশ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের থাকবে স্টক এক্সচেঞ্জে আনলিস্টেড কোম্পানীগুলিকে ধরলে। চীনের সরকার ২০০৭ সাল থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পক্ষেত্রকে আরো শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে প্রচুর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উল্টো দিকে খোদ ব্রিটেনেই কোভিড অতিমারির সময়ে মার্গারেট থ্যাচারের আমল থেকে অনুসৃত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের দীন হীন চেহারা প্রকট হয়েছে। অতিমারির সময়ে রোগাক্রান্ত মানুষের সাথে রোগে মৃত মানুষের অনুপাতগুলি একেকটি দেশের হিসাবে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো রয়েছে এমন দেশগুলি বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার বাড় বাড়ন্ত যে সকল রাষ্ট্র, তাদের থেকে অনেক বেশি মানুষকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে।
এ দেশের অগণিত মানুষের স্বার্থে, শ্রেণী রাজনীতির স্বার্থে, বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এই মুহুর্তে এ দেশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যই হল’ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলিকে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে তোলা। মহান নভেম্বর বিপ্লবের আরেক বর্ষপূর্তিতে এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রকে রক্ষা করা ও পুনরুজ্জীবন করার উদ্দেশ্যে ধারাবাহিক লড়াই অবশ্যই চলবে।
তথ্যসূত্রঃ
1. Public Sector Enterprises in India: Evolution, Privatisation and Reforms; Govind Bhattacharya (2020); SAGE Publications.
2. The Wages of Destruction: The Making and Unmaking of the Nazi Economy; Adam Tooze (2206); Allen Lane.
3. CPIM Party Programme
4. Website of Department of Investment and Public Asset Management (DIPAM)
5. “Government Not in Business”; The Print (2022); TCA Sharad Raghavan
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া