Neoliberalism

Modern Monetary Theory: A Discussion

সুকুমার আচার্য

বাস্তবিক পক্ষে টাকার কোনো গাছ হয় না। তাই কোনো নির্বোধ ও টাকার গাছের সন্ধানে বের হয় না। কিন্তু হালচাল দেখে আমাদের অন্তত মনে হচ্ছে, অর্থনীতি জগতের চারজন পুরস্কর ব্যক্তি টাকার গাছের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন, এবং গত কয়েকবছর ধরে এমন চিৎকার ও তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন, যেন তাঁরা সে রকম গাছও পেয়ে গেছেন।

অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিবিদ বিল মিশেল প্রথম কিছু কথা শোনালেন। সেই কথাগুলির সমন্বয় করে তিনি একটি তত্ত্ব হাজির করলেন আর সেই তত্ত্বের নাম দিলেন ‘Modern Monetary Theory’ সংক্ষেপে MMT; বাংলায় বলা যায় আধুনিক অর্থ তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে জনপ্রিয় করার প্রয়াসে মাঠে নামলেন আমেরিকার রাজনীতিবিদ – আলেকজান্দ্রিও ওকেশিও। ২০০৮ সালে বিল মিশেল সহ চার জন মিলে ঐ আধুনিক অর্থতত্ত্বের একটা ব্যাখ্যাও দিলেন। তাঁদের বইটার নাম – Full Employment Abandoned’ । ২০১৩ সালে সামাজিক প্রচার মাধ্যমে সেই কথাগুলিকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা নেওয়া হল। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে আমেরিকার অর্থনীতিবিদ স্টেফনি কেল্টন ‘The Deficit Myth : Modern Monetary Theory and the Birth of the People’s Economy’ নামে একটা বই লিখে ঐ তত্ত্বটার আরো প্রচার সংগঠিত করলেন। বইটি ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস্’-এর বিচারে সর্বাধিক বিক্রিত বই বলে বিবেচিত হল। পুঁজিবাদী মহলের একটা অংশ যেন আদা জল খেয়ে নেমে পড়ল এই তত্ত্বের প্রচারের জন্য । কি যেন মুক্তির মহামন্ত্র পেয়েছে ওরা! কি আছে এই তত্ত্বে ? এর প্রেক্ষাপটই বা কি রকম?

এর প্রেক্ষাপটটা হল বর্তমান সময়। কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী সমস্ত দেশের সরকারগুলি নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেটকে ছাড় আর লুঠ করতে দেওয়ার ফলে সরকারী কোষাগারে টান পড়ছে। ফলে জনগণের উপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়ছে। ট্যাক্সের বোঝা একটু কম বাড়িয়ে যদি নোট ছাপানো যায়, তবে সেখানেও বিপদ। মুদ্রাস্ফীতির চাপ। তাহলে কি করা যায় ? বাজারে সরকারী বন্ড ছেড়ে ধার নেওয়া ? সেখানেও সমস্যা। সুদ মিটানোর বহর বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে উপায় ?

এই অর্থনীতিবিদরা এই ধরনের সরকারগুলির জন্য কিছু দাওয়াই কিছু মোদক হাজির করলেন। তাঁদের কথাগুলি – প্রথমে ছিল মূলতঃ আমেরিকা, ইংলন্ড, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার সরকারগুলির উদ্দেশ্যে। পরে স্টেফনি কেল্টন তাঁর লেখায় একটা সাধারণ সূত্র হাজির করলেন, দুনিয়ার সমস্ত পুঁজিবাদী সরকারগুলির জন্য। উল্লেখিত চারটি দেশের উদ্দেশ্যে তাঁদের বক্তব্য হাজির করার প্রধানতম করাণ হল- এই চারটি দেশের কারেন্সী বা ছাপানো নোটগুলোর রয়েছে কারেন্সী সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ এই কারেন্সীগুলি যেন স্বয়ম্ভূ, এদের উপরে আর কেউ নেই, আর এদের কোনো বস্তুগত ভিত্তিও নেই যে তার উপর নির্ভর করবে। সাধারণতঃ সোনা বা মূল্যবান ধাতুর উপর ভিত্তি করে কারেন্সী ব্যবস্থা রাখা হয়। এদের সে সব নেই। এগুলোকে সেই জন্য ‘ফিয়্যাট মানি’ ও বলা হয়। যেহেতু কোনো ভিত্তি নেই তাই যেন যতখুশী ছাপতে ও খুব – একটা অসুবিধা নেই। অর্থনীতির ব্যাকরণগত অর্থে সোভরিন মানি বা সার্বভৌম অর্থ হল সেই অর্থ যার ভিত্তি ঋণ হবে না। এখানেই ফিয়াট মানির সঙ্গে তফাৎ। ফিয়াট মানির কোনো ভিত্তি থাকবে না আর সোভারিন মানির ভিত্তি থাক বা না থাক ঋণ কখনোই হবে না। পৃথিবীর প্রায় এমন কোনো দেশ নেই যার কোনো ঋণ নেই, তা হলে সব দেশের অর্থেই তো ঋণ ভিত্তির উপাদান থাকছে। এঁদের বক্তব্যগুলো বহুস্বর বিশিষ্ট। একজনের সঙ্গে আর একজনের বক্তব্যের তফাৎও আছে। তবে সেটা গৌন। তাঁদের কথাগুলির কিছু সাধারণ সুর ও আছে। সেইগুলি হল-

(i) সরকারকে একটা গৃহস্থের আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে এক করে দেখা যায় না। একজন গৃহকর্তাকে সব সময় জমা খরচের হিসাব করে ভাবতে হয়। সে জমা দেখে, আয় দেখে, তারপর খরচের তালিকা তৈরী করে। সরকারের এত ভেবে লাভ নেই। সরকারের হাতে নোট ছাপানোর ক্ষমতা এবং টাকা তৈরী করার ক্ষমতা আছে। একজন গৃহকর্তার সে ক্ষমতা নেই। অতএব সরকারকে একজন গৃহকর্তার মত সাবধানী হবার দরকার নেই ।

(ii) একজন গৃহকর্তা আয় বুঝে ব্যয় করেন। সরকারকে করতে হবে উল্টোটা। আগে ব্যয়ের ফর্দ তৈরী করতে হবে। তারপর ট্যাক্স বাড়িয়ে, নোট ছাপিয়ে, অর্থ তৈরী করে ব্যয়ের চাহিদা মিটাতে হবে। তাতে মুদ্রাস্ফীতি হয় হোক। ঋণ হয়।

হোক। তাহলে, একে আপনি মুদ্রাস্ফীতির তত্ত্ব বা ঋণতত্ত্বও বলতে পারেন । এমনও হয়ত হতে পারে, সরকার একটা সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ভাল উদ্দেশ্যে ব্যয়ের তালিকাই না হয় আগে তৈরী করলেন, কিন্তু তারপর তাকে তো আয়ের সঙ্গে মিলাতে হবে । কিন্তু তা যদি না করা হয়, তাহলে তো মুদ্রাস্ফীতি ও ঋণের চর্চাই সামনে চলে আসবে আর বাকী সব উদ্দেশ্য একদম পিছনে চলে যাবে। আবার, অপর দিকটাও দেখুন, দেনা যাতে না বাড়ে, যাতে ভবিষ্যতে সুদ না গুনতে হয় সে জন্য আবার সরকারী বন্ড ছাড়তে কেউ কেউ বারণও করেছেন।

(iii) দেনা বাড়লে লাভ বাড়ে- এমন অদ্ভূত কথা শুনেছেন? এঁরা কিন্তু সেই কথা-ই বলছেন। এঁদের বক্তব্য হল জনগণকে কাজ দিতে গেলে, জনগণের আয় বাড়াতে হলে, জন কল্যাণ মূলক কাজ, যেমন- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বেকারত্ব দূর করা ইত্যাদির উপর জোর দিতে গেলে আজ দেনা বাড়বে। কিন্তু সেই দেনা আগামী দিনের প্রজন্ম পুষিয়ে দেবে। কারণ – তাদের ভবিষ্যতে আয় বাড়বে এবং আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর করের বিষয়টাও বাড়বে। এই ভাবনাটা আজ ভাল মনে হতে পারে, কিন্তু যে ভিত্তির উপর কথাগুলি দাঁড়িয়ে আছে তা কতটা সর্বনাশের সেটাই আগে বিবেচনায় আসা দরকার।

(iv) এঁদের কথায় সরকারের পক্ষে ঘাটতি হলে, সেটা যে সব সময় খারাপ হবে, এমনটা ভেবে লাভ নেই। সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য আজ কিছু বিনিয়োগ করতে গিয়ে যদি ঘাটতির মুখে পড়ে তো পড়ুক। পরে উন্নয়ন থেকে সেটা পুষিয়ে যাবে। আর উন্নয়ন করতে গিয়ে কিছু লোক তো কাজ পাবে। কথাগুলি শুনতে ভাল লাগলেও বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? প্রকৃতপক্ষে হিসেব নিকেশ করে সরকার চালাতে গিয়ে এমনিতেই সরকারগুলো ঘাটতি, পরে আরো বেশী ঘাটতি এই পথেই চলছে। আর সেগুলি মিটাতে গিয়ে সরকারকে সেই ‘নন্দ ঘোষ’ জনগণের উপর ট্যাক্স বসাতে হচ্ছে। তাহলে ঘাটতি মিটাবার উপায় ?

এঁদের দাওয়াই হল সরকারকে প্রচুর অর্থ তৈরী করতে হবে। কিন্তু কি ভাবে ? এখানেই তাঁদের বক্তব্য – প্রয়োজন মত সরকার নোট ছাপাক। নোট ছাপালে সরকারের লাভ। একটা ১০০ ডলারের নোট ছাপতে ৩ সেন্ট খরচ হয়। সরকারের লাভ ৯৯.৭ ডলার । একটা ৫০০ টাকার নোট ছাপলে সরকারের লাভ ৪৯৭ টাকার বেশী। একটা ২০০০ টাকার নোট ছাপালে সরকারের লাভ ১৯৯৬ টাকার বেশী। সারা বিশ্বে সরকারের নোট ছাপানোর খরচ নোটের মূল্যের ৩ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে। বাকীটা পুরো সরকারের লাভ। একে বলা হয় ‘সিগনিওরেজ’ (SIGNIORAGE)। সরকারের নোট ছাপিয়ে আয় । এটা করে সরকার দেনা কমায়। কিন্তু অঢেল ছাপার ইচ্ছা থাকলেও সরকার তা পারে না। কারণ মুদ্রাস্ফীতি বিরাট আকার নিলে, সরকারের সমস্যা আছে। তবুও ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল অবধি ভারত সরকার যত নোট ছাপিয়েছে, তার প্রায় দেড়গুণ নোট ছাপিয়েছে ২০১৪ থেকে ২০২২ এর মধ্যে পরবর্তী ৮ বছরে (সূত্র – economictimes.com)। কিন্তু এগোতে বলা হচ্ছে কাকে? সরকারকে? অথচ কাজটা তো সরকারের নয়, কাজটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। প্রতিটি দেশের আর্থিক পদ্ধতির (মানিটরি সিস্টেমের) নিয়ন্ত্রক হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংবিধান থেকে সে বিশেষ কিছু ক্ষমতা পায় এই জন্য যে সরকার পরিবর্তন হলেও আর্থিক বিষয়ের মূলনীতিগুলি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মডার্ন মানিটরি তত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাত থেকে সেই ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দিচ্ছে। এর ফলে যে আর্থিক অবস্থা তৈরি হবে তা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মাইকেল হাড্সনের ভাষায় Indipendent from democratic controll -গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতা। আসলে নৈরাজ্য!

যাই হোক, জনমানসে প্রতিক্রিয়া সামলানোর হিসাব করে সরকার এই লাভের জগতে এগোয়। বেশীর ভাগ কাজটা চলে ডিজিট্যালের মাধ্যমে। যা কিছু লেন-দেন হয়, তার বড় অংশটা হয় ডিজিট্যালে। ডিজিট্যাল মানি বা প্রযুক্তিজাত অর্থের জন্ম হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থাকে ঘিরে। আমেরিকাতে যে পরিমান ডলারের লেনদেন চলে তার ৯৭%ই চলে ডিজিট্যালে। আমাদের দেশে এতটা নয়, তবে হতেও আর বেশী দেরী নেই। ব্যাংক টাকা তৈরী করে কিভাবে ? ব্যাংক আপনাকে টাকা ধার দিল। যে টাকা ধার দিল, তা সুদ সহ আপনার কাছ থেকে ফেরৎ নিল। এই সুদটাই হল ব্যাংকের তৈরী করা টাকা। যেভাবে চালানো হোক না কেন, তা আসলে বস্তুগত পন্য উৎপাদনে তৈরী হওয়া লাভেরই অংশ। সুদের ভিত্তি কিন্তু ওটাই । আপনি উৎপাদনে বিনিয়োগ করে যে লাভ পেয়েছেন, তারই তো একটা অংশ সুদ হিসাবে ব্যাংকে ফেরৎ দিচ্ছেন। যাই হোক, এবার আসা যাক ঋণ প্রক্রিয়ায়। ব্যাংক আপনাকে ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু যে ব্যাংক আপনাকে ঋণ দিচ্ছে, সেই ঋণের অতি সামান্য অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রেখে বাকী বহুগুণ বিবর্ধিত আকারে ঋণ দিচ্ছে। আপনি যে ঋণ পাচ্ছেন তা আপনি কেবল সুনিশ্চিয়তা দিয়েই পাচ্ছেন। অর্থাৎ আপনার আয়ের নিরাপত্তা বা জমি ইত্যাদি বা সোনা ইত্যাদি বিভিন্ন নিরাপত্তার বিষয় দিয়েই আপনি ঋণ পাচ্ছেন। আপনি যে ঋণ পাচ্ছেন, তার প্রায় অধিকাংশই পাচ্ছেন ডিজিট্যালে। আসল আর সুদ ও আপনি মিটাচ্ছেন ডিজিট্যালে । টাকা (অর্থ) ছাপানো হচ্ছে না, কিন্তু তাঁদের মতে অর্থ তৈরী হচ্ছে এইভাবে। আর এটা পাচ্ছে সরকার । দেশের ভাঁড়ারে মূল্যবান ধাতুর উপস্থিতি যদি ‘ভাঁড়ে মা ভবানী ও হয় তা হোক, – ডিজিট্যাল মানির চলাচলে তার কোনো ছাপ পড়বে না। কারণ, অর্থটার কোনো বস্তুগত ভিত্তি নেই – ওটা ফিয়াট মানি বা সোভারিন কারেন্সী। এরসঙ্গে শেয়ার বাজারের দিকে মানুষের আকর্ষণ বাড়াতে পারলে, শেয়ারের দাম বাড়তে থাকবে, শেয়ারের সূচক বাড়তে থাকবে। ওখানে অর্থ তৈরী হতে থাকবে। সরকার ‘ক্যাপিট্যাল গেইন’ ট্যাক্স নিয়ে তার আয় বাড়াবে। এবার শেয়ার বাজার এর সাথে ইনভেস্টম্যান্ট ব্যাংক (বিনিয়োগ ব্যাংক) এমনিতেই জুড়ে দেওয়া আছে। তারও গতি বাড়বে। তার সঙ্গে যদি কমার্শিয়্যাল ব্যাংক (যারা কেবল ধারের কারবার করে) কে জুড়ে দেওয়া যায়, তবে তারও গতি বাড়বে। সেও আরও অর্থ তৈরী করবে।

কোথাও কোনো নোট ছাপানোর দরকার নেই। সবই প্রায় ডিজিট্যাল । পুঁজিবাদী দেশগুলোতে বেশী অর্থ তৈরী হয় শেয়ার বাজারে। সেখানেই নানা ভাবে প্রচুর অর্থ আসে। সামগ্রীক ভাবে শেয়ারের সূচক বাড়লে একটা হিসাব করা হয় কত অর্থ তৈরী হল। তাই ওঁদের বক্তব্যের বড় অংশ আবর্তিত হচ্ছে শেয়ার বাজারকে ঘিরে। কিন্তু তাঁদের বক্তব্যে এই কথাটি কোথাও স্পষ্ট করে বলেন নি। বলেছেন- সরকারকে বিপুল অর্থ তৈরীর জন্য সবরকম প্রচেষ্টা নিতে হবে। কিন্তু শেয়ার বাজারে ধ্বস নামলে কি হবে? প্রথমে লালবাতি জ্বলবে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে, তারপর জ্বলবে তার হাত ধরে থাকা কমার্শিয়াল ব্যাংকে, তারপর আবার তার হাত ধরে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে, তারপর আবার তার হাত ধরে থাকা সরকারের এবং শেষমেস গোটা দেশের।

(v) সরকারকে রপ্তানি নয় – আমদানির উপরই জোর দিতে হবে। এমন অদ্ভূত কথা শুনেছেন কখনো – রপ্তানি হল প্ররকৃপক্ষে আর্থিক খরচ, আর আমদানি হল প্রকৃতপক্ষে আর্থিক আয় (সূত্র- ওয়ারেন মোসলার এর বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (১১ই মে, ২০১৯) প্রদত্তভাষণ) ? এতদিন জেনে এসেছি, দেশের রপ্তানি বাড়লে, আয় বাড়ে, দেশের মানুষের কাজ বাড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়ে। অপরদিকে আমদানি হল অন্যদেশের শ্রমশক্তির ফসল নেওয়া এবং বিনিময়ে আমাদের দেশের খরচ বাড়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমা।

(vi) এঁদের বক্তব্য হচ্ছে, সরকারের না কি কখনো দেনা হয় না। সরকারের যা দেনা, তা দেশবাসীর কাছে সঞ্চয় হিসাবে না কি সমপরিমানেই আছে। অংকের দিক দিয়ে না হয় ধরেই নেওয়া হল ঠিকই আছে। ভারত সরকারের যা দেনা, তার বড় অংশটাই আদানি-আম্বানী সহ কর্পোরেটদের কাছেই সঞ্চয় হিসাবে আছে। কিন্তু তাতে সরকারের বা দেশের কি লাভ ?

(vii) এঁদের প্রস্তাব দেশে জমা টাকার উপর সুদের হর০% করতে হবে। যাতে ব্যাংক টাকা না জমিয়ে মানুষ উৎপাদনে বা অর্থ তৈরী হয় এমন সব যায়গায় (শেয়ার বাজার) বিনিয়োগ করে।

(viii) এঁরা বলছেন- সরকারকে বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা ঠিক হবে না। কারণ, তাতে করে সরকারকে সুদ দিতে হবে – যা আসলে অর্থ তৈরীর উল্টো। বরং সরকারকে কর্পোরেটদের বন্ড যত পারা যায় ততটাই কিনতে হবে কারণ সে সুদ পাবে এবং এভাবে সে অর্থ তৈরী করতে পারবে। ২০১৯ সালের পূর্বোক্ত ভাষণে ওয়ারেন মোসলার সব বলার পরে ইংলন্ড (UK)-র জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও রেখেছিলেন। সেইগুলি হল-

(ক) প্রতি বছর GDP র ৫% হারে ঘাটতি বাড়াতে হবে (লক্ষ্যণীয় WTO বলেছে GDP-র ৩.৫% এর বেশী ঘাটতি যেন কখনোই না হয়)।

(খ) পাকাপাকি ভাবে সুদের হার ০% করতে হবে।

(গ) সবাইকে কাজ দেবার জন্য আর্থিক নীতি চালু করতে হবে।

(ঘ) কাজের সুনিশ্চয়তা নীতি প্রয়োগ করতে হবে।

(ঙ) জনকল্যাণ, বিনিয়োগ এবং গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ খরচ করতে হবে।

ড. স্টেফনি কেলটন তাঁর বইতে কোনো দেশের জন্য এত সুনির্দিষ্ট ভাবে বলেন নি। কিন্তু তাঁর বই-এর আটটি অধ্যায়ের প্রত্যেকটিতে এই ধরনের প্রস্তাবের মূল সুরগুলি রয়েছে। সব শুনে কেউ কেউ আনন্দে লাফিয়ে বলছেন, এহল – ‘Magic Money Theory’ – ‘যাদু টাকার তত্ত্ব’ আবার কেউবা বলছেন- এ হল ‘Magic Money Tree’- ‘বুঝলে কি-না ভায়া- এ হল যাদু টাকার গাছ। এরা টাকার গাছ দেখেছে।’

আমাদের রাষ্ট্রীয় আর্থিক জীবনে একটা সাম্যতার ব্যবস্থাপনা আছে। এঁরা তাকে বরবাদ করে দিচ্ছেন। কিন্তু নতুন কোনো সাম্যতার ব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট ছক বা গাণিতিক নিয়ম ভিত্তিক প্রমাণ আজও দিতে পারছেন না। যে সাম্যতার ব্যবস্থাপনার কথা আমাদের সামনে রয়েছে তা এই রকম –

S = সঞ্চয়, I= = বিনিয়োগ

সব মিলিয়ে সাম্যতার ব্যবস্থাপনায়

সরকারের (TG) + জনগণ ইত্যাদির (S1) + বিদেশের (M – X) = 0

অথবা, G-T+SI+M-X=0

অথবা, T + S + M=G+I+X

অর্থাৎ সরকারী আয়, সঞ্চয় এবং বিদেশ থেকে আসা অর্থ-সরকারী ব্যয়, বিনিয়োগ এবং বিদেশে যাওয়া অর্থের সঙ্গে সমান হবে আর তা না হলে আয়ের দিকটা বেশি হলে উদ্বৃত্ত বা ব্যয় এর দিকটা বেশি হলে ঘাটতি।

মুক্তিহীন সর্বনাশের এই তত্ত্বের ফেরিওয়ালারা তবু না কি যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা যেন আহ্বান করছেন সবাইকে সব সমস্যার সমাধান না কি হয়ে যাবে যদি অর্থটাকে সার্বভৌম করা যায়- ফিয়াট মানি করা যায়। সরকারের হাতে তো অর্থ তৈরীর মেশিন আছে আর না কি সব কৌশলও তার জানা আছে। ভাবনা কি! সরকারের কাছে তো টাকার গাছই আছে। চাইলেই অর্থ তৈরী হয়ে যাবে। হয় কি? যে অর্থের ভিত্তি নেই- সে তো শিকড়হীন গাছ। শিকড়হীন গাছ কি বাঁচে? গন্তব্য যদি শেষমেস হয় শেয়ার বাজার- তবে তার কি কোনো সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থাকতে পারে?

আসলে, এই কথাগুলি শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলে বোঝা যায় এই তত্ত্ব একটি কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী তত্ত্ব। তত্ত্ব যখন বলে- কর বাড়াও, কিন্তু সে বলে না কর্পোরেট কর বাড়াও উত্তরাধিকার কর বাড়াও, কর ছাড়ের স্বর্গরাজ্যের ব্যবস্থাপনা বাতিল কর তখন বোঝা যায় তত্ত্বটা সমস্ত গরীব-মধ্যবিত্তর উপর কর বাড়াতে বলছে। যখন এই তত্ত্ব বলে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে সরকারের ভাবার কিছু নেই, তখন বোঝা যায় সে কর্পোরেটদের কথাই বলছে। কারণ মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে কর্পোরেটদের লাভ। কর্পোরেটরা মুদ্রাস্ফীতিকে সামনে রেখে জিনিসের দাম বাড়িয়ে তার লাভটা ঠিকই তুলে নেবে। মুদ্রাস্ফীতির গোটা কোপটা গিয়ে পড়বে জনগণের উপর। এই তত্ব কর্পোরেটদের বন্ড কিনে সরকারকে কর্পোরেটদের অর্থ দিতে বলে এবং কর্পোরেটদের ভাগ্যের সাথেই জনগণের ভাগ্যকে জুড়ে দেয়, কিন্তু যে কথাটা এই তত্ব কখনো বলে না, সরকার রাষ্ট্রায়ত্ব কারখানা গড়ে তার আয়ের পরিসর বৃদ্ধি করুক।

তবু ইংলন্ড এবং আমেরিকায় এই তত্ত্ব কিছু মানুষের কাছে আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়েছে। বিশেষ করে বেকার যুবক এবং গরীবদের কাছে। তার কারণ হল তত্ত্বটা যেহেতু কাজ এবং জনস্বার্থমূলক কিছু কর্মসূচীর মুখোশ পরে কথাগুলো বলছে। কেউ কেউ ভাবছেন, আমারটা হলেই হল- সামগ্রীক ভাবে দেশের কি হল এত ভেবে লাভ নেই। সস্তা জনপ্রিয়তাবাদের এটা হল বিষময় ফল। রাজনীতিগতভাবে তত্ত্বটা প্রতিক্রিয়াশীল সম্ভা জনপ্রিয়তাবাদের একটা রূপ।

তবু বড় বড় পুঁজিবাদী মহলেও আলোচনা চলছে এই তত্ত্বের অসারতা নিয়ে। তার কারণ হল, এই তত্ত্বটা কার্যকরী করতে গিয়ে পুঁজিবাদী মহলকে আরো বেশী দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে ভয়টা তাঁরা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছেন। কর্পোরেট মহলের একজন বড় চূড়ামণি ‘ব্ল্যাক রক’ (বিশ্বের সবচেয়ে বড় হেজ ফান্ড)-র মালিক লরি ফিংক বলেছেন- ‘MMT is a garbage’ – (আধুনিক অর্থতত্ত্ব একটি আস্তাকুঁড়ে), আমেরিকার ইকনমিক কাউন্সিলের প্রাক্তন ডাইরেক্টার পরি সামার্স বলেছেন- ‘Modern Monetary Theory is a recipe of disaster’ (আধুনিক অর্থতত্ত্ব হল মহামারীর মচ্ছব)। আমেরিকার একটি বিখ্যাত অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থা ব্লুমবার্গ বলছে- ‘Modern Monetary Theory Would Sink US in debt’ (আধুনিক অর্থতত্ত্ব আমেরিকাকে দেনায় ডুবিয়ে দেবে)। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ, প্রগতিশীল চিন্তা দিয়ে যিনি সমাজকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তোলেন – পল ক্রুগম্যান, তিনি ২০১১ সালে ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস্’ পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেই প্রবন্ধের অংশ বিশেষে তিনি বলেছেন- ‘যদি ধরেও নেওয়া যায় সিগনিওরেজে (নোট ছাপিয়ে লাভ) সরকারের প্রচুর লাভ হবে এবং তা জাতীয় আয়ে যোগ হবে, তবু বলতে পারা যায়, মুদ্রাস্ফীতি বার বার তীর গতিতে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে আসবে এবং তার ফলে আমেরিকার কারেন্সী ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। যদি সরকারের বন্ড বিক্রি করেও একই রকম ঘাটতি চলতে থাকে, তবুও একে (আধুনিক অর্থতত্ত্ব) মেনে নেওয়া যায় না’।

আধুনিক অর্থতত্ত্ব কি আমেরিকা মেনে চলছে না? এই তত্ত্বের জন্মের আগে থেকেই সে মেনে চলছে। তার ডলার কে সে ১৯৭১ সালেই ফিয়্যাট মানি করে দিয়েছে। সুদের হার একসময় শূন্যের কোঠায় (০.২৫%) নামিয়ে দিয়েছিল। আমেরিকা ২০০ বছরে যা ডলার ছেপেছে, করোনার সময় মাত্র কয়েকটা বছরে তার দ্বিগুণের বেশী ডলার ছেপেছে। শুধু সরকারী বন্ডটা সে ছেড়েছে- যা এই তত্ত্বের সঙ্গে মিলে না। তার কি অবস্থা আজ ? জাপান এই পথেই চলেছে। তার দেনা, জাতীয় আয়ের ২৫৬% । তবুও এই সমস্ত তত্ত্বের ফেরিওয়ালারা বলে বেড়াচ্ছেন- এগুলো ভেবে লাভ নেই – সরকার তোমার হাতে টাকা ছাপানোর মেশিন, আর ব্যাংক এবং অনুচ্চারিত- (শেয়ার বাজার) এর ডিজিট্যাল কম্পিউটারগুলো। ভয় কি! এগুলোই টাকার গাছ। লেগে পড়!

‘ঘর পুড়া কাশিয়ার বুদ্ধি’। ওডিশা সংলগ্ন আমাদের রাজ্যের গ্রামগুলোতে এইরকম একটা কথা আছে। কোনোকালে কাশী নামে হয়ত কেউ একজন ছিল। সে তার ঘরে আরশোলা, ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে গোটা ঘরটাতেই আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবখানা এই যে, ঘর পুড়ে গেল তো কি হল? আরশোলা – ইঁদুরতো মরল! এ হচ্ছে সেই রকম। ছোট বিপদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য বড় বিপদ ডেকো না। সংকট আছে তো কি হয়েছে? ভাবতে হবে না। নোট ছাপতে গেলে যদি তার চেয়েও বড় সংকট আসে তো কি হয়েছে? সেই দিকেই চলো। বোঝা কি যাচ্ছে না যে এছাড়া কোনো উপায় নেই! সেখানেই তো টাকা (অর্থ) প্রতি মুহূর্তে তৈরী হচ্ছে। সেটাই তো আসলে টাকার গাছ। এই হচ্ছে আধুনিক অর্থতত্ত্ব বা ‘মডার্ন মনিটারি থিওরির মূল কথা।

প্রধানতঃ চারটি দেশ- আমেরিকা, ইংলন্ড, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় এই তত্ত্বের চর্চা চলছে। আমাদের দেশেও এই তত্ত্বের চর্চা যে কোনো দিন শুরু হতে পারে। আমরা তাই, এই তত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণা ও মতামত দেবার চেষ্টা করছি। এনিয়ে সমালোচনা, বিতর্ক ইত্যাদি চলতে পারে। যে ভাবেই চর্চাটা হোক না কেন, তা আমাদের সবাইকে অবশ্যই সমৃদ্ধ করবে।

Spread the word

Leave a Reply