Lenin Legacy Souvik ghosh

Lenin: A Legacy

“আশ্চর্য রকমের একজন নেতা – যিনি নেতৃত্ব করছেন নিতান্তই তাঁর মেধার জোরে; বেরঙীন, বেরসিক, অটল, অনাশক্ত, এমনকি চমকপ্রদ কোন পাগালামিও তার কিছুই নেই, কিন্তু আছে গভীরতর ভাবনাকে সহজে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে নিখুঁতরুপে বিশ্লেষণের শক্তি। বিচক্ষণতার সঙ্গে মিলনে যা এক মেধাশক্তির মহত্তম স্পর্ধা।”

কথাগুলো লিখেছিলেন জন রিড – দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন বইতে। লিখেছিলেন লেনিনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে।

লেনিন!

ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ!

১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সফল হবার পরমুহূর্ত হতে আজ অবধি গোটা দুনিয়ার বুর্জোয়া সংবাদপত্র – প্রথাসম্মত বুদ্ধিজীবী সমাজ অথবা লিবারাল ডেমোক্র্যাসির ভাড়াটে মেধা যাকে চিত্রিত করতে চেয়েছিল রক্তখেকো শয়তান হিসাবে, সেই স্রোতের বিপরীতে চলেই আমেরিকান সাংবাদিক জন রিড লিখতে বসে ভরসা করেছিলেন নিজের চোখকে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে। ভরসা করেছিলেন সাংবাদিকতার বুনিয়াদি নীতিতেই।

কেমন হন একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী? 

ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন এমন ব্যাক্তিত্বদের জনমানসে বরাবরই অতিমানব হিসাবে তুলে ধরতে চায় পুঁজিবাদ। বেঁচে থাকতে বিপ্লবীদের নিপীড়ন, অত্যাচার এমনকি খুনের উদ্দেশ্যে ঘৃণ্যতম চক্রান্ত করতে একমুহূর্ত বসে থাকে না যারা, তারাই একটা সময় বিপ্লবীদের মহামানব প্রমাণ করতে নামে – এহেন আচরণ অবশ্যই রাজনৈতিক। বিপ্লবী চেতনা, বিপ্লবী মতাদর্শ এবং সংশ্লিষ্ট চর্চা থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করার রাজনীতিই পুঁজিবাদী কৌশল। মার্কস শ্রমিকশ্রেণীর সাথে উৎপাদিত পণ্যের ব্যবধান, বিচ্ছিন্নতা বোঝাতে ‘অ্যালিনিয়েশন’র উল্লেখ করেছিলেন, সচেতনভাবেই পুঁজিবাদ মেহনতি জনগণকে বিপ্লবী মতাদর্শ এবং তার মূর্ত রুপের থেকে অ্যালিনিয়েট করে। লেনিন এহেন অ্যালিনিয়েশনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন কৃষক – শ্রমিকদের জোট যা চুরমার করেছিল সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিকে।

ঠিক এখানেই লেনিনের অনন্যতা বিপ্লবের ইতিহাসে নজীরবিহীন। জনমানসে বিপ্লব, বিপ্লবী স্লোগান এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রাথমিক স্তরে বহু ধোঁয়াশা থাকেই, লেনিন এই সত্য জানতেন। সমাজতন্ত্রের স্লোগান দেওয়া ব্ল্যাঙ্কিপন্থী সংগঠন, পরবর্তীতে রাশিয়ায় নারোদনায়া ভালিয়া (নারদনিক) ইত্যাদি সংগঠনের কর্মকাণ্ডে জনসাধারণ বিপ্লবী মানেই প্রাণের মায়া ত্যাগ করা ভয়ানক মেধা এবং সাহস সমৃদ্ধ ব্যাক্তিদের কথা মনে করত। সম্রাট জার’কে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত হওয়ার অপরাধে গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য বড় দাদা আলেকজান্দারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবার পরেই উপলব্ধি করেছিলেন “মুক্তির লক্ষ্যে ঐ রাস্তা কিছুতেই আমাদের পথ হতে পারে না”। গোড়া থেকে সমাজ বদলের লড়াইতে নিপীড়িত জনগণের সংগঠিত আন্দোলনই শেষ কথা – এই কথাই শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ইতিহাসের সার। এই ধারনাকে প্রয়োগ করে দেখিয়ে দেওয়ার কাজটা লেনিনের আগে কেউ কার্যকর করতে পারেননি। প্যারি কমিউনের শিক্ষা লিখেছিলেন মার্কস – এঙ্গেলস দুজনে মিলে, লেনিন সেই ঐতিহাসিক শিক্ষাকে আত্মস্থ করেছিলেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়াতে ব্যর্থ বিপ্লবের অভিজ্ঞতাও সেদেশের কমিউনিস্টদের লোহা থেকে ইস্পাতে পরিণত করেছিল।

লেনিন চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট বুঝতে আজকের প্রজন্মের পছন্দসই ওয়ানলাইনার কেমন হবে?

“নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ

“Concrete Analysis of the Concrete Condition”

মার্কসীয় বিশ্ববিক্ষা সম্পর্কে লেনিনের এই নোটই তাকে সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করে। লেনিনের ছোটবেলায় এমন একটিও উল্লেখযোগ্য ঘটনা (বিশিস্ট ব্যক্তিদের ছোটবেলা বলতে পুঁজিবাদী সংস্কৃতি ‘পার্টিকুলার ইভেন্ট’ কথার প্রয়োগ করে) নেই যা থেকে এমন সিদ্ধান্ত টানা চলে যে এই শিশুই বড় হয়ে সমাজ বদলের লড়াইতে ইতিহাস সৃষ্টি করবে। আসলে বাজার নিয়ন্ত্রিত ব্যাবস্থা এমনই চায় – সবকিছুকেই তাদের গাণিতিক যুক্তিতে প্রেডিক্টেবল – সম্ভাব্য করে তুলতে। বিশ্বব্যাপি মুনাফা লুটের ব্যবস্থার বুনিয়াদটাই তা নাহলে ভঙ্গুর প্রমানিত হয়! লেনিন সেই প্রমান দাখিল করলেন এবং করলেন এমনভাবে যা ইতিহাসে উত্তীর্ণ হল।

১৮৭০ সালের ৭ই এপ্রিল তারিখটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী লেনিনের জন্মদিবস। ১৯১৭ সালে রুশবিপ্লবের আগে রাশিয়াতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু ছিল। বাবা ছিলেন শিক্ষক, মা উদারচেতা চরিত্রের। কাজান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দাদা আলেকজান্দারের ড্রয়ার থেকে খুঁজে পান কার্ল মার্কসের “দ্য ক্যাপিটাল”। সমাজতন্ত্রের অধ্যয়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরতদের গোপন সংগঠনে সক্রিয়তা শুরু হয়। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এভাবেই। রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনের দুটি ধারা ছিল, প্রথমটি ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি আরেকদিকে মুখে বাম কাজে ডান ধরনের সংশোধনবাদী সমাজতন্ত্রী, এদের উভয়ের বিরুদ্ধেই কলম ধরেন লেনিন, কাজেও নামেন। সময়োপযোগী বিপ্লবী সংগঠনের চেহারা কেমন হতে হবে সেই সম্পর্কে ধারণা বুনতে থাকে রাশিয়ার কমরেডদের চেতনায়। এমনই একটি সময় প্রকাশিত হয় লেনিনের লেখা লিফলেট “কোথা থেকে শুরু করতে হবে” – সেই লিফলেটই পরে প্রকাশিত “কি করতে হবে” (What is to be done?) গ্রন্থের ভ্রুন। কিভাবে লিখতে হয়, কিভাবে তথ্য সংগ্রহ এবং বাস্তবোচিত, সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিপ্লবী তত্বের রচনায় তাকে ব্যবহার করতে হয় সেই কাজ শিখতে গেলে তার প্রথম দিককার লেখা “রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ” (Development of capitalism in Russia) পড়তেই হবে। অর্থনীতিবাদ (Economism) এবং সন্ত্রাসবাদী নারদনিকেরা প্রচার করত রাশিয়াতে পুঁজিবাদ খুবই দুর্বল, সুতরাং শ্রমিকশ্রেনির সংগ্রাম গুরুত্বহীন, লেনিন এই দূটি দলকেই রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া প্রমান করলেন। এই কাজই পূর্ণতা পেল পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে্র অধিবেশনে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র নীতিকে পার্টি পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, পার্টিতে কারা সদস্য হবেন সেই সংজ্ঞা নির্ধারিত করার সময়। বুলি কপচানো, আত্মমগ্ন বাবুদের চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক অকর্মণ্যতার বাইরে টেনে আনেন বিপ্লবী সংগঠনের পরিসর। সেই সংগঠনই ছড়িয়ে পড়ে মস্কো শহরের কল কারখানার গেট থেকে সাইবেরিয়ায় খনি অবধি। যুগ যুগ ধরে যারা পথের ধুলোয় মলিন হয়ে থাকাকেই নিজেদের কপালের ফের বলে মেনে নিতে অভ্যস্ত ছিল তারাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নিজেদের দেশে পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।

পার্টিতে কাজের নতুন এক ধারা প্রতিষ্ঠা করেন লেনিন। পেশাদার বিপ্লবী (Professional Revolutionary) – আজ যাদের আমরা হোলটাইমার বলে চিনি। বিপ্লবী সর্বহারা শ্রেনিচেতনার সবথেকে এগিয়ে থাকা অংশই হবে হোলটাইমাররা, যারা বিপ্লবের লক্ষ্যে বিপ্লবী পার্টির স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ – তারাই হবেন পেশাদার বিপ্লবী – এই ছিল তার ব্যাখ্যা। সেই সময় পার্টিতে এলিট হিসাবে পরিচিত মার্তফ, আক্সেলরদ, ট্রটস্কি সকলেই লেনিনের এই কথার বিরোধিতা করেছিলেন – এমনকি রাশিয়ায় মার্কসবাদের শিক্ষক গেওর্গি প্লেখানভ অবধি লেনিনের যুক্তি উপলব্ধি করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। এদের সবার সাথে সংগ্রাম করতে হয়েছিল লেনিনকে, সেই পার্টি কংগ্রেসে অনেক কাছের কমরেডই তাকে অনৈতিক আক্রমন করেছিলেন। লেনিন সমস্ত আক্রমনের মোকাবিলা করেছিলেন মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব, ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা এবং নিজের দেশে প্রলেতারিয়েতদের জীবন সংগ্রাম সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধি সম্বল করে। সেই সমস্ত আক্রমণ এবং তার জবাব প্রকাশিত হয় “এক পা আগে, দুই পা পিছে” গ্রন্থে। অনেকক্ষেত্রেই বইয়ের নাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ এক ভ্রান্ত ব্যাখা হাজির করা হয়, জেনে রাখা দরকার লেনিন ঐ বইতে পার্টি কংগ্রেসের মিনিটস এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা প্রকাশ করেছিলেন, মধ্যপন্থী, সুবিধাবাদী, নিজেদের এলিট ভাবা মানুষজন আসলে কেমন রাজনৈতিক চরিত্রের হন সেটা সবার সামনে স্পষ্ট করে দেওয়াই ছিল সেই সময় কর্তব্য। সুবিধাবাদী নিষ্কর্মাদের সম্পর্কেই লেনিন “এক পা আগে, দুই পা পিছে” কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। কেতাবি বুলি আউড়ে যাওয়া কিংবা নিরর্থক অক্লান্ত বিতর্কে সময় ব্যয় করা বুদ্ধিজীবীদের লেনিন “মার্শ” এবং “ফেরজুম্ফ” বলে উল্লেখ করেছেন এই বইতে, দুটো জার্মান শব্দেরই অর্থ প্রায় একই – বদ্ধ জলাশয়।

পার্টি সংগঠনের চেহারা থেকে শুরু করে বিপ্লবের কাজে শ্রমিক – কৃষকের জোটবদ্ধতার কর্মসূচি রুপায়ন, পার্টির মধ্যে ভ্রান্ত সমস্ত পথের (সংশোধনবাদী এবং সংকীর্ণতাবাদী উভয়ই) বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে শুরু করে ক্যাডার নির্বাচন এবং কাজ ভাগ করার নীতি, শ্রমিক রাষ্ট্রের বাস্তবিক কাঠামো সম্পর্কে সঠিক ব্যখ্যা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারের সাথে মার্কসীয় প্রজ্ঞার সম্মিলন – সবেতেই লেনিন শুধু অসাধারণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দেন নি, সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রায়োগিক মার্কসবাদের সারাংশ হিসাবে “নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ (Concrete Analysis of the Concrete Condition)” –কে সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করেছেন। লেনিন বুঝতে গেলে সাম্রাজ্যবাদের যুগে মার্কসবাদ কথাটির সাথে কমরেড স্তালিন লেনিনবাদ কথাটি জূড়ে দিয়েছিলেন তাকে আত্মস্থ করতে হলেও “নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ (Concrete Analysis of the Concrete Condition)” করতে হয়।

ব্যাংক পুঁজি এবং শিল্প পূঁজি একীভূত হয়ে কিভাবে লগ্নী পূঁজির জন্ম দেয় এবং মুনাফার লোভে দুনিয়াজূড়ে ছুটে চলা সেই লগ্নী পূঁজিই যে সাম্রাজ্যবাদের বীজ এই উপলব্ধিকেই তথ্য এবং বিশ্লেষণী তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন লেনিন “সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়” (Imperialism: The highest stage of capitalism) বইতে। তথ্য ও যুক্তিবোধ রহিত হলে উপ্লব্ধি করা সম্ভব না কেন বুখারিন, ক্রপ্টকিন এদের চরম বিরোধিতা স্বত্বেও বিপ্লবের পরে দেশ গঠনে নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (NEP) গৃহীত হয়েছিল। গোটা পশ্চিম ইউরোপ আজও যার রচনায় সমাজতন্ত্রের মহান বার্তা খুঁজে পায় সেই ট্রটস্কি বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ করার সুপারিশ করেছিলেন, লেনিন সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন। আজকের প্রজন্মের জন্য এই সমস্ত চরিত্রের স্বরুপ আরও একবার স্পষ্ট হওয়া উচিত, তাতে সেই একই ভুল দ্বিতীয়বার না হবার সম্ভাবনা বাড়ে।

লেনিন এক বিরাট অধ্যায়, একটি গোটা ঐতিহাসিক নির্মাণপর্বে নিজেই একটি ইতিহাসে পরিণত হওয়া ব্যক্তিত্ব – একটি প্রবন্ধের পরিসরে তাকে ধরা যায় না। তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত পার্টির মুখপত্রের নাম ছিল ইস্ক্রা (স্ফুলিঙ্গ) – সেই ধারা মেনেই ২০২২ সালে আরও একবার লেনিন স্মরণ করার মানে আসলে একটা উত্তরাধিকারকে স্বীকার করে নেওয়া এই অনুভবটুকু আমাদের চেতনায় রাখতেই হয়। সেই উত্তরাধিকার আসলে কেমন তা বুঝতে তিনটি প্রসঙ্গই যথেষ্টঃ

১) ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব (যাকে আমরা নভেম্বর বিপ্লব বলি) সফল হবার পরে লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকার প্রথম যে আইনগুলি প্রণয়ন করে সেগুলি এরকম ছিল –

ক) জমি সংক্রান্ত আইন (Decree Of Land) যাতে জমিহীনদের মধ্যে জমি বিলি করার বন্দোবস্ত, আইনী সীমার উর্ধে থাকা ব্যাক্তি এবং সংগঠনের মালিকানাধিন জমি কেড়ে নেবার নিদান এবং যৌথ কৃষি খামার ব্যবস্থার পরিকল্পনা ছিল।

খ) রাশিয়ার জনগণের অধিকার আইন (Declaration of the Rights of the Peoples of Russia) যাতে রাশিয়ানরা ছাড়াও অন্যান্য যে জাতিগোষ্ঠীগুলি সেই দেশের নাগরিক ছিল তারা নিজেদের ইচ্ছায় নিজস্ব জাতি রাষ্ট্র গঠনের অধিকার পায়, এরই ফলে জন্ম হয় স্বাধীন ফিনল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া, ইউক্রেন, ট্রান্স ককেসিয়া এবং পোল্যান্ডের।

গ) আইনানুগ বিচার ব্যাবস্থার ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয় ন্যায় সম্পর্কিত সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (Socialist Sense of justice)-র উপরে। অর্থাৎ কেউ চুরি করলে তার বিচার করার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতায় সে চুরি করেছে তাও বিচার করার দায় স্বীকার করা হয়, বুর্জোয়া আইনের মতো চুরি মানেই শাস্তিযোগ্য জঘন্য অপরাধ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় না।

ঘ) সর্বজনীন শিক্ষাকে জনপ্রিয়করণ কর্মসূচী (Decree on Popular Education) – এরই ফলে রাশিয়ায় নিরক্ষর মানুষজন উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পান।

ঙ) লিঙ্গভেদ দূরীকরণের কর্মসূচী – মহিলাদের সমানাধিকার আইনি স্বীকৃতি পায়, তাদের উন্নত জীবনমানের লক্ষ্যে অনুপযুক্ত বিবাহ বন্ধন থেকে আইনানুগ বিচ্ছেদের ব্যাবস্থা করা হয়। সারা পৃথিবীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহিলারাই সর্বপ্রথম অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আইনি অধিকার পেয়েছিলেন এবং সবশেষে

চ) শ্রমিক অধিকার আইন (Decree on Workers) যার ফলে দেশের সম্পদ রক্ষিত হয়, শ্রমিকেরা বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক পরিবেশে কাজের সুযোগ লাভ করেন, শিল্পসংস্থাসমূহের নিয়ামক গোষ্ঠীতে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের আইনি সুযোগ পান – মে দিবসের দাবিসমুহের সফল রুপায়ন করে সোভিয়েত সরকার।

কমিউনিস্টরা কেমন সমাজ গড়তে চায়, শ্রমিক রাষ্ট্রের বাস্তব চেহারাটা ঠিক একমন হয় সেই সম্পর্কে যাবতীয় ধোঁয়াশা কাটিয়ে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই কাজের নেতা ছিলেন লেনিন।

২) ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সংগঠিত হবার আগে পার্টির মধ্যে বিপ্লবী পরিকল্পনা চুড়ান্ত করতে সভা হয়, লেনিন সেই সভায় প্রতিক্রিয়াশীল কেরেনস্কি সরকারকে উচ্ছেদ এবং বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন। লেনিনের মতের পক্ষে ভোট পড়ে দশটি, বিরুদ্ধে ভোট দেন লেনিনের দীর্ঘদিনের সাথী জিনোভিয়েভ (Grigory Yevseyevich Zinoviev) এবং কামেনেভ (Lev Borisovich Kamenev) বিপ্লবের সাফল্য সম্পর্কে তাদের সংশয় ক্রমশ তাদের পার্টি বিরোধী করে তোলে। পার্টিতে নিজেদের মতামত পরাজিত হলে বাজারি সংবাদ পত্রে বিপ্লবের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দেন দুজনে। তাদের সংশয়কে ভ্রান্ত প্রমান করেই রুশ বিপ্লব সফল হয়েছিল। বিপ্লব সফল হবার পরেও জিনোভিয়েভ এবং কামেনেভের জন্য শাস্তির বিধান দেন নি লেনিন, সোজাসুজি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। নিজে খাঁটি বিপ্লবী ছিলেন বলেই বুঝতেন বিপ্লবী সংগঠন মানুষ নিয়েই গড়ে ওঠে – আনন্দ, দুঃখ, ভয়ভীতি রহিত যন্ত্র দিয়ে নয়। মানুষের ভুল হয়, সেই ভুল শুধরে মানুষেরই জয়যাত্রা শুরু হয়। জিনোভিয়েভ এবং কামেনেভ দুজনেই সোভিয়েত সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

৩) রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের পূর্বে ট্রটস্কি লেনিনের লেখা একটি চিঠির খন্ডাংশ পড়ে শোনান। উদ্দেশ্য লেনিন পরবর্তী সময়ে স্তালিন যেন কিছুতেই পার্টিতে সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচিত না হন। ট্রটস্কির সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। স্তালিনকেই পার্টি কংগ্রেস থেকে পুনঃনির্বাচিত করা হয়, ট্রটস্কি নিজেও ভোট দেন। আজও পৃথিবীতে ট্রটকাইস্ট নামে পরিচিত বিচিত্রস্বভাব সমাজতন্ত্রীরা সেই চিঠিকে লেনিনের উইল (Testament) বলে প্রচার করে চলেছেন। এই প্রবন্ধের প্রসঙ্গ স্তালিন নন। কিন্তু প্রসঙ্গ হল কমিউনিস্ট পার্টি তো আর পাঁচটা বুর্জোয়া সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলের মতো না যেখানে কোন একজনের কথায় সবকিছু চলবে, লেনিন নিজেও সারাজীবন সেই নীতি মেনেই চলেছেন। তবে এমন একটি চিঠি তিনি লিখলেন কেন? ট্রটস্কিকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সুপারিশ করতে? নাকি স্তালিনের স্বরুপ প্রকাশ করে দিতে? এই প্রসঙ্গে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বই ছাপিয়ে মিথ্যার বেসাতি প্রচার করা হয়েছিল, আজও হয়। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে পার্টি কর্মী, সমর্থক এবং নতুন প্রজন্মকে গুলিয়ে দেওয়া যায়। আসলে লেনিন নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকেই এমন কাজ করেছিলেন। বুলেটের আঘাতে দীর্ঘ অসুস্থ শরীর, ঠিকমতো লিখতেও পারছেন না, বুঝতে পেরেছিলেন তার সময় ফুরিয়ে আসছে। পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত হতে পারলে পার্টি, পার্টি সংগঠন এবং ভবিষ্যতে পার্টির কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজের মুল্যায়ন সম্পর্কে যা কিছু বলতেন সেই কথাগুলিকেই লিখে পাঠিয়েছিলেন কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় কমিটির পরিসরে আলোচনার জন্য। এই লেখা কোন উইল নয়, লেনিনের উত্তরাধিকার অর্জন করতে হয় সংগ্রামের আগুনে পুড়ে – আইনের পাতায় লেখা কিছু ধারার বয়ানে সেই হিসাব বুঝে নেওয়া যায় না। ট্রটস্কি নিজের বহুবিধ যোগ্যতা সত্বেও সেই ভুল করেছিলেন, আমাদের সেই একই ভুল যেন দ্বিতীয়বার না হয়।

১৫৩ তম জন্মদিবসে লেনিন স্মরণ পৃথিবীতে এক নতুন ঐতিহাসিক পর্যায়। ভোগবাদে আচ্ছন্ন বেনিয়া সভ্যতার আক্রমনে শুধু মানুষের জীবন না, ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ – জীবজগত। মারণ ভাইরাস প্রানীদেহ থেকে বিপরীতমুখী চলনে মানুষকে সংক্রামিত করেছে। সংকট শুধুই জনস্বাস্থ্যের নয়। কাজ হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছেন, না খেতে পেয়ে মারা গেছেন, বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় পড়ে থেকেছে সারি সারি নিথর দেহ। সংক্রমন রোধে অতি প্রয়োজনীয় টীকা, ওষুধের কালোবাজারি হয়েছে, শক্তিশালী ধনতান্ত্রিক দেশগুলি নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত টীকার মজুত করেছে বাড়তি মুনাফায় বিক্রির আশায় – দগদগে চেহারায় স্পষ্ট হয়েছে পুঁজিবাদের অসারতা, অক্ষমতা। এর বিপরীতে গোটা পৃথিবী দেখেছে আরেক কর্মসূচি।

লড়াইয়ের, সংগ্রামের, জীবনের কর্মসূচি।

একজোট হওয়া মানুষ একে অন্যের দিকে হাতে বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই হাতে কখনো ধরা রয়েছে মাস্ক কিংবা স্যানিটাইজার, কখনো দুবেলার খাবার আবার কখনো বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী – সবটাই নিজেদের একতার জোরে।

এ হল সেই জোর যা সমাজ বদলের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে আজও।

রেলস্টেশনে নিথর মায়ের দেহ আঁকড়ে কাঁদতে থাকা শিশুর দু চোখ ভর্তি জল দেখেও চোয়াল শক্ত রাখা মানুষ সবশেষে মানুষের উপরেই ভরসা রেখেছেন, রাখছেন।

দুনিয়াজুড়ে পুঁজিবাদ যখন মানুষকে কিছুজনের সুখে থাকার বিনিময়ে বহুজনের দুর্দশার পক্ষে শর্তাধীন করে তুলতে চাইছে ঠিক তখনই মানুষ সোচ্চারে ঘোষণা করছেন ভরসাযোগ্য বিকল্প সম্ভব, বিকল্প আছে, তার লক্ষ্যে সংগ্রামও রয়েছে।

এই ভরসারই মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন লেনিন। 

নিপীড়িত, শোষিত জনসাধারনের সেই ভরসাকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়ার কাজকে যারা আজও নিজেদের একান্ত কর্তব্য বলে মনে করবেন কমরেড লেনিনের উত্তরাধিকার তাদেরই।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply