Marx and India Part II

Karl Marx and India: An Assessment

Karl Marx and India শিরোনামে ২০১৭ সালে মার্ক্সিস্ট পত্রিকার জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় অধ্যাপক ইরফান হাবিবের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। আজ কার্ল মার্কসের জন্মদিবসে সেই প্রবন্ধেরই সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ দুই পর্বে রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হল। ইরফান হাবিব তাঁর মূল প্রবন্ধে মার্কস-এঙ্গেলসের রচনাবলী (মস্কো অথবা লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজি বই) থেকে উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, সেই সকল উদ্ধৃতির বঙ্গানুবাদও অনুবাদকের।

দ্বিতীয় পর্ব

পুঁজিবাদের নিজস্ব বৈশিষ্টগুলিকে আরও বেশি করে স্পষ্ট করতে ভারতীয় সমাজ ও তার অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে এই সকল তথ্যই (১ম পর্বে উল্লিখিত) ব্যবহার করেছেন মার্কস। তবে এছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে যায়, যা হয়ত এখনও প্রাসঙ্গিক, তা হল ভারতের শোষণে ব্রিটেনের ভূমিকা। এই প্রসঙ্গে খুব বেশি তথ্য যোগাড় করতে না পারলেও ‘পূঁজির আদিম সঞ্চয়’ সম্পর্কে নিজস্ব তত্ত্ব ব্যখ্যায় মার্কস বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রেখেছিলেন। কমিউনিস্ট ইশতেহারে ‘পূঁজির আদিম সঞ্চয়’ প্রসঙ্গে সমকালীন রাজনৈতিক অর্থনীতি (পলিটিক্যাল ইকোনমি)-র পরিসরের বাইরে প্রায় কিছুরই উল্লেখ ছিল না। সেই ব্যখ্যার অর্থ, পুঁজিবাদ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে কেবলমাত্র বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের নিজস্ব সম্পদবৃদ্ধি এবং দেশে (এখানে দেশ বলতে ইংলন্ড বোঝানো হয়েছে) ও উপনিবেশগুলিতে ক্রমবর্ধমান বানিজ্যের কারণে।

পুঁজি-র (ক্যাপিটাল) প্রথম খণ্ডে অষ্টম ভাগের পঁচিশতম অধ্যায়ে পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ব্যখ্যায় ধ্রুপদী অর্থনীতির সেই দ্বিবিধ যুক্তিকেই রীতিমত অপমানজনকভাবে খণ্ডন করলেন মার্কস। অতিদ্রুত নিজেকে একটি বিশ্বব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পুঁজিবাদের উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত ছিল ক্রমবর্ধমান ‘পূঁজির আদিম সঞ্চয়’, এর পিছনে দুইপ্রকার জবরদস্তির ভূমিকা রয়েছে। প্রথমটি হল ইংলন্ডে জোরপূর্বক কৃষিজমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করা হল, তাদের গায়ের জোর খাটিয়ে সর্বহারায় (প্রলেতারিয়েত) রূপান্তরিত করা হল, তার সাথে যুক্ত হল অনেক আগেই চার্চের থেকে কেড়ে নেওয়া বিরাট পরিমানের জমি – যা বাড়তি পুঁজি হিসাবে ব্যবহারযোগ্য ব্যাক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। আদিম সঞ্চয়ের নির্মাণে এটাই ছিল অভ্যন্তরীণ কারন। দ্বিতীয়টি বাইরে থেকে শক্তি যুগিয়েছিল, ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে যার সুত্রপাত ঘটে। ঔপনিবেশিক বন্দোবস্তের ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে ইংলন্ডে সম্পদ আহরিত হতে থাকে। মার্কস উল্লেখ করেছেনঃ

“আমেরিকায় সোনা ও রুপা আবিষ্কৃত হওয়া, সেখানকার আদিবাসীদের প্রথমে উচ্ছেদ ও পরে দাসে পরিণত করার মাধ্যমে খনির অন্ধকারে সমাধিস্থ করে, ভারত ও পূর্ব-এশিয়াতে লুঠতরাজ চালিয়ে এবং কালো চামড়ার মানুষদের ব্যবসার পণ্যে পরিণত করতে আফ্রিকাকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই পুঁজিবাদের গোলাপবিছানো ঊষালগ্নের সুত্রপাত। পূঁজির আদিম সঞ্চয়ে প্রাণ সঞ্চারিত করতে প্রধান উপায়গুলি ছিল এমনই সব মনোরম প্রক্রিয়া”। (ক্যাপিটাল ১ম খন্ড, ডোনা টর সম্পাদিত, পৃষ্ঠা – ৭৩৬-৭৩৯)

ইংরেজরা ভারতে কি কি করেছে তার বর্ণনায় এর পরেও প্রায় গোটা একটি পাতা ব্যয় করেছেন মার্কস, উপনিবেশগুলিতে চলতে থাকা লুঠতরাজ প্রসঙ্গে নিজের সাধারণ মতামতকে বহুবিধ নির্দিষ্ট তথ্যের উদাহরণ সহ ফুটিয়ে তুলেছেন।

মার্কসের রচনায় পূঁজির আদিম সঞ্চয় প্রসঙ্গে সহায়ক বহিঃস্থ শর্ত হিসাবে নির্লজ্জ লুঠতরাজের বিষদ বিবরণ থাকা স্বত্বেও, ইউরোপীয় মার্কসবাদীরা ঔপনিবেশিক লুঠের বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দেন নি। সেই তুলনায় পুঁজি সঞ্চয়ের আদিম কৌশল ব্যখ্যায় মার্কস বর্ণিত অভ্যন্তরীণ কারণটিকেই তারা বড় করে দেখিয়েছেন। আমেরিকাতে স্প্যানিশদের লুঠতরাজ সম্পর্কে মার্কস যথেষ্টই অবহিত ছিলেন, তাই এটা আন্দাজ করলে খুব ভুল হবে না যে ১৮৫৩’র পর ভারত থেকে ব্রিটেনে লুঠ করে পাচার করা সম্পদের বিষয়টি তাঁর নজর এড়িয়ে যায় নি। সেই সময় মার্কসের বিভিন্ন লেখায় ব্রিটিশ অর্থনীতির কবলে থাকা ভারতে চলতে থাকা লুঠের কথা প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটেনের স্বৈরাচারী শাসনও তখন ভারতের বাজারকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসতে চাইছে। ১৮৫৯ সালে মার্কস স্পষ্ট করেই উল্লেখ করলেন ১৮৫৮ সাল নাগাদ চীনের সাথে ব্রিটেনের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি, যা তারা পুষিয়ে নিয়েছিল চীনে ৯ মিলিয়ন পাউন্ডের আফিম ও তুলার রপ্তানি মারফৎ। এই সম্পদের সবটাই উদ্বৃত্ত হিসাবে ভারত থেকে আহরিত করা হয়।

১৯৫৯ সালে মস্কো থেকে প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল‘ (৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ২৬৯-৭০) উল্লেখ রয়েছে ১৮৫৫ নাগাদ ভারত থেকে নজরানা বাবদ ব্রিটেনের আদায়ের পরিমাণ প্রায় ৫ মিলিয়ন পাউন্ড। এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় মরিস ডব যেমনটা ধরে নিয়েছিলেন, ইংলন্ডে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও পুঁজি সঞ্চয়ের আদিম পন্থাটি আদৌ বন্ধ হয় নি, তৎকালীন পুঁজিবাদী শাসনের অঙ্গ হিসাবেই তারা ধারাবাহিকভাবে সেই কৌশল প্রয়োগ করে চলেছিল। মার্কস আরও লিখেছেন, এহেন নজরানার পরিমাণ পরে আরও বেড়ে যায়। ১৮৮১ সালে ড্যানিয়েলসন’কে লেখা মার্কসের চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, “কৃতজ্ঞতা স্বরুপ ভারতীয়রা প্রতি বছর ইংলন্ডে বহুল পরিমানে সম্পদ পাঠিয়েই চলেছে – সেদেশে কৃষিকাজ ও শিল্পগুলিতে খেটে চলা ষাট মিলিয়ন মজদুরদের মোট রোজগারের থেকেও সেই নজরানার পরিমাণ বেশি”।

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
কার্ল কাউটস্কি

এবার আমরা মার্কস-এঙ্গেলসের এক বিশেষ চিন্তার প্রসঙ্গে উপনীত হতে পারি, তাঁরা দুজনেই ভারতের বুকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধী সম্ভাব্য এক বিদ্রোহের কথা ভেবেছিলেন। তাঁদের মনে হয়েছিল এহেন বিদ্রোহের প্রতি ইউরোপের সোশ্যালিস্ট শক্তিগুলির পক্ষ থেকে সমর্থন জানানো প্রয়োজন। ১৮৫৩ সালেই মার্কস মনে করেছিলেন, “হিন্দুরা নিজেরাই একদিন না একদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে একেবারে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে যথেষ্ট সক্ষম হয়ে উঠবে”। পরে সেই পরিকল্পনার বিকল্প হিসাবে তাঁর মতামত, ব্রিটেনে শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত সর্বহারা শ্রেণীর দ্বারা ইংরেজ বুর্জোয়াশ্রেণীর উচ্ছেদ ঘটবে, যা একইসাথে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি ঘটাবে। ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী এহেন সংগ্রাম তখনকার ভারতে কেবলমাত্র তখনই সম্ভব হত যদি আমাদের দেশের অন্যান্য শ্রেণিগুলিও স্বাধীনতার লড়াইতে নিজেদের সংগঠিত করে তুলত, ভারতীয় সর্বহারা শ্রেণি তখনও একা লড়াই চালাতে যথোপযুক্তরুপে শক্তিশালী ছিল না। ১৮৫৭’এ ভারতে বিদ্রোহ শুরু হলে, মার্কস চিহ্নিত করলেন এই বিদ্রোহের সুত্রপাত ঘটেছে সেনাবাহিনীতে কর্মরত সিপাইদের পক্ষ থেকে, যদিও কৃষক সহ জমিদারেরাও ক্রমশই সংগ্রামে যুক্ত হচ্ছে। দ্বিধাহীনভাবে মার্কস এই বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ এবং ‘বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছিলেন। অনেক পরে ১৮৮২ নাগাদ ড্যানিয়েলসন’কে লেখা চিঠিতে তিনি গভীর আশার সাথে জানাচ্ছেন, ‘যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন, ভারতে হিন্দু এবং মুসলমানেরা একে অন্যকে সহযোগিতা করছে’। ঐ সময় নিজের সতীর্থের মতো ফ্রেডরিক এঙ্গেলসও কাউটস্কি’কে চিঠিতে লিখেছিলেন (১২সেপ্টেম্বর, ১৮৮২)

“যতদূর সম্ভাবনার বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ভারতে এক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু হতে চলেছে। ইউরোপীয় সর্বহারা শ্রেণি যেভাবে উঠে আসছে তাতে এখনই তাদের পক্ষে ঔপনিবেশিক শাসন বিরোধী কোন যুদ্ধ সংগঠিত করা সম্ভব নয়, আর তাই ভারতের মতো দেশে এহেন বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ সুযোগ দিতেই হবে। আসন্ন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অনেককিছুই ধ্বংস হবে, কিন্তু বিপ্লবের পথে সেইসব ধংস্বকে এড়িয়ে গিয়ে সামনে এগোনো যায় না”। মার্কসবাদের রচয়িতাদ্বয় সমবেত শ্রেণিসমূহের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আলোকেই ভারতে উপনিবেশবাদ বিরোধী সংগ্রামকে পর্যালোচনা করেছিলেন। ভারতে ইংরেজ শাসন গোটা দেশকেই নিপীড়ন করেছে-শোষণ করেছে, এই ছিল মার্কস-এঙ্গেলসের অমন অবস্থানের পিছনে যুক্তি। জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে তাঁরা দুজনেই নিজেদের মতামতের পক্ষে আরও বেশি তথ্য-প্রমান পেয়েছিলেন, সেই উপলব্ধি তাঁদের দুজনকেই ঋদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতার সংগ্রামে দেশের অভ্যন্তরে কার্যকরী শক্তিসমুহের সাফল্য পুনর্বিবেচনা করার কাজে এই সত্যকে অগ্রাহ্য করা আমাদের পক্ষেও সম্ভব হবে না।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে ভাষান্তর করেছেন সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply