ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৭)
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি হিন্দু পুনরুত্থান বাদের চিন্তা-চেতনাকে আপ্তবাক্য হিসেবে ধরে নিয়ে যে কর্মকাণ্ড একাংশের মানুষ চালাচ্ছিলেন বাংলায় ,তার ব্যাপ্তি এক ধরনের ঘটেছিল বাংলার বাইরে উত্তর ভারত ,বিশেষ করে অবিভক্ত পাঞ্জাবে, তার ব্যাপ্তি আর একরকম ভাবে ঘটেছিল। হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা যে বোধের উপর দাঁড়িয়ে তাঁদের নেতিবাচক চিন্তা-চেতনাকে উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করছিলেন, যেটি পরবর্তীকালে আরএসএস বা তার সঙ্গী সাথীরা তাদের আদর্শগত ভিত্তি হিসেবে মিলে ধরে, এবং সেটিকে একটি রাজনৈতিক দ্যোতনা দিতে চেষ্টা করে ,বাংলায় সেই চিন্তা চেতনার একদম প্রাথমিক পর্যায়ে, সেই ধরনের ভাবনার যাঁরা প্রচারক ,তাঁদের সঙ্গে কিন্তু ব্যবসা জগতের কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না ।
বাংলায় হিন্দু পুনরুত্থানবাদী চিন্তা-চেতনাকে যাঁরা প্রসারিত করবার চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের সেই চেষ্টার পেছনে কোনোরকম ব্যবসায়ী মহল নিজেদের কায়েমি স্বার্থ সিদ্ধির তাগিদে, তাঁদেরকে উৎসাহিত করার জন্য একটা বিনিয়োগ হিসেবে ,গোটা ব্যাপারটিকে দেখেছিলেন –এমনটা কিন্তু ঘটেনি। অপরপক্ষে ব্যবসায়ী মহলের হিন্দু পুনরুত্থানবাদ কে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহারের দৃষ্টান্তটি কিন্তু আমরা পাই অবিভক্ত পাঞ্জাব ,উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশে ।
হিন্দু পুনরুত্থানবাদের যাঁরা সমর্থক ছিলেন বাংলায় ,তাঁরা বিশেষ করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ভেতর দিয়ে একটা আক্রমণাত্মক প্রচার করতে শুরু করেন। এই প্রচার কাজটি কিন্তু বাংলার বাইরেও, অবিভক্ত পাঞ্জাব ,উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশে ঘটেছিল ( লালা লাজপত রাইয়ের ‘ ট্রিবিউন ‘ পত্রিকা এই কাজে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল পরবর্তীতে) বাংলার বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ে তখন ‘ভারতবর্ষীয় আর্য ধর্ম প্রচারিণী সভা’ সহ নতুন বেশ কিছু সংগঠন তৈরি হয় ।যেগুলি প্রাচীন ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনার সমন্বয়ে দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার-প্রসারের প্রেক্ষিত গুলিকে একটা কৌণিক অবস্থানে দেখে ,আজ যে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক অভিধারার সংযুক্তি ঘটানো হচ্ছে, ঠিক তেমন আঙ্গিকেই , প্রাচীন ভারতবর্ষের যাবতীয় ঐতিহ্য কে, একটি বিদ্বেষমূলক ভাবনার আঁতুড়ঘর হিসেবে কৌশলে দেখিয়ে ,হিন্দু ধর্মের নিজেদের মনগড়া একটা গৌরবের ভূমিকা উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করছিল।
বেদ , তন্ত্র এবং পুরানকে আর্য ধর্মের পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে মেলে ধরাই ছিল এই পুনরুত্থানবাদীদের সবথেকে বড় কাজ ।এই পর্যায়ের টিকে ব্যবহার করবার স্বার্থে পরবর্তীকালে আরএসএস নানাভাবে হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের বিভিন্ন প্রেক্ষিত কে নগ্নভাবে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। বাংলার হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা যে আঙ্গিকে তাদের কর্ম ধারা প্রবাহিত করেছিলেন ,তার সঙ্গে উত্তর ভারতের কর্মধারার বিস্তর ফারাক ছিল।
আরএসএস কিন্তু এই ফারাক টিকে একটিবারের জন্যও না দেখিয়ে ,গোটা পুনরুত্থানবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি একমাত্রিক, পরধর্ম বিদ্বেষী ,পরধর্ম অসহিষ্ণু, পরমত অসহিষ্ণু রাজনৈতিক হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গির উপর স্থাপিত করে তুলে ধরে ,প্রাচীন ভারতের বহুত্ববাদী চেতনাকে কার্যত চেপে দিয়ে, প্রাচীন ভারত কে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের চিন্তা-চেতনার ভিত্তিভূমি– এটা দেখাবার চেষ্টা করে গেছে।
এই চেষ্টাতে তারা সব থেকে বেশি ব্যবহার করেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর রচিত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ ‘ কে। এই উপন্যাসে সংযোজিত বঙ্কিমের অমর সৃষ্টি ‘বন্দেমাতরম’ স্ত্রোত্রটিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চরমপন্থী ধারার নেতা কর্মীদের ঘিরে এক ধরনের আবেগ ছিল। সেই আবেগেথ মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিন্দু পুনর্জাগরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না — এই কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু সেই আবেগ ,পুনর্জাগরণ বাদের চিন্তাধারার সবকিছুর মূলে ছিল– কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ও ছিল। ঘোরতর ব্রিটিশ বিদ্বেষ সেখানে ছিল।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কে দেশ থেকে বিতাড়িত করবার আত্মনিবেদিত প্রেরণা ছিল সেখানে।
আরএসএস বা তার রাজনৈতিক সঙ্গী-সাথীরা একটিবারের জন্যও ব্রিটিশবিরোধী ন্যূনতম কোনো অবস্থান না নিয়েই , ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম বিরোধিতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় না দিয়েই, স্বাধীনতার আগে এই বন্দেমাতরম কে, তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ,যে স্বার্থ টিকে তারা একটা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মোরক দিয়ে মানুষের কাছে উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করে গেছে, সে ভাবেই ব্যাবহার করে গেছে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মুখোশ পড়ে সাম্প্রদায়িকতাকে ভারতবর্ষের সমাজজীবনে স্থায়ী করে ,ভারতবর্ষের চিরকালীন বহুত্ববাদী দর্শন কে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে, রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে ভারতবর্ষের সার্বিক প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত করবার আরএসএস এবং তার সঙ্গী সাথীদের এই যে ঘোরতর কায়েমি স্বার্থ,সেইস্বার্থ ,সেটিকে কিন্তু প্রচার প্রসার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার আগেও যেভাবে বঙ্কিমচন্দ্র বা তাঁর সমসাময়িকতা কে ব্যবহার করা হতো, স্বাধীনতার পরে ঠিক একইভাবে বঙ্কিমচন্দ্র বা তাঁর সমসাময়িকতা কে ব্যবহার করা হয় ।
বঙ্কিম কে এইভাবে ব্যবহারের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত আমরা দেখলাম ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচার করতে এসে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন অংশে প্রচারে অংশ গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদি তাঁর অভ্যস্ত নাটকীয় ভঙ্গিমায় বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর বন্দেমাতরম স্রোত্রটি কে সংকীর্ণ রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক ,মৌলবাদী, সন্ত্রাসী দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবহার করলেন। বস্তুত বঙ্কিমের এই মাতৃবন্দনা টিকে নরেন্দ্র মোদি গত লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে যেভাবে ব্যবহার করলেন ,তাতে ভারতবর্ষের চিরন্তন বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বুকে এক অর্থে ছুরি বসানোর কাজটিকে তিনি আরো সূচারুরূপে সম্পাদন করে গেলেন।
মজার কথা হল ; বঙ্কিম কিন্তু এই বন্দেমাতরম স্ত্রোত্রটি রচনা করেছিলেন ১৯৭৫ সালে ।সেটিকে তিনি সেই বছর তাঁর সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় একটি পৃষ্ঠায় ফাঁকা জায়গা ভরাট করার লক্ষ্যে পাদপুরাণ হিসেবে ছেপেছিলেন ।অনেকেই অনুমান করেন যে ; বঙ্গদর্শনের ফাঁকা পাতার অংশটিকে ভরাট করার লক্ষ্যে বঙ্কিম ওই বন্দেমাতরম স্ত্রোত্রটি কে রচনা করেছিলেন ।সেটি পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৮২ সালে তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসের সংযোজিত করেন। এই স্ত্রোত্রটি কিন্তু’ আনন্দমঠ ‘ উপন্যাসের সংযোজিত হওয়ার পরও ভারতীয় জনসমাজে ততখানি ব্যপ্তা লাভ করেনি। রবীন্দ্রনাথ জাতীয় কংগ্রেসের ১৮৯৬ সালের অধিবেশন উপলক্ষে ,এই স্ত্রোত্রটি তে সুরারোপ করে প্রথম সেটিকে পরিবেশন করেছিলেন। তারপর থেকে এই গানটি জাতীয় আন্দোলনের চরমপন্থী ও নরমপন্থী দুই ধারার অভিব্যক্তিতে একটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিল।
আচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার খুব যথার্থভাবেই বলেছিলেন; ফরাসি বিপ্লবের,’ লা মার্সেলিশ ‘ গানটি যেভাবে গোটা ফরাসি জাতিকে আন্দোলিত করেছিল ,বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানটি ও কিন্তু সেভাবেই গোটা ভারতবর্ষের জনগণকে আপ্লুত করেছিল, আবেগায়িত করেছিল, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এই রকম একটি গান গোটা দেশবাসীকে, তার জাতীয় সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার প্রশ্নে ফরাসি বিপ্লবের সময় কালে লা মার্সেলিজ ব্যতীত আর কোনো দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আচার্য সুকুমার সেন অনুমান করেছিলেন ; ‘ মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পরিত্যক্ত ‘ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র কে উদ্দেশ্য করে। ১৮৮৮ সালের, অর্থাৎ; ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ২৮ শে জ্যৈষ্ঠ এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন;
” তোমরা আনিময়া প্রাণের প্রবাহ / ভেঙিছ মাটির আল ,/তোমরা আবার আনিছ বঙ্গে/ উজান স্রোতের কাল ।/নিজের জীবনে মিশায়ে যাহারে/ আপনি তুলেছ গড়ি/ হাসিয়া হাসিয়া আজিকে তাহারে / ভাঙিছ কেমন করি তবে সেই ভালো কাজ নেই তবে তবে!/ তবে সেই ভালো, কাছ নেই তবে/তবে –/ গৃহকোণে এই জীবন আবেগ /করি বসে পরিপাক !/সানাই বাজিয়ে ঘরে নিয়ে আসি /আট বরষের বধু,/ শৈশব কুঁড়ি ছিঁড়িয়া বাহির /করি যৌবন মধু !/ফুটন্ত নবজীবনের প’রে/ চাপায় শাস্ত্রভার/জীর্ণযুখের ধূলিসাথে তারে /করে দিই একাকার !”—
এই কবিতার শেষ অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ;
” ভয় নাই যার কি করবে তার
এই প্রতিকূল স্রোতে! তোমারি শিক্ষা করিবে রক্ষা
তোমারি বাক্য হতে ।”
বঙ্কিম কে ঘিরে উনিশ শতকের শেষভাগ বা বিশ শতকের সূচনাপর্বে জাতীয় আন্দোলনের দুটি ধারাতেই যে আলোড়ন এবং পরবর্তীকালে সেই পর্যায়ক্রম থেকে একটি কৌণিক সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা সঙ্গে বঙ্কিমকে একাত্ম করে দেওয়ার উপক্রম আরএসএস তার জন্মলগ্ন থেকেই করেছে । বর্তমান সময়ে তারা এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি করে এই প্রক্রিয়াটি আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিত টির একটি নির্মোহ আলোচনা আমাদের করা দরকার ,কারণ; বঙ্কিমের সমসাময়িক কালকে আলোচনা করতে গেলে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ,উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রভাবে মহর্ষি ডিরোজিওর কে কেন্দ্র করে যে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল, তাঁদের প্রচার-প্রসার আমাদের চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে যে বিজ্ঞানমুখী আধুনিক ধারার স্রোতকে সঞ্চারিত করেছিল এবং সেই স্রোতকে বিপথে পরিচালনা করার লক্ষ্যে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতবর্ষের সার্বিক সংস্কৃতির সামাজিক ধর্মীয় পরিবেশকে দেখতে যারা অভ্যস্ত ছিলেন, তাদের যে কার্যক্রম, তাকে কেন্দ্র করে যে পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে ভারতবর্ষের বুকে গেঁথে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আরএসএস তার জন্মলগ্ন থেকে সেই গোটা প্রেক্ষিত কে কিন্তু একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা হিসেবে ব্যবহার করে তাকে সামাজিক পটভূমিকায় পর্যবসিত করবার জন্য সব রকমের চেষ্টা অতীতেও করেছে ,বর্তমানে করে চলেছে ।
ডিরোজিওর যে আদর্শ ,সেই আদর্শ থেকে কিন্তু যাঁরা ডিরোজিয়ান নামে খ্যাত ছিলেন, সেই সমস্ত ব্যক্তিত্বেরা, যেমন ;তারাচাঁদ চক্রবর্তী, দক্ষিণা রঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র,রসিক কৃষ্ণ মল্লিক , রামগোপাল ঘোষ , দিগম্বর মিত্রেরা তাঁদের পরিণত বয়সে অনেকখানি সরে গিয়েছিলেন। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে ‘ জাতীয় সভা’ র উদ্যোগে হিন্দুমেলার সপ্তম অধিবেশনে রাজনারায়ণ বসুর হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা বিষয়ক বক্তৃতা কে ঘিরে ব্রাহ্মসমাজের ভেতর যে আভ্যন্তরীণ বিরোধ, অর্থাৎ ;ব্রাহ্ম বিবাহ আইন কে ঘিরে যে বিতর্ক রয়েছে ,সেই বিতর্কটি সর্বাংশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল ।কিন্তু রাজনৈতিক হিন্দুরা কিন্তু রাজনারায়ণ বসুর এই অবস্থানটিকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতার একটি পরিচায়ক হিসেবে চিরদিন দেখে এসেছে।
‘ সনাতন ধর্ম রক্ষিণী সভা’ র পক্ষ থেকে সংগঠনের সভাপতি কালীকৃষ্ণ দেব রাজনারায়ণ বসু বর্ণনা করেছিলেন এই সময়কালে র ,’ হিন্দুকুলশিরোমণি’ হিশেবে।অনেকেই রাজনারায়ণ বসু কে ,’ কলির ব্যাস ‘ বলে পর্যন্ত সম্বোধন করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এঁরা কেউ ই একটিবারের জন্য এটি উল্লেখ করেন নি যে, রাজনারায়ণ বসু ব্রাহ্মধর্মের অভ্যন্তরীণ বিরোধ, বিশেষ করে ব্রাহ্ম বিবাহ আইন কে ঘিরে যে বিতর্ক ,তার প্রেক্ষিতে তাঁদের সংগঠনের নিজস্ব গোলমাল কে কার্যত প্রকাশ্যে নিয়ে এসে, যেভাবে হিন্দু ধর্মের জয় গান গেয়েছিলেন, সেই ভাষণের শেষ অংশে তিনি বলেছিলেন ;
” আমি দেখিতেছি আমার সম্মুখে মহাবল-পরাক্রান্ত হিন্দু জাতিনিদ্রা হইতে উত্থিত হইয়া বীরকুন্ডল পুনরায় স্পন্দিত করিতেছে এবং দেববিক্রমে উন্নতির পথে ধাবিত হইতে প্রবৃত্ত হইতেছে। আমি দেখিতেছি যে এই জাতি পুনরায় নবযৌবনান্বিত হইয়া পুনরায় জ্ঞান ধর্ম ও সভ্যতাতে উজ্জ্বল হইয়া পৃথিবী কে সুশোভিত করিতেছে; হিন্দুজাতির কীর্তি ,হিন্দু জাতির গরিমা, পৃথিবীময় পুনরায় বিস্তারিত হইতেছে।”
১৮৬৬ সালে কিন্তু রাজনারায়ণ বসু ‘ জাতীয় গৌরবেচ্ছা সম্পাদনী সভা ‘ র যে অনুষ্ঠান পত্র প্রচার করেছিলেন এবং সেই প্রচারের প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা হিসেবে কিন্তু ১৮৬৭ সালে নবগোপাল মিত্র যে জাতীয় মেলা র প্রবর্তন করেন , সেই জাতীয় মেলা , যাকে ‘হিন্দুমেলা’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে, এই মেলার সম্পাদক হিসেবে ১৮৬৮ সালে সংগঠনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সম্পাদক হিসেবে গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মেলাটির উদ্দেশ্য হিসেবে বলেছিলেন ;
” এই মেলার প্রথম উদ্দেশ্য, বৎসর শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা ।যত লোকের জনতা হয় ততই ইহা হিন্দু মেলা ও ইহা হিন্দু দিগের ই জনতা এই মনে করিয়া আনন্দিত ও স্বদেশানুরাগ বর্ধিত হইতে থাকে ।”
সংশ্লিষ্ট অধিবেশনই মনমোহন বসু বলেছিলেন;
” সমাজে যতদূর বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে ।এই দুরবস্থা চাক্ষুষ করিয়া কোন চিন্তাশীল হিন্দু থাকতে পারে? কোন্ সুশিক্ষিত স্বদেশবৎসল মন প্রতিবিধানের অগ্রসর না হইয়া স্বীয় ধর্ম প্রবৃত্তির উত্তেজনা ও ধিক্কারে বধির থাকিতে পারে ?যে সকল মহাশয়গণের এরূপ উন্নত মন ,যে সকল হিন্দু কুলোদ্ভব মহাত্মাগণ এইরূপ চিন্তাশীল , তাঁহারাই এই ‘ চৈত্র মেলা’ নামা হিন্দুসমাজ বন্ধনের অদ্বিতীয় উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন।”
আরএসএস তার জন্মলগ্ন থেকে হিন্দুত্বকে যেভাবে ভারতবর্ষের প্রচলিত সামাজিক রীতি নীতির সঙ্গে একাত্ম করে দেখে গোটা বিষয়টিকে একটি ক্ষমতা দখলের রাজনীতি অভিপ্সা তে পরিণত করেছে, হিন্দুমেলার চিন্তা চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত যে হিন্দু ভাব, বা হিন্দুত্বের ধারণা ,তার সাথে সেই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অভিযোগ অবস্থাতে কিন্তু ছিল না।
হিন্দু ভাবের সাথে জাতীয় ভাবকে সংমিশ্রিত করে দেওয়ার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে কিন্তু হিন্দুমেলার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে প্রথম থেকেই সম্পৃক্তি ছিল। হিন্দু মেলার কর্মকর্তা ,কর্মী-সমর্থক এবং দর্শকদের ভেতরে যে রাজনৈতিক চেতনা ছিল ,সেই চেতনা কিন্তু সার্বিকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের মানুষদের জাগরিত করবার একটি লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত হয়েছিল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সম্যক ভারতবর্ষে কে জাগরিত করবার চেতনার ভেতর হিন্দু ব্যতীত ভারতবর্ষে অবস্থানরত মুসলমান সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের সেই কর্মকাণ্ডে উদারভাবে আহ্বান জানানো হয়নি ।এটি সেই গোটা প্রেক্ষাপটের একটি সীমাবদ্ধতা এবং অবশ্যই একটি অতি উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক দিক হলেও, আরএসএস যেভাবে হিন্দু চেতনাকে, জাতীয় চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে , একটি মুসলমান বিদ্বেষী ধারাতে সেটিকে পর্যবসিত করে ,হিন্দু মেলার কর্মকর্তা, যাঁদের অনেকের সাথেই হিন্দু পুনরুত্থান বাদে চিন্তাচেতনার ও একটা সম্পৃক্ত থাকার ইতিহাস আমরা পাই ,তাঁদের চিন্তা-চেতনায় কিন্তু ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস ,অতীতের উজ্জ্বল পুনরুদ্ধার– সবকিছুর সঙ্গে হিন্দু সংমিশ্রণ থাকলেও , আরএসএস পরবর্তীকালে এই হিন্দু সংমিশ্রণ কে যেভাবে তীব্র মুসলমানের বিদ্বেষে পরিণত করেছে , তেমন রাজনৈতিক দুরাচার সম্পন্ন চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ,মানসিকতা– কোনোটাই কিন্তু ছিল না ।
এ প্রসঙ্গে ১৮৭২ সালে জাতীয় সভার কার্যবিবরণী তে দিগম্বর মিত্রের যে প্রতিবাদ ,তার দিকে আমরা একটু নজর দিতে পারি।
দিগম্বর মিত্রের অভিমত সম্পর্কে জাতীয় সভার কার্যবিবরণীতে লেখা হচ্ছে;
” He opposed the proposal of the Government , to abolish the customs of Antarjali and Gangajatra on the ground that social evils should be removed in education and enlightenment , and not by the hand of law’.
এই পর্যায়ে একটি ঘটনা কিন্তু বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় যে; সতীদাহ প্রথা বন্ধে জোরদার সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া রাজা রামমোহন রায় ও হিন্দু সমাজের সামাজিক রীতি নীতি বিদেশি শাসকেরা আইন করে নির্ধারণ করে দিক– এটা চান নি।তিনি ও চেয়েছিলেন; হিন্দু সমাজের ভিতর থেকেই সামাজিক আন্দোলন তৈরি হোক।সেই সামাজিক আন্দোলনের চাপেই সতীদাহের মতো কুপ্রথার অবলুপ্তি ঘটুক।স্যার হাইড ইস্টকে লেখা এক চিঠিতে রামমোহন তাঁর এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন ।অধ্যাপক দিলীপ বিশ্বাস তাঁর ‘ রামমোহণ সমীক্ষা’ তে সংশ্লিষ্ট চিঠিটি উল্লেখ করে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
ধারাবাহিক লেখাগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ www.cpimwb.org.in
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৬)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৫)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৪)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১৩)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১২)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১১)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব – ১০)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পর্ব- ৯)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (অষ্টম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (ষষ্ঠ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (পঞ্চম পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (চতুর্থ পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (তৃতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (দ্বিতীয় পর্ব)
ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (প্রথম পর্ব)