যন্ত্রণার দু’ বছর, ধ্বংসের দু’ বছর
বিগত দুই বছর, যবে থেকে মোদী সরকার পুননির্বাচিত হয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছে, ভারতকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের চিরকালীন পরিকল্পনা মোতাবেক একটি চূড়ান্ত অসহিষ্ণু, ধর্মবাদী, ফ্যাসিস্তসুলভ “হিন্দু রাষ্ট্র” গঠনের কাজ, যা কিনা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে শুরু করা হয়েছিল’, তাকে পুনরুদ্যমে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। ১৯২৫ সালে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই এটি তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। সাভারকারের দ্বারা “হিন্দুত্ব” শব্দটির উদ্ভাবনার সাথে সাথে যে রাজনৈতিক পরিযোজনার জন্ম হয়, তা হিন্দু ধর্মের সাথে অসম্পৃক্ত এক মতাদর্শ এবং সেই মতাদর্শের ভিত্তিতে যে সাংগঠনিক কাঠামো গোলওয়ালকর নির্মাণ করেন ১৯৩৯ সালে, তা এ দেশের সংবিধানের ওপর বর্তমানকালের এই আক্রমণের ভিত্তি রচনা করে, যে সংবিধান সঙ্ঘের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত এক দলিল। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক সংবিধানের ধ্বংসসাধনের এই প্রক্রিয়া আরো উন্মত্ত গতি লাভ করেছে ২০১৯ এর নির্বাচনের পর থেকে।
অতিমারির বীভৎসা
এই অতিমারির একদম শুরু থেকেই, যা কিনা এ দেশে ২০২০ সালের জানুয়ারি নাগাদ প্রথম দেখা যায়, মোদি সরকারের তরফ থেকে এর সুষ্ঠুভাবে মোকাবিলা করা এবং মানুষের প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তাগিদটা কম লক্ষ্য করা যায় এবং অধিকতর উৎসাহ দেখা যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের রাজনৈতিক পরিকল্পনা রূপায়ণের ক্ষেত্রে।
দেশের সাধারণ মানুষকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। গোটা একটা বছর সময়কাল ধরে আমদের পার্টি এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলির তোলা দাবি বা অনুরোধ করা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকারের তরফে নেওয়া তো হয়নিই, উলটে সরকারের তরফে সেসবের প্রতি চরম ঔদাসিন্য লক্ষ্য করা গেছে।স্বাস্থ্য ক্ষেত্রকে প্রস্তুত রাখা, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষামূলক উপকরণের যোগাড়, হাসপাতালের স্থান সংকুলানের জন্য আরো বেশি ব্যবস্থাপনা, বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা (স্পেনের সরকার সে দেশের যাবতীয় বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে সাময়িক ভাবে জাতীয়করণ করেছে, তা দেখিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও); অক্সিজেনের ব্যবস্থা রাখা এবং সর্বোপরি যে সকল টিকার উদ্ভাবন ঘটছিল’ সে সময়, তা আগে থেকেই ‘বুক’ করে রাখা, এসবে কোনো রকমের সরকারি উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি, যা কিনা পরবর্তী সময়ে সরকারি ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হয়।
আকস্মিক ও অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ভারতের অর্থনীতি, যা কিনা এমনিতেই মন্দার দিকে এগোচ্ছিল এই অতিমারির আগে থেকেই, প্রায় ধ্বংসের দিকে চলে যায়। কয়েক কোটি মানুষ তাদের কাজ হারান। ক্ষুধার নিবৃত্তি হওয়া ক্রমশ কমতে থাকে, অথচ প্রত্যক্ষ নগদ টাকা প্রদান বা বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের বন্টনের কোনো সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হল’ না।
পরিযায়ি শ্রমিকদের দলে দলে তাদের কর্মস্থল (মূলতঃ ম্যানুফাকচারিং শিল্প) ছেড়ে দিয়ে তাদের নিজেদের বাড়ির পথে যাত্রা, যা কিনা দেশভাগের সময় বাস্তুচ্যুত মানুষের ঢলের কথা মনে করায়, তাদের যাত্রা সুগম করার জন্য কোনো রকমের রেল বা সড়কপথে পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়না। স্বাভাবিকভাবেই এই অব্যবস্থার কারণে করোনা আরো বেশি করে ছড়িয়ে পরে, সাথে সাথে এই সকল গরিব শ্রমিক, যারা কিনা এ দেশের ম্যানুফাকচারিং শিল্পের মেরুদন্ড, ও তাদের পরিবারের ওপর যে অবর্ণনীয় দুর্গতি নামিয়ে আনে এবং জীবনহানী ঘটায়, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আগাম সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও মোদি কোরোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের ঘোষণা করে দিলেন।সাথে সাথে নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ প্রতিপন্ন করার মরিয়া প্রয়াসে তিনি যথেষ্ট আত্মশ্লাঘার সাথে ঘোষণা করে দিলেন যে ভারতবর্ষ নাকি গোটা মানবজাতি কে বাঁচানোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে করোনার টিকা উৎপাদনের মাধ্যমে।
এরই মধ্যে কুম্ভেমেলার অনুমোদন মঞ্জুর করা হলো।আগামী বছরে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন কে মাথায় রেখেই নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই এই মেলা অনুষ্ঠিত করা হল’ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে ভোট পাওয়ার অভিলাষে। বিরাটাকার সমস্ত নির্বাচনী জমায়েত অনুষ্টিত হল’ প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর উপস্থিতিতে, সকল কোভিড সংক্রান্ত নিয়মাবলীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। এই সকল সিদ্ধান্তরই ভয়াবহ পরিণতি দেখা গেল’। এর ফলে এই জীবানুর গোষ্ঠী সংক্রমণের হার অতি দ্রুত বেড়ে গেল’।সংক্রমণের হার এবং মৃতের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বাড়তে থাকল’ এবং এর সাথে যুক্ত হল’ টিকার অপ্রতুলতা।
অতিমারির এই দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহভাবে শুরু হতে না হতেই মোদি সরকার তাদের যাবতীয় দায় ঝেড়ে ফেলে, রাজ্য সরকারগুলির ওপর এই দায় চাপানোর চেষ্টা করে কোনো রকম আর্থিক প্যাকেজের ব্যবস্থা না করেই এবং সাধারণ মানুষের বিধিনিষেধ মানার ক্ষেত্রে অপারগতা বা দুর্বলতা কেই দায়ী করে। এর নিটফল দাঁড়ায় অক্সিজেনের অভাবে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে বহু মানুষের মৃত্যু, জীবনদায়ী ওষুধ, ভেন্টিলেটরের অপ্রতুলতা এবং হাসপাতালে মারাত্মক স্থানাভাব।
এ মুহূর্তে গোটা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ দৈনিক মৃত্যুর এবং সংক্রমণের সংখ্যায় ভারত এক নম্বরে। মোদি সরকারের তরফে কোভিড পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতারই পরিচায়ক এটি। এই সরকার না বাঁচাতে পেরেছ মানুষের জীবনকে, না পেরেছে মৃত্যুর পর মানুষের জন্য কোনো রকম সম্মানজনক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থাটুকুও করতে। মানুষের শবদেহ গঙ্গা এবং অন্যান্য নদীতে ভাসতে থাকার বীভৎস দৃশ্য এবং বহু শবদেহ একত্রিত করে গণসৎকার করা এই সরকারের দায়িত্বে এ দেশে মৃত্যুর প্রলয়নৃত্যের প্রমাণ বহন করছে।
আজ অবধি সরকারের তরফে সকল সম্ভাব্য জায়গা থেকে টীকা যোগাড় করে বিনামূল্যে দেশের সকল মানুষের জন্য টীকারণের ব্যবস্থা করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বাস্তবে এ কাজ কখনোই করা হবে না যতক্ষণ না এ দেশের মানুষ এই সরকারকে বাধ্য করতে পারে গণটীকাকরণের কর্মসূচীকে গ্রহণ করতে আর তার সাথে সাথে নগদ অর্থ প্রদান এবং খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে মানুষের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করতে।
সংবিধানের ধ্বংসসাধন
মোদি সরকারের এই দ্বিতীয় ইনিংস শুরুই করা হয় সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা, যা কিনা জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রক্ষা করে চলেছিল’, তাকে বাতিল করে দেওয়ার মাধ্যমে; যার ফলে জম্মু কাশ্মীর স্রেফ এক কলমের খোঁচায় রাজ্য হিসাবে তার মর্যাদা হারায় এবং সেনাবাহিনীর দখলীকৃত এক অঞ্চলে পরিণত হয়। সাথে সাথে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় সমস্ত মাধ্যমকে ছিন্ন করা হয় এবং দৈনন্দিন জীবনযাপন কে বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়। এই পদক্ষেপের দু বছর পরেও কাশ্মীরের পরিস্থিতি এবং সেখানকার মানুষের জীবন স্বাভাবিক হয়নি। এই গোটা প্রক্রিয়াটি যে চোরাপথে ঘটানো হল’ তা সংবিধান এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার এক নির্লজ্জ অবমাননা।
এর পরেই নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী আনা হল’ যা কিনা আমাদের সংবিধানের আরেক নির্লজ্জ অবমাননা। এই প্রথমবার এ দেশের নাগরিকত্ব কে ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে জুড়ে দেওয়া হল’। এই আইনের বিরুদ্ধে দেশজোড়া গণআন্দোলনকে, যার পুরোভাগে ছিল’ যুবসমাজ, যেভাবে দমন করার চেষ্টা করা হল’, তার থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই সরকার ঠিক কতখানি ঘৃণার চোখে মানুষের শান্তিপূর্ণ গণ আন্দোলনের সাংবিধানিক অধিকারকে দেখে। এই সরকারের তরফে এই আইনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান গণ সংহতি কে ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বর্বোরোচিত আক্রমণ নামিয়ে আনা হল’ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর এবং পরিকল্পিতভাবে দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো হল’ যখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে “নমস্তে ট্রাম্প” নাম দিয়ে সরকারি সংবর্ধনা দেওয়া চলছিল’।
সংবিধানের ভিত্তি স্তম্ভগুলির উপর আক্রমণ
সংবিধানের উপর এই সরকারি আক্রমণ আদতে স্বাধীন ভারতের মৌলিক চরিত্রের উপরেই আঘাত।এ দেশের সংবিধান এই বিরাট বৈচিত্রসম্পন্ন দেশের এবং তার মানুষের বহুত্ববাদকে তুলে ধরে। ভারতের ঐক্য সুরক্ষিত করা সম্ভব একমাত্র বৈচিত্রের মধ্যে এই একাত্মবোধের গ্রন্থিকে আরো শক্তিশালী করার মধ্য দিয়েই। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং বিজেপি এই বৈচিত্র্যকেই শেষ করে দিতে চায় যাবতীয় সাংস্কৃতিক, বাচিক এবং ধর্মীয় ভাবপ্রকাশের উপর এক অভিন্ন সংস্কৃতি আরোপ করে দিয়ে। “হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের” মূল ভাবনাটাই হল’ সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিভিন্ন জনজাতিভুক্ত মানুষকে বাধ্য করা ‘হিন্দু’ হয়ে যাওয়ার জন্য আর নয়ত’ তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বাঁচতে বাধ্য করা, সংবিধানপ্রদত্ত সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান’ স্লোগানের মাধ্যমে এ দেশের বিভিন্ন ভাষার অবদমন ঘটিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক অধিকারসমূহকে সংকুচিত করে সামাজিক এই আধিপত্যবাদ সুনিশ্চিত করতে চাইছে বিজেপি ফ্যাসিস্তসুলভ রাষ্ট্রযন্ত্রের চন্ডনীতির মাধ্যমে যেমন UAPA কিংবা “দেশদ্রোহীতা” আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। এ সকল পরিকল্পনার বিরোধিতা করা হলেই সে সকল ব্যক্তিকে “আভ্যন্তরীণ শত্রু” বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবেই লাগাতার সংবিধানপ্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করা চলেছে।
কাশ্মীরের কায়দায় বর্তমানে লাক্ষাদ্বীপেও মানুষের সাংবিধানিক অধিকারসমূহের উপর নির্লজ্জ আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু বর্গের মানুষের উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ নামিয়ে এনে।
আত্মনির্ভরশীলতা
দেশের আত্মনির্ভরশীলতার যাবতীয় স্তম্ভকে ২০১৪ পরবর্তী সময়ে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, যে প্রক্রিয়া ২০১৯ সালের পর থেকে ত্বরান্বিত করা হয়েছে। জাতীয় সম্পদের নির্মম লুঠ চলছে। এর সাথে চলছে লুম্পেন পুঁজিবাদের সবচেয়ে নগ্ন আস্ফালন। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রকে বেচে দেওয়া হচ্ছে জলের দরে এবং আর্থিক ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে যার ফলে প্রান্তিক অংশের মানুষকে বিরাটাকারে বঞ্চিত করা হবে।
এসবের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের উপর নির্মম আক্রমণ। সকল শ্রম আইনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে যে ‘লেবার কোড’ চালু করা হয়েছে তা শ্রম আইনের নামে এক লজ্জা। কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেট স্বার্থের দাসে পরিণত করার জন্য নতুন কৃষি আইনসমূহ প্রণয়ন করা হয়েছে যার ফলে নিশ্চিতভাবে এ দেশের কৃষি এবং কৃষক ধ্বংস হবে। একইভাবে ভারতের খনিজ সম্পদকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিপুঁজির মুনাফার সর্বোচ্চায়ণের উদ্দেশ্যে।
উপরোক্ত এ সকল সরকারি পদক্ষেপের ফলে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতিকে ফলাও করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির রাস্তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত অস্বচ্ছ নির্বাচনী বণ্ড এবং রাজনৈতিক দলের বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা গ্রহণকে বৈধ করে দেওয়ার মাধ্যমে।
উপরোক্ত সরকারি সিদ্ধান্ত সমূহের ফলশ্রুতি হল’ আর্থিক অসাম্যের ব্যাপক বৃদ্ধি যার ফলে গরিব মানুষ আরো বেশি করে দারিদ্র্যে তলিয়ে যাচ্ছে আর ধনিক শ্রেণীর সম্পদ অশ্লীল মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো
বিগত দু’ বছরে রাজ্যের অধিকারসমূহের উপর আক্রমণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিমারির এই পুরো সময়কালের মধ্যে যুক্ত্ররাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর এই আক্রমণ অব্যাহত থেকেছে। রাজ্যগুলির মতামতকে অগ্রাহ্য করে যেভাবে জিএসটি লাগু করা হল’, রাজ্যগুলিকে তাদের বকেয়া অর্থ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, অবর্ণনীয় পরিমাণে যে হারে জীবনদায়ী ওষুধ এবং চিকিৎসার বিবিধ উপকরণের উপরেও কর ধার্য করা হচ্ছে, তার ফলে রাজ্য সরকারগুলির সাংবিধানিক অধিকারকে পদদলিত করা হচ্ছে।
সামাজিক ন্যায়
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারী, দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হিংসা এবং বিদ্বেষমূলক প্রচারের মাধ্যমে বিষাক্ত এক পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে। দলিত কিশোর কিশোরীদের গণধর্ষণ এবং খুন, জঙ্গলের জমি থেকে জনজাতিভুক্ত মানুষের উচ্ছেদ, বনের অধিকার আইনের প্রায় বিলুপ্তিকরণ, নারীদের উপর অপরাধের সংখ্যার ভয়াবহ বৃদ্ধি এবং সার্বিকভাবে দরিদ্র শ্রেণীর উপর আক্রমণ, ভারতের সংবিধানের সামাজিক ন্যায়বিধানের তাবৎ নীতিসমূহকেই নস্যাৎ করে দিচ্ছে।
“নতুন ভারতের” ভাষ্য
গত দু’বছর ধরে এই মোদি সরকারের যাত্রাপথ থেকে এটা স্পষ্ট যে এই সরকারের লক্ষ্যই হল’ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক এই প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করে এক অত্যুগ্র হিংস্র এবং অসহিষ্ণু, ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের নির্মাণ করা। এই পরিকল্পনা রূপায়নের জন্য এই সরকারের প্রয়োজন যাবতীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যা কিনা রাষ্ট্রক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার পক্ষে সহায়ক, সে সকল সংস্থাকে নিশ্ছিহ্ন করা।
সংসদ
এই প্রক্রিয়া শুরু হয় সংসদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে, যুক্তিপূর্ণ আলোচনা এবং বিবিধ সংসদীয় কমিটির কার্যাবলী কে স্তব্ধ করে দিয়ে। বর্তমানে পার্লামেন্টকে স্রেফ সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে একচেটিয়া মনোভাব নিয়ে পরিচালিত করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভারতের সংবিধানের মূল আধার হল’ দেশের নাগরিকসমূহের সার্বভৌমত্ব। এই সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করা হয় সংসদে দেশের নাগরিকেদের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে যারা তাদের নির্বাচকমন্ডলী অর্থাৎ সাধারন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এবং দেশের সরকার এই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ। সংসদ কে অপ্রয়োজনীয় করে তুললে ভারতের নাগরিকবৃন্দের এই সার্বভৌমত্বকেই ক্ষুণ্ণ করা হয়।
উপরোক্ত প্রবণতার সাথে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পিতভাবে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা কে ক্ষুণ্ণ করা (৩৭০ ধারার বিলোপ সংক্রান্ত দায়ের করা মামলাগুলি কিংবা নাগরিকত্ব সংশোধন আইন সংক্রান্ত মামলাগুলির এখনো অবধি শুনানি করা হয়নি)। সিবিআই, ইডি, ক্যাগ জাতীয় সাংবিধানিক সংস্থাসমূহের নিরপেক্ষতা কে জলাঞ্জলি দিয়ে খোলাখুলি ভাবেই কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
গণমাধ্যম
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন এক বশংবদ গণমাধ্যমের, যারা বিজেপি সরকারের যাবতীয় বক্তব্যকে বস্তুনিষ্ঠ ‘সংবাদ’ হিসাবে প্রচার করবে সরকারের এক মিথ্যা ভাবমূর্তি নির্মাণের উদ্দেশ্যে এবং মেরুকরণের লক্ষ্যে সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপকে সমর্থন যুগিয়ে যাবে। স্বাধীন ভারতে গত দু বছরের মত এই বিপুল পরিমাণে সরকারের তল্পিবাহক কর্পোরেট মিডিয়া দেখা যায়নি।
যুক্তিবোধের উপর আক্রমণ
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পরিকল্পনা সফল করতে হলে এটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি যে যুক্তিবোধ এবং বিজ্ঞানমনস্কতা যাতে কিছুতেই গণমানসকে প্রভাবিত না করতে পারে। বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞানচর্চাকে ধ্বংস করে তার জায়গায় অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের নির্মাণকল্পে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, যা কিনা যুক্তিবোধ চর্চার স্থান, সেগুলিকে আক্রমণ করা হচ্ছে যাতে অবিজ্ঞান এবং অপবিজ্ঞানের চর্চা চালানো যায়, সঙ্ঘের চিরকালের চাহিদা অনুযায়ী ভারতের ইতিহাসের পুনর্লিখন করা যায়, ভারতের বহু ভিন্নতার মিলনে গড়ে ওঠা দীর্ঘকালের ইতিহাসের চর্চার বদলে হিন্দু পুরাণের চর্চা এবং ভারতীয় দর্শনের বদলে হিন্দু আধ্যাত্মভাবনার চর্চা চাপিয়ে দেওয়া যায়। নতুন শিক্ষানীতির মূল নির্যাস এটাই, যা কিনা অতিমারির সময়কালে এই সরকারের দ্বারা অগণতান্ত্রিকভাবে প্রণয়ন করা হল’।
নতুন ভারতের প্রতীক
“নতুন ভারতের” এই সরকারি ভাষ্যের প্রয়োজন রয়েছে স্বাধীন ভারতের ব্যবহৃত বহু প্রতীকচিহ্ন কে পালটে নতুন কিছু চিহ্নের আমদানি করা। ‘বুলেট ট্রেনের’ মত কিছু অবাস্তব অথচ চটকদারি প্রকল্প, বিশালাকৃতি মূর্তি নির্মাণ, নতুন দিল্লীর সেন্ট্রাল ভিস্টার নতুন করে নির্মাণ, এ সব কিছুই বার্লিনে হিটলারের সরকারের দ্বারা পরিকল্পিত সেই গম্বুজখচিত বিশাল সভাগৃহের কথা মনে করিয়ে দেয় যা কিনা তার ফ্যাসিস্ত শাসনব্যবস্থার প্রতীকচিহ্ন ভাবা হয়েছিল’। সেই সভাগৃহ অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আর পুরোপুরি গড়ে তোলা যায় নি!
ভয়াবহ দুই বছর
বিগত দু’ বছর ধরে এ দেশের মানুষ এবং আমাদের সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র এক ভয়াবহ সময় অতিবাহিত করছে। আজ সময় আগত যে সকল মানুষ ভারতের সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র, তার মানুষের জীবন, জীবিকা, জীবনযাত্রার মান রক্ষা করতে ইচ্ছুক, মানুষের অলঙ্ঘনীয় সাংবিধানিক সমানাধিকার এবং অন্যান্য অধিকারসমূহকে, ব্যক্তিস্বাধীনতা কে রক্ষা করতে ইচ্ছুক, যারা সাংবিধানিক সকল মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ভারতের সাধারণতন্ত্র এবং ভারতীয় মানুষের উপর এই আক্রমণ কে প্রতিহত করতে হবে।