২৮-২৯ মার্চ,২০২২ – দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট
নতুন উচ্চতায় সংগ্রামের স্থাপনা
১ম পর্ব
তপন সেন
এক বছর জুড়ে চলা ঐতিহাসিক কিসান আন্দোলন, যা কিনা সকল মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ এবং ধারাবাহিক সমর্থনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-বিজেপি পরিচালিত সরকার কে বাধ্য করেছে তিনটি জনবিরোধী কৃষি আইন প্রত্যাহারে, তার সফল পরিসমাপ্তির সময়কালে, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের যৌথ মঞ্চ এবং স্বাধীন ক্ষেত্রীয় ফেডারেশনগুলির তরফে ২ দিনের দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে জনবিরোধী, মেহনতি মানুষের স্বার্থবিরোধী, দেশবিরোধী মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক নীতিসমূহের বিরুদ্ধে, “মানুষ বাঁচাও, দেশ বাঁচাও” এই উদাত্ত আহ্বানকে সামনে রেখে।
এই সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দুটি প্রধান উৎপাদক শ্রেণীর চলমান আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবেই দেওয়া হয়েছে দেশবিরোধী বর্বর স্বৈরাচারী সরকারের দেশের অর্থনীতিকে মুষ্ঠিমেয় কর্পোরেটের স্বার্থে নিলাম করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে থামানোর জন্য। বর্তমান সময়ের নীতিসমূহ আদতে রাষ্ট্রীয় মদতে দেশের কোষাগার এবং জনগণের সম্পদের লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের উপর অকল্পনীয় দুর্দশা ও দুঃখভোগ নামিয়ে আনছে যার ফলে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকাংশের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
সংযুক্ত মঞ্চের সম্প্রসারণ
এই সাধারণ ধর্মঘট ১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি পর্বের আরম্ভের পরে একবিংশতিতম ধর্মঘট হতে চলেছে। এই তিন দশকের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, প্রতিটি সাধারণ ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে এবং তার মধ্যে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে সংগঠিত ও অসংগঠিত অংশ মিলিয়ে অসংখ্য নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের সংযুক্ত মঞ্চ গড়ে উঠেছে, সম্প্রসারিত হয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে এক ছাতার নীচে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিজেপি সরকার গঠন করার পরে অবশ্য ২০১৫ সালে বিএমএস এই মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়, তবে তাতে বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সময়, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা শিল্পের ক্ষেত্রে, বিএমএস অনুমোদিত বহু ট্রেড ইউনিয়ন তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিজেপি সরকারের স্বপক্ষে অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। যৌথ মঞ্চের এই সম্প্রসারণ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দেখাতে পেরেছে। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিই নয়, পরিষেবা ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিবিধ অংশ, যেমন সরকারী কর্মচারী, ব্যাঙ্ক, বীমা, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের কর্মচারীদের বহু স্বতন্ত্র সর্বভারতীয় ফেডারেশনকেও এক ছাতার তলায় আনতে সক্ষম হয়েছে। আন্দোলনের যৌথ মঞ্চের এই সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে কর্মস্থল ও ক্ষেত্রীয় স্তরে এমন বহু শ্রমিক কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা গেছে যারা কিনা এই সকল ট্রেড ইউনিয়নের সরাসরি সদস্য নয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন আরো ব্যাপক এবং গভীর সংহতির জন্ম দিচ্ছে তৃণমূল স্তরে।
চেতনার বিকাশ ও আন্দোলনের বিস্তার
আরেকটি বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন বিশেষ করে এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। নয়া উদারবাদী এই সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার যে বিক্ষোভ, ধর্মঘটে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে যে শ্রমজীবি জনতাকে, তাদের ক্ষোভ যতখানি বেশি পরিমাণে চালিত হচ্ছে সে সকল নয়া উদারবাদী নীতিগুলির বিরুদ্ধে যা কিনা তাদের জীবনে, জীবিকায় ক্রমবর্ধমান দুর্দশা সৃষ্টি করছে, তাদের অধিকারকে সঙ্কুচিত করছে; সেই সকল নীতির যারা নির্ধারক, তাদের বিরুদ্ধে ততখানি নয়। যদিও ট্রেড ইউনিয়নগুলি, বিশেষ করে লাল ঝান্ডার আন্দোলন একেবারে প্রথম থেকেই ধারাবাহিকভাবে সূচিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এই সকল নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতিসমূহের পিছনের আসল রাজনীতিটা কে চিহ্নিত করে চলেছে, তদুপরি নয়া উদারবাদের প্রথম দশকগুলিতে শ্রমজীবি জনতার দুর্দশার মূল কারণগুলি এবং সরকারে বসে থাকা সেই সকল দুর্দশার মূল কারিগরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের চেতনার বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হয়নি।
তবে, বিগত তিন দশকের বিভিন্ন ক্ষেত্রীয় এবং জাতীয় স্তরে লাগাতার আন্দোলন-ধর্মঘট, অসংখ্য ঐক্যবদ্ধ লড়াই বৃথা হয়ে যায়নি। সরকারী নীতি ও সেই নীতির নির্ধারকদের বিরুদ্ধে চেতনার বৃদ্ধি ঘটানো এক ধারবাহিক প্রক্রিয়া। পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান কাঠামোগত সঙ্কটের এবং শ্রমজীবি জনগণের জীবন জীবিকায় সেই সঙ্কট সঞ্জাত দুর্ভোগের পশ্চাৎপটে শ্রমিক শ্রেণীর ধারবাহিক লড়াই ধীরে ধীরে সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষকেও সংগঠিত লড়াই আন্দোলনের মধ্যে নিয়ে আসার পথ তৈরি করে দিচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের প্রেক্ষিতে গ’ড়ে ওঠা এই কিসান আন্দোলন ধীরে ধীরে তাদের এক যৌথ মঞ্চ গ’ড়ে তুলেছে নয়া উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াইয়ের জন্য। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ভিত তৈরি হচ্ছে কিসানদের দুঃখ দুর্দশার মূল কারণগুলি এবং সেই সকল কারণের পিছনে যে রাজনীতি ও সেই রাজনীতির নির্ধারকরা রয়েছে, তাদের চিহ্নিত করার।
এগিয়ে চলা
গত দশকের শুরু থেকেই দুটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত সঙ্কট ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার দেউলিয়াপনা উন্মোচিত করতে থাকে এবং অন্য দিকে শ্রমজীবি জনতার ক্রমবর্ধমান দুর্দশার পিছনে পুঁজিবাদী শ্রেণীর নিষ্ঠুর এবং বর্বরোচিত ভূমিকাও উন্মোচিত হতে থাকে। কেন্দ্রে দ্বিতীয়বার বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই জনগণের উপর এই আক্রমণ এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর আক্রমণের বিরুদ্ধে অর্থনীতির দুই প্রধান উৎপাদক শ্রেণীর লড়াই এবং সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের উপর সেই লড়াইয়ের ব্যাপক প্রভাবের ফলে এই খুনে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থার সরকারী নীতি নির্ধারকদের আসল চেহারা উন্মোচিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে।
দেশের মানুষ এক স্বৈরাচারী সরকারের তরফে জীবন জীবিকার উপর এক ভয়ঙ্কর আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। অতিমারির গোটা সময়কালে বর্তমান সরকারের নয় উদারবাদী শাসন ব্যবস্থার দাঁত নখ বার করা এক নিষ্ঠুর অমানবিক চরিত্র দেখেছে । অতিমারির সময়কালে মানুষের দুঃখ দুর্দশা কে কাজে লাগিয়ে এই সরকার কোনো রাখঢাক না রেখেই আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত হিংস্র এবং ধ্বংসাত্মক নীতিসমূহের প্রণয়ন করেছে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে। কৃষি ক্ষেত্রে তিন কালা কানুন প্রণয়নের উদ্দেশ্যই ছিল কৃষির উপর কৃষকদের অধিকার বিলোপ করে গোটা কৃষি ক্ষেত্রকে মষ্ঠিমেয় মুনাফালোভী কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার, যার ফলে দেশের স্বনির্ভরতা এবং দেশের অগুণতি ক্ষুধায় পীড়িত মানুষের খাদ্যের ন্যুনতম নিরাপত্তাকে শেষ করে দেওয়া। বর্তমান শ্রম কোডের উদ্দেশ্য হল’ শ্রমিক শ্রেণীকে ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করা যাতে পুঁজিবাদীদের মুনাফার অফুরান লোভকে তুষ্ট করা যায় শ্রমিকের মজুরি কে যথাসম্ভব কমিয়ে দিয়ে। শ্রমিকের মজুরি কে যথাসম্ভব হ্রাস করার এই প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন অর্থনীতির উৎপাদনী ক্ষমতা দ্রুতহারে কমে যাচ্ছে, বেকারত্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং রোজগারের উপায় ক্রমাগত ধ্বংস হয়ে চলেছে এবং কাজের নিরাপ্ততা অতি দ্রুতহারে কমেই চলেছে। অর্থনীতির এই অন্ধকার সময়ে মুদ্রাস্বীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, যেমন খাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ এবং কোনমতে বেঁচে থাকাটুকুর জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের দাম দ্রুত হারে বাড়ছে ঠিক সেই সময় যখন সাধারণ মানুষের গড় আয় দ্রুত নিম্নগামী হচ্ছে এবং এই মূল্যবৃদ্ধি আপনা আপনি হচ্ছে না, এটা ঘটানো হচ্ছে বৃহৎ কর্পোরেটের স্বার্থে সাধারণ মানুষকে লুঠ করার রাস্তা আরো প্রশস্ত করার জন্য। বেকারত্ব আজ এক ভয়াবহ স্তরে পৌঁছে গেছে যার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘটে চলেছে আরো বেশি মাত্রায় কর্মহানি এবং কাজের পরিবেশের দ্রুত অবনতি যার ফলে দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা আজ ক্রমবর্ধমান। ২০২২-২৩ সালের ঘোষিত বাজেটে স্পষ্ট হয়েছে যে সরকার এই ধ্বংসাত্মক নীতিই চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ নয়া উদারবাদী নীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গত তিন দশকে বিবিধ পন্থায় নয়া উদারবাদী নীতির সম্প্রসারণ আজ এক চূড়ান্ত হিংস্র রূপ ধারণ করেছে যা ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইনের নামে গোটা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব উৎপাদন ক্ষেত্র কে, বিশেষ করে পরিকাঠামো ক্ষেত্রকে প্রায় বিনামূল্যে দেশী বিদেশী বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর যাতে তারা লগ্নি না করেই বা নামমাত্র লগ্নির মাধ্যমেই বিরাট আয় করতে পারে।
২য় পর্ব আগামীকাল প্রকাশিত হবে