4

Freedom Struggle And The Communists: Part IV

সুজন চক্রবর্তী

গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানুষের স্বার্থ এবং অধিকার রক্ষায় বরাবরই গৌরবজনক ভূমিকা নিয়ে চলেছে এ দেশের কমিউনিস্টরা। স্বাধীনতার আগে কিংবা স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাত্রে স্বাধীনতার স্বপ্ন, শপথ কিংবা প্রতিশ্রুতি হিসাবে নেতারা দেশের মানুষের কাছে যে অঙ্গীকার করেছিলেন, স্বাধীনতার পর তা যথাযথভাবে রক্ষিত হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই স্বপ্ন এবং শপথকে রক্ষা এবং কার্যকরী করার জন্য ধারাবাহিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সংগ্রামের পথে থেকেছেন কমিউনিস্টরা।

Logo

সিপিআই(এম) কিংবা নানান গণসংগঠণ সেই মনোভাবে অবিচল থেকেছে। বামপন্থীদের পরিচালিত রাজ্যের সরকারগুলিও এবিষয়ে ধারাবাহিকভাবে দায়বদ্ধ থেকেছে। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারে মন্ত্রীত্ব গ্রহণ কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শনের নানাবিধ সুযোগ থাকলেও, বামপন্থীরা সাধারণভাবে তার চাইতে অনেকবেশি গুরুত্ব দিয়েছে মানুষের স্বার্থ রক্ষায়। ভারতীয় পার্লামেন্টকে ব্যবহার করে জনমূখী নীতি এবং প্রকল্প, প্রতিটিক্ষেত্রেই বামপন্থীরা ধারাবাহিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং যেকোনো রকম জনবিরোধী নীতি এবং প্রকল্পের বিরোধীতায় অবিচল থেকে দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করেছে।

১) যে কোন রকমের পশ্চাদপদ চেতনা কে দূরে সরিয়ে রেখে বামপন্থীরা বরাবরই গণতান্ত্রিক চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করেছে। আধুনিক ভারত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আদর্শগত এবং বিজ্ঞানসম্মত চেতনার প্রসারে কমিউনিস্টরা বরাবরই অবিচল থেকেছে। যেকোনো রকম সামন্ততান্ত্রিক, কুপমন্ডুক ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং গণচেতনার বিকাশের অগ্রসর ভূমিকা নিয়েছে। যুক্তিবোধের বিস্তার ঘটিয়েছে। নতুন নতুন সৃষ্টিকে উৎসাহ দিয়েছে। দেশব্যাপী নানান অংশের মধ্যে উন্নত সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ এবং উন্নত সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ এবং চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছে।

২) দেশের রাজনীতিতে সামন্ততন্ত্র এবং জমিদারতন্ত্র বিরোধী কৃষকসমাজের ইস্যু গুলোকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ে আসার মধ্যদিয়ে দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা হয়েছে। ১৯৪৩ সালের ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে কার্যত গোটা বাংলাতে চল্লিশের দশক জুড়ে তেভাগার লড়াই। কমিউনিস্টরাই তার নেতৃত্ব দিয়েছে। একইরকম ভাবে দারুন গুরুত্বপূর্ণ তেলেঙ্গানা প্রজা বিদ্রোহ। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তেভাগা আন্দোলনে যেমন অজস্র মানুষ মারা গেছেন, অজস্র অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে সারা বাংলা জুড়ে তেমনই তেলেঙ্গানাতে। প্রায় ছয় হাজার কৃষক এবং কমিউনিস্ট কর্মী খুন হয়েছিলেন। প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি কৃষক এবং কমিউনিস্ট কর্মী জেল খেটেছেন। এরই পাশাপাশি  কেরলে পুন্নাপা-ভায়লার কৃষক আন্দোলন সহ স্বাধীনতার আগে থেকে গড়ে ওঠা মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি আদিবাদী আন্দোলন, ত্রিপুরায় রিয়াং বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, আসামের সুরমাভ্যালির মত নানাবিধ ছোট বড় কৃষক আন্দোলন। যেগুলি দেখিয়ে দেয় কৃষককে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের ভবিষ্যত ভাবতে যাওয়া সম্ভব নয়। এই প্রক্ষাপটে দেশের জমিদারি উচ্ছেদ আইন কিংবা জমির উর্দ্ধসীমা সংক্রান্ত আইনগুলি বিবেচনা করা জরুরি। “Taking peasants in the center stage of Indian politics” দেশের রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

৩) ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন এমনই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। জাতিস্বত্তার প্রশ্নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাষা-সংস্কৃতি। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবীতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা জরুরি। নানান ভাষা-সংস্কৃতি মিলেমিশে বিবিধ চেহারার রাজ্য অথবা রাজন্য এলাকা। এসব নিয়ে সেসময়ে অনেক তর্কবিতর্ক। বিশাল অন্ধ্র কিংবা বর্তমান কেরল এর মত এলাকাগুলিকে একজায়গাতে নিয়ে আসা এবং ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের দাবীতে কমিউনিস্টরা প্রথম থেকেই সোচ্চার, আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন সম্ভব হয়েছে। যদিও রাজনীতির কূটিল খেলায় স্বাধীনতার অংশ হিসাবেই ভাষাভিত্তিক বাংলা প্রদেশ বিভক্ত হয়ে গেল। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

৪) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষ্যে বামপন্থীরা প্রথম থেকেই সরব। কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমশই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে সরতে থেকেছে। বরাবরই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করবার একটা প্রচেষ্টা থেকেছে। তার বিরুদ্ধেও ৫০ এর দশক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ধারণায় বামপন্থীরা লড়াই জারি রেখেছে।  রাজ্যগুলির নিজস্ব অধিকার, ভাষার অধিকার, সংষ্কৃতির অধিকার, রাজ্যের অর্থনৈতিক অধিকার এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতিরেকে রাজ্যের ক্ষমতার প্রশ্ন; এই বিবেচনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করার পক্ষে লড়াই। প্রত্যেক রাজ্য কে তার নিজের মত করে গড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হয়। ভাষা, সংস্কৃতি, বৈচিত্রকে রক্ষা করতে হয়। ঐক্যের জন্যও তা জরুরি। সেই জায়গা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার নানা সময়েই সরে এসেছে। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রশ্নে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে লড়াই, বামপন্থীরাই ধারাবাহিকভাবে তা চালিয়ে এসেছে। আশির দশকের গোড়ায়, জ্যোতি বসুদের নেতৃত্বে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সরকার সমূহের একাধিকবার কনক্লেভ। রাজ্যের দাবী। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শক্তিশালী করার দাবীতে নানাবিধ আন্দোলন। শেষমেশ সারকারিয়া কমিশন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারকে তা খানিকটা হলেও মান্যতা দিতে হয়েছে।

৫) দেশের ঐক্য সংহতি রক্ষা করার প্রশ্নে বরাবরই কঠিন লড়াই লড়েছে কমিউনিস্টরা। দেশের নানা প্রান্তে, নানা সময়, নানা কারনে বিচ্ছিন্নতার শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাকে রুখতে উদাহরণযোগ্য ভূমিকা কমিউনিস্টদের। আসাম, পাঞ্জাব, দার্জিলিং ইত্যাদি উদাহরণ অজস্র। বিচ্ছিন্নতার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইতে আসামে অজস্র বাঙালি—অবাঙালি— অসমিয়া কমরেড খুন হয়েছেন। একইরকম ভাবে পাঞ্জাবে যখন খালিস্থানি আন্দোলন দানা বাঁধছে, রুখে দাঁড়িয়েছেন অজস্র মানুষ। তৎকালীন শাসকদল সহ সবাই। অজস্র তরুণ বামপন্থী কর্মী প্রান দিয়েছেন। দার্জিলিঙে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির পিছনে মদত দিয়েছে প্রতিক্রিয়ার নানা শক্তি। তার বিরুদ্ধে লড়াই বামপন্থী শক্তির। এক মুহূর্তের জন্যও পিছপা হননি। ঐক্য সংহতি রক্ষায় উদাহরণযোগ্য লড়াই কমিউনিস্টদের। বস্তুত আসামে যখন ‘বাঙালি খেদাও’ এর নামে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি প্রচন্ড তৎপর, সত্তরের দশকের শেষভাগ, তখন বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি আসামে চোখে পড়ার মত। বিধায়ক সংখ্যা সিপিআই(এম) এর ১১জন বামপন্থীদের ২০জন। অথবা পাঞ্জাবে যখন সিপিআই(এম) এর বিধায়ক সংখ্যা ৫জন এবং বামপন্থীদের ১৪জন, সেরকম সময়ই খালিস্থানি আন্দোলনের বিকাশ। কাকতালীয় কী? প্রশ্নটা অবশ্যই সঙ্গত। কিন্তু সে আলোচনা অন্যত্র।

৬) একইরকমভাবে, বামপন্থীদের আপোষহীন লড়াই স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে। সত্তর দশকে বাংলা প্রত্যক্ষ করেছে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস। পরবর্তীতে দেশজুড়ে জরুরী অবস্থার বীভৎসতা। অজস্র, অসংখ্য কর্মী আক্রান্ত। আক্রান্ত সাধারণ মানুষ। আক্রান্ত বিরোধী মনোভাবাপন্ন যে কেউ। প্রতিবাদের অধিকারটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হল। অন্ধকারের রাজত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। সামনে দাঁড়িয়ে জয়প্রকাশ নারায়ণ। বামপন্থীরা সর্বশক্তি দিয়েই স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইতে সামিল। দেশের যেকোনো জায়গায়, গণতন্ত্র রক্ষার যেকোনো সংগ্রামে, মানুষের পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মত বামপন্থীরা।

৭) সংবিধানের নির্দেশ মোতাবেক, গণতন্ত্রকে রক্ষা করার প্রশ্নে যেমন, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করার প্রশ্নেও একইরকমভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা বামপন্থীদের। সাম্প্রদায়িক শক্তি নানা সময়েই বিভাজন, অস্থিরতা, দাঙ্গার পরিবেশ তৈরী করতে সচেষ্ট থেকেছে। রাজনীতির সোপানে চড়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার নানা ফন্দি ফিকির সাম্প্রদায়িক শক্তির। নানা ক্ষেত্রেই মৌলবাদী শক্তি সক্রিয়। সাম্প্রদায়িক শক্তির পথ বেয়ে বিষাক্ত রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশজুড়ে। নানা অছিলায় শাসকদলের আপোষকামিতা এদের বাড়তে সাহায্য করেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে হবে। ধারাবাহিক ভাবেই সবচাইতে দৃঢ় অবস্থান বামপন্থীদের। বামপন্থীদের সবচাইতে বড় সমালোচকরাও এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারেনা। যেকোনো দাঙ্গার বিরুদ্ধে, শিখ দাঙ্গা কিংবা বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সমগ্রমানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বামপন্থীরা জীবন পণ করে রাস্তায় থেকেছেন। যে বামপন্থীরা বরাবরই নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের বিরোধী, তারাই ১৯৯২ সালে প্রাচীন ঐতিহ্যের সৌধ ‘বাবরি মসজিদ’ ভাঙবার বিজেপির চক্রান্তকে ঠেকাতে এই ধারা প্রয়োগে সম্মতি জানিয়ে ছিল। যদিও তখন কেন্দ্রীয় সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালন করে নি। গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকেই কমরেড জ্যোতি বসু বিজেপি সম্পর্কে ‘অসভ্য বর্বরের দল’ বলতে পারেন। বামপন্থীদের শক্ত ঘাটি বলে পরিচিত পশ্চিমবাংলা কিংবা ত্রিপুরাতে সাম্প্রতিক সময়ের আগে পর্যন্ত বিজেপি মাথাচাড়া দিতে পারেনি। কেরালাতে আজও নয়। মানুষের মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতি, গণতান্ত্রিক ভাবধারা কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার বিবেচনায় বামপন্থীরা বরাবরই গৌরবজনক ভূমিকা পালন করে এসেছে, এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট।

৮) খাদ্য সংক্রান্ত সুস্থ নীতি দেশে কখনোই ছিল না। ক্ষুধার নীরিখে দেশের স্থান বরাবরই খুব নীচে। খাদ্য এবং পুষ্টির দাবীতে মানুষের আন্দোলন নেতৃত্ব দিয়েছে বামপন্থীরা। জোরদার খাদ্য আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই রেশন ব্যবস্থা বা পিডিএস। তাকে বানচালের চক্রান্ত হয়েছে বহুবার। রুখে দাঁড়িয়েছে বামপন্থীরাই। আন্দোলনের নিরীখেই পরবর্তী সময়ের ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’— এরকমই বহুবিধ উদ্যোগ। 

Spread the word

Leave a Reply