বাংলার পুনর্জাগরণের জন্য বামপন্থার পুনরুত্থান প্রয়োজন – মহম্মদ সেলিম

৭ জুলাই ২০২৩ (শুক্রবার)

তৃতীয় পর্ব

হিন্দিতে বক্তৃতা করার সময় একটা কথা বলতাম, ‘লুঠ চলে না, যদি ঝুট না বলে’। আসলে বোকা বানিয়ে দিতে হবে লোককে, তাই মিথ্যা, তাই অভিনয়। তাহলে লুঠ চলবে না যদি না ঝুট বলা না হয়। ঝুট মানে মিথ্যা জানে সবাই। আবার ঝুটকে লোকে বিশ্বাস করবে না যদি ফুট না ডালো। ফুট মানে হচ্ছে ভাগ করা। তাহলে এটা একটার সঙ্গে একটা যুক্ত। দুর্নীতির চিত্র, তার সঙ্গে মিথ্যাচার, এমনি এমনি যে মুখ ফস্কে বলেছেন তা নয়, পরে যে বলবে সরি ভুল হয়ে গেছে তা-ও না। মিথ্যা প্রতিদিন বলে যাচ্ছে। কেন্দ্রেও দ্যাখো। রাজ্যেও দ্যাখো। আর অন্যদিকে হচ্ছে এই ভাগাভাগির রাজনীতি যা বললে। ভাগাভাগি করলে কী হয়? লোকে গুজবেও বিশ্বাস করে নেয়। হিংসার সময় তার মধ্যে ঘৃণা তৈরি করে। ঘৃণা তৈরি হয় কিসের ভিত্তিতে? কতগুলো ইতিহাসকে বিকৃত করে। কতগুলো ঘটনাকে বিকৃত করে। তাহলে যে মানুষ একসঙ্গে লড়াই করতে পারত, যারা জোতদার জমিদার দের বিরুদ্ধে তেভাগার লড়াই লড়ল, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়ল, যার সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার কথা, তাকে দুর্বল করার জন্য বলা হল সরকার প্রচণ্ড প্রতিপত্তিশালী। শাসক প্রচণ্ড হিংসাশ্রয়ী। আর তুমি অসহায়। তুমি কিন্তু কেন অসহায়? তাহলে একজন কৃষককে আরেকজন কৃষকের বিরুদ্ধে। একজন সাধারণ নাগরিককে আরেকজন সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে, একজন দোকানদারকে আরেকজন দোকানদারের বিরুদ্ধে। অথচ দুইজনেরই দোকানদারি চলছে না। এই যা এখন হয়েছে বড় বড় ব্যবসা, হোম ডেলিভারি চালু হয়েছে, তাতে তোমার ছোট ছোট দোকান চলছে না। কিন্তু যখন দাঙ্গা হয় তখন একটা দোকানদারের বিরুদ্ধে আরেকটা দোকানদারকে লেলিয়ে দেয়।

তাহলে এই যে বাইনারি এটাকে ভাঙার জন্য যেটা চেষ্টা করা দরকার, সমস্বার্থের বিষয় গুলো কে এক জায়গায় নিয়ে আসা। আর ওরা যেটা করে সেটা হল সমস্বার্থের বদলে যেটা পরস্পর বিরোধী স্বার্থ সেটাতে জোর দেয়। মর্যাদা চাই। সম্মান চাই। অপরাধীর বিচার চাই। এর জন্যই সবাইকে এককাট্টা হতে হবে। তাহলে যে অপরাধীর পক্ষে থাকছে সে অপরাধীর পক্ষে দাঁড়াবার আগে একবার না একশবার ভাববে। আসিফা থেকে শুরু করে সবকটা ঘটনায় অপরাধী কে, অপরাধ কার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে এবং তার ধর্ম, জাতিসত্তার পরিচয় এসব বলে যদি একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে করে দেওয়া হয়, তবেই মমতার অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া যাবে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে না, নারী নিরাপত্তার বিষয়টা পিছনে চলে যাবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার বদলে পরস্পরবিরোধী হয়ে জনসাধারণ একে অপরের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে যাবে।

আমরা মণিপুরে কী দেখছি? এরা তো একসঙ্গেই ছিলেন। পাহাড় এবং সমতল। গ্রেটার ইম্ফল ও দূরদূরান্তের পাহাড়ি অঞ্চল। নাগা, কুকি, মেইতি। ভারত মানেই তো তামিল, তেলুগু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবটা নিয়ে। জনগণমন গানের মধ্যে যেমনটা রয়েছে। এটাকেই তো আমরা celebrate করি। একদিকে এরা বলছে uniformity. সবাইকে একরকম হতে হবে। তোমার পোশাক আলাদা কেন? তোমার খাদ্য আলাদা কেন? তোমার সংস্কৃতি আলাদা কেন? তোমার রীতিনীতি আলাদা কেন? uniformity তে এমন হবে না। আমাদের বৈশিস্টই হল unity in diversity। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান। এই মিলন মহানের ধারনাকেই celebrate করতে হয়। ওরা কী বলছে? এ কেন হিজাব পরে? এ কেন হিজাব পরে না? ও কেন লুঙ্গি পরে? তাহলে এ বাংলাদেশি, ও রোহিঙ্গা। এ কেন এটা খায়? কে আমিষ? কে নিরামিষ! এসবের কোনও শেষ নেই। যত বেশি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করবে তত বেশি এইসব বিভাজনের ইস্যু, সীমারেখা টেনে দেয় সেগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হবে। উত্তরবঙ্গে কী হচ্ছে? মণিপুরে দেড় মাস হয়ে গেল এখনও পর্যন্ত পুড়ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া। ছোট্ট একটা অঞ্চল। কেন্দ্রের মন্ত্রী, রাজ্যের মন্ত্রী তার ঘর পুড়ছে, তাহলে বুঝতে পারছ তো? সাধারণ মানুষের উপরে, চার্চের উপরে, মন্দিরের উপরে কীভাবে আক্রমণ হয়? এবং এটা ধর্মীয় এজেন্ডা না, এটা insurgency ও না। ভোটের সময় ধর্মকে, জাতিসত্তাকে, ভাষাকে ব্যবহার করে, পরস্পরবিরোধী স্লোগান তুলে এনে, একটা অংশের মানুষের বিরুদ্ধে আরেকটা অংশের মানুষকে লেলিয়ে দিয়ে সাময়িক লাভ পেতে চাইছে। একসময় এই ভাগের স্ফুলিঙ্গ দাবানলেই পরিণত হবে, মণিপুরে সেই দাবানল হচ্ছে। আমাদের এখানে কুর্মি ও আদিবাসীদের মধ্যে এরকম লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কুর্মিদের নিজস্ব দাবি আছে, নিজস্ব জাতিসত্তা আছে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর তাই আছে। তাদের ভাষা আছে। নিজের নিজের ভাষা নিয়ে, নিজের নিজের সংস্কৃতি নিয়ে, নিজের নিজের রীতিনীতি নিয়ে শুধু তাকে বাঁচানো নয়, তাকে উন্নত করতে হয়। আজকে বিশ্বায়নের যুগে ছোট ছোট জনগোষ্ঠী তার নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি রীতিনীতি প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে৷ এটা যেমন বিশ্বায়নের দাপটে হয় তেমনই মিডিয়ারও কিছু ভুমিকা থাকে। আগে একেকটা জনজাতি তাদের নিজের মত করে বাঁচত। বিশ্বায়নের দাপট মানে সবাইকে মাইকেল জ্যাকসনের মতই নাচতে হবে। আমি একটু ব্যাকডেটেড বলে মাইকেল জ্যাকসন, এখন যারা আছে তাদের মত করে। সবার আচার আচরণ একরকম হবে। সবার চেহারা একই রকম হবে। কখনও সম্ভব নয়। সবার খাবার একরকম হবে না, সবার পোশাক একরকম হবে না। যারা এটা করতে চাইছে আবার তারাই এই ইস্যুতে মানুষকে উশকে দিচ্ছে। সি উস্কানি প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে। আমরা বলছি আদিবাসীদেরও নিজস্ব অধিকার আছে। রীতিনীতি, ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা সব নিয়েই। আবার কুর্মিদেরও আছে, রাজবংশীদেরও আছে। একইভাবে মুসলমানদেরও আছে, যেমন বর্ণহিন্দুদেরও আছে। মতুয়াদেরও আছে, তপশিলি জাতিদেরও আছে।

সামগ্রিক ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে তবেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে, নিজেদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়ে গেলে সবারই অধিকার হারাবে। খালিস্তানি মুভমেন্ট করে পাঞ্জাবের কি ভালো হয়েছে? এতদিন ধরে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে যা করেছে তার ফলে দার্জিলিংয়ের কি ভালো হয়েছে কিছু? বিজ্ঞাপনে বলতে পারে পাহাড় হাসছে। জঙ্গলমহলও হাসছে বলছিল। এখন বলতে পারবে জঙ্গলমহল হাসছে? তাহলে বিজেপি ও তৃণমূলের রাজনীতি, বিশেষত আর এস এস-এর রাজনীতি এটাই যে সামগ্রিকভাবে একটা সংখ্যাধিক্যের রাজনীতি তৈরি করবার জন্য, যেটাকে বলে majoritianism, বহুসংখ্যকবাদ। সেখানে এই যে ছোট ছোট জনগোষ্ঠী আছে তাদের ঐক্যকে ভাঙার চেষ্টা করে। একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এইটা ফ্যাসিস্ট এক রেজিম তৈরি করার জন্য এইটা একেকটা ধাপ। এইজন্য আমাদের সচেতন থাকতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেকের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, লড়াই করবার, সংগঠন করবার অধিকার আছে। কিন্তু তা যাতে পরস্পরবিরোধী না হয়ে যায়। একের স্বার্থ অন্যের স্বার্থের সঙ্গে মেলানোটা একটা রাজনীতি। আর একের স্বার্থকে নিয়ে অন্যের স্বার্থকে পরস্পর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া আরেকটা রাজনীতি। একটা হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি। আরেকটা হচ্ছে ঐক্য ও সম্প্রীতির রাজনীতি। এখানেই হচ্ছে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের মধ্যে তফাৎ।

মনে রাখতে হবে এগিয়ে চলার তিনটে ধাপ আছে। বাংলা পুনর্জাগরণের জন্য বামপন্থার পুনরুত্থান প্রয়োজন। বামপন্থার পুনরুত্থান সম্ভব নয় নতুন প্রজন্মের উত্থান ছাড়া। তাহলে resurgent left দরকার বাংলাকে রক্ষা করার জন্য, তার সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্য। সমৃদ্ধ করার জন্য। রাজনীতি, অর্থনীতি সহ গোটা সমাজকে, সংস্কৃতিকে সঠিক লাইনে আনতে হবে। আর সেটার জন্য কাঁধে দায়িত্বটা নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। এইটাই হয়। সমাজ মনস্তত্ত্বের দিক থেকে, মানবসভ্যতার ইতিহাসের দিক থেকে তুমি দেখলে, social movement বলো, political movement বলো, economic resurgence বলো, it must be youth-driven. কারণ প্রত্যেক প্রজন্ম যে সংকটের সামনে এসে দাঁড়ায় আর প্রতিদিনই এই সংকটটা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, এই জটিলতর সমস্যায় আমাদের মত প্রজন্ম কী হয়, পুরনো প্রজন্ম, তারা থতমত খেয়ে যায়। কিন্তু এটাই হচ্ছে মানবসভ্যতার, history of mankind এর একটা ধর্ম যে প্রজন্ম যে নতুন প্রজন্ম যে নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয়, এই সমস্যার মোকাবিলা করবার মত যন্ত্রপাতি, কৃৎকৌশল, কলা এগুলো তারা আবিষ্কার করে। অধ্যয়ন করে এবং আয়ত্ত করে। তারপরে এই জটিলতর পরিস্থিতি তারা মোকাবিলা করতে পারে। এখানে বয়স্ক মানুষ, তার অভিজ্ঞতা, পোড়খাওয়া মানুষের যে শিক্ষা, তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, তারা গাইড হবেন, তারা মেন্টর হবেন। কিন্তু যে উর্জা, যে শক্তি, যে তাকত, যে উদ্ভাবনী শক্তি, যে সৃজনশীলতা, সেটা তোমার নতুন প্রজন্ম। পৃথিবীব্যাপী দেখবে সেই সমস্ত পেশা, সেই সমস্ত ব্যবসা, সেই সমস্ত বাণিজ্য যেগুলোতে নতুন প্রজন্ম এসেছে, এই কঠিন অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েও সেগুলো expand করেছে, সেগুলো develop করেছে, সেগুলো আবার নতুন technology কে ব্যবহার করেছে, নতুন কৃৎকৌশলকে আয়ত্ত করেছে এবং survive করেছে। আর যারা এটাকে করতে পারেনি, তারা কিন্তু survive করতে পারেনি। এটা instinctively একটা survival instinct. আমরা এটা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, কোনো আত্মসন্তুষ্টি নয় এটা। তৃণমূল grassroot থেকে নেতা তৈরি করেনি। যুব তৃণমূল কংগ্রেস হয়েছিল। কিন্তু তারা নতুন কোনো তরুণ প্রজন্মের নেতা দিতে পারেনি। আর বিজেপি, আমাদের যখন বামপন্থীদের স্কুলে কলেজে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয়নি, ১০ বছর ধরে গণশক্তি বিক্রি করতে দেওয়া হয়নি, পোস্টার লাগাতে দেওয়া হয়নি, মিছিল মিটিং করতে দেওয়া হয়নি, আক্রমণ করেছে, ঘরছাড়া করেছে, জেল দিয়েছে, জরিমানা দিয়েছে, আমাদের কাছে একঝাঁক, শুধু নেতা নয়, কর্মী, দরদী, এই যে মিছিল মিটিং দেখবে, resistance লড়াইটা দেখবে, youth তো সামনে আছে। সব প্রান্তিক মানুষের ঘরের ছেলেমেয়েরা। উল্টোদিকে বিজেপির কাছে কী আছে? শাখা বেড়েছে, এই হয়েছে সেই হয়েছে। কিন্তু নেতা কারা? উপর থেকে নিচ অব্ধি? আমি নাম বলে দেব তোমায় সব! সব recycled material. এই যে তোমার খাতা যখন পুরনো হয়ে যাবে, বিক্রি হয়ে যাবে, তারপর ওটা ঠোঙা হবে, তারপর ওটা অন্য কিছু কাজ হতে পারে, প্লাস্টিক যেমন recycled হয় কাঁচের শিশির বোতল, ওরকম পুরনো তৃণমূল নতুন আঙ্গিকে বিজেপির কাছে এসে হাজির হয়েছে। সেই বড় বিরোধী দলের নেতা থেকে শুরু করে শঙ্কুদেব পণ্ডা। গত ১০-১২ বছরে তুমি তৃণমূল নেতাদের নাম বলো। তারা সব এখন বিজেপির নেতা। এখন তো যাইনা টেলিভিশন চ্যানেলে। আগে যখন যেতাম প্রায়ই, দিল্লি থেকে আসতাম, কোনো চ্যানেলে কাউকে তৃণমূল ভেবে খুব গাল দিচ্ছি, কথা শোনাচ্ছি, তখন সে আমায় একটা চিরকুট ধরিয়ে বলল, আপনি ভুল করছেন, আমি এখন বিজেপি। কয়েকদিন পরে হয়েছে, আমি তখন দূর থেকে জয়েন করছি, অনেকসময় শোনা যায় না ভাল, আমি তো বিজেপি ভেবে বলে যাচ্ছি, তখন ওপার থেকে বলছে, আপনি আবার ভুল করছেন। আমি এখন তৃণমূল। বিজেপি ছেড়ে দিয়েছি। এই যে অদলবদল হচ্ছে তাইলে এখানে নতুন প্রজন্ম আসবে কোত্থেকে? বীজতলা আমরা তৈরি করেছি। এখন সে সবুজ দেখছ ওটা বীজতলা। এগুলো আমরা মহীরুহ বলছি না৷ এগুলোকে লালন পালন করতে হবে। আন্দোলন সংগ্রাম। এরা জেল খাটছে। এরা নিজেদের সহকর্মীর জন্য জান বাজি রেখে লড়াই লড়ছে। এরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়ছে। এবং এরা পুলিশ লাঠি গুলি রোবোকপ তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকটা যে বাধা আছে, যে ব্যারিকেড আছে সেটা ভাঙছে। তুমি যেটা দেখছ সামনে সেটা হচ্ছে horizontally barricade ভাঙছে৷ আসলে এই সমাজ রাজনীতি ও অর্থনীতির এই যে বন্ধ্যাবস্থা, এই যে অচলায়তন, সেখানে এরা কিন্তু ceiling ভাঙছে। এটাই হচ্ছে মানুষের কাছে বামপন্থীরা নতুন করে ভরসাস্থল হয়ে উঠছে। এটা আমাদের পরিবারে হয়। যখন দাদু দিদা ঠাকুমারা নিজেদের সন্তানের উপর আর ভরসা করে উঠতে পারে না তখন তার নাতি নাতনি তার উপরে ভরসা করে। মনে করে তোর বাপ কে দিয়ে তো হল না, তোকে দিয়ে হবে। এইজন্যে একটা জেনারেশনের সঙ্গে তার পরের পরের জেনারেশনের ভাব টা বেশি হয়। দাদুর সঙ্গে নাতিনাতনির।

চতুর্থ পর্ব

এটা কোনো প্রজন্মের বিরুদ্ধে একটা প্রজন্ম নয়। সম্মিলিত ধারা। collective মানে শুধুই পাঁচটা লোক নয়। collective মানে শুধু এ ধর্ম বা ওই ধর্ম নয়। collective মানে শুধু এ পাড়া ও পাড়া সে পাড়া নয়। collective মানে একটা গোটা প্রজন্মও বটে। একাধিক প্রজন্মের এক উপযুক্ত combination, সেটা একটা বড় শক্তি৷

একটা সহজ বিষয় স্পষ্ট। এই সরকার ভোট করতে চায় না। কিন্তু মানুষ যে প্রস্তুত এইবার তারা সেটা দেখেছে। মানুষ আর নিজেদের মধ্যে অযথা লড়তে চাইছেন না। সবাই একসঙ্গে মিলে এই দুর্নীতি-দুষ্কৃতি রাজকে সমাপ্ত করতে চাইছেন। সম্প্রীতি এবং ঐক্যের ভিত্তিতে। কোনও একজন মানুষ ভুল করতেই পারে। কিন্তু যখনই ব্যপারটা collective হয়ে যায় তখন কিন্তু ভুল করার সম্ভাবনা কমে যায়। আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে।

এক, তৃণমূলের হুমকি দেবার মত শক্তি এখন আর নেই। কিন্তু পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এবং এই বোমা বন্দুক পিস্তল মেশিন। আমাদের দাবি হচ্ছে সমস্ত বেআইনি বোমা বন্দুক পিস্তল মেশিন উদ্ধার করতে হবে। দরকারে আমরা থানা এস পি থেকে শুরু কিরে ডিজির কাছেও যাব। কারণ পুলিশকে যদি তার নিজের পদমর্যাদা রাখতে হয়, এবং এই যে মানুষের মেজাজ সেটা বুঝতে হবে। তুমি দেখেছ আগেই। আমি সমর্থন করছি না। তাও দেখো শ্রীলংকা থেকে মণিপুর মানুষের মেজাজ হলে নিরাপত্তারক্ষী কম ছিল! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজ্য মন্ত্রীর বাড়ি আগুন লাগিয়ে দিল। দিতে পারে! তার মানে উনি গোটা রাজ্যে কী চাইছে? গৃহযুদ্ধ চাইছে! মানুষ ভোট দিতে চাইবে। সেখানে এই বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র বোমা বন্দুকবাজি যদি করে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই খবর পেয়েছি যেমন মেদিনীপুরে, দ: ২৪ পরগণায়, প: বর্ধমানে আরও কয়েকটা জায়গায়, আমি থানাগুলোর নামও বলতে পারি, পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বা পুলিশ নিজে গিয়ে প্রার্থীদের হুমকি দিচ্ছে। ডেকে পাঠাচ্ছে। যেটা সম্পূর্ণ বেআইনি। মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে না। যে আইনরক্ষক সে যদি বেআইনি কাজ করে, ভাঙরে তো বন্দুক পিস্তল নিয়েই সদলবলে লোকজন এসেছিল। মানুষ শুধু তাড়া দিয়েছে তা নয়, বেঁধে রেখেছে। যেমন বলেছিলাম চোর ধরো, জেল ভরো। কিন্তু পুলিশ ধরল না। পুলিশ না ধরলে মানুষ ধরবে। মানুষের তো জেল নেই, হাতকড়া নেই৷ তাকে বেঁধেই রাখবে। সে তো সবটা বলল। মমতা ব্যানার্জি বলতে পারে, তৃণমূলের জেলা সভাপতি বলতে পারে যে এসবের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সে তো নাম ধরে বলছে, তার পরিবারের লোকেরা বলছে যে কীভাবে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তৃণমূলের এই মস্তানবাহিনীকেও বলব দ্যাখো তোমার নিজের স্বার্থ কোথায় রক্ষা হচ্ছে সেটা দ্যাখো। ৫ হাজার টাকা দেবে, আধ লিটার তেল ভরে দেবে। বিরিয়ানির প্যাকেট দেবে। আর তুমি গিয়ে একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার যে কারবার হচ্ছে তার অংশ হবে সেটা হবে না। আর পুলিশকেও বলব নিয়ম মেনে কাজ করুন, আইন মেনে কাজ করুন। নিজের ঊর্দির মর্যাদা রাখুন। আমরা বামফ্রন্ট সরকার এলে নতুনভাবে পুলিশ রিফর্ম করবই। পুলিশ কেন শাসক দলের হয়ে কাজ করবে। পুলিশ তো মানুষের হয়ে কাজ করবে। নিরাপত্তার জন্য কাজ করবে। মানুষের নিরাপত্তার জন্য কাজ করবে। পুলিশ যদি এইভাবে গুণ্ডামস্তানদের নিরাপত্তা দেয় তাহলে পুলিশকেও নিরাপত্তারক্ষী রাখতে হবে। পরিষ্কার কথা। তাকেও বাঁচতে হবে। এই রাজ্যে তৃণমূলের হাতে ৫ জন পুলিশ খুন হয়েছে। একটারও বিচার হয়নি। দার্জিলিং থেকে মেটিয়াবুরুজ। এটা পুলিশকে খেয়াল রাখতে হবে। যদি পুলিশ খুন করে আনিস খানকে আমরা যেমন ইনসাফ চাইছি, তৃণমূল পুলিশ খুন করলেও আমরাই ইনসাফ চাইব। তারপরে প্রত্যেকটা ঘটনাকে যেমন আইন আদালতে গিয়ে আমাদের আইনজীবীরা যে ভূমিকা পালন করছেন, গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, এখন সব ধরা পড়ছে, যারা চাকরিচুরি করে ওএমআর শিটে গড়বড় করে ভেবেছিল যে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, এখন সব তো বেরচ্ছে। তাহলে নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত যে অফিসার আধিকারিক আছেন, নমিনেশন থেকে কাউন্টিং পর্যন্ত, এবং যে পুলিশ আছে, তাদেরও সমস্ত কার্যকলাপ রেকর্ডেড হচ্ছে। এবং যেটা আনরেকর্ডেড তার রেকর্ডও কিন্তু চাওয়া হবে। সেইজন্যে নির্বাচন কমিশনকে তার ভূমিকা পালন করতে হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব থেকে যত মৃত্যু হয়েছে তার দায় কমিশনের। আর কারো যাতে মৃত্যু না হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও কমিশনের। ভোট এক দফায় হচ্ছে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কারণ তৃণমূলের এখন এত কর্মী নেই যে ওয়ান ডে খেলে ভোট লুট করবে। ওদের এখন পুলিশের পোশাকের দরকার হয়ে পড়েছে। ভোট লুটের বাহিনী যদি শহরাঞ্চল থেকে কিংবা ভিন রাজ্য থেকে আনার চেষ্টা করা হয় তার পরিণতিও ভালো হবে না। আমাদের দাবি, আন্তঃরাজ্য সীমানা সিল করা হোক। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে গড়িমসি ছেড়ে সব বুথে মোতায়েন করা হোক। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে থানায় বসিয়ে না রেখে রুট মার্চ করানো হোক।
সব বুথকে স্পর্শকাতর চিহ্নিত করা কেন হলো না? যে সব বুথে গত নির্বাচনে গন্ডগোল হয়েছে, মনোনয়ন পর্বে যেখানে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বাধা হয়েছে সেই সব ঘটনা ধরে স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হোক, এই ছিল আমাদের দাবি। কিন্তু তা হয়নি। কমিশন মাত্র ৭ শতাংশ বুথকে স্পর্শকাতর বলছে কেন? কারণ মাত্র ৭ শতাংশ বুথেই তৃণমূল ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে, ওখানে নিজেদের নিরাপদ করতে চাইছে। বাকি কোথাও তৃণমূল নিরাপদ নয়। মুখ্যমন্ত্রী রক্ষণাত্মক হয়ে গিয়েছেন, গ্রামে পা রাখার জায়গা না পেয়ে তিনি ঘরে ঢুকে গিয়েছেন।
পুলিশ ভোট প্রচারে বাধা দিয়েছে। তাও লড়াইয়ের ময়দানে বামফ্রন্ট এবং সহযোগীরা আছেন। প্রতিদিন বোমা ফাটছে, মানুষ মারা যাচ্ছেন। মমতা ব্যানার্জির মতোই পুলিশের ডিজি বলেছেন, ‘কয়েকটা ছোট ঘটনা’। নির্বাচন কমিশনার আর ডিজি দু’জনেই কানে ব্লু টুথ লাগিয়ে বসে আছেন, কালীঘাট থেকে যা নির্দেশ আসছে তাই বলছেন। পুলিশ প্রশাসন কালীঘাটের বিবৃতি না দিয়ে বলুক, আর রক্তপাত হবে না, বোমা ফাটবে না। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করুক। পুলিশ যদি ভূমিকা পালন না করে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন যদি অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে তাহলে মানুষকেই সজাগ ও সতর্ক ভূমিকা পালন করতে হবে। সিভিল সোসাইটিকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে। শাসকদলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মনোনয়ন জমা দেওয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবকিছু মানুষ করেছেন, এখন ভোটের দিন ভোট লুটের চেষ্টা হলে, গণনার দিনেও লুটের চেষ্টা হলে তা রোখার জন্য যা করার করতে হবে। মানুষ রায়কে প্রতিফলিত করতে বদ্ধপরিকর।
রাজ্যজুড়ে বোমা বন্দুকের রাজত্ব চলছে, আর রাজ্যপাল কোচবিহার থেকে ভাঙড় বাসন্তী ক্যানিং ছুটে বেড়াচ্ছেন। রাজ্যপাল কি ঘোড়া যে ছুটছেন? রাজভবনের পাশে রেসকোর্স আছে, তামাশা করতে চাইলে ওখানে ছুটুন। রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি, তিনি প্রশাসনের অংশ। প্রশাসনের অগণতান্ত্রিক কাজের বিরুদ্ধে উনি তামাশা করছেন কেন? রাজ্যপালের চোখ দিয়ে ঘটনার বর্ণনায় মিডিয়া পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল বনাম বিজেপি লড়াই দেখানোর চেষ্টা করছে। বাণিজ্যিক মিডিয়ার স্বাধীনতা নেই বলেই তারা পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের হিংসা দেখতে পায় না, জ্বলন্ত মণিপুরে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হলেও দেখতে পায় না। প্রধানমন্ত্রী মোদী পশ্চিমবঙ্গে ২২ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির কথা বললে তার প্রচার হয়, কিন্তু শুধু চিটফান্ডেই লক্ষ কোটি টাকার কেলেঙ্কারির দোষীদের এখনো শাস্তি কেন হলো না তা প্রচার হয় না। মোদী বলেছিলেন, জিএসটি বসায় দাম কমবে, তবু জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কেন? কৃষকদের ফসলের দাম নিশ্চিত করতে মমতা ব্যানার্জির কিষান মান্ডি কী করছে, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে তাঁর টাস্ক ফোর্স কী করছে, এসব প্রশ্ন মিডিয়া তুলছে না। আজ মিডিয়াকেও শৃঙ্খলমুক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
আর সবচেয়ে জরুরি যেটা। আমরা চিরকাল বলে এসেছি। সবার উপরে মানুষ সত্য। মানুষ যদি এককাট্টা থাকে, আজকে এই হুমকি শক্তি যেমন কমেছে, পুলিশের এই দালালি শক্তিও কমবে। এবং জ্যোতি বসুর কথা মনে রাখবে, মানুষই ইতিহাস রচনা করে। বাংলার মানুষ নতুন ইতিহাস রচনার জন্য সেটা লালঝাণ্ডা কাঁধে নিয়ে তারা লড়াইয়ের ময়দানে আছে। বাকি সমস্ত মানুষের আমরা সহযোগিতা ও সমর্থন চাইছি।

Spread the word

Leave a Reply