সত্যেন সরদার
তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু জমায়েতের তুফান তুলে ধর্মতলা ভাসিয়ে দেওয়া প্রতিবাদী জনতা মাথা ঢাকার কোনো নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেননি। না তাঁরা ছাতা খুলেছেন। না কোনো আচ্ছাদনের খোঁজে এদিক ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজেছেন, নেতৃত্বের বক্তব্য শুনেছেন, আর প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদের এই মহাসমাবেশের উত্তাপ বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছেন। রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বছর বছর এই ধর্মতলায় সমাবেশ করে তৃণমূল। সরকারকে সাথে রেখে, ডিম-ভাত খাইয়ে লোক জড়ো করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কিন্তু লালঝান্ডাওয়ালাদের ধর্মতলায় সমাবেশ করতে দেয় না কালীঘাটের গৃহপালিত হয়ে ওঠা পুলিশ। এবারেও ধর্মতলায় সভা করার অনুমতি পায়নি বামফ্রন্ট। তোয়াক্কা করেননি লালঝান্ডার নেতৃত্ব। তোয়াক্কা করেননি লালঝান্ডা কাঁধে পথ হাঁটা মানুষ। তুমুল বৃষ্টি মাথায় গোটা ধর্মতলা চত্বর ভাসিয়ে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, শাসক তৃণমূল এবং সেই দলের মাথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির যাবতীয় প্রতারণার হিসাব বুঝে নেবে বাংলা। রাজ্য থেকে তৃণমূলকে তাড়ানো হবে। কেন্দ্র থেকেও বিজেপি সরকারকে হটাতেও যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করবেন তামাম পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।
সাধে কি আর জনতার নেতা কমরেড জ্যোতি বসু বলেছিলেন, মানুষই শেষ কথা বলেন!
এই ৩১শে আগস্টের ঘটনা। ধর্মতলায় গণআন্দোলন এবং খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবসের সমাবেশের দৃশ্যপট ছিলো এমনটাই। ভিজছেন সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, ভিজছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, ভিজছেন বামফ্রন্টের নেতৃত্ব। সাথে জওহরলাল নেহরু রোডের দু’লেন ভাসিয়ে দেওয়া মহা-জমায়েতও বিলকুল চুপচুপে হয়ে কাক ভেজা ভিজছে। সেই প্রত্যয়ী জনতার সাথে সরাসরি আলাপচারিতায় চলে গেলেন মহম্মদ সেলিম। তিনি বললেন, বৃষ্টিতে ভিজছি আমরা সবাই। এখানে আসার সময় মিছিলেও আমরা বৃষ্টিতে ভিজেছি। কোনো অসুবিধা আছে? গোটা ধর্মতলা কাঁপিয়ে ঘনঘোর বর্ষণস্নাত সেই মহাসমাবেশ সোচ্চারে জবাব দিলো ‘‘না, না, নেই”। প্রত্যয়ী সেই সমাবেশের জোশ আরো বাড়িয়ে দিলেন মহম্মদ সেলিম। তিনি বললেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে রক্তে ভিজে আজ আমরা ধর্মতলায় পৌঁছেছি। বৃষ্টি হোক। অসুবিধা নেই। আমরা এগোবোই।
সেদিনও এমন বৃষ্টিতে ভিজেই লাখো মানুষের প্রতিবাদী মিছিল সামনে এগিয়েছিলো। ১৯৫৯ সালের ৩১শে আগস্টের বিকেলেও ছিলো এমনই তুমুল শরীর ভেজানো বৃষ্টি। ধর্মতলার সমাবেশে সেদিনের সেই কাহিনী শুনিয়েছেন বিমান বসু। তখন তিনি ছাত্র। সেদিনের সেই মিছিলের ভলেন্টিয়ার।
কি ঘটেছিলো সেদিন? কি লেখা আছে গণআন্দোলনের ইতিহাদের পাতায়?
সদ্য দেশভাগের ক্ষত আগলে বাংলা তখন বিধ্বস্ত। জেলায় জেলায় গরিব মানুষের মহল্লা আর উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে খাদ্যের হাহাকার। রেশনব্যবস্থা প্রায় তুলে দিয়েছে প্রফুল্ল সেনের সরকার। চাল নেই, গম নেই, কেরোসিন নেই। ভাতের অভাবে মানুষ টিঁকে রয়েছেন আধপেটা মাইলো খেয়ে। খাদ্যের দাবিতে জেলায় জেলায় চূড়ান্ত বিক্ষোভ আর তীব্র আন্দোলন। তারপর এলো সেই দিন। ৩১ শে আগস্ট, ১৯৫৯। লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত সেদিন কলকাতায়, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে। তখন শহীদ মিনার নামকরণ হয়নি। শহীদ মিনার তখন অক্টারলোনি মনুমেন্ট। খাদ্যের দাবিতে, খাদ্যসুরক্ষার দাবিতে সেই মনুমেন্ট ঘিরেই বুভুক্ষু মানুষের ক্ষুব্ধ জমায়েত। গোটা ধর্মতলা চত্বর মানুষে মানুষে ছয়লাপ। ভুখা মানুষের মিছিলের শুরুতে পুলিশ শুধু বাহিনীর জমায়েতই বাড়িয়ে গেছে। গ্রেট ইস্টার্ণ হোটেলের কাছে, রাজভবনের সামনে আটকে দেওয়া হয় সেই মিছিল। প্রায় ২ঘন্টা মিছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। পরিভাষায় যাকে বলে স্ট্যান্ড স্টিল। ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে হটাৎ করে সেখানেই চারদিক ঘিরে শুরু হয় পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ। দেদার টিয়ার গ্যাসের সেল পড়লো এদিক সেদিক। কোনো গুলি চলেনি, উদগ্র হিংস্রতায় শুধুমাত্র লাঠি দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে মানুষের মাথা ফাটিয়ে তাঁদের মরণের পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছিলো। খাদ্য আন্দোলনের স্মৃতি চারনায় বারে বারে একথাই বলেন বিমান বসু। শুধু লাঠির পর লাঠির আঘাতে সরকারি হিসেবেই খুন করা হয় ৮০ জনকে। বেসরকারি মতে মৃত্যুর কোনো ইয়ত্তা নেই। তাও কলকাতার রাজপথ ছেড়ে এক পাও নড়েননি ক্ষিপ্ত জনতা। ভাতের থালা সামনে নিয়ে খাদ্যের অধিকারের দাবিতে একসাথে শহীদ হয়েছেন ৭৫-এর চুনীলাল দত্ত আর মাত্র ১৪-র সরোজ দাঁ। এরকম আরো কত। পুলিশি অত্যাচারে, তখনকার কংগ্রেস সরকারের প্ররোচনায় আর অনাহার, অর্ধাহারের অভিঘাতে বাংলায় তখন শ্মশানের নৈশব্দ। তবু লড়েছেন কমিউনিস্টরা। ভুখা মানুষের মিছিল সাজিয়ে লড়ে গেছেন খাদ্যের দাবিতে।
খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস থেকে গণআন্দোলনের দিনলিপি
১৯৫৯ সালের ৩১শে আগস্টের সেই ভয়ঙ্কর দিনের পর শুরু হলো খাদ্য আন্দোলনের এক নতুন পর্যায়। পুলিশের লাঠি চালনা ও হিংস্র তাণ্ডব এবং গণহত্যর বিরুদ্ধে ১লা সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট পালিত হলো। এই ধর্মঘটি ছাত্রদের উপরেও পুলিশ আক্রমণ করে, লাঠি চার্জ করে এবং গুলি চালায়। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনার ফলে ৮ জন নিহত ও ৭৭ জন আহত হলেন। এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩রা সেপ্টেম্বর পালিত হলো সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল। সেদিনও রাজ্যের নানা জায়গায় গুলি চললো। মারা গেলেন ১৭ জন এবং আহত হলেন ১৭২ জন। নির্বিচারে গ্রেপ্তার করাও হলো। কংগ্রেস সরকারের লুম্পেন পুলিশ বাহিনীর গুলির আঘাতে জেলাগুলোতেও মৃত্যু মিছিল। শিবপুরের ১৮ বছরের হারাধন পাল পুকুরে স্নান করতে নামার সময় পুলিশের গুলি খেলো। মা ছুটে এসে জাপটে ধরলো সন্তানের লাশ। পুলিশ লাশশুদ্ধু মা-কে থানায় টেনে নিয়ে গেলো। সেদিন রাতে রাজ্যের নানা শ্মশানে পুড়লো এমন আরো ১৭টা লাশ।
কিন্তু এতো অত্যাচার সত্বেও মানুষের প্রতিবাদ স্তব্ধ করা গেল না। মানুষ খাদ্যের দাবিতে আরও উত্তাল হয়ে উঠলেন। ৮ই সেপ্টেম্বর সারা রাজ্যে ছাত্রদের ডাকে শহীদ দিবস পালিত হলো। রক্তস্নাত কলকাতার বুকে ১০ই সেপ্টেম্বর সংগঠিত হলো অবিস্মরণীয় এক মৌন মিছিল। হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্য তদন্ত চাই, খাদ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ চাই। সেই মিছিল থেকেও ১৮৫৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।
১৯শে সেপ্টেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লনে শহীদ স্তম্ভ বানানো হলো। ২৪শে সেপ্টেম্বর সত্যাগ্রহ পালান করলো নানা সংগঠন। ২৬শে সেপ্টেম্বর কলকাতা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে শহীদ স্তম্ভ নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হলো।
সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, লড়াইয়ের ব্যাপ্তি ও প্রতিরোধ-সংঘাতের বিচারে ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য খুবই বিরাট। বামপন্থী দল ও গণসংগঠনসমূহ ঠিক করলো, প্রতি বছর ৩১শে আগস্ট খাদ্য আন্দোলনের শহীদ দিবস হিসাবে পালন করা হবে। পরে ঠিক হয়, শুধু খাদ্য আন্দোলনের শহীদ নন, সকল শহীদের স্মরণেই ৩১শে আগস্ট গণআন্দোলনের শহীদ দিবস হিসাবে পালন করা হবে। এবং তারপর থেকে সেই পরম্পরাই চলে আসছে।
খাদ্য আন্দোলন মানে কোনো একটি বছর নয়, একটা সময় পর্ব
বাংলায় খাদ্যের হাহাকার শুরু হয়েছিলো অবশ্য এরও ঢের আগে। ১৯৪৩ সালে। পরাধীন ভারতে অবিভক্ত বাংলায় এক দুর্ভিক্ষের মহামারীর মধ্যে দিয়ে। শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবে যে মহামারীতে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিলো। দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বুকে ভাতের হাহাকার চিরতরে মিটলো না। তার মাঝেই তেভাগার আন্দোলন হলো। ১৯৪৬-৪৭ সালে। ভাগচাষীদের, বর্গাচাষীদের ফসলের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন। আসলে সেটাও অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটানো গরিব, প্রান্তিক কৃষিজীবী মানুষের খাদ্যশস্যের দাবিতে আন্দোলন। এরআগে ভাগচাষী, বর্গাচাষীদের রক্তে বোনা ফসল পুরোটাই প্রথমে জমিদার, জোতদারদের গোলায় উঠে যেত। তারপর যাঁরা চাষ করতেন সেই ভাগচাষী, বর্গাচাষীদের জন্য বরাদ্দ হতো অর্ধেকেরও অনেক কম ফসল। বেশিরভাগ সময় তিন ভাগের মাত্র একভাগ। তেগাভার দাবি ছিলো ফসলের ৩ ভাগের ২ ভাগ যাঁরা চাষ করেন সেই ভাগচাষী এবং বর্গাচাষীদের দিতে হবে। তার দাবিতেই বাংলার গরিব, প্রান্তিক কৃষিজীবী মানুষের জান কবুল আর মান কবুল লড়াই। এই আন্দোলন অবশ্য দুই বাংলা জুড়েই হয়েছিলো। যে আন্দোলনকে ঘিরেও সৃষ্টি হলো শিল্পীদের একের পর এক অমর দিনপঞ্জি। সোমনাথ হোরের ছবি। তেভাগার ডায়েরি। সলিল চৌধুরির ‘হেঁই সামালো ধান হো / কাস্তেটা দাও শান হো’ গান। নিবারণ পন্ডিতের ‘মোদের দুখের কথা কাকে জানাই’। সাথে পুর্ণেন্দু পত্রী, গোলাম কুদ্দুস, মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়ের একের পর এক অমর সাহিত্য রচনা। তেভাগার দাবি আদায় হলো, কিন্তু খাদ্যের সঙ্কট মিটলো না। রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের সর্বনাশা নীতি আর মজুতদারদের নষ্টামী কারনে গরিব মানুষের খাদ্যের হাহাকার চলতেই থাকলো। সকাল হলেই কলকাতা শহরের বুকে অ্যালুমিনিয়াম অথবা কলাই করা থালা হাতে গ্রাম থেকে আসা বুভুক্ষু মানুষের ভিড়। তীব্র খিদে আর যন্ত্রনায় নিয়ে ঘরের দুয়ারে ‘মা একটু ফ্যান হবে’ হাঁক।
১৯৫৯ সালের ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের পর ফের বিধানসভা নির্বাচন বাংলায়। ফের সরকারের ফিরলো কংগ্রেস। চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাত এবং পাকিস্তানের সাথে সম্মুখ সমর। সেটাও তখন আরেক প্রেক্ষাপট। ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাঙলো। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি দু‘টুকরো হয়ে সিপিআই(এম)-র পথ চলা শুরু। ১৯৬৫ থেকে বাংলায় ফের শুরু হলো চরম খাদ্য সংকট। রেশনে মাথাপিছু আধ কেজি চাল আর এককেজি গম বরাদ্দ। তাও মেলে না সময় মতো।
মানুষ খাবারের অভাবে মরছেন। আর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন তখন মানুষকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ভাতের সাথে কাঁচকলা খান। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় কাঁচকলায় আয়রন আছে। তাতে শরীরে রক্ত হবে। আরো জুত হবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রফুল্ল সেন। ১৯৬৫ সালে প্রফুল্ল সেন বিধানসভায় একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেন, মহলানবিশের রিপোর্ট অনুসারে মানুষের মাথাপিছু ১৮ আউন্স খাবার প্রয়োজন। কিন্তু আমার মতে ১৬ আউন্স হলেই চলে। এরপরেই রাজ্যের মানুষকে কার্যত অপমান করেই তিনি বলেন, ‘‘আবার অনেকের মতে যত পাই তত খাই”। তিনি আরো বলেন, আমি আগেই বলেছি, বর্তমান খাদ্য সঙ্কটে আমাদের খাদ্যের অভ্যাসের পরিবর্তনের প্রয়োজন। এরপরেই তাঁর পরামর্শ, ভাতের সঙ্গে রুটি, আলু, কাঁচকলাটাও খেতে হবে। সবগুলোতেই ফাইবার, আয়রন, কার্বোহাইড্রেট আছে। তোমরা ভাতের সাথে কাঁচকলা, পটল, বেগুন, কুমড়ো সিদ্ধ খেয়ে পেট ভরাতে পারো।
এই পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের অভিজ্ঞতা সাথে নিয়েই ১৯৬৬, ৩০ শে জানুয়ারী সিপিআই(এম) ডাক দিলো, ‘কলকাতা চলো’। কৃষক সভা ঘোষণা করলো, ‘আর নিঃশব্দে মৃত্যু নয়, বাঁচার পথ সংগ্রামের।’ ১৯৫৯ সালের সেই নৃশংস দিনের ভয়াবহ স্মৃতিকে হেলায় হারিয়ে আবার পথে নামলেন লাখো মানুষ। দু‘মুঠো ভাতের জন্য, পেটের দায়ে। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ওমে ফের উত্তাল হলো খিদের শহর কলকাতা। ১১ ই ফেব্রুয়ারী বাম নেতৃত্ব খাদ্যের ও বন্দীমুক্তির দাবিতে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিলেন। ১৬ তারিখ বসিরহাটে কোর্ট ঘেরাও করলো ছাত্রছাত্রীরা। গুলি চললো, লাশের হিসেব নেই। গোটা রাজ্যে শুরু হলো প্রতিবাদ। প্রতিবাদী মিছিলে পুলিশের গুলিতে খুন হলো স্কুলছাত্র নুরুল ইসলাম। তার লাশের কসম নিয়ে চোয়াল শক্ত হলো জনতার। শুরু হলো গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে দলদাস পুলিশ হাঠানোর লড়াই।
গণআন্দোলন তখন রাজপথের দখল নিয়েছে পুরোপুরি। জেলার পর জেলা জুড়ে চলছে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে আন্দোলন। নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণাসহ সমস্ত জেলায় প্রতিদিন পুলিশ ব্যারিকেড ভাঙছেন মানুষ। গ্রেফতার হচ্ছেন শয়ে শয়ে বামকর্মী। কখনও বা থানা ঘেরাও, কখনও বা পুলিশের সাথে সম্মুখ সমরে গিয়ে লড়াইয়ের সাথীদের ছাড়িয়ে আনছেন ছাত্ররা, কৃষকেরা, শ্রমিকেরা।
এরই মাঝে দিল্লিতে লাগাতার বাংলায় গণঅভ্যুত্থানের নিন্দা করে চলেছে ইন্দিরার কংগ্রেস সরকার। নির্দেশ আসছে বাম নেতৃত্বকে গ্রেফতার করার। ১০ ই মার্চ হরতাল ডাকলো বামেরা। একদিনে গ্রেফতার হলেন প্রায় ৮০০০ বামকর্মী ও নেতৃত্ব। চরম পুলিশি বাধা পেরিয়েও ১০ এবং ১১ ই মার্চ সফলভাবে পালিত হলো হরতাল, সারা রাজ্য জুড়ে। ১৩ ই মার্চ শহর জুড়ে হলো মৌন মিছিল। মিছিলে হাঁটলেন আট থেকে আশি, খাদ্যের দাবিতে। মহিলারা পথে নামলেন, স্লোগান তুললেন খাদ্যের দাবিতে, বন্দীমুক্তির দাবিতে। ৪৪ জন বাম মহিলা নেতৃত্ব খাদ্যের দাবিতে আইন অমান্য করে কারাবরণ করলেন একইসাথে।
তখন প্রতিদিন রাজ্যজুড়ে চলছিলো আইনঅমান্য, হরতাল, গণ অনশন। আন্দোলনের চাপে টনক নড়লো দিল্লির সরকারের। মুক্তি দেওয়া হলো ৪৮ জন বাম নেতাকে, কিন্তু তখনও ৭৫০০ মানুষ জেলে। তাই ৬ ই এপ্রিল আবার ধর্মঘট বামেদের। ব্যাপকভাবে সমর্থন করলেন বাংলার মানুষ। সরকারকে তাদের ভাষায় যোগ্য জবাব দিতে চোয়াল শক্ত করেছিলেন বাংলার মানুষ। শপথে ছিলো এইবার হয় এসপার নয় ওসপার।