তিলক কানুনগো
ভারতে বিদ্যুতের প্রদর্শনমূলক ব্যবহার প্রথম হয় ১৮৭৯ সালে কলকাতায়। ফ্লুয়ারি এন্ড কোম্পানি প্রথম বৈদ্যুতিক বাল্ব প্রদর্শন করে। ১৮৮৯ সালে প্রথম রাস্তায় বিদ্যুতের আলো জ্বালানো হয় হ্যারিসন রোডে বর্তমানে যা মহাত্মা গান্ধী রোড নামে পরিচিত। ১৮৯৭ সালে বানিজ্যিক ভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়। মুলতঃ অফিস, বন্দর এবং বড়লোকদের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তখন বিদ্যুৎ সরবরাহ করত Kilburn & Co. (CESC) । ভারতে প্রথম বিদ্যুৎ আইন তৈরী হয় ১৯১০ সালে। এই আইনে ব্যাক্তি মালিকদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়।
আগে কলকাতায় ট্রাম টেনে নিয়ে যেত ঘোড়া। ১৯০০ সালে কলকাতায় ঘোড়ায় টানা ট্রামের পরিবর্তে বিদ্যুৎ বাহিত ট্রামের প্রচলন হয়। এই একই সময়ে হাত পাখার পরিবর্তে সিলিং ফ্যানের প্রচলন হয়। আগে রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বালানো হোত। সেই গ্যাস বাতি বাতিল হয়ে যায়।
ভারতে প্রথম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরী হয় ১৮৯৬ সালে দার্জিলিং এর সিদ্রাবং এ মুলতঃ চা বাগানে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য। ১৮৯৯ সালে প্রথম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরী হয় হুগলির ইমামবাড়ায়। তৈরী করে সি ই এস সি।
তারপর আস্তে আস্তে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। যেমন হাওড়া, আলিপুর, উল্টোডাঙ্গায়। উল্টোডাঙ্গায় ১৯১০ সালে অল্টারনেটিভ কারেন্ট সাপ্লাই শুরু হয় মুলতঃ পাট শিল্পে।
১৯২৯ সালে হুগলি নদীতে টানেলের মাধ্যমে কলকাতার Southern Generating Station ও হাওড়ার Botanical Garden এর মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ করা হয়। বর্তমানে সেই ব্যবস্থা আর নেই।
কলকাতার পরেই মুম্বাই শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। এরপর ধীরে ধীরে গোটা দেশেই অঞ্চল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যেমন দক্ষিন ভারতে Shibasundaram (শিবসুন্দরম) Power Station, পশ্চিম ভারতে Tata Hydro Electric Power Supply Company, Andhra Vally Power Supply company. উত্তর ভারতে Jammu Power Plant ও Mohora Water Power Plant ইত্যাদি।
স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথম বিদ্যুৎ আইন Indian Electricity Supply Act,1948.এই আইন প্রণয়নের প্রশ্নে সংবিধান প্রণেতা ডঃ বি আর আম্বেদকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই আইন বলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত হোল। কিছু কিছু জায়গায় প্রাইভেট কোম্পানি থাকল। যেমন CESC, Bombay Suburban Electric Supply Co., Delhi Electric Supply Co. ইত্যাদি। সি ই এস সি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে আরো অনেক ছোট ছোট কোম্পানি ছিল। যেমন ভাটপাড়া ইলেকট্রিক সাপ্লাই, দিসেরগড় পাওয়ার সাপ্লাই , বারাকপুর ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি, ক্যানিং ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি ইত্যাদি। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এই সমস্ত কোম্পানিগুলো রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের হাতে আসে।
১৯৫০ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সংস্থাপিত ক্ষমতা ছিল ১৭১৩ মে ও। তখন প্রাইভেট সেক্টর উৎপাদন করত ৬৩০ মে ও। আর ৩১শে মার্চ,২০১৯ এ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৫৬,১০০.৯ মে ও। অর্থাৎ ১৮৮৯ থেকে ১৯৫০ ৬১ বছরে ব্যাক্তিমালিকানাধীন সংস্থার উৎপাদন যেখানে ৬৩০ মেঃও সেখানে মাত্র ২ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের উৎপাদন ১০৮৩ মেঃও।
১৯৪৮ সালের আইন বলে বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্যুৎ পর্ষদ গঠন হলেও পঃবঙ্গে পর্ষদ গঠন হয় ১লা মে ১৯৫৫ সালে। এর পিছনে যুক্তি ছিল ডি ভি সি আছে, তারাই পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। কিন্তু ডিভিসি অত্যন্ত নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
ভারতে ১৯৫০ সালে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল মাথাপিছু ১৫ ইউনিট বর্তমানে (২০২০ সালের হিসাবে ) ১২০৮ ইউনিট।. অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবস্থাতেই মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৪-৭৯) গড়ে উঠল NTPC, NHPC, NPCIL-র মত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা।
১৯৪৮ সালের বিদ্যুৎ আইনের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে উন্নত সেচ ব্যবস্থা। তার মধ্যে দিয়েই দেশ কৃষি ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে পেরেছে। ১৯৯১ সালে দেশে এল উদার অর্থনীতি। উদার অর্থনীতির হাত ধরেই এল বিদ্যুৎ ক্ষেত্রেও উদারীকরণ নীতি। এই উদারনীতির হাত ধরেই ১৯৯৫ সালে প্রথম ওড়িশা রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদকে বেসরকারিকরণ করা হোল। ১৯৯৯ সালে ওড়িশায় হয়ে যাওয়া সুপার সাইক্লোনে ওড়িশার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্পুর্ন ভেঙে পড়লে ব্যাক্তিমালিকানাধীন সংস্থা ভেঙে পড়া বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনর্গঠনে অস্বীকার করলে রাজ্য সরকারকেই অর্থ বরাদ্দ করতে হয় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনর্গঠনে।
১৯৯৮ সালে Electricity Regulatory Commission Act র মধ্য দিয়ে তৈরী হোল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। মাশুল নিয়ন্ত্রণ সহ প্রায় সমস্ত ক্ষমতায় সরকারের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে দেওয়া হোল কমিশনের হাতে।
এরপর এল বিদ্যুৎ আইন,২০০৩। এই আইনে পারস্পরিক ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলা হোল। বলা হোল বিদ্যুৎ শিল্প বেসরকারিকরণ করার কথা। যদিও ২০০৪ সালে প্রথম ইউ পি এ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বামপন্থীদের চাপে আইনে অনেকগুলি জনস্বার্থবাহী সংশোধনী আনতে হয়।
এখন নিয়ে আসা হয়েছে বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল,২০২১। যদিও দেশজুড়ে বিদ্যুৎ কর্মী ও ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় সমন্বয় কমিটির তীব্র লড়াই এবং সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার এক ব্ছরের বেশী সময় ধরে চলা লড়াইয়ের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল,২০২১ আপাতত স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সুযোগ পেলেই এই বিলকে কেন্দ্রীয় সরকার আবারও যে নিয়ে আসবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর সেই কারনেই জম্বু কাশ্মীর, চন্ডীগড় এবং পন্ডিচেরির বিদ্যুৎ ব্যাবস্থাকে বিক্রি করে দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কেন্দ্রশাসিত এই সমস্ত অঞ্চলগুলির সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে বিদ্যুৎ কর্মীরা যে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন সেই আন্দোলনের সামনে কেন্দ্রীয় সরকার মাথা নত করতে বাধ্য হয়। এই বিলকে আইনে পরিনত করার মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ শিল্পের বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া সম্পুর্ন করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিদ্যুৎ শিল্পকে বড়লোকের ভোগ্যপন্যে পরিনত করতে চাইছে। দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে স্বাধীনতাপূর্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে চায়। বেসরকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাকে ৪০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ বেশী দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য থাকবে বন্টন কোম্পানীগুলি। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। এই প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি মহারাষ্ট্রে দাভোলে এনরন কোম্পানির কথা। মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ নিজস্ব উৎপাদন বন্ধ রেখে বেশী দাম দিয়ে এনরনের বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হয়েছিল। ন্যুনতম ১৬ শতাংশ মুনাফার গ্যারান্টি দিতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে নিজের দেশেই এনরন দেউলিয়া ঘোষিত হয়ে যাওয়াই ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি হবে। ব্যাক্তি মালিকানাধীন সংস্থার দুর্নীতির একটি বড় উদাহরণ রিলায়েন্স গোষ্ঠীর সাসান বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ সংস্থার নিয়ম অনুসারে যে কোনও বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থা বানিজ্যিক উৎপাদনের আগে ইউনিটকে অন্তত ১৪ দিন পরীক্ষামূলকভাবে চালাতে হবে যার মধ্যে অন্তত ৭২ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘোষিত উৎপাদন ক্ষমতার সম্পুর্ন উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে রিলায়েন্স নিজেরাই জানিয়ে দেয় বানিজ্যিকভাবে উৎপাদনের দিন ৩১শে মার্চ,২০১৩। এর মধ্যে দিয়ে মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান,দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের বন্টন কোম্পাণীগুলিকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। এই ঘটনায় অল ইন্ডিয়া পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারস ফেডারেশন কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রন কমিশনের কাছে তাদের আপত্তির কথা জানালে সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে কমিশন জানায় বানিজ্যিক উৎপাদনের দিন ১৬ই আগষ্ট,২০১৩। রিলায়েন্স গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এপিলেট ট্রাইবুনালে আপিল করলে এপিলেট ট্রাইবুনাল রিলায়েন্সের নির্ধারিত দিনকেই মান্যতা দেয় এবং এর মধ্য দিয়ে রিলায়েন্স প্রায় ১০৫০ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা অর্জনের সুযোগ পেয়ে যায়। এপিলেট ট্রাইবুনালের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অল ইন্ডিয়া পাওয়ার ইঞ্জিনীয়ারস ফেডারেশন মহামান্য সুপ্রীম কোর্টে মামলা দায়ের করে। সেই মামলার রায়ে সুপ্রীম কোর্ট বলেন রিলায়েন্স বন্টন কোম্পাণীগুলির সাথে প্রতারনা করছে এবং এই প্রতারনার কাজে সহযোগিতা করছে এপিলেট কমিটি । এইভাবে বেসরকারী কোম্পানিগুলি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারনা করছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ব্যাতয় ঘটিয়ে গুজরাট সরকার হাই পাওয়ার কমিটি তৈরী করে আদানি গোষ্ঠিকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে।
বিদ্যুৎ কর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধে এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল পাশ করাতে পারেনি। এউ অবস্থায় বিদ্যুৎ শিল্পকে ঘুরপথে বেসরকারিকরনের লক্ষ্যে নিয়ে এসেছে একটি নতুন স্কীম, যার নাম দিয়েছে রিভ্যাম্পড ডিস্ট্রিবিউশন সেক্টর স্কীম(RDSS)।
এই স্কীম কার্যকর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার চালু সমস্ত আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। ৩ লক্ষ কোটি টাকার প্রিপেড স্মার্ট মিটারিং স্কীমে ২ লক্ষ কোটিরও বেশী টাকার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকার ও গ্রাহকদের উপর।
কি হবে এই “RDSS” স্কীম চালু হলে?
এই স্কীম চালু হলে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের নামে পারষ্পরিক ভর্তুকি তুলে দেবে। তার ফল কি হতে পারে তা আমরা দেখেছি গ্যাসের ক্ষেত্রে। রেগুলেটরি কমিশনকে বাধ্য করা হবে বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি করতে। গোটা দেশজুড়ে গ্রাহকদের বাধ্য করা হবে প্রিপেড স্মার্ট মিটার বসাতে। এবং তা বসাতে হবে গ্রাহককে নিজস্ব ব্যায়ে। স্মার্ট মিটারের আয়ু বড় জোর ৭/৮ বছর। মিটারের দাম হবে ৭/৮ হাজার টাকা। গ্রাহকের বিদ্যুতের বিলের বোঝা বেড়ে যাবে ভয়াবহভাবে। স্মার্ট মিটার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গ্রাহকের বিদ্যুৎ ব্যবহারের চিত্র চলে যাবে স্মার্ট মিটার বসানোর কাজে নিযুক্ত এজেন্সির হাতে। মুনাফাখোর ব্যাবসায়ীদের কাছে চলে যাবে কখন কোন এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা বেশী সেই চিত্র। ফলে লাভজনক এলাকা চিহ্নিত করে ব্যাক্তি মালিকানাধীন সংস্থা যথেচ্ছ দাম হাঁকাতে পারবে। ব্যাক্তি মালিকানাধীন সংস্থা সবচেয়ে লাভজনক এলাকায় বিদ্যুৎ বন্টন করার লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করতে পারবে। স্মার্ট মিটার বসানো এজেন্সি ঠিক করবে কোথায় কতটা বিদ্যুৎ দেবে। টাকা শেষ হয়ে গেলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। দিনের বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুতের দাম হবে বিভিন্ন। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় দাম বেড়ে যাবে অস্বাভাবিক হারে। ফলে গরীব মানুষ এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষও বিদ্যুৎ ব্যবহারের অধিকার হারাবে।
পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা কি? ২০১০-১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুতের গড় মাশুল ছিল ৪.৭১টাকা। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুতের গড় মাশুল ৬.৪৩টাকা। ২০১৮-১৯ সালে গড় মাশুল ছিল ৭.১১টাকা। এর থেকে মনে হতে পারে গড় মাশুল কমেছে। বাস্তব চিত্র কিন্তু অন্য কথা বলছে। এই সময়ে গড় মাশুল কমলেও ফিক্সড চার্জ বেড়েছে প্রভুত পরিমানে। ফলে বিদ্যুৎ বিল বাবদ গ্রাহককে অনেক বেশী টাকা দিতে হচ্ছে। গড় মাশুল কমানো আসলে গ্রাহককে ধোঁকা দেওয়া। ২০১০-১১ সালে ন্যুনতম চার্জ ছিল ২৫ ইউনিট পর্যন্ত। পরবর্তীকালে বেড়ে হয়েছিল ৪৪ ইউনিট। বর্তমানে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৭৫ ইউনিট। অর্থাৎ আপনি বিদ্যুৎ ব্যবহার করুন আর নাই করুন আপনাকে ৭৫ ইউনিটের টাকা দিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০শে ডিসেম্বর, ২০২২ এই স্কীমকে বন্টন সংস্থার উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। এই প্রকল্পে প্রিপেড স্মার্ট মিটার চালু করতে ১২৬২৩.১২ কোটি টাকার বোঝা বাংলার জনগনের উপর চাপানো হবে। এই স্কীমের বাইরে রাজ্য সরকার নিজস্ব উদ্যোগে কিছু স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ শুরু করেছিল। সেই কাজ বন্ধ করে পুরো নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হচ্ছে এজেন্সির হাতে। গোটা বাংলা জুড়ে ২.০৭ কোটি গ্রাহককে স্মার্ট মিটারের আওতায় আনতে চলেছে সরকার। এছাড়াও ৩ লক্ষ ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার, ১২ হাজার ৩৩ কেভি ও ১১ কেভি লাইনে থাকা ভালো মিটারগুলি প্রিপেড স্মার্ট মিটারের মাধ্যমে পরিবর্তন করছে। এইভাবে রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের উপর ২০ হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। ডিসেম্বর,২০২৩ এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে এই কাজ সম্পুর্ন করার জন্য সময় সীমা নির্ধারণ হয়েছে।
এর ফলে গ্রাহকদের উপর নেমে আসবে বিপদ। চুক্তি অনুযায়ী যে গ্রাহকের লোড কম আছে অথচ বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন বেশী তাঁরা বিপদে পরবেন। লোড বেশী হলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। লোড বাড়ানোর জন্য তাঁকে ছুটতে হবে বণ্টন কোম্পানীর অফিসে। সেখানে আবেদন করার পরে টাকা জমা দিতে হবে। তারপর বণ্টন কোম্পানী মিটার কোম্পানিকে জানালে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হবে। বিলের টাকা বেশী মনে হলেও কার্যত কোন অভিযোগ জানাতে পারবেননা। অভিযোগ যদিও বা জানাবেন তা জানাতে হবে বন্টন কোম্পানীর কাছে। তারা জানাবে মিটারিং কোম্পানিকে। তারা এসে মিটার চেক করবে। মিটারের কোন সমস্যা থাকলে বন্টন কোম্পানিকে জানাবে। তারপর বণ্টন কোম্পানী ব্যবস্থা গ্রহন করবে। কিন্তু আপনি যতক্ষন পর্যন্ত স্মার্ট মিটারে টাকা ভরবেননা ততক্ষন বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হবেনা।
কেন স্মার্ট মিটারের বিরোধিতা:
১) এখন আমরা আগে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি, তারপর বিদ্যুতের বিল বাবদ টাকা জমা দিই। স্মার্ট মিটারিং ব্যবস্থায় আগে টাকা দিতে হবে, তারপর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন। যেমন মোবাইলে আপনি আগে টাকা দেন তারপর কথা বলতে পারেন। টাকা শেষ হয়ে গেলে নিজে থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এমনকি মিটারিং সংস্থার ভুলে টাকা শেষ হয়ে গেলেও কার্যত কিছু করার থাকবেনা।
২) সকল গ্রাহকের ভর্তুকি কার্যত তুলে দেওয়া হবে। বিশেষ করে কৃষি গ্রাহকদের ফিডার আলাদা করে তাদের পারষ্পরিক ভর্তুকি তুলে দেওয়া হবে। যার ফলে দেশের কৃষি ব্যবস্থা চুড়ান্ত সংকটে পরবে।
৩) চালু করা হবে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার। অর্থাৎ যদি কোন রাজ্য সরকার ভর্তুকি দিতে চায় তাহলে তা সরাসরি ব্যাংকে ট্রান্সফার করা হবে। যা ইতিমধ্যে রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রে চালু করা হয়েছে। এবং তার পরিনতি কি হয়েছে তা সবাই জানি।
৪) স্মার্ট মিটারিং ব্যবস্থা গ্রাহককে সরাসরি খোলা বাজারে ঠেলে দেবে। বিদ্যুতের মাশুল বৃদ্ধি হবে অস্বাভাবিক হারে। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় বিদ্যুতের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। সর্বোচ্চ চাহিদার সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫০ টাকা অথবা তার থেকেও বেশী হবে।
৫) বন্টন সংস্থা বাজার থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহককে সরবরাহ করবে। কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করবে স্মার্ট মিটারিং কোম্পানী এবং সমস্ত সরকারি বেসরকারী কোম্পানীর টাকা ফেরত দেবার পরে অবশিষ্ট যা থাকবে তা পাবে বন্টন কোম্পানী। অর্থাৎ বন্টন কোম্পানিকে তার প্রাপ্য টাকার জন্য তৃতীয় পক্ষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।
৬) রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ আর্থিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। বেসরকারি কোম্পানী লাভজনক এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবসা করবে। অপরদিকে ভেঙে পরা আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে গ্রামীন এলাকায় ব্যাপক হারে অবিদ্যুতায়ন করবে সরকারী কোম্পানী।
৭) বিরাট সংখ্যক গ্রাহকের ব্যাক্তিগত তথ্য চলে যাবে দেশী বিদেশী বেসরকারি কোম্পানীর হাতে।
৮) ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলছে এই ব্যবস্থা অত্যান্ত বিপজ্জনক।
৯) লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মচারী , যাঁরা মিটার রিডিং, বিলিং এবং আনুষঙ্গিক কাজে যুক্ত আছেন তাঁদের কাজ চলে যাবে চিরতরে। যার মধ্যে অধিকাংশ ঠিকা শ্রমিক।
১০) এই ব্যবস্থা দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করবে।