Crony Capital Cover

Crony Capitalism: The Tide

সুকুমার আচার্য

একসময় কমিউনিস্টদের নামে বিদ্রূপ করে দক্ষিণপন্থী শাসক ও তার দলবল বলত- এরা রাশিয়ায় বৃষ্টি হলে বাংলায় ছাতা ধরে। সে তো না হয় আদর্শগত দিক। বিশ্ব মানবতার কোনো সীমানা যেমন নেই, তাকে কোনো কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যায় না, তেমনি মতাদর্শ, সাহিত্য, নান্দনিক শিল্প, বিজ্ঞান তার ও কোনো সীমানা নেই। তাকেও কোনো কাঁটা তারের বাঁধুনি দিয়ে আটকে রাখা যায় না। কমিউনিস্ট মতাদর্শ একটা বিজ্ঞান। তার মতাদর্শ হল সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ। তাই তাকেও এভাবে আটকে রাখা যায় না।

Capitalism and Religion Cover

পুঁজিও আন্তর্জাতিক, সে সব দেশে বিচরণ করে, শোষণও চালাতে পারে। নয়া-উদারবাদের যুগে তার গতি তীর হয়েছে। পুঁজিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে লুঠেরাদের চক্র। লুঠেরারা সরকারকে ব্যবহার করে, তাদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে অর্থচালছে আর তারপর যে মুনাফা তুলে আনছে সেই উৎপাদন বিচ্ছিন্ন পুঁজিকে বলা হচ্ছে স্যাঙ্গাত পুঁজি। স্রেফ লুঠেরাদের ও সরকারের মধ্যে দোস্তিজাত পুঁজি। লুঠেরাদের দোস্তিকে চলতি কথায় বলে স্যাঙ্গাত। সেই থেকে স্যাঙ্গাত পুঁজি নাম।

পুঁজি আন্তর্জাতিক হলে তার তরঙ্গ এক দেশ থেকে গিয়ে পড়ে আর এক দেশে। একদেশের শেয়ার বাজার থেকে আর এক দেশের শেয়ার বাজারে অর্থ চলে যায়। যেখান থেকে যায় সেখানে পড়ে মাথায় হাত, আর যেখানে যায় সেখানে একটু খুণী খুণী ভাব আসে শাসকদের মধ্যে। এইভাবে পুঁজির তরঙ্গ এক দেশ থেকে আর এক দেশে তরঙ্গায়িত হয়। সাঙাত পুঁজি ও সেইরকম। একদেশের ঘুষ কান্ড, আর এক দেশের শেয়ার বাজারে গিয়ে ছাপ ফেলে। আদানিদের সম্পর্কে আমেরিকার রুকলিন জেলা আদালত যে কথা বলতে চেয়েছে, তা অনেকটা এইরকম। তারা অবশ্য বলেছে, এটা অভিযোগ। গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে বলেছে, নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে আদানিদের এবং তারজন্য উক্ত আদালত সাহায্যও করবে। ধরে নেওয়া যাক, আদালতে আদানিরা নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। কিন্তু গোটা ঘটনার মধ্যে বা অভিযোগের মধ্যে যে প্রক্রিয়ার বাস্তবতা মেনে নেওয়া হল, তা স্যাঙ্গাত পুঁজির তরঙ্গায়িত হবার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয় এবং স্যাঙ্গাত পুঁজি এইভাবেও তাহলে এক দেশ থেকে আর এক দেশে তরঙ্গায়িত হতে পারে। এইবার অভিযোগের সম্পূর্ণ ঘটনায় আসা যাক।

২১শে নভেম্বর, ২০২৪ নিউইয়র্কের রুকলিন জেলা আদালত, গৌতম আদানি সহ আট জনের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ আনে। অভিযোগগুলি এইরকম-

ক) ঘুষ দেওয়া,

খ) প্রতারণা করা,

গ) তদন্তে অসহযোগিতা করা,

ঘ) পরিকল্পিত ভাবে তথ্য প্রমাণ লোপাট করা।

অভিযোগ করা হয়েছে আদানি গ্রীন এনার্জী এবং তার সহযোগী সংস্থা এ্যাজিওর পাওয়ার এ যুক্ত কয়েকয়জনের বিরুদ্ধে এবং এদের সাথে সিডিপিকিউ নামে একটি সংস্থার কয়েকজনের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ হলেন- গৌতম আদানি, তাঁর তাইপো সাগর আদানি, আদানি গ্রীন এনার্জীর সিইও বিনীত জৈন, এ্যাজিওর পাওয়ার এর সিইও প্রজিত গুপ্তা এবং ‘সিডিপিকিউ’র সিরিল কাবালিশ, সৌরত আগরওয়াল ও দীপক মালহোত্রা। ‘সিডিপিকিউ’ একটি কানাডার সংস্থা। এটি এ্যাজিওর পাওয়ার এর বড় শেয়ার হোল্ডার।

অভিযোগটা হল, আদানি গ্রীন এনার্জী প্রচুর সৌরবিদ্যুত উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু তারা তো সরাসরি বিক্রি করতে পারে না। রাজ্যগুলিকে বিক্রি করতে হয়। সৌরবিদ্যুত বিপননের জন্য ভারতে একটি মাধ্যম সংস্থা আছে। তারা বিদ্যুৎ উৎপাদকদের কাছ থেকে কেনে এবং রাজ্যগুলিকে বিক্রি করে। সংস্থাটির নাম ‘সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’ বা এস ই সি আই। এটি একটি ভারত সরকারের অধীনস্থ সংস্থা। অভিযোগ এইরকম যে, আদানি গ্রীন এনার্জি আট শত কোটি ওয়াট (আট গিগা ওয়াট) এবং এ্যাজিওর পাওয়ার চার শত কোটি ওয়াট (চার গিগা ওয়াট) বিদ্যুৎ এসইসিআই’কে বিক্রি করবে। প্রতি ওয়াটে তারা দাম নেবে ‘এসইসিআই’র কাছ থেকে ২ টাকা ৪৯ পয়সা। কিন্তু ২০২০ সালে তখন না কি। দাম ছিল ওয়াট প্রতি ২ টাকা বা তারও কম। এখন এই বাড়তি দামে যারা কিনবে তাদের কে রাজী করাতে হবে। অন্তপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, ছত্তিশগড় এবং জম্মু কাশ্মীরের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের রাজী করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। অভিযোগ পত্রে অন্তপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর নাম লেখা না থাকলেও ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা (দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়া টুডে, ডেকান হেরাল্ড) ওয়াই এস আর কংগ্রেসের জগনমোহন রেডিডর দিকে ঈঙ্গিত করেছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে এদের ২৬২ কোটি ডলার (২০২৪ ভারতীয় মুদ্রায় ২২৩৬ কোটি টাকা) ঘুষ দেবার বিনিময়ে সম্মতি আদায় করা হয়েছে। এরা বেশী দাম দিয়ে এসইসিআই-র কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনেছেন। এই সমস্ত লেনদেনে নাকি গৌতম আদানি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় আগামী ২০ বছরে আদানি গ্রীন এনার্জী নাকি ভারতীয় মুদ্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা লুট করত। দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট সব রাজ্যগুলি ২০২১-এর জুলাই থেকে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারী এই ব্যাপারে চুক্তি করেছে।

এই সমস্ত তথ্য দায়ের করেছে আমেরিকার একটি সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফবিআই’। তারা এমন অভিযোগও করেছে যে সাগর আসানি তাদের সহযোগিতা করেনি। তারা আমানিদের আমেরিকায় থাকা সমস্ত ল্যাপটপ, ই-মেল সহ বৈদ্যুতিন মাধ্যম বাজেয়াপ্ত করে এবং সেইগুলি বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে তারা অভিযোগ দায়ের করেছে। আইনী পরিভাষায় এর নাম ‘ওয়্যার ফ্রড’ (Wire Fraud) অর্থাৎ বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রতারণা।

কিন্তু ঘুষ কান্ড তো চলছিল ভারতে। আমেরিকার মাথা ফাটল কোথায় যে তারা তদন্তের কাজে নেমে গেল? ‘সিকিউরিটি ফ্লাড’ অর্থাৎ শেয়ার বাজারকে ঘিয়ে প্রতারণা বদ্ধ করার জন্য আমেরিকার একটা আইন আছে। উল্লেখিত আদানিদের ঘুষ তরঙ্গ আমেরিকার শেয়ার বাজারকে খাতা দিল বলে আমেরিকার মাথাব্যাথা শুরু হল। বিষয়টা কি রকম?

ফরেন কোরাপ্ট প্র্যাকটিশ এ্যাক্ট ‘এফসিপিএ’ বলে আমেরিকায় একটা আইন আছে সেটা হল আমেরিকার শেয়ার বাজার থেকে যে সমস্ত কোম্পানী অর্ধ তুলবে (শেয়ার বা বন্ডের মাধ্যমে) তাদের এটা জানাতে হবে যে তারা বিশ্বের কোথাও খুষ এবং প্রতারণার কাজে যুক্ত থাকতে পারবে না। যদি তারা এটা করে তবে আমেরিকায় আইনে তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে বিবেচিত হবে। সংস্থাটি আমেরিকার না হলেও তাদের আমেরিকার আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হবে। আদানিদের সংস্থা ও তার সহযোগী সংস্থা, প্রকাশ্যেই জানায় যে তারা সর্বোচ্চ নীতি নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত এবং পৃথিবীর কোথাও তারা অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। দুর্নীতির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ‘জিরো টলারেন্স’ অর্থাৎ দুর্নীতি সম্পর্কে তারা অসহিষ্ণু।

আদানি গ্রীন এনার্জীর সহযোগী সংস্থা হ্যাঙ্গুরে পাওয়ার ২০১৬-র অক্টোবরে আমেরিকার স্টক এক্সচেজে নখীভূক্ত হয় এবং তাদের কোম্পানীর শেয়ার বাবদ ৪৭ কোটি ডলার অর্থ সংগ্রহ করে, তারপর ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে ৩২ কোটি ডলার গ্রীন বন্ড বাবদ সংগ্রহ করে। ২০২১ এর মার্চ অবধি আদানি গ্রীন এনার্জী এবং ত্যাজুরে পাওয়ার ১৩৬ কোটি ডলার আমেরিকার শেয়ার বাজার থেকে সংগ্রহ করেছে।

সুত্রঃ দ্য ইকনমিক টাইমস

অপরদিকে ভারতে ‘এসইবিআই’ স্টক এক্সচেঞ্জ বোর্ডের একটা নিয়ম আছে। সেটা হল প্রহিবিশন অব ফ্রডলম্যান্ট এন্ড আনফেয়ার ট্রেড প্র্যাকটিশ রিলেশন হ্যাক্ট। এই আইনের বলে, ভারতের শেয়ার বাজারে কোনো নথীভুক্ত কোম্পানীর বিরুদ্ধে পৃথিবীর কোথাও যদি কোনো তদন্ত শুরু হয় তবে তা তৎক্ষণাৎ এসইবিআই কে জানাতে বাধ্য থাকবে।

১৭ই মার্চ, ২০২৩ আমেরিকার এফ. বি.আই তদন্ত শুরু করেছে শুধু নয়, আমেরিকায় থাকা তার সমস্ত বৈদ্যুতিন মাধ্যম বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ও গৌতম আদানির ‘ই-মেলে’ না কি জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। এখন এসইবিআই এবং ভারত সরকার বিষয়টা নিয়ে ২০২৪-এর ডিসেম্বর অবধি কিছু ভেবেছে বলে অন্ততঃ তেমন খবর প্রকাশিত হয়নি।

এদিকে আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। আমানিদের শেয়ার বাজারে যে সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এইসময় তার পরিমান কম নয়- প্রায় ২৩ লক্ষ কোটি টাকা। দেশে যা ক্ষতি হওয়ার তো হলই, আমেরিকার শেয়ার বাজারেও তার ঢেউ লাগল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার স্টক এক্সচেজ গুলির শেয়ার হোল্ডাররা চেঁচাতে শুরু করল। একেই বলে স্যাঙ্গাত পুঁজির তরঙ্গায়িত হবার প্রক্রিয়া। ঘটনা ঘটছে ভারতে আর ফল পড়ছে আমেরিকায়। কোথায় পড়ছে বৃষ্টি আর কোথায় মেলে ধরছে ছাতা!

সে যাই হোক, আর্থিক পুঁজির উদারীকরণ প্রক্রিয়ায় স্যাঙ্গাত পুঁজিরও প্রতাপ বাড়ছে। সারা বিশ্বে বাড়ছে। ভাবতেও বাড়ছে। উইকিপিডিয়া ভারতবর্ষ নিয়ে যে তথ্য দিচ্ছে তা অত্যন্ত মারাত্মক। ১৯৫৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯০ এর মধ্যে বড় আর্থিক দুর্নীতির ঘটনা ঘটে মাত্র ৪টি। ১৯৯০ সালে স্পষ্টত ভারত আর্থিক উদারীকরনের পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯১ থেকে ২০২৪ নভেম্বর অবধি ভারতে বাড় ধরনের নানা দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে ৬৬টি। তার মধ্যে বড় ধরনের আর্থিক দুর্নীতির ঘটনা ৬৯টি। এ তো তরঙ্গ নয়। যেন সমুদ্রের বড় ঢেউ। দুনিয়ার সব দেশেই হয়ত এইরকম চেউ উঠছে। সময় এলে এক এক দেশে এক এক রকম ভাবে আছড়ে পড়তে পারে। যাকে হয়ত আটকে রাখা যাবে না।

কভারে ব্যবহৃত ছবিঃ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা নির্মিত

Spread the word

Leave a Reply