২০১০ সাল। মাওবাদী-তৃণমূলী যৌথ চুক্তি-প্রকল্পই ছিল এ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল থেকে কমিউনিস্টদের উৎখাত করা। প্রতিদিন সাথীদের রক্তে রাঙা হচ্ছে সবুজ বনানী। ভয়াবহ সেই সন্ত্রাসের দিনলিপি চিত্রশিল্পীদের তুলির আঁচড়ে ধরে রাখতে বিজয় পালের সম্পাদনায় পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটি প্রকাশ করেছিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শিল্প’ শিরোনামে চিত্রশিল্পের এক অনন্য দলিল-গ্রন্থ। গ্রন্থটির অসামান্য ভূমিকা লিখেছিলেন সদ্য প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদার। আজকের সময়েও তাঁর লেখার প্রতিটি শব্দ-বাক্য সমান প্রাসঙ্গিক।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/07/Tarun-Maujmder-1.jpeg)
আমাদের জীবন মোটামুটি শান্ত সরলরেখায় চলতে চলতে মাঝেমধ্যে, অকস্মাৎ, কোমর দুলিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে নেচে ওঠে। অদৃশ্য সিসমোগ্রাফে ধরা পড়ে সেই কাঁপন— কখনও মৃদু, কখনও বা গুরুতর। এই যে স্বাভাবিক একটা ধারার মধ্যে আচমকা বিকারের লক্ষণ ফুটে ওঠা— এ সময়টায় আমাদের সতর্ক থাকার সময়। কেন না, ভূকম্পের সময় রিখটার স্কেল একটা নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে ছোটাছুটি করলে যেমন অনেক সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে, জীবনেও যদি ছন্দের বাইরে অতিরিক্ত কাঁপন দেখা দেয়, তবে সেখানেও অনেক অনাসৃষ্টির সম্ভাবনা।
এই ব্যাপারে আগাম সতর্কবার্তা চট করে আমজনতার কানে এসে পৌঁছয় না। যাঁদের মারফৎ পৌছনোর কথা সেই মিডিয়াও এখন বহুক্ষেত্রেই ধর্মভ্রষ্ট। মানবতার বার্তার বদলে মালিকের বার্তাকেই লাউডস্পীকারের মতো চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়াটাই নিজেদের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/07/Tarun-Majumdar.jpg)
তাহলে?
বিপর্যয় যখন জোরে কড়া নাড়ে তখন মানুষকে সতর্ক করবে কে বা কারা?
এখানেই আসে শিল্পীদের কথা, সাহিত্যিকদের কথা,গায়কদের কথা, সুরকার বা নাটকের লোকজনদের কথা। যেহেতু সাধারণ ভালো মানুষ অথবা পাকা মতলববাজ— এই দুটি শ্রেণি থেকেই তাঁরা স্বতন্ত্র— তাঁদের বুদ্ধি অনেক বেশি শাণিত , দূরদৃষ্টি বহুবিস্তৃত আর মনটাও অনেক বেশি সংবেদনশীল— তাই সময়ের ডাকে তাঁদেরই সবার আগে সাড়া দেবার কথা। যদি দেন, তাহলে বুঝতে হবে তাঁরা নিজ অধিকারে সমাজের শিরোভূষণ। তাঁদের আমরা মাথায় করে রাখব।
কিন্তু এই শ্রেণির বরেণ্য মানুষরা সর্বদা সময়ের বাঁকে সাড়া দেন কি? শাণিত বুদ্ধি আর সংবেদনশীল মন নিয়েও পিতামহ ভীষ্ম অথবা দ্রোণের মতো চরিত্রেরা মহাভারতের সেই কুখ্যাত পাশাখেলা অথবা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মুহূর্তে চুপ করে ছিলেন। আমাদের দেশে স্বাধীনতা পূর্ব কতো বড় যে একটা মন্বন্তর— যা কিনা শাসক কুলের তৈরী মহা দুর্ভিক্ষ কুখ্যাত— সেখানে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর অকারণ মৃত্যুর বীভৎসার মাঝখানে দাঁড়িয়েও ক’ জন শিল্পী ঠিক সেই মুহূর্তে, হাতের তুলিকে তরবারির মতো ব্যবহার করেছিলেন? ক’জন লেখক কলমের ডগায় আগুন ছুটিয়ে ছিলেন? জানি, ব্যতিক্রমী হিসেবে জয়নাল আবেদীন, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোড়, তারাশঙ্কর বা প্রবোধ সান্যালের নাম উঠে আসবে। কিন্তু এঁরা তো হাতে-গোনা। বাকিরা? বাকি হাজার হাজার শিল্পীরা? তাঁরা কেন প্রলয়কালে নীরব থেকে অপেক্ষা করে রইলেন সেই নিরাপদ সময়ের জন্য যখন পরিস্থিতি দুঃস্বপ্নমুক্ত এবং বাতাস থেকে গলিত লাশের গন্ধ নির্বাসিত? কেন তাঁরা প্রবল বিক্রমে হাত লাগালেন সেই সময়টাতে— যখন সময়জ্ঞানের নিরিখে সমাজসচেতনার কাজে তাঁদের এই ধরনের প্রয়াসের আর তেমন কোনও ভূমিকা নেই। যা হতে পারত পথের দিশা দেখাবার কাজ তার অবমূল্যায়ন ঘটে হয়ে দাঁড়াল নিতান্ত কিছু ঘটে-যাওয়া ঘটনার বিবরণ মাত্র?
এ রকম ঘটনা বার বার ঘটেছে আমাদের অতীতে। সত্তরের উত্তাল দশক তারা সাক্ষী।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/07/70s-BEngal.png)
কিন্তু আর যেন ভবিষ্যতে এসব না ঘটে।
যাঁরা শিল্পী— তাঁরা শুধু ভালো লেখেন, ভালো আঁকেন, ভালো গান করেন বা অভিনয় করে দেখাতে পারেন— শুধুমাত্র এই গুণেই শিল্পীপদবাচ্য নন। সময় যখন ডাক দেয় তখন উচিত কথা বলার জন্য সাহসে ভর করে সব কিছুকে বাজি রাখতে প্রস্তুত, এমনকী নিজেদের নিরাপত্তা পর্যন্ত, বিবেকবান সেই সৃষ্টিশীল মানুষদেররই— একমাত্র তাঁদেরই— আমরা শিল্পী হিসেবে স্বীকার করব, শ্রদ্ধা জানাব। আর কাউকে নয়। কখনই নয়।
এই সংকলনগ্রন্থের শিল্পীদের সেই সম্মান প্রাপ্য।কারণ তাঁরা সময়ের আগে আগে বিবেকের নিশান হাতে নিয়ে ছুটেছেন। সময়ের পিছনে নয়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/07/Tarun-Majumdar-2-1024x508.jpeg)