G Dimitrov Cover

‘A world Party does not play with insurrection and revolution’: Georgi Dimitrov Mihaylov

শান্তনু দে

বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব জর্জি ডিমিট্রভ। একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। একজন সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদী। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একজন অদম্য যোদ্ধা। তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা।

বস্তুত, সেই সময়ের বিপ্লবী ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের তত্ত্বায়ন এবং শ্রমিকশ্রেণিকে মতাদর্শের হাতিয়ারে সজ্জিত করার সৃজনশীল প্রয়োগের মিলনের প্রশ্নে ডিমিট্রভের সঙ্গে আর কারো তুলনা চলে না। ফ্যাসিবাদের চরিত্র উদঘাটনে তিনি ছিলেন এক দুরন্ত নেতা।

ডিমিট্রভ মুখ্যত জড়িয়ে রয়েছেন গত শতকের ইতিহাসের তিন ও চারের দশকের অধ্যায়ের সঙ্গে, যে সময় দেখেছে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রাম। যে সংগ্রাম ছিল অধঃপতিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবতা, সামাজিক প্রগতি ও শান্তির সংগ্রাম।

নক্কারজনক রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ড মামলায় তিনি ছিলেন মূল অভিযুক্ত। নিজের মামলা তিনি নিজেই লড়েছিলেন। এবং নগ্ন করেছিলেন নাৎসিবাদের জঘন্য অভিযোগ। আদালতের কাঠগড়াকে ব্যবহার করেছিলেন সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের ধ্যানধারনা প্রচার করার জন্য। ফ্যাসিস্ত আদালতের সমস্তরকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কমিউনিস্টদের ওপর রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ডের দোষ চাপানো যায়নি। এবং শেষে মুক্তি দিতে হয়েছিল ডিমিট্রভকে।

হিটলারের আদালতে অকুতোভয়

হিটলারের আদালতে সর্বহারার মতাদর্শের প্রতি ডিমিট্রভের দৃঢ় ও প্রত্যয়ী অবস্থানই ছিল নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে প্রথম নৈতিক জয়।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ডিমিট্রভের ভূমিকা ছিল তাঁর তত্ত্বের চেয়েও প্রকট। ছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক। নাৎসি আদালতে তাঁর শানিত যুক্তি গড়ে তোলে বিশ্ব মতামত। মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে তাঁর নাম। লাইপৎসিক আদালতে গোটা বিশ্বের সামনে ডিমিট্রভ তুলে ধরেন কমিউনিস্ট মাতদর্শের নীতি-আদর্শ।

নাৎসি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়য়ে সোচ্চারে ঘোষণা করেন, ‘একথা সত্য যে, আমি একজন বলশেভিক, একজন প্রোলেতারীয় বিপ্লবী। একথাও সত্য যে, বুলগেরীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে আমি একজন দায়িত্বশীল কর্মী ও নেতা। কিন্তু তাই বলে আমি সন্ত্রাসবাদী বা মতান্ধ নই, হঠাৎ আক্রমণে লিপ্ত চক্রী নই, নই কোনও আগুনবাজ।… একথাও সত্য যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির আমি একজন উৎসাহী সমর্থক ও গুণগ্রাহী, কেননা এই পার্টি ভূ-গোলকের এক-ষষ্ঠাংশ জুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো দেশটি শাসন করছে। এবং যার নেতৃত্বে রয়েছেন আমাদের মহান নেতা, সমাজতন্ত্রের সফল নির্মাতা স্তালিন।’ (জর্জি ডিমিট্রভ, এ শর্ট বায়োগ্রাফিকাল স্কেচ, প্রেস ডিপার্টমেন্ট অব দি মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স, বুলগেরিয়া, ১৯৪৮)।

যেমন ১৯৩৩ সালের ১১ ডিসেম্বর ‘ডিমিট্রভ ও তাঁর সঙ্গীদের মুক্তির জন্য জার্মান জনগণের কাছে আবেদনে’ রম্যাঁ রলাঁ লিখছেন, ‘আমাদের সময়কার সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর মামলা শেষ হইয়া আসিতেছে। পঞ্চাশ দিনেরও বেশি সাধারণের মধ্যে ও প্রত্যেক দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশ্য আলোচনার পর রাইখস্ট্যাগ মামলা শেষ হইয়া আসিতেছে।… কিন্তু যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হইয়াছে, তাহার ফলে বিচারশালার আবহাওয়া বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে এবং এ আবহাওয়া যে রায়কে পর্যন্ত প্রভাবিত করিতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়াছে। যে মন্ত্রীর হাতে বিচার-বিভাগের ভার ন্যস্ত, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর কথা যাহার সবচেয়ে বেশি এবং ধৃত ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্য যিনি নিজে দায়ী, তিনিই যখন বিচারশালার মধ্যেই দাঁড়াইয়া প্রকাশ্যে আসামীদের ভয় দেখান, রায় যদি তাহার নির্দেশ অনুযায়ী না হয়, তবে আসামীদের নিহত হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে! …এ মহাকাব্যের উপসংহার যাহাই হউক না কেন ডিমিট্রভের বীরমূর্তি ভবিষ্যতের পটভূমিকায় চিরদিন অনন্ত মহিমায় উজ্জ্বল হইয়া রহিবে।’ (রম্যাঁ রলাঁ: শিল্পীর নবজন্ম, দ্বিতীয় খণ্ড, ভাষান্তর সরোজ কুমার দত্ত, অগ্রণী বুক ক্লাব, ১৯৪৮)।

পনেরো বছর বয়েসেই ট্রেড ইউনিয়নে

বুলগেরিয়ার এক গরিব দর্জি বাবার সন্তান ডিমিট্রভ। বারো বছর বয়েসে স্কুল ছাড়তে হয়। ছাপাখানার কম্পোজিটার হিসেবে জীবন শুরু। পড়তে ভালোবাসতেন বলে এই কাজের প্রতি ছিল বাড়তি আগ্রহ। পড়তেন রুশ সাহিত্য। এখানেই প্রথম পড়েন নিকোলাই চেরনিশেভস্কির উপন্যাস ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’। চেরনিশেভস্কির এই বইটি লেনিনকেও রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক উৎসাহিত করেছিল। ১৯০২, লেনিন তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কাজের নাম দিয়েছিলেন ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’।

ডিমিট্রভের বয়স যখন পনেরো, তিনি তখন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, সোফিয়া ইউনিয়ন অব প্রিন্টার্স অ্যাপ্রেন্টিসেস’র সম্পাদক। ওই সময়ই ছাপাখানার কর্মীদের শোভনসুন্দর কাজের পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে দৈনিক পত্রিকায় তাঁর প্রথম লেখা, ‘প্রিন্টার্স অ্যাপ্রেন্টিস’। আঠারো বছর বয়েসে তিনি প্রিন্টার্স অ্যাপ্রেন্টিস ইউনিয়নের সম্পাদক নির্বাচিত হন।

দু’বছর বাদে যোগ দেন বুলগেরিয়ার সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে। তখন পার্টির অভ্যন্তরে সংস্কারবাদী (‘ব্রড’) ও বিপ্লবীদের (‘ন্যারো’) মধ্যে তুমুল বিতর্ক। ন্যারো’রা প্রধানত ছিলেন রুশ বলশেভিক, লেনিন, স্তালিনের অনুগামী। ডিমিট্রভ হন ন্যারো অংশের সোফিয়া সংগঠনের সম্পাদক। এই ন্যারো অংশই পরে হয় বুলগরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি, আরও পরে বুলগরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি (কমিউনিস্ট)।

লেনিনের সঙ্গে প্রথম দেখা

১৯১৩, একত্রিশ বছর বয়েসে বুলগেরিয়ার সংসদে নির্বাচিত হন তিনি। সেসময় শুধু বুলগেরিয়াতে নয়, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে তিনি ছিলেন একমাত্র শ্রমিকদের প্রতিনিধি। সেইসঙ্গেই ছিলেন সোফিয়া পৌরসভার কাউন্সিলর। ১৯১৯, বামপন্থী সমাজতন্ত্রীরা বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পার্টির পক্ষ থেকে কোলারভ এবং কাবাকিচেভের সঙ্গে ডিমিট্রভকে পাঠানো কমিউনিস্ট ইন্টারন্যশনালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে। প্রতিনিধিরা কৃষ্ণসাগর দিয়ে রাশিয়া যাচ্ছিলেন। যদিও তা ব্যর্থ হয়। মাঝপথে তুমুল ঝড় উঠলে নৌকা গিয়ে ভেড়ে রোমানিয়ার উপকূলে। ডিমিট্রভ, কোলারভ ধরা পড়ে যান রোমানিয়ার পুলিশের হাতে। যদিও, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার শ্রমিকদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাঁরা আর কংগ্রেসে যেতে পারেননি।

অবশেষে, ১৯২০’র শেষে ইতালি হয়ে রাশিয়াতে পৌছন ডিমিট্রভ। যোগ দেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যশনালের তৃতীয় কংগ্রেসে।

রাশিয়াতে পৌছনোর পরের দিনই লেনিনের সঙ্গে দেখা করেন ডিমিট্রভ। দু’জনের মধ্যে দু’ঘণ্টার মতো কথা হয়। লেনিন তাঁর কাছে বুলগেরিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। ডিমিট্রভ বলেন শ্রমিক ও কৃষকের গণসংগ্রামের কথা। লেনিন বলেন: ‘আমার পরামর্শ হলো আপনাদের বিচার-বিশ্লেষণের উদ্যমকে ম্লান হতে দেবেন না!’ ধাপে-ধাপে পরিস্থিতির অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে লেনিন বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এখনও বেশ শক্তিশালী, তবে পরিস্থিতি কমিউনিস্টদের জন্য অনুকূলও হতে পারে। এই কংগ্রেসেই ডিমিট্রভের সঙ্গে স্তালিনের পরিচয় করিয়ে দেন স্তালিন। (জর্জি ডিমিট্রভ, এ শর্ট বায়োগ্রাফিকাল স্কেচ, প্রেস ডিপার্টমেন্ট অব দি মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স, বুলগেরিয়া, ১৯৪৮)।

লেনিনের পূর্বাভাসই পরে মিলতে দেখা যায়। ডিমিট্রভ, কোলারভের নেতৃত্বে বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২৩ সালে বুলগেরিয়ার রাজতন্ত্রী ফ্যাসিস্ত একনায়কত্বের অবসানে বিপ্লবী অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়। যদিও তা ব্যর্থ হয়। সেপ্টেম্বরের সেই অভ্যুত্থান কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে প্রথম ফ্যাসিস্ত-বিরোধী অভ্যুত্থান বলে পরিচিত। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় ডিমিট্রভ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এক-দু’বছর নয়। দীর্ঘ বাইশ বছর।

গ্রামশি, তোগোলিয়াত্তির মতো ইতালির কমিউনিস্টদের বাদ দিয়ে (১৯২২, মুসোলিনির উত্থান)—  সেই অর্থে, ডিমিট্রিভের সময়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে—  ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক থোরেজ, ফিনল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কুসিনেন, জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা থালমান, চেকোস্লোভাকিয়ার গোটওয়াল্ড, জার্মানির পিয়েক-সহ সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে—  তিনিই ছিলেন প্রথম, যাঁর ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।

১৯২৯ সালের মার্চে বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবিরোধী কংগ্রেসের কাজে যোগ দিয়েছিলেন ডিমিট্রভ। যেখানে ২৪টি দেশের ৩০০ জন প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। এরপর অস্ট্রিয়া ও যুগোস্লাভিয়ায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ে আলোচনার জন্য মধ্য ও দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন জার্মানির শহর কোনস্টাঞ্জে। যদিও পরে অস্ট্রিয়ার ফ্যাসিস্তদের উত্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আত্মসমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গিতে বলেন, কোনস্টাঞ্জে ‘অস্ট্রিয়ার ফ্যাসিকরণ নিয়ে আমরা অতি সরলিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিলাম।’ ভ্রান্তি ছিল ‘জনগণের পরিণত মানসিকতা ও নির্ণায়ক সংগ্রামে তাঁদের প্রস্তুতি’কে বাড়িয়ে দেখার মধ্যে, ছোট করে দেখা হয়েছিল বুর্জোয়াদের প্রভাবকে।

বিশ্বস্ত লেনিনবাদী

ডিমিট্রভ ছিলেন একজন বিশ্বস্ত লেনিনবাদী। ১৯১৯, লেনিনের ‘ইউরোপ ও আমেরিকার শ্রমিকদের প্রতি’ পুস্তিকার ভূমিকা লেখার সময় থেকেই তিনি লেনিনের সৃজনশীল মার্কসবাদকে বুলগেরিয়ার সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সংহত করেন। পরে মস্কোয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে যোগ দিয়ে লেনিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত বৈঠকে তিনি তাকে আরও সমৃদ্ধ করেন। তাঁর বিপ্লবী জীবনে ডিমিট্রভ বরবার গ্রহণ করে চলেছেন সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার লেনিনীয় নীতি।

যেমন ১৯২৩ সালে প্রতিক্রিয়ার শক্তি যখন নির্বাচিত অ্যাগ্রেরিয়ান পার্টিকে উৎখাত করতে ফ্যাসিস্ত সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়, তখন নিরপেক্ষ থেকে বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি গুরুতর ভুল করেছিল। যা দুই দলের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটায়। ডিমিট্রভই এই ভ্রান্তি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। এবং অ্যাগ্রেরিয়ান পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেন। পরে পার্টির মূল্যায়নে তিনি এই ভ্রান্তিকে কোনও দ্বিধা না রেখে স্বীকার করেন। এবং এই ভুল অবস্থানের জন্য ব্যক্তিগত দায়িত্বও স্বীকার করেন। এমনই ছিল তাঁর কাজের ধরন, যা তাঁকে একজন প্রকৃত লেনিনবাদী হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল, যা তাঁকে পার্টির দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পথ দেখিয়েছিল।

যুক্তফ্রন্টের স্থপতি

যুক্তফ্রন্টের প্রশ্নে লেনিনের বোঝাপড়ার সৃজনশীল বিকাশে ঐতিহাসিক আবদান রেখেছিলেন ডিমিট্রভ।

লেনিনের জীবদ্দশায়, ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় ও চতুর্থ কংগ্রেসে ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ফ্রন্টের প্রশ্নটিই ছিল মুখ্য বিষয়। এমনকি হিটলারের আদালতেও ডিমিট্রভের মনজুড়ে ছিল যুক্তফ্রন্ট: ‘কোনও রোমাঞ্চকর কার্যকলাপ নয়—  গণফ্রন্ট, গণসংগ্রাম, গণপ্রতিরোধ এবং যুক্তফ্রন্ট—  এসবই হলো কমিউনিস্ট রণকৌশলের আলফা আর ওমেগা।’ (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৩)।

১৯৩২ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কার্যনির্বাহী সদস্যদের কাছে পাঠানো তাঁর চিঠির ভিত্তি ছিল জার্মানিতে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—যাতে তিনি প্রধানত তুলে ধরেছিলেন কিছু জরুরি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এবং দিয়েছিলেন তার কিছু উত্তর—  যা পরে ১৯৩৫ সালে ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেসে সম্পূর্ণ চেহারা পায়।  

ফ্যাসিবাদের চরিত্র এবং তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথাযথ রণকৌশল নিয়ে যখন বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভ্রান্ত, তখন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেসে ডিমিট্রভ ব্যাখ্যা করেন তাঁর যুক্তফ্রন্টের তত্ত্ব। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের গোটা পর্বে তিনিই ছিলেন ইন্টারন্যাশনালের অবিসংবাদী নেতা। ১৯১৯, তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৯, ইন্টারন্যাশনালের সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান বিভাগের প্রধান, আর ১৯৩৫ থেকে ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৩, ইন্টারন্যাশনাল ভেঙে দেওয়ার আগে পর্যন্ত। যুদ্ধ শেষে তিনি বুলগেরিয়ার সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের শুরুর বছরগুলিতে নেতৃত্ব দেন।

আজও সমান প্রাসঙ্গিক

যুক্তফ্রন্ট নিয়ে ডিমিট্রভের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা নিছক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেসে তাঁর তীক্ষ্ণ ভাষণে ডিমিট্রভ ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি ও উদ্ভব সম্পর্কে যে প্রাজ্ঞ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করেছিলেন, তা আজও একইরকম প্রাসঙ্গিক।

ফ্যাসিবাদকে তিনি ‘চরম প্রতিক্রিয়াশীল, উৎকট স্বদেশপ্রেমী এবং লগ্নী পুঁজির চূড়ান্ত সাম্রাজ্যবাদী অংশের উন্মুক্ত সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্র’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা দখল এক বুর্জোয়া সরকার থেকে আরেক বুর্জোয়া সরকারের বদলের মতো সাধারণ কোনও প্রক্রিয়া নয়। ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা দখলের অর্থ শাসকশ্রেণির এক চরিত্রের শাসনের বিকল্প হিসাবে অন্য চরিত্রের শাসনের প্রবর্তন। বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে উন্মুক্ত সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্রের প্রবর্তন।

ভারতের রাজনীতিতে ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর যে দক্ষিণপন্থী অভিমুখটি তৈরি হয়েছে এবং তার অগ্রগতি যে ক্রমশ আরও সুসংহত রূপ গ্রহণ করছে, তা স্পষ্ট। বিজেপি আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আরএসএসের ঘোষিত কর্মসূচীই হলো ভারতের আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রকে তাদের ভাষ্য অনুযায়ী চরম অসহিষ্ণু ধর্ম-ভিত্তিক এক ফ্যাসিবাদী ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ হিসাবে গড়ে তোলা। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা না হলেও, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক তরঙ্গাভিঘাত।

এই মুহূর্তের জরুরি প্রশ্ন হলো—  বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সাধারণতন্ত্রের ধ্বংসসাধন করে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই অভিঘাতকে সফল করতে দেওয়া হবে কি না। সেকারণে এই মুহূর্তের জরুরি কর্তব্য—  ফ্যাসিবাদের অভিমুখে এই তরঙ্গোচ্ছাসকে প্রতিহত করা। আর তা করতে হলে তার উদ্ভবকালে ফ্যাসিবাদ যে প্রচার-পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, সেসম্পর্কে ডিমিট্রভের শিক্ষা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

‘প্রত্যেক দেশের ঐতিহাসিক, সামজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আন্তর্জাতিক অবস্থান অনুযায়ী ফ্যাসিবাদের বিকাশ ও ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের চরিত্র এক এক দেশে এক এক রূপ পরিগ্রহ করে থাকে।… যখন তার অবস্থান বিশেষভাবে সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন নিজ শ্রেণিচরিত্র অক্ষুন্ন রেখে, সংসদীয় গণতন্ত্রের স্থূল ভাওতাবাজির সঙ্গে উন্মুক্ত সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্রের সম্মিলনে নিজ ভিত্তি সম্প্রসারণের প্রয়াস থেকে ফ্যাসিবাদকে বিরত করা যায় না।

কমরেডস, ফ্যাসিবাদের ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে এমন সরলভাবে ব্যাখ্যা করলে চলবে না, যেন লগ্নি পুঁজির কোনও একটি কমিটি কোনও এক বিশেষ দিনে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।… ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই বুর্জোয়া সরকারগুলিকে সাধারণত কতগুলি প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে আসতে হয়। এবং এমন কিছু প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় যা ফ্যাসিবাদের ক্ষমতাসীন হবার প্রক্রিয়াকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে। যদি এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিপর্বেই তাকে প্রতিহত করা না যায়, তাহলে তা ফ্যাসিবাদের জয়যাত্রার পথকেই সুগম করবে।’

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেসে ভাষণ, ২ আগস্ট, ১৯৩৫

Spread the word

Leave a Reply