প্রাককথন
কার্ল হাইনরিখ মার্কস কখনো কোনও কাজে যাকে বলে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন? মার্কস শব্দটির উচ্চারনের সাথে সাথেই শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখের যে ছবিটির কথা সাধারণত আমাদের মনে পড়ে তাতে অমন হুমড়ি খেয়ে পড়ার বিষয়ে কিছটা সন্দেহের উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। কারণ আমাদের সহজ অভ্যাসই হল ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে বেশ কিছুটা উঁচুদরে বেঁধে তারপরে তাঁদের সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ করা। আমাদের মতো দেশে সামাজিক আচরণের শিকড়ে কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব যে রয়েছে এ হল তারই উদাহরণ।
অমন সন্দেহের যাতে অবসান হয় সেই উদ্দেশ্যেই রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে আমরা সিদ্ধান্ত নিই এমন কোনও ঐতিহাসিক লেখা প্রকাশ করার যাতে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকা অবস্থায় কার্ল মার্কসের ছবি কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়।
অভূতপূর্ব, অসামান্য মেধাবী হিসাবে কার্ল হাইনরিখ মার্কসের যে পরিচিতি তা শুধুই মার্কসের গুণকীর্তনের উদ্দেশ্যে করা হয় না। কৃতিত্বের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে মার্কসের জীবন যেভাবে কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসাবে রূপান্তরিত হয় তাকে যতদূর সম্ভব আড়াল করতেই এমন প্রচেষ্টা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এহেন আড়াল করার রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের সচেতন থাকতে হয়। এক মহাজীবনের অনুসারি হতে তাকে উপলব্ধি করতে হয় দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই। তাকেই ইংরেজিতে ‘ইন টোটালিটি’ বলে।
কিছুটা একই উদ্দেশ্যে তরুণ মার্কস বনাম পরিণত বয়সের মার্কসকে একে অন্যের বিরোধী হিসাবে তুলে ধরা হয়। এধরনের যাবতীয় প্রচেষ্টা আসলে অ-দ্বান্দ্বিক, একদেশদর্শী এবং ইচ্ছাকৃতরূপে সংকীর্ণ। এহেন সংকীর্ণতা দক্ষিণ ও বাম উভয় বিচ্যুতিরই সাধারণ বৈশিষ্ট। এরা সকলেই নিজেদের বিশেষ সুবিধা হয় এমন তথ্যকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন, বাকিটুকু চেপে রাখতে চান। কমিউনিস্টদের এমন হলে চলে না।
সাবেক পূর্ব জার্মানির সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টির তরফে প্রকাশিত মার্কসের জীবনীগ্রন্থটি এক্ষেত্রে অন্যতম একটি বই। প্রকাশক ছিলেন জিডিআর’র পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় কমিটি দ্বারা পরিচালিত মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ইন্সটিটিউট বইটি সম্পাদনার কাজ শেষ করে। এধরণের অন্যান্য কাজের সাথে কলেবরের তুলনামূলক বিবেচনায় বইটি যথেষ্ট নজরকাড়া। মূল লেখাটি জার্মান ভাষায়, তা থেকেই প্রথমে ইংরেজি ও পরে ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
জার্মান ভাষায় প্রকাশিত বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখার কাজে অনুবাদককে সহায়তা করেন জিডিআর’র ভাইস কনসাল বি পীরশেল নিজেই। মূল অনুবাদক হাইনরিখ গেমকোভ ছাড়াও বাংলায় কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন যুগান্তর চক্রবর্তী। প্রথম বাংলা অনুবাদের প্রকাশক ছিলেন ‘লেখাপড়া’র পক্ষে রাখাল সেন। ২০১৭ সালে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি বাংলা বইটির নিজস্ব সংস্করণ প্রকাশ করে। সেই সংস্করণ থেকেই ‘বিপ্লব শুরু’ নামের একটি অংশ আজ কার্ল হাইনরিখ মার্কসের ২০৬-তম জন্মবর্ষে প্রতিবেদনের আকারে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।
প্রতিবেদনের শিরোনাম ওয়েবডেস্কের নিজস্ব।
বিপ্লব শুরু
ছাপাখানা থেকে ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ বেরোবার মুখে ব্রুসেল্স-এ মার্কসের কাছে ও লন্ডনে কমিউনিস্ট লীগের নেতাদের কাছে খবর এসে পৌঁছল যে প্যারিসে বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে। জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ফ্রীডরিখ লেস্নার এক দশক পরে এই অবিস্মরণীয় দিনটি সম্পর্কে লিখেছেন, “এই খবর আমাদের মধ্যে কী প্রচণ্ড সাড়া জাগাল তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। উৎসাহে আমরা উন্মত্ত হয়ে উঠলাম। আমরা টগবগ করতে লাগলাম একটিমাত্র অনুভূতিতে, একটিমাত্র চিন্তায়: মনুষ্যজাতির মুক্তির জন্য জীবন ও সম্পদ সমর্পণ।”
যেমন লন্ডনে তেমনি ব্রুসেল্স। যেই না খবর এসে পৌঁছল যে ‘ব্যাঙ্ক-মালিকদের রাজা’ লুই ফিলিপকে প্রলেতারিয়েত উৎখাত করেছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্রুসেলসেও কী উৎসাহ কী উদ্দীপনা। পুলিস ও মিলিটারিকে তুচ্ছ করে দলে দলে মানুষ বেরিয়ে এল রাস্তায় ও পার্কে। ‘লোকে চিৎকার করে বলতে লাগল ‘ভিভা লা রেপুব্লিক, মার্সেলেজ গাইল আর ঠেলাঠেলি টানাটানি করতে লাগল’ কথাগুলো লিখেছেন এঙ্গেলস, যিনি জানুয়ারি মাসের শেষদিকে প্যারিস থেকে বিতাড়িত হয়ে পুনরায় ব্রুসেল্স-এ চলে এসেছিলেন। অবশেষে এসে গিয়েছে সেই দিনটি যার জন্যে মার্কস ও তাঁর কমরেডরা এমনভাবে প্রতীক্ষা করেছেন, সেই দিনটি যখন সাধারণ মানুষরা কিছু একটা করার জন্যে দৃঢ়সংকল্প আর প্রতিক্রিয়ার স্তম্ভগুলো ভেঙে পড়ছে।
মার্কস হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সমস্ত খবরের কাগজের ওপরে, হাতের কাছে যতগুলো পেলেন। প্যারিস থেকে আসা সর্বশেষ খবরগুলো ভাল করে জানলেন। কমিউনিস্ট লীগের সংগঠনগুলির সঙ্গে এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের মধ্যে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গেও। চিঠিপত্রের যোগাযোগ রাখলেন ও পরামর্শ করলেন। অধীর প্রত্যাশা নিয়ে জার্মানি থেকে আসা প্রত্যেকটি খবর এবং জার্মানি সম্পর্কে প্রত্যেকটি খবর খুঁটিয়ে পড়লেন।
বিপ্লব যে শুরু হয়ে গিয়েছে এতে তিনি বিস্মিত হননি। অনেক আগেই তিনি বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং এঙ্গেলস ও তিনি একসঙ্গে এই বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি করেছিলেন। কিন্তু এখন বিপ্লব এসে যেতে একথা অতি দ্রুত স্পষ্ট হয়ে উঠল যে প্রত্যেকটি দেশে বিপ্লবী আন্দোলন ঘটবে নিজস্ব চেহারায়। এটা অস্বীকার করলে বিপ্লবেরই সর্বনাশ। ইতালীয় রাজ্যগুলিতে জনগণ প্রায়শই অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াই করল এবং বুর্জোয়া- লিবার্যাল সংবিধানে রাজন্যদের বাধ্য করল। প্যারিসের জনগণ ব্যারিকেড তুলে সশস্ত্র লড়াই চালাল এবং একটি রিপাবলিকের ঘোষণা জয় করে নিতে সমর্থ হল। ফরাসী শ্রমিকরা যদিও মোহগ্রস্ত হয়ে ভেবেছিল যে তারা একটি “সমাজমূলক রিপাবলিক” লাভ করেছে কিন্তু আসলে তা ছিল বুর্জোয়া রিপাবলিক পত্র। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্যারিসের প্রলেতারিয়েতকে জানতে হল সত্যটি। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে দক্ষিণ ও মধ্য- জার্মানির রাজ্যগুলিতে এবং হাঙ্গেরি বোহেমিয়া ও পোল্যান্ডেও শুরু হয়ে গেল বিপ্লবী আন্দোলন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিপ্লবে একটা ইউরোপীয় চরিত্র প্রকাশ পেয়ে গেল।
কিন্তু প্রতিক্রিয়া চুপ করে থাকল না। মার্কসকে তা জানতে হল নিজের গায়ে আঁচ পেয়েই। বেলজিয়ামের বুর্জোয়ারা যখন রাজার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে, রাজা তখন নিজের সৈন্যবাহিনী লাগিয়ে দিয়েছে রাজধানী ঘিরে ফেলতে এবং জনগণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সহিংস অভিযান চালাতে। গভর্নমেন্ট বিশেষভাবে চেষ্টা করল ব্রুসেল্স-এ বসবাসকারী বিদেশীদের, বিশেষ করে জার্মান শ্রমিকদের ও রাজনৈতিক আশ্রয়গ্রহণকারীদের খেপিয়ে তুলতে। কোনোরকম কারণ দেখানো হল না, ভিলহেল্ম ভোল্ল্ফ গ্রেপ্তার নিগৃহীত ও বহিষ্কৃত হলেন।
এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকায় ব্রুসেল্স-এর জার্মান আশ্রয়গ্রহণকারীরা কমিউনিস্ট ও গণতন্ত্রী উভয়েই আরো বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে বেলজিয়ান গণতন্ত্রীদের সঙ্গে হাত মেলালেন ও একযোগে ময়দানে নামলেন। ব্রুসেল্স-এর শ্রমিকদের অস্ত্র যোগান দেবার জন্যে মার্কস দান করলেন হাজার হাজার ফ্রাঁ। এই মাত্র কয়েক দিন আগে, অবশেষে, পৈতৃক উত্তরাধিকার সূত্রে মোটা রকমের টাকা পেয়েছিলেন তিনি, তা থেকেই দান করলেন। তাঁর স্ত্রী পূর্ণ সম্মতি ছিল এই দানে। কয়েক বছরের তীব্র দারিদ্র্যের পরে ঠিক এই সময়েই জেনী শেষপর্যন্ত আর্থিক নিরাপত্তা আশা করতে পারছিলেন। কিন্তু বিপ্লবী আন্দোলনের প্রয়োজনের কথা ভেবে ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলেন না।
গণতান্ত্রিক লীগে তৎপর থাকার সঙ্গে সঙ্গে মার্কসকে বড়ো রকমের উদ্যম দিতে হয়েছিল কমিউনিস্ট লীগে। ২৭শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি লীগের লন্ডনস্থিত কেন্দ্রীয় ব্যুরো থেকে খবর পেলেন যে ইউরোপ মহাদেশের বৈপ্লবিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা তাঁদের কর্তৃত্ব ব্রুসেল্সর জেলা নেতৃত্বের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এমনিভাবে বিপ্লবের শুরুতেই কমিউনিস্ট লীগের সরাসরি নেতৃত্ব নিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। সঙ্গে সঙ্গে নেতৃমণ্ডলীর বৈঠক ডাকলেন মার্কস এবং পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন।
এবারে ঘটনার পর ঘটনা ভিড় করে আসতে লাগল। মার্চের শুরুতে মার্কস সশ্রদ্ধ আমন্ত্রণ পেলেন অস্থায়ী রিপাবলিকান গভর্নমেন্টের কাছ থেকে। “সাহসী সমুন্নত মার্কস – ফরাসী রিপাবলিক স্বাধীনতার সকল বন্ধুর কাছে মুক্ত রাষ্ট্র। অত্যাচারী শক্তি তোমাকে বহিষ্কার করেছিল; মুক্ত ফ্রান্স তোমার সামনে আবার দুয়ার উন্মুক্ত করছে।”” মার্কস এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন- বিপ্লবের লীলাভূমি প্যারিস, সমস্ত কিছুই তাঁকে প্যারিসের দিকে টানছিল।
৩রা মার্চ তারিখে প্যারিস থেকে যেদিন আমন্ত্রণ পেলেন ঠিক সেইদিনই সন্ধ্যার দিকে মার্কসের ওপরে হুকুম জারি হয়ে গেল যে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। কমিউনিস্ট লীগের সদ্যগঠিত কেন্দ্রীয় ব্যুরোর সদস্যরা তৎক্ষণাৎ মার্কসের বাড়িতে মিলিত হলেন, কেন্দ্রীয় ব্যুরোর সকল ক্ষমতা তুলে দিলেন তাঁর হাতে এবং প্যারিসে একটি নতুন কেন্দ্রীয় ব্যুরো গঠন করার ক্ষমতা দিলেন তাঁকে। তাঁরাও বাড়ি ছাড়লেন আর জোর করে ভিতরে ঢুকল পুলিস, মার্কসকে গ্রেপ্তার করল। তারপর যে পুলিসী দাপট চলল তার বর্ণনা দিতে গিয়ে দিনকয়েক পরে একটি ফরাসী পত্রিকায় মার্কস লিখেছেন: ‘আমি গ্রেপ্তার হবার অব্যবহিত পরেই আমার স্ত্রী বেলজিয়ামের গণতান্ত্রিক সমিতির সভাপতি মঁসিয় জোৎরাঁর সঙ্গে দেখা করলেন, মসিয় জোৎরী যাতে দরকার মতো মামলা শুরু করতে পারেন তার ব্যবস্থা করার জন্যে। ফিরে এসে আমার স্ত্রী দেখতে পেলেন আমাদের বাড়ির সামনে একজন পুলিস দাঁড়িয়ে। অতিমাত্রায় বিনয় দেখিয়ে সে জানাল যে তিনি যদি হের মার্কসের সঙ্গে কথা বলতে চান তাহলে একবারটি শুধু তার সঙ্গে যেতে হবে। আমার স্ত্রী আগ্রহের সঙ্গে এই প্রস্তাবে রাজী হলেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল পুলিসের সদর দপ্তরে। সেখানে যেতে পুলিস কমিশনার প্রথমেই বলে বসল যে হের মার্কস সেখানে নেই। তারপর রূঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলো তিনি কে, হের জোৎরাঁর সঙ্গে তাঁর কী কাজ, পরিচয়সূচক কাগজপত্র তাঁর আছে কিনা… আমার স্ত্রীকে বলা হল ভবঘুরে আর এই ছুতোয় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল নগর পরিষদের জেলখানায়। সেখানে অন্ধকার একটা ঘরে বেশ্যাদের সঙ্গে তাঁকে আটক রাখা হল। পরদিন বেলা এগারোটায়, পরিষ্কার দিনের আলোয়, একদল প্রহরীকে সামনে রেখে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল অনুসন্ধানকারী বিচারকদের দপ্তরে। সেখানে দু ঘণ্টা তাঁকে রেখে দেওয়া হল একেবারে আলাদা করে, চারদিক থেকে প্রচণ্ড প্রতিবাদ হওয়া সত্ত্বেও। আবহাওয়া ছিল খারাপ, গ্রহরীরা তাঁকে নিয়ে চূড়ান্ত রকমের স্থূল রসিকতা করছিল সমস্ত সহ্য করে সেই অবস্থাতেই থাকতে হল তাঁকে।
‘শেষপর্যন্ত তাঁকে হাজির করা হল অনুসন্ধানকারী বিচারকের সামনে। বিচারক তো রীতিমতো অবাক, কেননা ছেলেমেয়েদের রক্ষণাবেক্ষণ করার কাণ্ডজ্ঞানটুকু পুলিসের হয়নি। অনুসন্ধান যা হল তাকে প্রহসন ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। মোটামুটি আমার স্ত্রীর অপরাধ ছিল এই প্রশীয় অভিজাত বংশের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিনা তাঁর স্বামীর গণতান্ত্রিক মতামত মেনে নিয়েছেন।‘এই লজ্জাকর ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ আমি দিতে চাই না। আর শুধু এইটুকুই উল্লেখ করি যে যখন আমরা মুক্তি পেলাম তার আগেই চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনীয় সামান্যতম জিনিসও আমরা সঙ্গে আনতে পারিনি, আমাদের চলে আসতে হয়েছে।’
প্যারিসে এসে মার্কস সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বন্ধুদের খুঁজে বার করলেন, যাঁরা প্যারিসে থাকতেন। জনকয়েক বন্ধুর অবস্থা দেখে তিনি একটু অবাকই হলেন যেন; ‘বৈপ্লবিক মাতলামি’ তাঁদের একেবারে মাথায় গিয়ে ঢুকেছে এবং তা তাঁদের টেনে নিয়ে গিয়েছে বিপজ্জনক বৈপ্লবিক ভঙ্গিবিলাসের দিকে। অধৈর্য ও দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ হয়ে তাঁরা ভেবে বসে আছেন যে জার্মানির বিপ্লব যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে না। বোর্নসেস্টট ও তুল হেরভেগ-এর মতো পেটি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা আওয়াজ তুলেছিলেন যে আশ্রয়গ্রহণকারীরা স্বেচ্ছাবাহিনী গঠন করুন এবং বেয়নেটের ডগায় জার্মানিতে স্বাধীনতা নিয়ে যান। বহু জার্মান শ্রমিক ও কারিগর এই আওয়াজ সমর্থন করেছিলেন। জার্মান গণতান্ত্রিক সমিতি নামে একটি সংগঠনে তাঁরা একজোট হয়েছিলেন, একটি জার্মান সেনাদল গঠন করেছিলেন এবং জার্মানিতে সামরিক মুক্তি অভিযান চালাবার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। এই সমস্ত অবিমৃশ্য পরিকল্পনার প্রতিবাদ করলেন মার্কস, যদিও কেউ কেউ তাঁর নামে ভীরুতার অপবাদ ছিল। ৬ই মার্চ তারিখে জার্মান শ্রমিকদের এক সভায় তিনি এই বিষয়ে বক্তৃতা দিলেন। কমিউনিস্ট লীগের তৎকালীন সভ্য ও মার্কসের পরিচিত সেবাস্তিয়ান জাইলার পরবর্তীকালে লিখেছেন:
“জার্মানিতে রিপবালিক প্রতিষ্ঠার জন্য বাইরে থেকে সৈন্যদল পাঠানোর সমস্ত রকমের চেষ্টার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রীরা ও কমিউনিস্টরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতেন। রূস্যাঁ দেনিসে তাঁরা প্রকাশ্য সভা করতেন। ভবিষ্যৎ স্বেচ্ছাবাহিনীর সদস্যরাও যোগ দিতেন এই সমস্ত সভায়। এমনি একটি সভায় মার্কস দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতায় যে বিষয়টিকে তুলে ধরেছিলেন তা এই যে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ইউরোপীয় আন্দোলনের সূচনা মাত্র, সেইভাবেই এই বিপ্লবকে দেখা উচিত। অল্পকালের মধ্যেই এই প্যারিসে প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়াদের মধ্যে খোলাখুলি সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। জুন মাসে প্রকৃতই শুরু হয়ে গেল। ইউরোপীয় বিপ্লবের জয় কিংবা পরাজয় নির্ভর করছিল এই সংগ্রামের ফলাফলের ওপরে। মার্কস নিশ্চিত ছিলেন যে জার্মানিতেও বিরোধী শ্রেণীগুলির আভ্যন্তরিক দ্বন্দ্বের ফলে জনগণের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটবে। বাইরে থেকে সৈন্য পাঠালে আসন্ন এই বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকেই বিপন্ন করা হবে। কেননা সশস্ত্র হস্তক্ষেপ ঘটলে জার্মান প্রতিক্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ নেবে জাতীয়তাবাদী উদ্দেশে ও বিপ্লব-বিরোধী স্বার্থে তা ব্যবহার করার।
৮ই মার্চ তারিখে মার্কসের উদ্যোগে কমিউনিস্ট লীগের চারটি প্যারিস শাখায় জার্মান গণতান্ত্রিক সমিতির পাল্টা হিসেবে সকলের জন্য উন্মুক্ত একটি জার্মান শ্রমিক ক্লাব গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ৯ই মার্চ তারিখে ক্লাবের গঠনবিধির একটি খসড়া পেশ করলেন মার্কস।
ইতিমধ্যে শাপের, মল্ ও হাইনরিখ বাউয়ার এসে উপস্থিত হয়েছেন লন্ডন থেকে এবং ভিলহেল্ম ভোল্ল্ফ ও কম্পোজিটর কাল ভালাউ ব্রুসেল্স থেকে। ১০ই মার্চ তারিখে তাঁরা গঠন করলেন কমিউনিস্ট লীগের নতুন কেন্দ্রীয় ব্যুরো তাতে তাঁরা নিজেরা থাকলেন, মার্কস ও এঙ্গেলস সহ। মার্কস হলেন সভাপতি আর শাপের সম্পাদক। এঙ্গেলস তখনো ছিলেন ব্রুসেল্স-এ, তাঁকে রাখা হল কেন্দ্রীয় ব্যুরোতে। ২১শে মার্চ তারিখে এঙ্গেলসও প্যারিসে পৌঁছে গেলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যুরোর সভা বসত প্রায় প্রত্যহ, সদস্যরা তাঁদের পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করতেন। খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া হত জার্মানির ওপরে, জার্মানির দুই বৃহৎ রাজ্য প্রশিয়া ও অস্ট্রিয়ার ওপরে। অবশেষ সংবাদ এল: ভিয়েনার শ্রমজীবী জনগণ ১৩ই মার্চ তারিখে ব্যারিকেড তুলেছে। ঘৃণিত চ্যান্সেলর মেটেরনিখ উৎখাত হয়েছে ও পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছে। হাপ্ সবুর্কের রাজা বুর্জোয়া লিবার্যাল মন্ত্রিসভা গঠন করতে বাধ্য হয়েছে। দিনকয়েক পরে ১৮ই মার্চ তারিখে বিপ্লবী লড়াই তুঙ্গে উঠল বার্লিনের রাস্তায়। যোল ঘন্টা ধরে তীব্র রাস্তার লড়াই চালিয়ে রাজার “উৎকৃষ্ট সৈন্যদলের” বিরুদ্ধে জয়লাভ করল বার্লিনের শ্রমিক, কারিগর, পেটিবুর্জোয়া ও ছাত্ররা। তারা দেখিয়ে দিল, সাধারণ মানুষ যদি একজোট হয় আর দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করে তাহলে কিছুই অসাধ্য নয়।
যদিও এই যুদ্ধে রাজার সেরা সৈন্যরা নিযুক্ত হয়েছিল কিন্তু অভূতপূর্ণ সাহসের পরিচয় দিয়েছিল বিশেষ করে শ্রমিকরা ব্যরিকেড তুলে যারা লড়াই চালিয়েছিল তাদের বেশির ভাগই ছিল এই শ্রমিক। তারা বহুবার পাল্টা আক্রমণ করেছিল, এমনকি কামান পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল এবং ১৯শে মার্চের রাত্রিটি কাজে লাগিয়ে নিজেদের ঘাঁটিগুলোকে জোরদার করেছিল। তাদের এই অটল প্রতিরোধের সামনে পড়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৈন্যরা অফিসারদের হুকুম মানতে অস্বীকার করে বসল। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে রাজ-দরবারের সমস্ত শঠতামূলক চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ব্যারিকেড-যোদ্ধারা দাবি তুলল বার্লিন থেকে মিলিটারির সম্পূর্ণ অপসারণের। তাদের দৃঢ়তা রাজাকে বাধ্য করল ১৯শে মার্চ তারিখে শহর থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে। শুধু তাই নয়, এই ১৯শে মার্চ তারিখেই বিজয়ী জনগণ তাদের দলের মৃতদের বহন করে নিয়ে এল রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে এবং সচরাচর উদ্ধত প্রকৃতির রাজাকে বাধ্য করল মৃত ব্যারিকেড-যোদ্ধাদের সামনে খালিমাথায় মাথা নত করতে। এই ঘটনা ছিল বিপ্লবী জনগণের হাতে সামন্ত প্রুশিয়ার মস্ত পরাজয়ের প্রতীক।
জার্মানির বিপ্লব তুঙ্গে উঠেছিল ১৮ই মার্চে বার্লিনের ব্যারিকেড-যুদ্ধে। আতঙ্কে ও ভয়ে হোহেনৎসোলেন রাজাকে বলতে হল যে প্রুশিয়া জার্মানির সঙ্গে মিশে যাবে। উদারনীতিমূলক সে-সব সংস্কারের কথা আগে একবার বলা হয়েছিল সেগুলো আবার নতুন করে বলতে হল। মার্চ শেষ হবার আগেই গঠিত হল নতুন মন্ত্রিসভা- ব্যাঙ্ক-মালিক ও শিল্পপতি কাম্পহাউজেন ও হানজেমান-এর নেতৃত্বে।
বাংলা বইয়ের বানান ও অন্যান্য অংশ অপরিবর্তিত
ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রাককথন
সৌভিক ঘোষ ও সরিৎ মজুমদার