সাগ্নিক দাশ
গত গোটা সপ্তাহ ধরে বাংলার রাজনীতি সরগরম। শিক্ষক নিয়োগে যে বেলাগাম দুর্নীতি তৃণমূলের শাসনকাল ধরে চলছে, এবার তা থেকে দুর্গন্ধ বেরতে শুরু করেছে। কোথাও দুর্গন্ধের মূল্য ২০ কোটি তো কোথাও ৩০-৪০ কোটি। সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখলেই সবুজ, গোলাপি নোটে ছেয়ে থাকা একটি কদর্য দৃশ্য- যা বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে প্রায় অভাবনীয়। ২০১১তে বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেওয়ার পর থেকেই দুর্নীতি ও তৃণমূল যেন সমার্থক শব্দ।সরকারে আসার সাথে সাথেই সারদা চিট ফান্ড দুর্নীতি। তৃণমূলের বাঘা বাঘা নেতাদের নাম জড়ালো। গরীব মানুষের সঞ্চিত কয়েক হাজার কোটি টাকা নিমেষে লোপাট। ২০১৬’র নির্বাচনের আগে মানুষ দেখলেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা কেমন অবলীলায় ক্যামেরার সামনে নির্লজ্জ ভাবে হাত পেতে ঘুষ নিচ্ছে।
তবে এইসব ঘটনাগুলি চোখের সামনে এসেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তৃণমূলের দুর্নীতির মূল চিত্র সারদা বা নারদ ঘুষ কাণ্ড নয়। তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি যন্ত্রের মূল নিহিত রয়েছে বাংলার রোজকার জীবনে। এবং এই দুর্নীতির যন্ত্রটি ব্যবহার করে বাংলায় তৃণমূল গড়ে তুলেছে এক সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ১০০ দিনের কাজের প্রাপ্য টাকার ‘কাট মানি’ খাওয়া থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগ, গ্রুপ সি, ডি স্তরের কর্মী নিয়োগ সর্বত্র সেই ব্যবস্থা বিরাজমান। বাংলার মানুষের যে কোন প্রকারের জীবন-জীবিকার সাথে ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে তৃনমূলের দুর্নীতির যন্ত্র। একটা গোটা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে যার মূলে রয়েছে দুর্নীতি।
এখানেই প্রশ্ন জাগে এই যে দুর্নীতির উপর ভিত্তি করে একটা ব্যবস্থা তৈরি করা হল তার সাথে কি বাংলার আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কোন সম্পর্কই নেই? অর্থনীতির নিরিখে বিচার করলে বলতে হয় সম্ভবত আছে। অর্থনীতি নিয়ে যারা সামান্য পড়াশোনা করেছেন তারা জানেন যে একটি দেশ বা রাজ্যের অপরাধের হার, দুর্নীতির প্রবণতা এগুলি অনেকটাই নির্ভর করে দেশ বা রাজ্যটির নির্দিস্ট অর্থনৈতিক অবস্থার উপরে। যে কারণে প্রথম বিশ্বের তুলনায় তৃতীয় বিশ্বে দুর্নীতির হার বেশি। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা না থাকলে সরকারি বা সরকার পরিচালিত যে কোন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বাসা বাঁধে। বেঁচে থাকতে মরিয়া মানুষের অসহায়তাকে কাজে লাগিয়েই একটি দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
তৃণমূল যে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থা তৈরী করেছে, তার সাথে কী পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থার কোনও সম্পর্ক রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। তৃণমূল সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির রেখাচিত্রের গোটাটাই নিম্নগামী। সাধারণ কিছু পরিসংখ্যান দেখলেই সেটা বোঝা যায়।
১৯৯৪-২০০০ সময়কালে, পশ্চিমবঙ্গে মাথা পিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হার ছিলো ৫.৫%। একই সময়কালে ভারতের মাথা পিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হার ৪.৬%। ২০০০-২০০৫ সময়কালে ঐ বৃদ্ধিরই হার ছিল ৪.১% পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ও ৪%- ভারতের ক্ষেত্রে। ২০০৫-২০১০ সময়কালের পরিসংখ্যানে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ৫.৭% ও ভারতের ক্ষেত্রে ৭%। ২০০০-২০১০ সময়কালের গড় ধরলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান দাঁড়ায় ৪.৯% ও ভারতের ক্ষেত্রে ৫.৫% । ০.৬ পার্সেন্টেজ পয়েন্টের ব্যবধান। কিন্তু ২০১২-২০২০ সময়কালে, মাথা পিছু আয়ের বৃদ্ধির গড় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ৪.২% ও ভারতের ক্ষেত্রে ৫.২%। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী দশকে যেই ব্যবধান ছিল ০.৬ পার্সেন্টেজ পয়েন্টের, তা তৃণমূলের আমলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে গোটা ১ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট ।
অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী বিচার করলে তৃণমূল সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক অধঃপতন আরো প্রকট ভাবে ফুটে ওঠে। গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (GSDP) অনুযায়ী, ১৯৯৪-২০০০ সময়কালে, পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদন ক্ষেত্রে গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৩%, দেশে ৭%। পরিষেবা ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৯.৪%, ভারতের ৭.৯%। ২০০০-২০১০ সময়কালে, পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৭.১%, ভারতের ৭.৪%। পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গের জন্য ১০.১% ও ভারতের জন্য ৮.৫%। কিন্তু ২০১২-২০২০ সময়কালে, পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার মাত্র ৬.৬% ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৬.৫%। একই সময়কালে ভারতের উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৮.৬% ও পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৭.৯%। অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দশক ও তৃণমূল সরকারের প্রথম দশকের বিচার করলে, তৃণমূল সরকারের আমলে রাজ্যের উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার শুধু হ্রাস পায়নি, ভারতের গড় উৎপাদন বৃদ্ধির হারের তুলনায় প্রায় ২ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট পিছিয়ে গেছে। ২০০০-২০১০ পর্বে যা ছিল মাত্র ০.৩ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট। পরিষেবা ক্ষেত্র, যা ১৯৯০-র পরবর্তীকালে ভারতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধির অন্যতম কান্ডারি, সেই খাতেই ২০০০-২০১০ সময়কালে ভারতের থেকে পশ্চিমবঙ্গের গড় বৃদ্ধির হার এগিয়ে ছিল প্রায় ১.৫ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট। তৃণমূল সরকারের আমলে পরিষেবা ক্ষেত্রে গড় বৃদ্ধির হারের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের থেকে পিছিয়ে গেছে ১.৫ পার্সেন্টেজ পয়েন্টে।
এমন অর্থনৈতিক অধঃপতনই মানুষকে মরিয়া করে দিচ্ছে একটি চাকরি বা কাজের সুযোগ পাওয়ার জন্য। আর সেই মানুষের অসহায়, মরিয়া অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল গড়ে তুলছে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। চাকরির অভাব না থাকলে কেউ জমি, বাড়ি, গয়না বেচে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হওয়ার জন্য ১০-১২ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হত না। তৃণমূল সরকার পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিকে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, দুবেলা খাবার জোটানোর জন্যেও মানুষকে দুর্নীতির রাস্তা বেছে নিতে হচ্ছে। একদিকে বাধ্য হয়ে প্রাপ্য চাকরির জন্য সংসার নিঃস্ব করে অসহায়ভাবে অপেক্ষারত পশ্চিমবঙ্গবাসী আরেকদিকে বিছানায় ২০-৩০ কোটি টাকার উপর শুয়ে রাজার হালে থাকা তৃণমূলের নেতা নেত্রীরা। অর্থনীতির হাল ফেরাতে না পারলে সামনে ভবিষৎ আরো অন্ধকার।
পরিসংখ্যানগুলি অর্থনীতিবিদ মৈত্ৰেশ ঘটকের Ideas for India তে ২০২১ সালের ১লা মে লেখা প্রবন্ধ: “West Bengal’s economic performance relative to India over the last three decades” থেকে গৃহীত
লেখক অর্থনীতির গবেষক, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউ ইয়র্ক