দিল্লির হিংসাঃ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পড়শিরাই বাঁচিয়েছেন

নয়াদিল্লি, ২৬ ফেব্রুয়ারি- শাহবাজের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছেন বিকাশ। জলভরা চোখে বিকাশকে আঁকড়ে শাহবাজ। বন্ধু রাহুল সোলাঙ্কির দেহ নেওয়ার অপেক্ষায় ওঁরা। সোমবার রাতে বাবু নগরের বাসিন্দা সোলাঙ্কিকে গলায় গুলি করে হামলাকারীরা। দিল্লির গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতালের মর্গের সামনে বুধবারের এই ছবি যেন ফের মোদীর ‘নিউ ইন্ডিয়া’ থেকে প্রকৃত ভারতে নিয়ে গেল। হিন্দুত্ববাদীদের লাগাতার বিদ্বেষের উস্কানি এবং হামলা হিংসার পরে নিহত ও আহত মানুষের ভিড় হাসপাতালে। সেখানে অবশ্য কোনো নেতাদের দেখা নেই। না, নিহত হিন্দুদের জন্যেও হিন্দুত্ববাদী নেতারা আসেননি। তিন দিন ধরে অপেক্ষা চলছে ময়নাতদন্তের পরে মৃতদেহ ফিরে পাওয়ার জন্য। প্রিয়জনকে মর্গ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় রাহুলের পরিবারের সঙ্গে অপেক্ষায় শাহবাজের মত প্রতিবেশী আর বন্ধুরা।

রাজধানী যখন জ্বলছে হিংসার আগুনে, সকলেই যদিও সময়মত এইরকম পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকার সুযোগ পাননি। সেই অবসরেই উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণে জীবন্ত পুড়ে মৃত্যু হয়েছে ৮৫ বছরের বৃদ্ধা আকবরীর। আবার বাইরে থেকে আসা হিন্দুত্ববাদীরা যখন জীবন্ত জ্বালাতে গেছে স্থানীয় এক মুসলিম ব্যক্তিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচিয়েছেন স্থানীয় হিন্দুরা। দিল্লির আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগেই স্পষ্ট, প্রতিবেশীরা পরস্পরকে আক্রমণ করেছেন এমন ঘটনা বিরল। অন্য জায়গা থেকে আসা সংগঠিত বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই এই হামলা করেছে। গামারি এলাকায় অধিকাংশ হিন্দুর বাস। অল্পসংখ্যায় থাকা মুসলিমদের বাড়িঘর, ছোট্ট একটি মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাসিন্দারা জানিয়েছন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কোরান। আধপোড়া কোরানের পাতা বুধবার সমাধিস্থ করেছেন সংখ্যালঘুরা। বছর পঁচিশের ইসমাইল জানিয়েছেন। ওরা একজন মুসলিমকে ধরে ফেলেছিল। তাঁকে জীবন্ত পোড়াতে গেছিল। কিন্তু এখানের হিন্দুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে নিয়েছে।

খাজুরি খাস থেকে দেড় কিলোমিটার দূরের গামরি এক্সটেনশন এলাকায় রেডিমেড পোশাকের ব্যবসায়ী মহম্মদ সঈদ সলমনির বাড়িতে। তাঁর পাঁচতলা বাড়ি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করেছে রামের নাম নিয়ে হামলাকারী শতাধিক হিন্দুত্ববাদী। নিচের দুটি তলায় জামাকাপড় তৈরি হত। বাড়িতে মজুত ৮ লক্ষ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে পুলিশমন্ত্রীর অনুগামীরা। বাড়িতে যখন আক্রমণ হয়েছে তখন এলাকায় ছিলেন না সলমণি। জানিয়েছেন, কয়েক ঘন্টা আমি আটকে ছিলাম রাস্তায়। প্রতি মুহূর্তে ভেবেছি আমার গোটা পরিবারকে শেষ করে দিয়েছে ওরা। আমার পরিবারের লোকেরা বাইরের গেট বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা ভেঙেই ওরা ভেতরে ঢুকে বেপরোয়া লুট করতে থাকে এবং আগুন লাগাতে থাকে। সলমণির মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে সবথেকে উপরের তলায় থাকেন। বড় ছেলে এবং তাঁর স্ত্রী হামলার সময়ে বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর পূত্রবধূ সন্তান সম্ভবা। হাসপাতালে ছিলেন তাঁরা। নিচের দুটি তলায় আগুন লাগিয়ে দেয় হামলাকারীরা। ছয় শ্রমিক ছিল। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে উপরে পালায়। আগুন ওপরের তলাগুলিও গ্রাস করতে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে সবাই ছাদে উঠে যায়। সেখানেও পৌঁছে যায় আগুন। অন্যরা কোনোক্রমে পালাতে পারলেও আগুনে পুড়েই প্রাণ হারিয়েছেন ৮৫ বছরের আকবরী। বুধবার হাসপাতালের মর্গে দাঁড়িয়ে সলমণির আপশোষ, ‘আমি থাকলে হয়তো মা-কে বাঁচিয়ে নিতাম।’

হিংসায় জ্বলছে দিল্লি। বুধবার রাত পর্যন্ত অন্তত ২৭জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। জখমের সংখ্যা তিনশো ছাড়িয়েছে। সরকারী দল সরাসরি হিংসায় উস্কানি দিয়ে চলেছে, যাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলানো হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ পরিস্থিতির উপরে কড়া নজর রেখেছেন। তাঁর নজরদারিতেই মঙ্গলবার রাতেও ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’-র পরেও ‘গোলি মারো...’ মিছিল করেছেন বিজেপি বিধায়ক অভয় বর্মা। লক্ষ্মী নগরে নানান ধরনের উস্কানিমূলক স্লোগান দেওয়া বিজেপি বিধায়কের মিছিলের ভিডিও এসেছে সামনে। এভাবেই মঙ্গলবার রাতে এলাকা বিশেষে কারফিউ, দেখামাত্র গুলির নির্দেশের পরেও অবাধে বিচরণ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। বিজেপি’র নেতা-কর্মীরা। উস্কানি, প্ররোচনা দিয়েছেন অবাধে।

মঙ্গলবার রাতেও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে মুস্তাফাবাদের ঝুপড়ি। শতশত ঝুপড়ি জ্বলেছে হোলিকা দহনের মত। একটি ওয়েবপোর্টালের সাংবাদিকের তোলা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে আশপাশের বাসিন্দা দিনমজুর হিন্দুরা বলছেন, শ্রীরামের নাম করে বজরঙ দলের কর্মীরা মুসলিমদের ঝুপড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আতঙ্ক প্রকাশ করে তাঁরা বলেছেন, আমরা এখানে ছেলেপিলেদের নিয়ে থাকি। এই ভয়ঙ্কর আগুন তো মুসলিমদের ঝুপড়িতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। মুস্তফাবাদের মত বিভিন্ন জায়গায় হামলাকারীদের লাগিয়ে দেওয়া আগুন বুধবার বিকেল পর্যন্ত নেভাতে হয়েছে দমকল কর্মীদের।

জিটিবি হাসপাতালে বসে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁছে হিন্দুত্ববাদীদের ভয়ঙ্কর আক্রমণের কথা জানিয়েছেন আফজল। বছর তিরিশের যুবক জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গী বলেছিলেন আমি হিন্দু। তাঁকে হনুমান চালিশা বলতে বলে হিন্দুত্ববাদীরা। সে বলতে না পারায় তাঁকে এবং আফজলকে দুইজনকেই লাঠি রড দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়েছে। হাত-পা ভেঙেছে হিন্দুত্ববাদীরা। সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, কিভাবে তাদের পদবী জানার পরে বলা হয়েছে, হিন্দু বলে বেঁচে গেলি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে কিভাবে সারাদিন ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে আক্রান্তদের। হাসপাতালের এক মহিলা কর্মী বলছেন, মৃতদেহে ভরে উঠেছে আমাদের মর্গ।

মঙ্গলবার রাত থেকে জরুরি শুনানিতে দিল্লি হাইকোর্ট দিল্লি পুলিশের কঠোর সমালোচনা করতে শুরু করে। সুপ্রিম কোর্টও অন্য মামলাতে সমালোচনা করেছে দিল্লি পুলিশের। সরকারের শীর্ষকর্তাদের পৌঁছতে হবে প্রত্যেক আক্রান্তের কাছে। সব নিহতদের পরিবারের সদস্যদের আশ্বস্ত করতে হবে। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি মুরলীধরের এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো ঘুম ভাঙে প্রধানমন্ত্রীর। ট্রাম্পে পিঠ চাপড়ানির ‘হ্যাঙ্গ আউট’ থেকে উঠে নরেন্দ্র মোদী বুধবার দিল্লিবাসীর উদ্দেশ্যে শান্তির বাণী বিলি করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল কালো চশমায় চোখ ঢেকে আক্রান্ত এলাকায় ভরসা দিতে গেছেন। সেখানে ‘ইনসাআল্লা’ শব্দ ব্যবহার করে তিনি আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের কাছের লোক সাজতে চেয়েছেন নাকি অন্যকিছু বোঝাতে চেয়েছেন স্পষ্ট হয়নি। যেমন অবরুদ্ধ কাশ্মীরে গিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার সাজানো ভিডিও দেখিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। তবে বন্দী কাশ্মীর কথা বলতে না পারলেও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন দিল্লির আক্রান্ত এলাকার বাসিন্দারা। পুলিশ নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বললেও তাতে মোটেই আশ্বস্ত হননি নাগরিকরা। তাঁরা মুখের ওপরেই দোভালকে সেকথা শুনিয়ে দিয়েছন। যদিও তিনি দাবি করেছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। সেখান থেকে ফিরে অমিত শাহকে ‘রিপোর্ট’ করেছেন দোভাল, তেমনই জানা গেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে। হামলাকারী হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গ দেওয়ায় অভিযুক্ত দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে তারা শতাধিক গ্রেপ্তার করেছে। ১৮টি এফআইআর করেছে। যদিও সেই তালিকায় বিজেপি’র নেতাদের নাম নেই।

দুধ আনতে বেরিয়েছিলেন সোলাঙ্কি। আর ফেরননি। মঙ্গলবারও একই ঘটনা ঘটেছে। মধ্যরাতে ওষুধ কিনতে বেরিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণ গেছে অটোচালক, দিনমজুর, ইলেকট্রিশিয়ান, ইস্ত্রি করে সংসার চালানো গরিব মানুষগুলোরই জীবন গেছে। এক পুলিশ কর্মী, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী, এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারও প্রাণ হারিয়েছেন। অধিকাংশের পরিচয় বুধবার রাত পর্যন্ত অজানা। কারো স্ত্রী সন্তান সম্ভবা, কারো দুই-তিনটি সন্তান রয়েছে। ঘরবাড়ি, দোকান, গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সোলাঙ্কির বাবা হরি সিং সোলাঙ্কি সরাসরি দায়ী করেছেন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রকে। আসবাবের কারখানায় কাজ করেন হাসিব আহমেদ। মৌজপুরে বসবাস করেন। হিন্দুত্ববাদীদের হামলার অন্যতম কেন্দ্র। জানালেন, ১৯৮১সাল থেকে এখানে আছি। ৩৯বছর হয়ে গেল। বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে ১৯৯২সালের দাঙ্গা দেখেছেন। ১৯৮৪সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর শিখহত্যা দেখেছেন। আহমেদের বক্তব্য, তখনও এইরকম ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখিনি। সত্তর বছরের বৃদ্ধ জানালেন, এইভাবে বাইরে থেকে দলে দলে লোক এসে হামলা করতে দেখিনি। মৌজপুরে হিন্দু-মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা এক সঙ্গেই থাকেন। সেখানে চিহ্নিত করে মানুষের ঘরবাড়ি, দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আক্রমণ করা হয়েছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন