দিল্লিতে ফের পিটিয়ে হত্যা, মৃত বেড়ে ৪২...

নয়াদিল্লি, ২৮ ফেব্রুয়ারি— আবার কি নতুন করে হিংসার আগুন ছড়াতে শুরু করল উপদ্রুত এলাকাগুলিতে? শুক্রবার ভোরবেলা এক কাগজ কুড়ানিকে পিটিয়ে মারার খবর পাওয়া যায়। ৬০বছর বয়সি আয়ুব আনসারি নামের ওই কুড়ানিকে উত্তর-পূর্ব দিল্লির শিববিহার এলাকায় কে বা কারা আধমরা অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। পরে গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে (জিটিবি) মৃত্যু হয় ওই ব্যবসায়ীর। পরিস্থিতি আপাত শান্ত বলে দিল্লি পুলিশ জোর গলায় দাবি করলেও চারদিকে এখনও থমথমে। মৃত্যুমিছিলও অব্যাহত।

Mob beating a person during the clash between two groups at Khajuri Khass crossing in New Delhi on Tuesday. EXPRESS PHOTO BY PRAVEEN KHANNA 25 02 2020.


এদিন জিটিবি হাসপাতালে আরও চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। সবমিলিয়ে দিল্লির উত্তর-পূর্ব অংশের দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৪২। মৃতের এই সংখ্যা পুলিশ স্বীকার না করলেও বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে এমন খবরই মিলেছে। তবে বেসরকারি মতে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। বহু দেহের হদিশই মেলেনি বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষজনের। এদিন নতুন করে তেমন কোনও হাঙ্গামার খবর পাওয়া যায়নি। উপদ্রুত মহল্লাগুলি ছেড়ে বাক্সপ্যাঁটরা সমেত দলবেঁধে মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার ঢলও আটকাতে পারেনি প্রশাসনিক স্তোকবাক্য। এদিক-ওদিক কিছু দোকানপাট খুললেও এলাকা শুনশান, চারদিকে ধ্বংসের ছাপ প্রকট। নিরাপত্তা বাহিনীর টহল, ‘ভরসা জোগানো’ ফ্ল্যাগ মার্চও হারানো আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ।

প্রশাসনিক উদ্যোগকে বিশ্বাস করবেনই বা কী করে মানুষ? বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করে দাঙ্গার অনুসন্ধানের ভার এমন দুই পুলিশকর্তার হাতে দেওয়া হয়েছে যাঁদের কাজের ধরন নিয়ে ‘সুখ্যাতি’ নেই। জয় তিরকে এবং রাজেশ দেও নামের ডেপুটি কমিশনার পদমর্যাদার ওই দুই পুলিশকর্তার নিরপেক্ষতা নিয়েই ঘোরতর প্রশ্ন আছে প্রশাসনিক মহলেই। রাজেশ দেও’কে তো অতি সম্প্রতি দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। শাহিনবাগে গুলি চালানোয় অভিযুক্ত কপিল গুজ্জরকে কোনও তদন্ত ছাড়াই রাজেশ আপকর্মী বলে দাবি করেছিলেন। এমন এক পক্ষপাতদুষ্ট পুলিশকর্তা কীভাবে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ তদারকি করবেন সেই প্রশ্ন তুলে দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দিয়েছিল কমিশন। এই রাজেশ দেও’ই জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্তে গিয়ে ১৫ ডিসেম্বর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার তকমা সেঁটে দিয়ে ১০পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেন। এই রাজেশ দেও আবার জেএনইউ এবং জামিয়া নগরে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে সর্জিল ইমামের তদন্তের অন্যতম সদস্য।



রাজেশের মতোই দিল্লি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আরেক অফিসার জয় তিরকের পক্ষপাতিত্বের ‘সুনাম’ আছে। ৫জানুয়ারি জেএনইউ’তে এবিভিপি মুখোশধারীদের তাণ্ডবে জখম এসএফআই নেত্রী ঐশী ঘোষকেই তিনি উলটে অভিযুক্ত করেন হামলায় জড়িত থাকার অপরাধে। ১০জানুয়ারি তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি এবিভিপি সদস্যদের নামোল্লেখই না করে অভিযুক্ত ৯জনের মধ্যে চার বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের ৭জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

গত কয়েকদিনের হামলার জেরে ঘরবন্দি ছিলেন আয়ুব আনসারি। খাবারও জোটেনি গোটা পরিবারের। এদিন প্রশাসনিক ঘোষণায় আস্থা রেখে ভোরবেলায় শিববিহারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন দু’পয়সা উপার্জনের জন্য। পার্শ্ববর্তী রাজ্য উত্তর প্রদেশের লোনিতে চলে যেতেন কুড়ানির কাজে। সকাল ৬টা নাগাদ বাড়ির দরজা খুলে পরিবারের লোকজন দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন আনসারি। জানা গিয়েছে, সকালেই একদল উন্মত্ত মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরে কোন ধর্মাবলম্বী তিনি, তা জানতে চায়। আর তা জানার পরেই পিটিয়ে আধমরা করে ফেলে রেখে যায় বাড়ির দোরগোড়ায়। তাঁর আজন্ম বিশেষভাবে সক্ষম ছেলে সলমন বাবাকে জিটিবি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। তার আগে অবশ্য বাবাকে বাঁচাতে সলমন কোনক্রমে রিকশায় চড়িয়ে তিন কিলোমিটার দূরে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে চিকিৎসার জন্য ৫হাজার টাকা চাওয়ায় দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার সেই খরচ দিতে পারেনি। কয়েকজনের সাহায্যে অটোয় চড়িয়ে সলমন বাবাকে জিটিবি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও শেষরক্ষা হয়নি। সলমনের মা ওঁদের সঙ্গে থাকেন না। হাসপাতাল চত্বরে কাঁদতে কাঁদতে সলমন বলেন, ‘‘চারদিক ঠিকঠাক মনে করে বাবা ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়েছিল কাজে। কাগজ, লোহা বা ওই ধরনের জিনিসপত্র কুড়িয়ে বিক্রি করে দিনে ৩০০-৪০০টাকা রোজগার করত বাবা।’’ তিনদিন অভুক্ত থাকার পরে রোজগারের চেষ্টায় ভোরে বেরিয়ে পড়লেও ধর্মান্ধদের হাত থেকে রেহাই পেলেন না আনসারি।



এই ঘটনা সত্ত্বেও দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র রণদীপ রানধাওয়া এদিন দাবি করলেন, নতুন করে হামলার খবর পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি ক্রমশ শান্ত হয়ে আসছে। তিনি জানান, ১৮টি এফআইআর দাখিল করা হয়েছে। ৬৩০জনকে হয় গ্রেপ্তার নয়ত আটক করে রাখা হয়েছে। জখমের সংখ্যা ২৫০জনের মতো। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন জখম গুলির ঘায়ে বলে স্বীকার করেছেন রানধাওয়া। তবে তিনি মৃতের সংখ্যা ৩৮জনেই অনড় থাকেন। এদিন আরও চারজনের যে মৃত্যু হয়েছে, তা মানতে চাননি তিনি।

আবার সদ্য দিল্লি পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব নেওয়া এসএন শ্রীবাস্তব জানান, ইতিমধ্যে ৩৩১টি শান্তি বৈঠক হয়েছে। উপদ্রুত এলাকায় প্রায় ৭হাজর আধাসেনা মোতায়েন আছেন শান্তিরক্ষায়। ফ্ল্যাগ মার্চ চলছে মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে। শ্রীবাস্তব এমন দাবি করলেও মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। হামলাবাজরা এদিক-ওদিক হাঙ্গামা চালাচ্ছে বলেই অভিযোগ। আবার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসাররা স্বীকার করছেন, বহিরাগতরাই মূলত দাঙ্গা ছড়িয়েছে। আর এরসঙ্গে জুটে গিয়েছিল স্থানীয় দুষ্কৃতীরা। তবে তাঁরা স্বীকার না করলেও স্পষ্ট, বহিরাগত বা যাই হোক, হামলার ছক পূর্ব পরিকল্পিত। দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রশস্ত্র মজুত করে নামা হয়েছে ময়দানে।

পরিস্থিতি যে এখনও স্বাভাবিক হয়নি তা বোঝা যাচ্ছে দিল্লির আদালতগুলিতে গেলেই। উপদ্রুত এলাকা থেকে অভিযোগকারী অথবা আইনজীবী কেউই হাজির হতে পারছেন না আদালতে। ফলে সাম্প্রতিক দাঙ্গা সংক্রান্ত মামলার বিচার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। সিলামপুর, জাফরাবাদ, গোণ্ডা চক, মৌজপুর, চাঁদবাগে বসবাসকারী আইনজীবীরা আসতেই পারছেন না আদালতে। ফলে মামলাও ঝুলে রয়েছে। এমনকি অভিযোগকারীরাও পরিস্থিতি থমথমে এবং আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে না পেরে যেতে পারেননি আদালতে।

এদিকে, কংগ্রেসের ‘রাজধর্ম’ পালনের দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চাইল বিজেপি। উলটে বিজেপি’র পক্ষ থেকে সোনিয়া গান্ধী সহ কংগ্রেসকে ‘জ্ঞান’ না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এদিন সাংবাদিকদের কাছে বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ কংগ্রেস নেতাদের ‘নিজেদের চরকায় তেল দিন’ বলে পালটা হুমকিও দিয়েছেন। এরই সঙ্গে কপিল মিশ্র বা পরবেশ ভার্মার মতো বিজেপি নেতাদের উসকানিমূলক মন্তব্যের সঙ্গে তাঁরা সহমত নন, এমন সাফাইও শোনা যায় রবিশঙ্করের মুখে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন