বামপন্থীদের কাছে আতঙ্ক, যন্ত্রণার কথা জানালো দগ্ধ দিল্লি

২৭ ফেব্রুয়ারি- বলতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। তাও চাঁদবাগের মেয়েরা শেষ পর্যন্ত দুই বামপন্থী সাংসদ সহ সিপিআই (এম)’র প্রতিনিধি দলের কাছে তুলে ধরলেন সেদিনের ঘটনা। সঙ্ঘের দুর্বৃত্ত বাহিনী কীভাবে নিজেদের শরীরের নিম্নাঙ্গের পোশাক নামিয়ে সিএএ-বিরোধী অবস্থানে থাকা মহিলাদের বলেছে, ‘আও আজাদি দিলাতি হু।’ উন্মত্তবাহিনীর অশালীন আচরণের কথা বলতে গিয়ে কুঁকড়ে গিয়েছেন তাদের মায়ের বয়সি মহিলারা। তবু বামপন্থীদের সামনে পেয়ে যন্ত্রণার কথা বলতে পেরেছেন মন খুলে।

বৃহস্পতিবার উত্তর পূর্ব দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসা কবলিত বিস্তীর্ণ অংশে ঘুরে ঘুরে এটাই মনে হয়েছে, আক্রান্ত মানুষগুলোর কথা শুনতে কেউ আসেনি। তাঁদের যন্ত্রণা, আতঙ্ক, উদ্বেগ ভাগ করে নিতে কেউ চায়নি। বামপন্থীদের পেয়ে এদিন সেই কথাই জানিয়েছে সোনিয়া বিহার, শ্রীরাম কলোনি, চাঁদ বাগ, ব্রজপুরী, খাজুরি খাস এলাকার মানুষ। প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিপিআই (এম) সাংসদ কে কে রাগেশ, সিপিআই সাংসদ বিনয় বিশ্বম, সিপিআই (এম) দিল্লি রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মৈমূনা মোল্লা, অনুরাগ সাক্সেনা, আশা শর্মা এবং ওই অঞ্চলের পার্টিনেতা ফুলকান্ত মিশ্র ছিলেন। স্থানীয় সিপিআই (এম) কর্মীরাও যোগ দিয়েছিলেন।

প্রথমেই প্রতিনিধি দল যায় সোনিয়া বিহার এলাকায়। সেখানে আক্রান্ত মহম্মদ রহমত জানালেন, মঙ্গলবার রাতে বজরঙ দলের কর্মীরা হামলা চালায় এলাকায়। এমনিতে এলাকায় হিন্দুরাই অধিকাংশ। সামান্য কিছু ঘর মুসলিম। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনও সংঘাত নেই। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি মিলেমিশেই বসবাস করেন। এলাকার মানুষ জানালেন, হামলা হতে দেখে অন্তত দশবার পুলিশের ১০০ নম্বরে ফোন করা হয়েছে। অনেক পরে রাউন্ড দিয়ে চলে যায় পুলিশ।

এলাকায় ঘুরে বোঝা গেল, মুসলিমদের দোকান চিহ্নিত করে করে হামলা করা হয়েছে। দুটি মুদি দোকান, একটা মোবাইলের দোকান, চুল কাটার সেলুন, ইলেক্ট্রিকের দোকানে আগুন লাগানো হয়েছে। এক মুদি দোকানি জানালেন, ওরা এসে আমাদের দোকানে বলে চলে যাও। দোকানে সেই সময়ে আমার বাচ্চাগুলো ছিল। ওদের সরিয়ে নিয়ে আসি। এরপরে দোকানের জিনিসপত্র লুট করে। তারপর আগুন লাগিয়ে দেয়। এলাকার বাসিন্দা হিন্দুরাও এসে বামপন্থী সাংসদদের বললেন, আপনারা দেখুন ওঁদের যাতে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যায়। ওরা গরিব মানুষ। সবই শেষ করে দিয়েছে।

প্রতিনিধি দল এরপর স্থানীয় থানায় যায়। এসএইচওকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। পুলিশ অফিসার জানান, এফআইআর করা হয়েছে। যদিও তিনি এফআইআরের কপি দিতে অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত সাংসদদের চাপাচাপিতে এফআইআর নম্বর দিতে রাজি হন। দেখা গেল থানার কাছেই জড়ো করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক হিংসায় জ্বালিয়ে দেওয়া গাড়ি, মোটরসাইকেল।

ব্রজপুরীর অরুণ মর্ডান পাবলিক সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল। তিরিশ বছরের পুরানো স্কুল। এখানে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই পড়ে। ৩০-৪০ শতাংশ ছেলেমেয়েকে ফ্রি-তে পড়ানো হয়। সেই স্কুলে লুটপাট চালানো হয়েছে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং ওইধরনের মূল্যবান জিনিস লুটপাট করেছে প্রথমে। তারপর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে স্কুল। এলাকার মানুষ জানালেন, কারা স্কুল লুট করেছে এবং আগুন লাগিয়েছে সেটা স্পষ্ট করে বোঝা যায়নি। বোঝা যায়নি, তার কারণ হামলাকারীরা মুখ ঢেকে এসেছিল। তারা কোনও স্লোগানও দেয়নি। বিবরণ থেকে স্পষ্ট হামলাকারীরা খুবই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। হঠাৎ উন্মত্ততাতে এসে হামলা করেনি। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই হামলা হয়েছে। এলাকার মানুষ বারে বারে বলার পরেও তিন ঘণ্টা পরে ঘটনাস্থলে এসেছে পুলিশ।

গোয়েন্দা বিভাগের কর্মী অঙ্কিত শর্মার বাড়িতেও যাওয়ার চেষ্টা করেন সাংসদরা। কিন্তু গলির মুখে জটলা করে একদল লোক প্রতিনিধি দলকে বাধা দেয়। কোনও সাংসদ, বিধায়ককে যেতে দেওয়া হবে না বলেও তাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ হুঁশিয়ারি দিচ্ছিল। সোনিয়া বিহার দুসরা পুসতা এলাকায় প্রতিনিধি দলের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন এক মহিলা। ভয়ে, আতঙ্কে তিনি সিঁটিয়ে রয়েছেন। অন্য এলাকায় তাঁর কাকার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেই কথা জানিয়ে বলেন, এখানেও হামলার আশঙ্কায় আমরা শান্তিতে থাকতে পারছি না। ঘুমতে পারছি না দু’দণ্ড। মাঝেমাঝেই হিন্দুত্বের বাহিনী এসে জয় শ্রীরাম স্লোগানে এলাকা কাঁপাচ্ছে। প্রতিবারই হামলার আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন মানুষ।

চাঁদ বাগের মহিলারাই জানালেন সেদিনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। বললেন, রাস্তা অবরোধ করতে অল্প কয়েকজন মহিলাই গিয়েছিলেন। আমরা সবাই অবস্থানের তাঁবুতেই ছিলাম। সেখানেই হামলা চালায় পুলিশ এবং সঙ্ঘের লোকেরা। ছেলে পুলিশরাই সিএএ-এনআরসি বিরোধী অবস্থানে মহিলাদের লাঠি দিয়ে মেরে তোলে। সামনের একটা নার্সিংহোমের ছাদ থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ বা আরএসএস’র লোকেরা গুলি চালিয়েছে, পাথর ছুঁড়েছে বলেও তাঁরা অভিযোগ করলেন। একইসঙ্গে তাঁদের সঙ্গে ওই অশালীন আচরণের কথাও জানিয়েছেন মহিলারা।

সর্বত্রই আতঙ্কিত মানুষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন বামপন্থী সাংসদ, সিপিআই (এম) কর্মীরা। পুলিশ, প্রশাসনের কাছে তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবি করবেন বলেও জানিয়েছেন। রাজধানীতে যেখানে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা মানুষের বিপদে এগিয়ে আসেনি। পুলিশকে পাওয়া যায়নি। দুই সরকারি দলের বিধায়ক-সাংসদদের দেখা মেলেনি। সেখানে বামপন্থী সাংসদ, কর্মীদের পেয়ে কিছু হলেও ভরসা পেয়েছেন মানুষ।

মৈমূনা মোল্লা
শেয়ার করুন

উত্তর দিন