অগ্নিগর্ভ দিল্লি



ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের মাঝেই দিল্লির পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। গত রবিবার বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদে সিএএ আইনের পক্ষে একটি মিছিল করে ও মিছিল শেষে সরাসরি পুলিশকে হুমকি দিয়ে বলে যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফর শেষ হওয়ার পরেই কোন পুলিশের তোয়াক্কা না করে সিএএ বিরোধি অবস্থানকারীদেরকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এরপরেই জাফরাবাদ,মৌজপুর সহ উত্তর পূর্ব দিল্লিতে ব্যাপক হিংসা ছড়িয়ে পরে যা সোমবার ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দিল্লি শহরের কেন্দ্র থেকে ১৫ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত মৌজপুর, জাফরাবাদ, ভজনপুরা, কর্দমপুরী, দয়ালপুর এবং চাঁদবাগ অঞ্চলে হিংসা ছড়িয়ে পরেছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডাক্তারকে উদ্ধৃত করে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ জানিয়েছে যে নিহতদের মধ্যে ৪ জনের দেহের গুলির আঘাত স্পষ্ট। নিহত পুলিশ কনস্টেবল রতন লালের দেহে গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আধিকারিকদের মতে সম্ভবত পাথর বা লাঠির আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ২৬ জন পুলিশ আধকারিক সহ শতাধিক মানুষ এই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন। ৭০জন আহতের দেহে গুলির আঘাত মিলেছে।
রবিবার থেকে পরিস্হিতি উত্তপ্ত হতে থাকলেও কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ পুলিশ কোন সদর্থক ভূমিকা পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা গেছে “জয় শ্রী রাম” স্লোগান দিয়ে কিভাবে এলাকার পর এলাকা জুড়ে তান্ডব চালানো হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহকদেরকেও আক্রমণের মুখে পরতে হয় । প্রেস কার্ড দেখানোর পরেও তাদের ছাড় মেলেনি । বহু ক্ষেত্রে ক্যামেরা বা ফোন থেকে ছবি, ভিডিয়ো মুছে দিতেও তাদের বাধ্য করা হয়।
বিভিন্ন মিডিয়াতে ফুটে উঠেছে পুলিশের সামনেই বন্দুকবাজদের দাপাদাপির ছবি। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ কর্মীরা একাধিক যুবককে বেধড়ক মেরে তাদেরকে বাধ্য করছে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে( ভিডিয়োটির সত্যতা যাচাই করা যায়নি)। মঙ্গলবার দুপুর অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী হিংসার আঁচ যমুনাবিহারেও ছড়িয়েছে। ২০০২ সালে গুজরাতের সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি উস্কে দিয়েছে দিল্লির এই ভয়াবহ হিংসা। অনেকটা একই ধাঁচে পুলিশ প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রেখে এই তান্ডব চালানো হচ্ছে। মোদি,অমিত শা্হ ট্রাম্প বন্দনায় ব্যস্ত অথচ দিল্লির ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কোন কড়া পদক্ষেপ নেওযার উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুসারে উত্তর-পূর্ব দিল্লির একাধিক জায়গায় আধাসেনা মোতায়েন করা হয়েছে । নয়ডা সহ বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সংবাদসংস্থা এনআই জানিয়েছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির একাধিক জায়গায় দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দিল্লি পুলিশের তরফ থেকে, যা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যথেষ্ট আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে । জাফরাবাদ এলাকাতে শনিবার থেকে সিএএ আইনের প্রতিবাদে অবস্থানরত মহিলাদের পুলিশ নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সরিয়ে দিয়েছে । বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র এই অবস্থান তুলে দেওয়ারই হুমকি দিয়েছিল । সিবিএসই এর তরফ থেকে উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় বুধবার ২৬ ফেব্রুয়ারির দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা স্থগিত রাখার কথা জানানো হয়েছে।
একটানা ৪৮ ঘন্টার বেশি সময় ধরে এই তান্ডব চলতে দেওয়া হল কিভাবে সেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য । সদ্য বিপুল ভোটে জিতে আসা আম আদমি পার্টির কোন বিধায়ক এমনকি মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিবালের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। দিল্লির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রের সরকারের বলে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। গত ১৫ ডিসেম্বর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি তান্ডব ও নিরপারাধদের প্রেফতারের প্রতিবাদে গোটা দেশের আইনজীবিদের নিয়ে একটি 'হোয়াটসঅ্যাপ' গ্রুপ বানানো হয় 'লইয়ার্স ফর ডিটেইনিস' নামে। এই 'লইয়ার্স ফর ডিটেইনিস'-দিল্লি- এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে দিল্লি সরকার তথা কেন্দ্রের সরকারের হিংসা থামাতে ইচ্ছাকৃত দেরি করার অভিযোগ জানানো হয়েছে। অতীতে জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন , বিহারে লালু প্রাসাদ যাদব মুখ্যমন্ত্রী থাকাকলীন বা সাম্প্রতিক অতীতে কেরালায় পিনারাই বিজয়ন সরকার যেভাবে সাম্প্রদায়িক অশান্তির মোকাবিলা করেছে সেই উদাহরণ ও অনেকে মনে করাচ্ছেন।

শেয়ার করুন

উত্তর দিন