প্রাককথন
আজকের সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও তার অধিকার বলতে বুর্জোয়া অধিকার বুঝতে হয়, যদিও অনেকেই সেভাবে বিবেচনা না করে একে পবিত্র অধিকারের মর্যাদা দিয়ে ফেলেন। বুর্জোয়া ব্যবস্থাও ঠিক সেটাই চায়। যতদিন অবধি সম্পত্তির অধিকারকে বুর্জোয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারেই বিবেচনা করা চলবে অথচ লেখায়, কথায় এমনকি উপলব্ধির স্তরেও উল্লেখ করার বেলায় তা শুধুই সম্পত্তির অধিকার হিসাবে চিহ্নিত হবে ততদিন কাদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে? কমিউনিস্ট ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল- ‘The distinguishing feature of Communism is not the abolition of property generally, but the abolition of bourgeois property. But modern bourgeois private property is the final and most complete expression of the system of producing and appropriating products that is based on class antagonisms, on the exploitation of the many by the few.
In this sense, the theory of the Communists may be summed up in the single sentence: Abolition of private property.’- বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না, কিন্তু হয়। কারণ অধিকার বিষয়টিকে বুর্জোয়াদের মতো করে ভাবতে বাধ্য হতে হলেও আখেরে বেশিরভাগের সম্পত্তি বলতে যেহেতু প্রায় কিছুই নেই। যা বস্তুত নেই, তাকেই উপলব্ধি করতে গেলে কিছুটা বিড়ম্বনা সম্ভবত বাস্তবিক।
সম্প্রতি একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সম্পত্তির অধিকারকে ব্যখ্যা করার সময় সমাজতান্ত্রিক ধারণার প্রসঙ্গটি সামনে এসেছে। ভারতের সংবিধান রচনার সময় প্রণেতাদের বিবেচনায় সমাজতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে বিবেচিত হয়েছিল? সম্পত্তির অধিকারে রাষ্ট্র কতদূর হস্তক্ষেপ করতে পারে? সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে সেইসব প্রসঙ্গের আলোচনা করেছেন লেখক।
বড়দিন আনন্দের পাশাপাশি আস্থারও বিষয়। বক্তিগত বিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে আমাদের দেশে যে সকল উপলক্ষ্য জনসাধারণের প্রায় সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে আসে বড়দিন তেমনই একটি দিবস। আজকের দিনে রাজ্য ওয়েবসাইট প্রকাশ করছে সেই প্রতিবেদন। সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে আলোচনায় মনে রাখতে হবে ব্যক্তিগত না, আদ্যন্ত সামাজিক শক্তি হিসাবেই পুঁজি কার্যকরী হয় – ‘Capital is therefore not only personal; it is a social power’.
তাই একক কোনও রায় বা একক কোনও কোনও ব্যক্তি বিশেষ নয় এ প্রতিবেদনের পরিসর আগাগোড়া সামাজিক বন্দোবস্তটিকে ঘিরে বিস্তৃত।
বাবিন ঘোষ
গত ৫ই নভেম্বর, ২০২৪, Property Owners Association & Others Vs. State of Maharashtra & Others (Civil Appeal No. 1012 of 2002) মামলায় মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেন। ‘সোশ্যালিস্ট’ ৫৪ বার, ‘সোশ্যালিজম” ২৫ বার, ‘মার্কস’ ২ বার, ‘মার্কসিজম’ ২ বার, ‘কমিউনিস্ট’ এবং ‘কমিউনিজম’ ১ বার, ‘ক্যাপিটালিস্ট’/’ক্যাপিটালিজম’ শব্দটি ১৯ বার এ রায়ে উল্লিখিত হয়েছে। এই মামলার তথ্যসমূহে ঢোকার আগেই বুঝে নেওয়া যায়, যে এ রায়টি সংশ্লিষ্ট মামলার নির্দিষ্ট গন্ডি পেরিয়ে সার্বিকভাবে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের বিচার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরের মনোভাব (খন্ডিত যদিও) তুলে ধরেছে।
বিষয়টি কী?
ভারতের সংবিধানের ৩৯ নং ধারায় বলা হয়েছে-
39. Certain Principles of policy to be followed by the State- The State shall, in particular, direct its policy towards securing-
(a) that the citizens, men and women equally, have the right to an adequate means to livelihood;
(b) that the ownership and control of the material resources of the community are so distributed as best to sub serve the common good;
(c) that the operation of the economic system does not result in the concentration of wealth and means of production to the common detriment;
(d) that there is equal pay for equal work for both men and women;
(e) that the health and strength of workers, men and women, and the tender age of children are not abused and that citizens are not forced by economic necessity to enter avocations unsuited to their age or strength;
(f) that children are given opportunities and facilities to develop in a healthy manner and in conditions of freedom and dignity and that childhood and youth are protected against exploitation and against moral and material abandonment. [১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে এই অংশটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়]
উপরোক্ত (খ) উপধারায় যা লেখা রয়েছে, তার মর্মার্থ কী? ‘মেটেরিয়াল রিসোর্সেস অফ দ্যা কমিউনিটি’ মানে কি শুধুই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদ নাকি এই বাক্যবন্ধের মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদকেও রাখা যায়? অন্যভাবে বলতে গেলে, ‘জাতির বস্তুগত সম্পদ’– এর উপর মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণকে সাধারণের উপকারের (‘কমন গুড’) জন্য বন্টন (‘ডিস্ট্রিবিউটেড’) করার যে নির্দেশিকা সংবিধান রাষ্ট্রকে দিয়েছে, তার আওতায় কি ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ/ সম্পত্তিকেও ধার্য করা সম্ভব? এই প্রশ্নই এই মামলার মূল উপজীব্য এবং স্বাধীনোত্তর ভারতে মামলার রায়ে শ্রেণী লড়াইয়ের ইতিহাসের নির্দিষ্ট একটা স্তরের স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়।
সংবিধান প্রণয়নের সময়ে উপরোক্ত ধারাটি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হয়। ‘বাম’ দিক থেকে দামোদর স্বরূপ শেঠ, শিবন লাল সাক্সেনা, ডক্টর কে টি শাহ, আচার্য নরেন্দ্র দেব (মূলতঃ কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির) আর ‘দক্ষিণ’ দিক থেকে খোদ রাজেন্দ্র প্রসাদ আর এঁদের উভয়ের মাঝে আম্বেদকর। বামেদের বক্তব্য ছিল যে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার সাথে সাযুয্য রেখে জাতীয় সম্পদের ঠিক কোন কোন অংশগুলির মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ সর্বসাধারণের হিতার্থে রাষ্ট্রের আওতাধীন থাকবে, তা সংবিধানের এই ধারায় স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন আছে। যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ যথা জল, জঙ্গল, খনিজ পদার্থ এবং ভারি শিল্প সামাজিক স্বার্থে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন রাখা প্রয়োজন, যাতে মুষ্টিমেয় পুঁজিবাদীদের স্বার্থে তা ব্যবহৃত না হতে পারে। আম্বেদকর তাঁর জবাবী ভাষণে বলেন যে কোনো নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক মডেল (এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র)-কে অলঙ্ঘনীয় অবস্থানে বসানোর কথা কোন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান বলতে পারেনা। ইকোনোমিক ডেমোক্রেসি’র যে বার্তা সংবিধান জাতির কাছে রাখতে চায়, তার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক মডেলকে আগত সকল প্রজন্মের জন্য সাংবিধানিক প্রেসক্রিপশন হিসাবে বাতলে দেওয়া সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই একেক প্রজন্মকে তাদের নিজেদের মত করে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন সময়, ও পরিবেশে ‘ইকোনমিক ডেমোক্রেসি’র ধাঁচা ব্যাক্তিকেন্দ্রিক বা সমষ্টিকেন্দ্রিক, দুই-ই হতে পারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, আলোচনার সময় অধ্যাপক কে টি শাহের বক্তব্যের জবাবে আম্বেদকর খুব স্পষ্টভাবেই এ কথা বলেন যে-
‘If these directive principles to which I have drawn attention are not socialistic in their direction and in their content, I fail to understand what more socialism can be.’
অর্থাৎ, একটি বিষয় স্পষ্ট যে স্বয়ং আম্বেদকরের মতেও সংবিধানের ৩৯(খ) ধারায় সমাজতান্ত্রিক দ্যোতনা বা কন্টেন্ট রয়েছে। এ বিষয়ে যদিও প্রধান বিচারপতি শ্রী চন্দ্রচূড়, তাদের (৭ জন বিচারপতির) রায়ের ১৭৬ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে সংবিধান পরিষদের বিতর্কে সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদ, অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিসমূহে যে ‘সোশ্যালিস্ট স্পিরিট’-র কথা আম্বেদকর বলেছিলেন, তা নেহাৎ-ই এক ‘পাসিং রেফারেন্স’ এবং এর উদ্দেশ্য ছিল পরিষদের বহু বামমনষ্ক সদস্যের ‘স্ট্র্যাটেজিক কনসেশন’ আদায় করা, অর্থাৎ, সেই সব সদস্যকে আশ্বস্ত করা যে সংবিধানে বামপন্থী মতেরও অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। অথবা, সেই সকল বামমনষ্ক মানুষের সাথে একধরণের আপস-মীমাংসা করে নেওয়া যাতে বিতর্ক দীর্ঘায়িত না হয়। তদানীন্তন প্রধান বিচারপতির লিখিত মেজরিটি ওপিনিয়নের এই অংশটি খানিক বিষ্ময়ের উদ্রেক করে!
আম্বেদকরের রাজনৈতিক দর্শনে ফরাসী বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের আহ্বানের একটা বড় স্থান ছিল। সেই লক্ষ্যে পৌছতে হলে বর্ণাশ্রম এবং শ্রেণী, এ দুয়েরই বিলোপসাধন যে জরুরি, তা আম্বেদকরের বহু বক্তব্যে, লেখায় স্পষ্ট। তদানীন্তন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তার মতানৈক্য সমাজতন্ত্র’র ধাঁচা নিয়ে এবং সে লক্ষ্যে পৌছনোর পথ নিয়ে ছিল। কিন্তু তাতে এটা সত্যি হয়ে যায় না যে বর্তমানে সঙ্ঘ পরিবারের প্রচার অনুযায়ী আম্বেদকর ‘খোলা বাজার’ অর্থনীতির, বা আরো নির্দিষ্টভাবে বললে, নয়া উদারবাদী বন্দোবস্তের অন্তর্গত লুটেরা পুঁজির সমর্থক ছিলেন, বরং সংবিধান প্রণয়নের সময়কার তথ্য-প্রমাণ এর উল্টো সাক্ষ্য দেয়। ১৯৬৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রকাশিত ‘The Framing of India’s Constitution: Select Documents’-র দ্বিতীয় খন্ডে রয়েছে যে আম্বেদকর যে খসড়া সংবিধান পেশ করেন, তাতে তিনি নির্দিষ্টভাবে ‘স্টেট সোশ্যালিজম’-র প্রয়োজন ব্যক্ত করেন। অতিগুরুত্বপূর্ণ সকল শিল্পোৎপাদন সহ সমগ্র কৃষিক্ষেত্রকে তিনি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে লেখেন যে ‘স্টেট সোশ্যালিজম’ বাদে একজন কর্মহীন নাগরিক তার কাজ পাওয়ার মৌলিক অধিকারগুলিও সুরক্ষিত রাখতে পারবেন না এবং সেই কাজের উপার্জনে বেঁচে থাকার অসহায় তাগিদে অর্থাৎ, একজন সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের মত মৌলিক অর্থনৈতিক অধিকার সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে ব্যক্তিপুঁজির মর্জির ওপর। শুধুমাত্র ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতির মাধ্যমে ‘এক ব্যক্তি এক মূল্য’ (সমাজে প্রতিটি ব্যক্তির মানুষ হিসাবে সমান মূল্য), যা কিনা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তিনি লেখেন- ‘it was equally essential to prescribe the shape and form of the economic structure of the society’. সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসের এ সকল অংশ, অর্থাৎ, সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে আম্বেদকরের মতামত লিপিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যকে ‘পাসিং রেফারেন্স’ হিসাবে ধরে নেওয়ার কারণটা ঠিক স্পষ্ট নয়।
এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখতে হয় যে অধ্যাপক কে টি শাহ বা শিব্বন লাল সাক্সেনা’র মত সংবিধান পরিষদের সদস্যরা সরাসরি সংবিধানের প্রথম ধারাতেই এ দেশকে বিভিন্ন রাজ্যের একটি ‘সমাজতান্ত্রিক’ সঙ্ঘ অর্থাৎ সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন অফ স্টেটস’ হিসাবে বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন। কাজেই অর্থনৈতিক ন্যায়ের সংজ্ঞাও সমাজতান্ত্রিক মতেই তাঁরা প্রস্তাব করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সংবিধান পরিষদের কোনো একজন সদস্য’ও এ বিষয়ে আগাগোড়া বিতর্কে কখনো capitalism is freedom মার্কা প্রতিযুক্তি দেন নি। এই বিতর্কে কেউ খোলাখুলি সে সময় আজকাল যাকে বাজারমুখী বা ‘প্রো-মার্কেট’ অবস্থান বলে, তাও নে’ন নি। এ বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন মামলায় সংখাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের যে রায় (‘মেজরিটি ওপিনিয়ন’) তার ‘tone’ কে তুলনা করার জন্যই। আম্বেদকর ৩৯(খ) ধারার ভাষাকে ‘খোলামেলা’ রাখতে চেয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের নিজেদের মত করে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের আদর্শের দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। যদিও এ ধারার যে নির্দিষ্ট সমাজতান্ত্রিক অভিমুখ (কন্টেন্ট) রয়েছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। আম্বেদকরের এমন অবস্থান সংবিধান পরিষদে সংখ্যগরিষ্ট সদস্যের সমর্থন লাভ করে। কিন্তু এই মামলার রায়ে আম্বেদকরের সেই অবস্থানের সম্পূর্ণ বিরোধী একটি অবস্থান থেকে ৩৯(খ) ধারাকে ব্যখ্যা করা হয়েছে মেজরিটি ওপিনিয়নে। শুধু তাই নয়, মেজরিটি ওপিনিয়নে এই বিপরীত অবস্থানকে ডিফেন্ড করার জন্য এই ধারার ব্যখ্যায় বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে চলে আসা State of Karnataka v. Ranganatha Reddy [(1977)4SCC471] মামলায় জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের আইনি মত এবং পরবর্তীকালে Sanjeev Coke Manufacturing Co vs. Bharat Coking Coal Ltd. [(1983)1SCC147] মামলায় ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের উপরোক্ত মতকেই মান্যতা দিয়ে যে রায় প্রদান করে, সেসবকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার (Vaidyanathapuram Rama Iyer Krishna Iyer) ভারতের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এক অত্যুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। শ্রমিক/মজদুর/ প্রান্তিক মানুষের অধিকারের পক্ষে চিরকাল অবস্থান নেওয়া একজন অত্যন্ত বড় মাপের আইনবেত্তা ও সংবিধান বিশারদ ছিলেন। কেরলের প্রথম নির্বাচিত বামপন্থী ফ্রণ্ট সরকারে স্বরাষ্ট্র এবং আইন দপ্তরের মন্ত্রী ও ছিলেন। রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলায় জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের ৩৯(খ) ধারা বিষয়ে ব্যখ্যা ছিল-
‘Material resources of the community in the context of reordering the national economy embraces all the national wealth, not merely natural resources, all the private and public sources of meeting material needs, not merely public possessions...To exclude ownership of private resources from the coils of Article 39(b) is to cipherise its very purpose of redistribution the socialist way.’
বর্তমান এই মামলার রায়ে (মেজরিটি ওপিনিয়নে) বলা হয়েছে যে রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলায় ৭ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের মত ছিল ‘মাইনরিটি ওপিনিয়ন’ কাজেই পরবর্তী কোনো সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই মত মেনে চলতে বাধ্য ছিল না এবং সে কারণে সঞ্জীব কোক মামলায় ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ৩৯(খ) ধারার ব্যখ্যায় জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের মতামতকে মেনে নিয়ে ভুল করেছিল। এই বক্তব্যের সমর্থনে জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের রায়ে (মেজরিটি ওপিনিয়ন) বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে যে রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলায় এ কথা বলা হয়েছিল যে তারা (৭ সদস্যের মধ্যে ৪ জন, অর্থাৎ ‘সংখ্যাগরিষ্ট বিচারকরা’) ৩৯(খ) ধারা প্রসঙ্গে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের ‘সকল’ মতের সাথে সহমত পোষণ করেন না। রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলার রায়ের প্রাসঙ্গিক অংশটি নীচে উদ্ধৃত করা হল-
‘Since we have upheld the constitutional validity of the Act on merits by repelling the attack on it by a reasonable and harmonious construction of the Act, we do not consider it necessary to express any opinion with reference to Article 31- C read with clauses (b) and (c) of Article 39 of the Constitution. Our learned Brother Krishna Iyer, J. has prepared a separate judgment specially dealing with this point. We must not be understood to agree with all that he has said in his judgment in this regard.’
মনে রাখা জরুরি যে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের মতের ঠিক কোন অংশের সাথে তাঁরা (৭ এর মধ্যে ৪ জন বিচারক) সহমত হ’ন নি, সে কথা উপরোক্ত রায়ে কোথাও একবারের জন্যেও বলা ছিলনা। তদুপরি ঐ মামলার রায়ে ৩৯(খ) ধারা প্রসঙ্গে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার বাদে মেজরিটি ওপিনিয়নের ৪ জনের মধ্যে কোনো বিচারপতিই কোনো অবস্থান নেন নি। অর্থাৎ, ওপরে উদ্ধৃত ঐ একটি বাক্য বাদে আর কোনো অংশে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের বক্তব্যের কোনো নির্দিষ্ট বিরোধীতা করা হয়নি মেজরিটি ওপিনিয়নে। কাজেই রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলার রায়ের ৬ বছর বাদে ১৯৮৩ সালে যখন ৫ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ (জাস্টিস চিনাপ্পা রেড্ডি’র নেতৃত্বে) নির্দিষ্টভাবে ৩৯(খ) ধারার ব্যখ্যা করতে গিয়ে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের সেই মতামতকেই সর্বসম্মতিক্রমে মান্যতা দেয়, তাতে বিচারবিভাগীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ ঘটেনি। এর কারণ, সঞ্জীব কোক মামলায় ৫ সদস্যের বেঞ্চের তরফ থেকে পূর্ববর্তী ৭ সদস্যের (মানে, উচ্চতর মন্ডলীর) সাংবিধানিক বেঞ্চের মেজরিটি ওপিনিয়নের বিরোধীতা করা হয়নি, বরং উচ্চতর বেঞ্চের থেকে নির্দিষ্টভাবে ৩৯(খ) ধারার যে ব্যখ্যা করা হয়, তা একমাত্র জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের রায়েই রয়েছে (যে পয়েন্টে ঐ মামলার মেজরিটি ওপিনিয়ন কোনো পালটা ব্যখ্যা রাখেননি) যা কিনা পরবর্তীকালে কম সদস্যের এক সাংবিধানিক বেঞ্চ মেনে নিয়েছে। উল্লেখ্য যে সঞ্জীব কোক মামলায় সর্বসম্মতিক্রমে এই ‘লাইন’ মেনে নেওয়া হয় এবং একবারের জন্যেও এ কথা কোনো বিচারপতি বলেননি যে শুধুমাত্র উচ্চতর বেঞ্চের এক সদস্যের মতামত বলেই তার/তাদের মতের ভিন্নতা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও (এমন মতপ্রকাশের অধিকার অবশ্যই রয়েছে নিম্নতর বেঞ্চের) ঐ ব্যখ্যা তারা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে কোনো একটি আইনি প্রশ্নে নিম্নতর বেঞ্চ/ আদালত উচ্চতর বেঞ্চ/ আদালতের সেই প্রশ্নে যে অবস্থান ইতিমধ্যেই নিয়েছে, তাকে মেনে নিতে বাধ্য, প্রয়োজনে নিজেদের মতের ভিন্নতা ঘোষণা করেও। জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের রঙ্গনাথ রেড্ডি মামলার রায়ের বিরুদ্ধে এমন কোনো ভিন্নমত সঞ্জীব কোক মামলার রায়ের ব্যক্ত করা হয়নি।
বর্তমান মামলায় প্রধান বিচারপতি শ্রী চন্দ্রচূড়ের প্রণীত মেজরিটি ওপিনিয়নে অন্ততঃ ৪টি মামলার উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের অবস্থান স্পষ্টভাবেই ‘বামপন্থী’ (১৯৮৬ সালে Maharao Sahib Shri Bhim Singhji Vs Union of India মামলায়, সিলিং বহির্ভুত উবৃত্ত জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে জাস্টিস আইয়ার সরাসরি কার্ল মার্কসকে উদ্ধৃত করে রায় দেন) এবং সে কারণেই তা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষপাতি যা কিনা সংবিধান প্রণেতাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়! বামপন্থী মতদর্শের ‘দোষ’ বাদে সেই সকল উল্লিখিত মামলার কোনো একটিতেও জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের রায়ে কোনো ভুলভ্রান্তি ছিল কিনা, তা নিয়ে অবশ্য একবার ও কোনো আলোচনা (সমালোচনা) জাস্টিস চন্দ্রচূড় লিপিবদ্ধ করেন নি। অর্থাৎ, সংবিধান ব্যখ্যা করার ক্ষেত্রে বামপন্থী মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটানোই জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের তরফে একমাত্র এবং মারাত্মক অন্যায় হয়েছিল, জাস্টিস চন্দ্রচূড় তেমনটাই ব্যক্ত করেছেন। যে খসড়া রায় জাস্টিস চন্দ্রচূড় ৯ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে পেশ করেন, তাতে এমনটা লেখা ছিল- ‘The Krishna Iyer doctrine does a disservice to the broad and flexible spirit of the Constitution.’ এখানে ‘কৃষ্ণ আইয়ার ডক্ট্রিন’ বলতে বোঝানো হয়েছে যে ‘লাইনে’ জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার (পরবর্তীতে জাস্টিস চিনাপ্পা রেড্ডি) ব্যক্তি সম্পত্তিকেও রাষ্ট্রের দ্বারা সর্বসাধারণের স্বার্থে পুনর্বন্টনের যোগ্য বলে ধার্য করেছিলেন, অর্থাৎ ‘সমাজতান্ত্রিক লাইন’ গ্রহণ করেছিলেন। জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের মতামতের প্রতি এভাবে প্রায় ব্যক্তি আক্রমণকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই মামলার রায়েই জাস্টিস বি ভি নাগরত্ন এবং জাস্টিস সুধাংশু ধুলিয়া তাঁদের dissenting opinion-এ কঠোর সমালোচনা করেছেন। ভারতের বিচার ব্যবস্থার সামগ্রিক ইতিহাসে দুটি ‘প্রথম’ ঘটনা ঘটল এই রায়ে। এক, একটি ‘খসড়া’ রায়কে উদ্ধৃত করে কঠোর সমালোচনা করলেন একই বেঞ্চের দুই সদস্য ফলতঃ চুড়ান্ত রায়ে সেই বাক্য মেজরিটি ওপিনিয়নে বাদ দিতে বাধ্য হয়। দুই, খোদ প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে দু’জন সহ বিচারক তাদের কঠোর সমালোচনা সে রায়েই লিপিবদ্ধ করলেন!
কিন্তু জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ারের মতামতকে disservice to the broad and flexible spirit of the Constitution ধার্য করে, সংবিধানের ৩৯(খ) ধারা নিয়ে শেষ পর্যন্ত ঠিক কী সিদ্ধান্তে এসে পৌছলেন এই মামলার সংখ্যাগুরু বিচারকেরা?
নীচে তা উদ্ধৃত করা হল-
‘The direct question referred to this bench is whether the phrase ‘material resources of the community’ used in Article 39(b) includes privately owned resources. Theoretically, the answer is yes, the phrase may include privately owned resources. However, this Court is unable to subscribe to the expansive view adopted in the minority judgement authored by Justice Krishna Iyer in Ranganatha Reddy and subsequently relied on by this Court in Sanjeev Coke. Not every resource owned by an individual can be considered a ‘material resource of the community’ merely because it meets the qualifier of ‘material needs’
সহজ ভাষায় যা দাঁড়ালো, তা অনেকটাই সুকুমার রায়ের বক্তব্যের মতো-
'ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে
তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে!'
অর্থাৎ, জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার বা জাস্টিস চিনাপ্পা রেড্ডি’র ‘লাইন’-এ বিশেষ বা নির্দিষ্ট কোনো ভুল খুঁজে পাওয়া গেল না! তাহলে এত কথা, এত সমালোচনা করতে যাওয়া কীসের জন্য? নেহাৎ-ই একাডেমিক কারণে? এ প্রশ্নটি চিত্তাকর্ষক এবংগ্রুত্বপূর্ণ। ৩৯(খ) ধারার ব্যখ্যায় ‘সমাজতান্ত্রিক লাইন’-এর বিরোধীতা করতে গিয়ে প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা খরচ করা হয়েছে এই মামলার রায়ে, আর সে সব করার পর কিনা সেই ‘আমড়াতলার মোড়ে’ ঘুরে ফিরে এসে দাঁড়াতে হল?
এই বিরোধীতা করতে গিয়ে মেজরিটি ওপিনিয়নের ছত্রে ছত্রে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে বিচার ব্যবস্থা কখনো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। প্রশ্ন থাকে যে জাস্টিস কৃষ্ণ আইয়ার বা চিনাপ্পা রেড্ডি-রা কখনো কি তেমন কোনো চেষ্টা করেছিলেন? সেই রকম ‘অন্যায্য হস্তক্ষেপের’ কোনো কিছু জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের রায়ে উল্লিখিতও নেই। তবে একথা বলাই বা কেন?
জাস্টিস সুধাংশু ধুলিয়া তার ডিসেন্টিং ওপিনিয়নে স্পষ্ট লিখেছেন যে বর্তমানে এ দেশে অর্থনৈতিক অসাম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যার নিরসনের চেষ্টায় রাষ্ট্রের তরফে সর্বসাধারনের হিতার্থে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ/পুঁজির অধিগ্রহণ এবং পুনর্বন্টন করা যেতেই পারে। এইবারে, প্রশ্ন হল যেহেতু এই মামলার রায়ে মেজরিটি ওপিনিয়নে ‘কৃষ্ণ আইয়ার ডক্ট্রিনের’ বহু সমালোচনা সত্ত্বেও সেই ‘ডক্ট্রিন’কে খন্ডন করা সম্ভব হল না এবং তার সাথে সেই ‘ডক্ট্রিনের’ সমর্থনেই এ বেঞ্চেরই এক সদস্যের (জাস্টিস ধুলিয়া) জোড়ালো সমর্থন লিপিবদ্ধ হল’, তাহলে কি আদতে উপরোক্ত ডক্ট্রিনকে এই মামলায় ৯ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ মান্যতা দিয়ে ফেলল?
শ্রেণীর লড়াই বহুমাত্রিক এবং সমাজের বহুস্তরে প্রতিনিয়ত ঘটে চলে। সামাজিক দ্বন্ধের বহিঃপ্রকাশ একটি দেশে বা সমাজে বহু স্তরে বিভিন্ন ভাবে ঘটে। জাস্টিস ধুলিয়ার রায়ে আবারো সেই প্রশ্ন লিপিবদ্ধ হয়েছে যে দেশের সিংহভাগ সম্পদ মুষ্ঠিমেয় ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত, সে দেশে শুধুমাত্র ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’-র নিয়মেই কি রাজনৈতিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে? উৎপাদন প্রক্রিয়ার মালিকানার সাথে উৎপাদক শ্রেণীর এই তীব্র দ্বন্ধের বাস্তবতার মধ্যে রাজনৈতিক সমানাধিকার কি শুধুমাত্র ভোটাধিকারের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব?
বর্তমানে ভারতে শাসক শ্রেণীর তরফে উগ্র দক্ষিণপন্থী নীতির প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থন প্রমাণ করে দিচ্ছে যে সাধারণ মানুষের অধিকারকে পদপিষ্ট করে বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের বহু মৌলিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করেই সঙ্কটাপন্ন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উপরোক্ত দ্বন্ধকে মোকাবিলা করতে চাইছে। ১৯৯১-র নয়া-উদারনীতি গ্রহণ করার পর তিন দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। রেগান-থ্যাচার নীতির আদলে নরসিমহা রাও-মনমোহন সিং জুটির তরফ থেকে যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা পূরণ তো হয়ইনি, উল্টে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে এ দেশের বৌদ্ধিক চর্চার অন্যতম সর্বোচ্চ একটি স্তরেও (সুপ্রীম কোর্ট) এ নীতি আজ বহু প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন। এ প্রশ্ন যত বাড়বে, লুটেরা পুঁজিবাদের স্বরূপটিও সর্বসাধারণের সামনে তত বেশি করে উন্মোচিত হবে।