“করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচলেও, না খেতে পেয়ে মরে যাবো। আমাদের বাঁচান।”
সুবল, কার্ত্তিক, রোহিত, ভিকি, সুকুমার, রঞ্জন আলি, আসাদুল, ইমরান, জয়ন্ত, সাইফুল, আজিজুলদের কাতর আর্তি এরকমই। এঁদের সকলের পরিচয় একটাই, বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিক। উপার্জনের আশায় নিজ এলাকা ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন ঝাঁ চকচকে নগর থেকে শুরু করে বহু দুর্গম এলাকায় ওঁদের বাস। কেউ বছরের পর বছর রয়েছেন, কেউ বা সদ্য কয়েকমাস হল এসেছেন। আসলে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন বেড়ে চলা বেকারত্ব, পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে দুর্নীতি বহু যুবককে ফি বছর বাধ্য করে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে।
বিশেষত: উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের এক পরিযায়ী স্রোত লক্ষ্য করা যায়। মালদা, মুর্শিদাবাদ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং জেলার প্রতিটি ব্লক, মহকুমা এলাকার বহু শ্রমিক ভিন রাজ্যে কাজ করেন। বর্তমানে লকডাউনের ফলে সিংহভাগ শ্রমিকই বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি ঘোষণার সাথে সাথেই মুম্বইয়ের বান্দ্রা স্টেশন হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকদের বিক্ষোভ সারা দেশ দেখেছে। লকডাউন ভঙ্গ করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই হাজার হাজার শ্রমিকের উৎকণ্ঠার কারন কি ?
বান্দ্রায় আটকে পড়া বাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে মালদা ও মুর্শিদাবাদের লোকের সংখ্যাই বেশি। বান্দ্রায় আটকে পড়া মালদার মানিকচকের এক শ্রমিকের কথায়, “সরকার কিছু না বলে লকডাউন করে দিল। আগে বললে তো আমরা বাড়ি চলে যেতাম। ২১দিন লকডাউন হয়ে গেল। খাবার দিল না। আমরা করব কি ? খাবারের জন্যেই তো আমরা বান্দ্রা স্টেশনের সামনে গিয়েছিলাম। ৫ হাজার লোক, আর খাবার এনেছে পাঁচশো জনের জন্য। বাঁচব কিভাবে ?”
মুর্শিদাবাদের এক শ্রমিকের কথায়,“গ্রামে বাড়ির লোক রেশন না পেয়ে কাঁদছে, আমরা এখানে খাবার না পেয়ে কাঁদছি। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।” হাহাকার চারিদিকে। খাদ্য ও আর্থিক সংকটে জেরবার বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা। ভিন রাজ্যে মিলছে না ত্রান, আর নিজ রাজ্যে পরিবার পাচ্ছে না রেশন। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।
বান্দ্রায় আটকে থাকা উত্তরবঙ্গের শ্রমিক আসাদুল বলেন, “আগের মাসের ৩১ তারিখ থেকে এখানে সরকার খাবার দেবে বলেছিল কিন্তু দেয়নি। স্থানীয় লাল পার্টির লোকেরা আমাদের খাবার দিয়েছে যতটা পেরেছে। বিএমসি খিচুড়ি দিচ্ছে, কিন্তু সেটা গন্ধ হয়ে পচে যাচ্ছে। খাওয়া যায় না। আমরা বলছি, চাল-ডাল দাও আমরা ফুটিয়ে নেব কিন্তু সেটা ওরা দিতে চায় না। লাল পার্টির লোক মাঝে মধ্যে এসে কিছু খাবার দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অনেকগুলো পেট, চলবে কি করে !” আরেক শ্রমিক জয়ন্তর করুন আর্তি, “ভাইরাস আসার আগে না খেতে পেয়ে মরে যাবো। আমাদের বাঁচান।”
একই চিত্র দেশের অন্যান্য জায়গাতেও, উত্তর প্রদেশের বেনারসে আটকে পড়া মুর্শিদাবাদের শ্রমিকদের বক্তব্য, "প্রধানমন্ত্রী একদিনের জনতা কারফিউ করার পরেই সব বন্ধ করে দিলেন। যদি এই ইচ্ছাই ছিল, তো আমাদের জানাতেন প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী। যেভাবে হোক, আমরা ঘরে ফিরতাম। বর্তমানে এক-একটা ঘরে আমরা ১০ জন ২০ জন করে থাকি। দেশে মহামারী লেগেছে। জানি না আর বেঁচে ঘরে ফিরতে পারব কি না।”
আবার অন্যরকম অভিজ্ঞতাও রয়েছে। যেমন মালদা থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর সিটিতে কাজ করতে গিয়ে আটকে পড়েছেন রঞ্জন আলি সহ কয়েকজন শ্রমিক। লকডাউন, অর্থাৎ কাজও বন্ধ মালিকের কাজ ছিল, মালিকের দেওয়া দুবেলা খাবার ছিল। প্রথম কয়েকদিন সব ঠিক থাকলেও মালিকের নির্দেশ আসে, নিজেদের খাবার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। সোশ্যাল ডিস্টান্সিং মানতে হবে, অর্থাৎ ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের জন্য তৈরি অস্থায়ী টিনের আবাসন খালি করে দিতে হবে। মাথায় তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়ার যোগাড় রঞ্জন আলি সহ সকলের। মাথার ওপর ছাদটুকু তো চাই।
গোটা এলাকা স্তব্ধ, কারফিউ, সমস্তরকম পরিবহণ বন্ধ। শুরু হয় ঘর খোঁজার পালা। ঘর মেলে। দোকান থেকে আনাজ মেলে, রান্নার সামগ্রীও মেলে। দিন যায়, রাত যায়, ঘরে বসে সময় কাটে কিন্তু লকডাউন ওঠার আভাস মেলে না বরং বেড়েই যায়। গ্রামে কারোর মায়ের অসুখ, ছোট বোনের বিয়ে, কারোর বন্যা বিধ্বস্ত ঘর ঠিক করার প্রয়োজন, তাই উপার্জনের টাকার অল্প কিছু অংশ নিজেদের কাছে রেখে বাকি প্রায় পুরোটাই সবাই পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে।
এদিকে লকডাউন, আনাজ শেষ হয়ে আসছে, সবার সঞ্চয় মিলিয়েও পর্যাপ্ত অর্থ নেই। বাড়ি ফেরার উপায় নেই। স্থানীয় হেল্পলাইনে ফোন করে মেলেনি কোনো আশ্বাস। দিন কাটছে, অনাহারের আশঙ্কা বাড়ছে, এদিকে খবর পেয়ে অস্থির বাড়ির লোক। চিন্তিত হয়ে পড়ে গোটা গ্রাম।
এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা সংকটে, সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বামপন্থীরা। একরাশ অন্ধকারে একফোঁটা আশার আলো যেন জাগে। গ্রামের বামপন্থী যুব সংগঠনের কর্মীরা সাথে সাথে যোগাযোগ করেন জেলা সিপিআই(এম) নেতৃত্বের সাথে। শ্রমিক রঞ্জন আলি সহ সকলের পরিচিতি ও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করা হয় অন্ধ্রপ্রদেশের পার্টি নেতৃত্বকে। ব্যাস। আর অপেক্ষা করতে হয়নি। ১ দিনের মধ্যে পৌঁছে যায় লাল ঝান্ডার স্বেচ্ছাসেবক দল।
এক মহিলা কমরেডের নেতৃত্বে, তিনটি বাইকে চেপে ৫ জন। সাথে ৬ কেজি চাল, ২ ডজন ডিম, ২ প্যাকেট তেল, ডাল, সবজি সহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী ও অল্প কিছু টাকা। ছোটবেলা থেকে গ্রামের রাস্তায় লাল ঝান্ডা দেখে বড় হওয়া রঞ্জন আলির চোখ ছলছল করে ওঠে। মহিলা কমরেড ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর তেলেগু মিশিয়ে বলেন, “ভয় নেই, আপনারা বাঙ্গালের লোক, জ্যোতি বসুর সরকার দেখেছেন, এখন অর্থের প্রয়োজনে বাংলা ছেড়ে চিত্তুর গড়তে এসেছেন, এই দুঃসময়ে আপনাদের পাশে থাকা আমাদের কর্তব্য। রেশন শেষ হলে জানাবেন। আমরা আবার দিয়ে যাবো।” <><>
মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে আটকে পড়া মুর্শিদাবাদের শ্রমিকরা বলেছেন, "আমরা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করেছি। থানার ওসি-কে মেসেজ করেছি। কেউ কোনও সাহায্য করেননি। কলকাতা থেকে প্রশাসনের কেউ আমাদের খোঁজও করেননি। তারপর স্থানীয় সিপিআইএমের লোকেরাই ত্রান ও খাবার পৌঁছে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন এ পর্যন্ত।” কর্ণাটকে আটকে থাকা প্রবীণ শ্রমিক আজিজুল হকের কাতর আর্তি, "ছোট ছোট ছেলেগুলোর কষ্ট আর দেখতে পাচ্ছি না। সিপিআইএম পার্টি অনেক সাহায্য করেছে। আমরা ঘরে ফিরতে চাই।”
কেরালায় আটকে থাকা মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর ও উত্তর দিনাজপুর জেলার শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম। সেখানে করোনা সচেতনতা অনেক আগে থেকে শুরু হলেও লকডাউনের ফলে আটকে পড়েন বহু শ্রমিক। এমনই একজন রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, “কেরালা সরকার খুব সাহায্য করছে। বাংলা ভাষায় করোনা মোকাবিলা বুঝিয়েছে। আনাজ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই রেশন বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। কয়েক কিলোমিটার দূরেই খুলেছে কমিউনিটি কিচেন, সেখানে গেলেও খাবার পাওয়া যাচ্ছে। আমরা শ্রমিক, সারাদিন কাজ করি, এখন সময় কাটছে না বলে টিভি, রেডিও আর ইন্টারনেটের ব্যবস্থাও করেছে সরকার। খুব একটা অসুবিধা না হলেও বাড়ি ফিরতে চাই আমরা। আসলে মহামারীর সময় পরিবার ছেড়ে কেউই হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকতে চায় না।”
তবে দেশের সব জায়গায় পরিস্থিতি আবার এক নয়। দেশজুড়ে সামর্থ্য অনুযায়ী পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দাড়িয়েছে CPI(M), কিন্তু দেশজুড়ে শ্রমিকরা আজ প্রবল সংকটে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পাহাড়, নদী পেরিয়েও শ্রমিকরা বাধ্য হচ্ছেন ফিরতে। খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, সরকারি সাহায্য নেই, তাই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দার্জিলিং, আসাম থেকে শয়ে শয়ে শ্রমিক হেঁটে ফিরছেন কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে। অন্যদিকে ময়নাগুড়ি ও কালচিনি এলাকার বহু শ্রমিক আটকে রয়েছেন তামিলনাডুর চেন্নাইয়ের কাছে কল্যাণম গ্রামে। খাবার নেই, হাতে টাকাও নেই, বাসস্থানের ভাড়া মালিক আপাতত মকুব করলেও এত লোকের পেট চালানোর মত আনাজ নেই। ময়নাগুড়ির বিশ্বজিৎ, কালচিনির ভিকিরা কিছুদিন ধার করে খাবার যোগান করলেও বর্তমানে ভূখা পেটে দিন কাটছে। ভিকির কথা, “কাজ নেই, টাকা নেই, বাড়ি ফেরার উপায় নেই। আমাদের সাথে অনেকের পরিবার ও শিশু আছে, তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ। কিভাবে বাঁচবো জানি না।”
আলিপুরদুয়ার জেলার উত্তর পারোকাটা, কামাখ্যাগুড়ি এলাকার বহু শ্রমিক আটকে পড়েছেন আসামের গুয়াহাটিতে। খাদ্য নেই, অর্থ নেই, সরকারি সাহায্য নেই, কাতর আর্জি বাড়ি ফেরার জন্য।
কয়েকদিন আগে লকডাউনে পাঞ্জাবের অমৃতসরে আটকে পড়া মালদা জেলার এক শ্রমিক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। বস্ত্রশিল্প কারখানায় কম্বল বানানোর কাজ করতেন, আচমকাই লকডাউন, স্তব্ধ হয় দেশ। বাড়ি ফেরার উপায় নেই, খাদ্য নেই, চূড়ান্ত অবসাদগ্রস্ত হয়ে কারখানা চত্বরেই নিজেকে শেষ করে দিতে বাধ্য হন ওই শ্রমিক।
লকডাউনের আগে থেকেইমমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রের কাছে দাবি করছিলেন ট্রেন বন্ধ করার জন্য, মূলত ভিন রাজ্যে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা যাতে ফিরতে না পারেন। সেই সময়েই তিনি দাবি করেন, রাজ্যে এখন অনেক কাজ। বাইরে যাওয়ার দরকার কী ? কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে অন্য কথা। বাংলায় কাজ নেই, বেকারত্বের হার আকাশছোঁয়া, পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে কাজের দুর্নীতি, স্বজনপোষণের ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বাধ্য হচ্ছেন ভিন রাজ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যেতে। বর্তমানে এই মহামারীর সময় ক্রমশ প্রকট হচ্ছে সেই পরিযায়ী সংকট, একটু কান পাতলেই দেশজুড়ে শোনা যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাহাকার। রাজ্য সরকার পাশে নেই, চরম দুর্দশার শিকার এই শ্রমিকরা।
দেশে চলমান পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবি দেখে প্রবল সমালোচনার মুখে একসময় সরকার জানিয়েছিল, যে যেখানে আছেন থাকুন। সরকার দেখভাল করবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কেরালা ছাড়া আর কোথাও কার্যত পরিযায়ী শ্রমিকদের ‘দেখভাল’ হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় মূলত বামপন্থী গণসংগঠনের কর্মীদের সাহায্যেই তাঁরা দুবেলা খাবারটুকু পাচ্ছেন। আসলে এ কথা প্রমানিত, যুগে যুগে সঙ্কটকালে মানুষের পাশে নিঃস্বার্থ ভাবে দাঁড়িয়েছে একমাত্র বামপন্থীরাই।
ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া ও ওয়েবসাইট
শেয়ার করুন