Logo oF Communism

সিপিআই(এম)'র কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের প্রেস বিবৃতি

তারিখঃ ৩১ অক্টোবর, ২০২০

৩০ এবং ৩১ অক্টবর,২০২০ অনলাইনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠক থেকে নিম্নলিখিত বিবৃতি দেওয়া হয়ঃ

কোভিড-১৯ মহামারীর অবস্থা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং ব্রাজিল এই তিন দেশ উল্লিখিত ক্রমেই এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে সংক্রমনের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। ভারতে সংক্রমণ ছড়ানোর হার এবং মৃত্যুহারের ক্রমবর্ধমান সুচক উদ্বেগজনক।

মহামারী প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় সরকার এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেদের পরোক্ষভাবে নিজেদের দায় এড়িয়ে গেছেন। কোটি কোটি জনগণের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ চেহারা নিয়েছে একদিকে মহামারী অন্যদিকে আর্থিক মন্দার সাঁড়াশি আক্রমনের ফলে। এই বছরের ২৫ মার্চ সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা হবার পরেই সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে মানুষের হাতে নগদ অর্থ তুলে দেয়ার এবং বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বন্টনের যে দাবী জানানো হয়েছিল তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিছুতেই মানতে রাজি নন, সেই দাবী তিনি খারিজ করে দিয়েছেন। জনগণের ক্রমবর্ধমান দুর্ভোগ, বেড়ে চলা বেরোজগারি এবং ভুখা পেটে থাকার পরিস্থিতি যতই বেড়ে চলুক না কেন তার মোকাবিলায় বাস্তবিক কোন পরিত্রানের ব্যাবস্থাই নেই।

ভ্যাকসিনঃ সিপিআই(এম) সর্বদা বিনামূল্যে সর্বজনীনরুপে ভ্যাকসিন পাওয়ার অধিকারের দাবী করে এসেছে। স্মলপক্স রোধ করা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক পোলিও মুক্তি অবধি - স্বাধীন ভারতে এই প্রক্রিয়া শুরু থেকেই রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক দায়বদ্ধতা থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ব্যাপকভাবে প্রচার করে জনগণকে টিকঅ্যা নেবার জন্য আবেদন জানানো হয়। আশা করা যায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও এই একই পদ্ধতি নেওয়া হবে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই ব্যাপারে দায় মিটিয়ে ফেলতে ঘোষণা করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে রাজ্যসরকারগুলি নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই মনোভাব মেনে নেওয়া যায় না। কেন্দ্রীয় সরকারকে এখনই টিকার বিষয়ে ব্যাপক প্রচারকাজ শুরু করতে হবে এবং সবাইকে বিনামূল্যে টিকা নেবার ব্যাবস্থা করতে হবে।

কোয়াডঃ

ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক জোটের সাথে নিজেদের সম্পর্ক দৃঢ় করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের স্বার্থরক্ষায় স্বাধীন বিদেশনীতি অনুশীলনের বহু পরিক্ষিত রাস্তার বিপরীতে হেঁটে আমাদের দেশকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামরিক এবং স্ত্র্যাটেজিক পার্টনারে পরিণত করা হচ্ছে। মালাবার ২০২০ নাভাল অনুশীলনের নামে এই প্রথম কোয়াডের যৌথ সামরিক মহড়া আয়োজিত হবে।

অর্থনৈতিক মন্দা

রিজার্ভ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবর্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে (-) ৯.৫ শতাংশ হারে আর্থিক সংকোচন ঘটবে। ঐ একই বিষয়ে আইএমএফ’র গণনাকৃত হিসাবে দেখা যাচ্ছে সংকোচনের হার হবে (-)১০.৩ শতাংশ। রিজার্ভ ব্যাংকের ঘোষণায় আর্থিক ক্ষেত্রের এই পতন হবে এই ধারাবাহিকতা মেনেঃ ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে জিডিপি’র হার ৮.৩ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে জিডিপি’র হার ৮.৩ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে জিডিপি’র হার ৬.১ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে জিডিপি’র হার ৪.২ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে জিডিপি’র হার (-)৯.৫ শতাংশ। এই ধারা বিবরণী থেকেই স্পষ্ট যে শেষ পাঁচ বছর ধরেই দেশের অর্থনীতি অধোগতিপ্রাপ্ত।

জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যান্য দুর্গতিঃ এই আর্থিক অধোগতি বেরোজগারির ক্ষেত্রকে ভয়ংকরভাবে প্রভাবিত করেছে। শ্রমিক নিযুক্তির হার (Labour Participation Rate) মারাত্মকভাবে কমে গেছে এবং প্রায় ১৫ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন।

ক্ষুধা সমস্যার বেড়ে চলাঃ বিশ্ব ক্ষুধা সুচকের তালিকায় সারা পৃথিবীর ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪। এই পরিস্থিতি বিজেপি সরকারের অন্ধকারাচ্ছন্ন নীতিপ্রণয়নের ফলাফল। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলি – শ্রীলংকা, নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং পাকিস্তান খাদ্যসুচকের অবস্থানে আমাদের চেয়ে উন্নত অবস্থায় রয়েছে।

আমাদের দেশের জনগণের এক বড় অংশের বেড়ে চলা এই ভুখা পেটের পরিস্থিতি মেনে নেওয়া চলে না। কেন্দ্রীয় মজুতভান্ডারে কয়েক কোটি খাদ্যশস্য পড়ে রয়েছে, সেইসব পচছে। এই মজুতভান্ডারকে বিনামূল্যের রেশনের জন্য ব্যাবহার করতে হবে। বেড়ে চলা ক্ষুধা সমস্যার ঠিক উল্টোদিকে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে ২০২০ সালে ভারতের ৫০ জন ধনীতম ব্যাক্তির সম্পদ বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশ।

শ্রমিকশ্রেণী এবং মেহনতি মানুষদের উপরে আক্রমন

সংসদের বাদল অধিবেশনের সময়ে পাশ করানো চারটি শ্রম আইনের সাহায্যে ২৯টি প্রচলিত শ্রম আইনকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। এই আইনগুলিকে বাতিল করার দ্বারা মালিকপক্ষের হাতে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করার, এবং শ্রমিকস্বার্থরক্ষাকারী সকল সুযোগসুবিধা সংক্রান্ত যাবতীয় বিধিনিষেধকেই হয় যথেষ্ট লঘু করা হয়েছে নয়ত তুলে দেওয়া হয়েছে। এইসমস্ত আইনের বলে শ্রমিকদের দাসে পরিণত করার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।

সর্বনাশা কৃষি আইনসমূহ

আত্মনির্ভরতার নাম দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণাকৃত অর্থনৈতিক সংস্কারগুলির ফলে দেশের অর্থনীতি ব্যাক্তিগত মুনাফার অধীনস্থ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কৃষি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের তরফে অত্যন্ত সন্দেহজনক পদ্ধতিতে দেশের সংসদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। এই নতুন আইনে আমাদের দেশে কৃষিজাত পণ্যের বাজারসহ গোটা কৃষিক্ষেত্রকেই দেশই বিদেশী কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের কৃষককুল, জনসাধারন দুইপক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং ভারতের খাদ্যসুরক্ষা সংকটে পড়বে।

হিন্দুত্বের কর্মসূচি পালনে নিরলস আগ্রাসী মনোভাব

লকডাউনের কারনে জনজীবনে উপরে লাগু হওয়া বিধিনিষেধের সুযোগকে ব্যাবহার করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিরলসভাবে আরএসএস’র মূল কর্মসূচিকে রুপায়ন করতে চাইছে, তারা ভারতকে রুপান্তর করতে চায় এক তীব্র অসহনশীল ফ্যাসিবাদের ধাঁচে ধারণা সম্পৃক্ত ‘হিন্দুত্ব রাষ্ট্রে’।

দলিত, মহিলা, মুসলমান সংখ্যালঘু মানুষ, বিশিষ্ট মেধাবৃত্তিকার এবং বিরোধী দলে নেতৃত্ববর্গের উপরে আক্রমন সংগঠিত করার ঘটনাগুলি সেই কর্মসূচিরই সহযোগী।

জম্মু ও কাশ্মীর

জমির মালিকানা সংক্রান্ত নতুন বিধানে যে কোন এলাকার অধিবাসীদের জমি কেনার ছাড়পত্র দেবার আসল উদ্দেশ্য হল জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার জনবৈচিত্র ধ্বংস করা, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সেখানকার জনগণের সম্পত্তি লুঠ করার ব্যাবস্থা করা।

কেরালা

কেরালার এলডিএফ সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি(যেমন সিবিআই)-কে ব্যাবহার করা হচ্ছে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটি তার নিন্দা জানাচ্ছে। কেরালার জনগন যথাসময়ে এই দুষ্কর্মের যথাযোগ্য জবাব দেবে।

আগামী বিধানসভা নির্বাচনগুলীতে রণকৌশল

আগামীদিনে কেরালা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে যে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্য কমিটির প্রস্তাবসমূহে কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন দিয়েছে।

কেরালায় সিপিআই(এম) এলডিএফ’র অংশ হিসাবেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তামিলনাড়ুতে সিপিআই(এম) ডিএমকে’র নেতৃত্বে জোটে অংশগ্রহন করবে। অসমে অযোগ্য বিজেপি সরকার যেভাবে মানুষের মধ্যে বিভেদমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছে, সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করেছে এবং জনগণের দুর্দশা বাড়িয়ে তুলেছে তার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) কংগ্রেস সহ অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সাথে হাত মিলিয়েই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই(এম) কংগ্রেস এবং অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সাথে নির্বাচনী সমঝোতার ভিত্তিতে বিজেপি এবং টিএমসি উভয়েকেই পরাজিত করতে লড়াই চালাবে।

কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান

দেশজুড়ে নির্বাচনী সংগ্রামকে সামনে রেখে পার্টির প্রচারে কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বানগুলি হলঃ

১. কৃষিআইন, শ্রম আইন, সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, জাতীয় সম্পদ বিক্রির বিরুদ্ধে, বেড়ে চলা বেরোজগারি, সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যপরিষেবা, ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে (যার ফলে জনজীবনে দুর্দশা নামিয়ে আনা হয়েছে) পার্টি স্বাধীনভাবে প্রচার করবে।

২. ২৬-২৭ নভেম্বর,২০২০ তারিখে কিষাণ বিরোধের কর্মসূচির পক্ষে পার্টি সংহতি বাড়ানোর অঙ্গীকার করছে।

৩. ২৬ নভেম্বর,২০২০ সারা দেশে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে সাধারন ধর্মঘটে পার্টি সম্পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে।

৪. ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারির আগে এবং এবছর ২৬ নভেম্বরের মাঝের দুই মাসে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সাথে একযোগে জনসাধারনের স্বার্থবাহী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা, বিশিষ্ট মেধাবৃত্তিকার এবং অন্যান্য ব্যাক্তিবর্গকে সাথে নিয়ে মানবাধিকার, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের জন্য লড়াই করবে পার্টি। দানবীয় ইউেপিএ, এনএসএ এবং দেশদ্রোহিতার আইনের বলে কারারুদ্ধ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবীতে, দলিত-আদিবাসি এবং মহিলাদের উপরে আক্রমণের প্রতিবাদে, সংসদ, আদালত, নির্বাচন কমিশন সহ অন্যান্য স্বাধীন সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলীকে দলীয় রাজনীতির শিকার হওয়ার বিরুদ্ধে এবং মানুষের নির্বাচনী রায়কে অমান্য করতে বিজেপি’র পক্ষ থেকে যেভাবে অর্থবলের প্রয়োগ করা হচ্ছে তার প্রতিবাদে প্রচার করবে সিপিআই(এম)।

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস এবং ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৮ ডিসেম্বর অবধি সারা দেশে মানবাধিকার এবং সংখ্যালঘু অধিকারের সপক্ষে অবশ্যই প্রচার অভিযান সংগঠিত করতে হবে।

রাজ্যস্তরে এই সমস্ত ইস্যুগুলিতে, প্রয়োজনে কয়েকটি ইস্যুকে একসাথে নিয়ে প্রচারের কাজ করতে হবে। এই প্রচারের কাজে নিজেদের সক্ষমতার সম্পুর্ন ব্যাবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং সেইসাথে ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে সংবিধান বাঁচাও’র আহ্বানকে সামনে তুলে ধরতে হবে।
শেয়ার করুন

উত্তর দিন