নীলোৎপল বসু
লকডাউনের প্রথম থেকেই, হাজার হাজার পরিযায়ি শ্রমিকের কাঁধে মাথায় অসহনীয় ভার নিয়ে , বহু ক্ষেত্রেই নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে, শয়ে শয়ে কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার নিরন্তর দৃশ্য আমরা দেখে চলেছি ।চার ঘন্টার নোটিশে হঠাৎ করে দেশজোড়া লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এই জাতীয় দৃশ্যগুলো আমাদের তাড়া করছে। এই ঘোষণার পরপরই আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাসে কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিক হাজির হয়ে আসলে আমাদের দেশের কোভিড মহামারি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া নিয়ে যে ক্রমবর্দ্ধমান ও প্রবল আলোচনা সেই ময়দানে নিজেদের আগমনকে চিহ্নিত করেছে এবং ১৪ এপ্রিল দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের শুরুতে মুম্বইয়ের বান্দ্রা স্টেশনে আবার কয়েক হাজার শ্রমিকের হাজির হওয়া এই ধারা অব্যাহত থাকারই ইঙ্গিত দেয়।
সময়ের সাথে সাথে আরও হৃদয়বিদারক দৃশ্যাবলী আমাদের চেতনায় হানা দিয়েছে। তেলেঙ্গানার লঙ্কা ক্ষেতে কাজ করা ১২ বছরের জামলা মাকদম কয়েকশো কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ছত্তিশগড়ে তার বাড়ি থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে প্রাণ হারায়।ছয় জনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী, বিহারের পরিযায়ি শ্রমিক, ৩৫ বছরের ছবু মন্ডল গুরুগ্রামে রঙের কাজ করত। আড়াই হাজার টাকায় সে তার মোবাইল ফোন বিক্রি করে দেয়। এই টাকা স্ত্রীর হাতে দিয়ে অনাহারের দোরগোড়ায় থাকা পরিবারের জন্য খাবার তৈরির করতে বলে নীরবে আত্মহত্যা করে ছবু।
এই কঠোর লকডাউনের ফলে পরিযায়ি শ্রমিকদের অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনে নেমে এসেছে মৃত্যমিছিল। কোভিড ট্র্যাকার ভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হিসাব রাখছে কিন্তু এই লকডাউনের ফলে ঘটে যাওয়া প্রাণহানির কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। এই পরিহার্য সঙ্কটে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি এবং মানুষের ক্ষতির সাক্ষ্য বহন করে এমন কোন তথ্যই অনুপস্থিত।
অপরিকল্পিত লকডাউন
লকডাউন ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করে না , বড়জোর এর সংক্রমণের হারকে স্তিমিত করতে পারে।এই মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে সম্মিলিত বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা হিসাবে দেখা গেছে যে, ভাইরাল মহামারি মোকাবিলার উপায় হল পরীক্ষার মাধ্যমে সনাক্তকরণ, সংক্রামিতকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া এবং তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং তাদের চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কোয়ারান্টাইন করা।
ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণের উপায় হল বারবার হাত ধোয়া এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা কারণ এটি মানুষের থেকে মানুষে সঞ্চালিত হয়।প্রশাসনিক এবং আরোপিত লকডাউন বলপূর্বক গণ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সুনিশ্চিত করে।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চিনের উহান শহরে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে প্যাথোজেনটির গতিপ্রকৃতি বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিল। ৩০শে ডিসেম্বর চিন মারাত্মক নিউমোনিয়ার কিছু ক্লাস্টার তৈরি হওয়া এবং একটি অজানা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কথা জানায়। সৌম্য স্বামীনাথন, আইসিএমআর এর প্রাক্তন ডিজি এবং এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখ্য গবেষক মিন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সংক্রমণের কালানুক্রমিক ভাগ করেছেন ; ৪ জানুয়ারি ডব্লুএইচও এই নতুন বিপদ সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়া মারফৎ গোটা বিশ্বকে অবহিত করে।৫ জানুয়ারী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে বিশ্বকে আগাম সতর্ক করে, এবং চিন ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করে ৯ ই জানুয়ারিতে সেই তথ্য দুনিয়াকে জানায়।
স্থানীয় প্রশাসনের প্রাথমিক কিছু ভুল পদক্ষেপের জন্য উহান ও হুবেই প্রদেশে ভাইরাসটির গতি রোধ করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে চিন প্রশাসনের কিছু সমস্যা হচ্ছিল । যাইহোক, ২৩শে জানুয়ারির মধ্যে চিনা কর্তৃপক্ষ লক্ষ্য স্থির করেছিল এবং উহান ও হুবেইকে লকডাউনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করলেও জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং বাধ্যতামূলক বন্দিদশায় থাকা নাগরিকদের বেঁচে থাকার / জীবিকার প্রয়োজন উভয়কেই সম্বোধন করেছিল। জন স্বাস্থ্যের শক্তিশালী পরিকাঠামোকে ব্যবহার করে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত আয়োজন বাড়ির মধ্যেই রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে চীনকে দেশের বাকি অংশ থেকে ৪০,০০০ স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবীদের একত্রিত করতে হয়েছিল। অন্যদিকে ক্ষীপ্রগতিতে পরীক্ষা, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা , চিকিৎসা ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে কোয়ারান্টাইন করা এবং গুরুতর ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা করা এই সমস্ত পদক্ষেপগুলোই নেওয়া হয়েছে। চিনে অকল্পনীয় দ্রুততার সাথে দুটি কোভিড হাসপাতাল তৈরির সাক্ষী থেকেছে গোটা দুনিয়া । মোটামুটি এক মাসের মধ্যে চিন এই মারাত্মক ভাইরাসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
প্রাথমিকভাবে, 'হু' লকডাউনের আওতায় নাগরিকদের ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং তাদের চলাচলের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে কিছুটা সন্দিহান ছিল। তবে পরবর্তীকালে তারা চিনা প্ররয়োগের সাফল্যের সাথে সহমত হয়।তবে কোভিড ১৯ সংক্রমণকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈশ্বিক মহামারি হিসাবে ঘোষণা করার পরেও 'হু' সার্বিকভাগে জাতীয় স্তরের লকডাউন সুপারিশ করতে অস্বীকার করে; করোনার প্রতিক্রিয়া প্রত্যেকটা দেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্তের উপরেই ছেড়ে দিয়েছিল যাতে বোঝা যায় যে এই যুদ্ধটা একটা ‘সবার জন্য এক মাপ’ পদ্ধতির অনুসরণ করতে পারে না।তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তেই সর্বশেষ প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো প্রদান করে যাচ্ছিল এবং জোর দিচ্ছিল সরকার ও নাগরিকদের সর্বাত্মক উদ্দেশ্য ও কর্মকান্ডের ঐক্যের লক্ষ্যে।
২৫ মার্চ দেশজোড়া লকডাউন ঘোষণার আগে দৃশ্যতই ভারতে আমাদের কাছে দুমাস সময় ছিল।তবে, আমাদের প্রস্তুতির অভাবের মাত্রাটি ১৩ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ট্যুইট থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে - আমরা কার্যকরীভাবে ‘জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ পর্যায়ে পৌঁছতে পারি নি!
এই ধরনের বিস্ময়কর ঘটনা যদিও আমাদের কাছে হতবাক হওয়ার মতো ছিল না! এরা নিজেদের অগ্রাধিকারের দ্বারা পরিচালিত। ফেব্রুয়ারির বেশিরভাগ সময় সরকারের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ২২-২৪ ফেব্রুয়ারির 'নমস্তে ট্রাম্প'এর প্রস্তুতির উপরে , ২৪ শে ডিসেম্বর থেকে দিল্লিতে কুরুচিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং শেষ অবধি মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে কমলনাথ সরকারের পতন।এদের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ !
পরিযায়ি শ্রমিকদের গুরুত্ব
এখন এটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে পরিযায়ি শ্রমিকরা প্রভাবিত জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অংশ যা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশলটির সবচেয়ে বড় চ্যুতি ; কিন্তু, এটি অনুমান করা কি কঠিন ছিল?শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা , সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার মত সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োজনীয়তাগুলির জন্য দরকার একটি নির্দিষ্ট মাপের বাসস্থান, নিয়মিত জল সরবরাহ এবং ভাইরাস সম্পর্কে ন্যূনতম বৈজ্ঞানিক সচেতনতা।
যথাযথভাবে বলা হচ্ছে যে ভাইরাসটির আক্রমণ বর্ণ, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ এবং শ্রেণীর নির্বিশেষে হয়, তবে প্রতিরোধের ক্ষমতা অবশ্যই শ্রেণীর দ্বারা পৃথকীকৃত। বঞ্চিত ও ক্ষমতাহীন নিজেদের রক্ষা করতেও পারে না আবার রাষ্ট্রীয় সহায়তা ব্যতিরেকে নিজেদের রোগের বাহক হওয়া থেকেও আটকাতে পারে না। এটা আরো বেশি করে লক্ষ্যনীয় হয় যখন স্বাস্থ্যখাতে অস্বাভাবিক হারে ব্যয় সঙ্কোচনের মাধ্যমে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয় এবং বড় বড় বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমা সংস্থা ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে ঝটিকাগতিতে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
এই প্রসঙ্গেই পরিযায়ি শ্রমিকদের গুরুত্বের দিকটি উত্থাপিত হয়।২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ভারতে মোট অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যা ৪৫.৩৬ কোটি বা দেশের জনসংখ্যার ৩৭%।২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, ভারতের শ্রমশক্তি ছিল ৪৮.২ কোটি মানুষ। এই পরিসংখ্যানটি ২০১৬ সালে ৫০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয় ।অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ি শ্রমশক্তির পরিমাণ ২০২০ সালে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ২০ শতাংশ বা ১০ কোটিরও বেশি বলে ধারণা করা হয়।২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে এনএসএসও সমীক্ষা এবং অর্থনৈতিক সমীক্ষা দেখায় যে মোট ৬.৫কোটি আন্তঃরাজ্য অভিবাসী রয়েছে এবং এই অভিবাসীদের ৩৩ শতাংশই শ্রমিক।রক্ষণশীল অনুমান অনুসারে, এদের মধ্যে ৩০শতাংশ অনিয়মিত কর্মী এবং অন্য ৩০ শতাংশ নিয়মিত ভিত্তিতে কাজ করেন তবে ইনফর্মাল সেক্টরে।রাস্তার ওপরের ক্ষুদ্র বিক্রেতারা আরেকটি বিপন্ন অংশ যাদের কোন তথ্য এই শ্রমজীবি সমীক্ষাগুলোতে ধরা পরে না। গোটা দেশে এইরকম ১.২ কোটি থেকে ১.৮ কোটি মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র বাস করে এবং বর্তমানে তাদের রোজগার হারাতে বসেছে। সমীক্ষাগুলোতে দেখা যায় যে, ২০১৯ সালের অনুমান অনুসারে, ভারতের বড় শহরগুলির জনসংখ্যার ২৯% ই দৈনিক মজুর।এরা এমন একটা জনগোষ্ঠী যারা স্বাভাবিকভাবেই এই পরিস্থিতিতে নিজেদের রাজ্যে ফিরে যেতে চাইবে।
অন্য একটি গবেষণায়, ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক থাচিল ভারতে চক্রাকার স্থানান্তর(circular migration) সম্পর্কে ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে যে এই অভিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের গ্রাম-ভিত্তিক নৃতাত্ত্বিক বন্ধনকে পুরোপুরি ধরে রাখতে বা পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারে না, যা শহরে তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রক্রিয়া ভেঙে পরার পরে শত শত কিলোমিটার পথ হাঁটার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় লক্ষ্য করা যায়।
এই লকডাউন কতটা কষ্টকর তা এই সময়কালের কিছু সমীক্ষায় ফুটে উঠেছে। দিল্লি ভিত্তিক একটি এনজিও জন সাহস-এর ৩০০০ জন পরিযায়ি শ্রমিকের ওপরে করা একটি সমীক্ষায় এই চিত্র আরো প্রকট হয়েছে - সমীক্ষায় অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে ৯০% এই লকডাউনে তাদের আয়ের উৎস হারিয়েছেন , ৪২% মানুষের কাছে একদিনের খাদ্য জোগাড় করার মত অর্থ নেই। স্ট্র্যান্ডেড ওয়ার্কার্স অ্যাকশন নেটওয়ার্ক নামক ৭৩ জন স্বেচ্ছাসেবীর একটি দল অন্য একটি সমীক্ষা করে ১১,০০০ জন শ্রমিকের মধ্যে, যাদের বেশিরভাগ নির্মাণ শ্রমিক। তারা দেখেছেন যে এদের মধ্যে ৯৬% সরকারের কাছ থেকে কোন রেশন পাননি এবং ৮৯% র ক্ষেত্রে লকডাউনের সময় তাদের নিয়োগকর্তারা কোন অর্থ প্রদান করেনি।
রাজ্য সরকারগুলো নির্মান শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের রেশন এবং ১০০০ থেকে ৬০০০ টাকার মধ্যে নগদ প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।কিন্তু সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎকার এবং ১২ টি রাজ্যের সিএজি রিপোর্টের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এই আর্থিক ত্রাণটি বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পগুলিতে কয়েক বছর ধরে রাজ্য সরকারগুলোর দ্বারা আদায় করা ৫২,০০০ কোটি টাকার শ্রমিক কল্যাণ শুল্কের একটি ভগ্নাংশ মাত্র।
নীতিন শেঠি ও তার সহযোগীরা একটি দুই ভাগে প্রকাশিত রিপোর্টে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় পরিকল্পনার অভাব ও দিশাহীনতা নিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের হতাশার দিকটি উন্মোচিত করেছেন। রিপোর্টটি অনুসারে এই বিজ্ঞানীদের অনেকেই বিশেষজ্ঞ টাস্ক ফোর্সের সদস্য । তাদের একটি অভ্যন্তরীন আলোচনায় ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ও সর্বসাধারণের জন্য উপলব্ধ দুটি গবেষণায় পরিযায়ি শ্রমিকদের বিপন্নতার দিকটি উঠে এসেছে যা এই সমগ্র প্রচারপর্বে উপেক্ষিত থেকে গেছে। একজন বিজ্ঞানী আক্ষেপ করে বলেছেন, " গরীবদের ক্ষেত্রে ঘরে ঘরে গিয়ে স্ক্রিনিং এবং কোভিড পজিটিভদের দ্রুততার সাথে কোয়ারান্টাইন করা কে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্ব না দিলে লকডাউনের ফলে শুধু আন্তঃগোষ্ঠী সংক্রমণ বিস্তারকেই সাহায্য করা হবে"। “শহরে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকাগুলোতে দরিদ্ররা খুব সামান্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারে বা বহু ক্ষেত্রে তা অসম্ভব ; (তারা) সাধারণ শৌচালয়গুলোর মতো সর্বসাধারণের জন্য উপলব্ধ ব্যবস্থার মধ্যে বাস করে। এই লকডাউন সম্ভাব্য কোভিড-১৯ রোগীদের এই স্থানগুলি অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে বাধ্য করেছে। কল্পনা করুন যে কোনও কোভিড পজিটিভ ব্যক্তি প্রতিদিন শত শত লোকের সাথে কমিউনিটি টয়লেট ব্যবহার করছে, ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং এই কঠোর লকডাউন তাকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে বাধা দিচ্ছে। "
একটি শ্রেণী যুদ্ধ যার পতন অব্শ্যম্ভাবী
পরিযায়ি শ্রমিকদের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ প্রত্যাশিত ও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।গুজরাট বিজেপি ও কেন্দ্রের সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব এই লকডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২৮টা এসি বাসের ব্যবস্থা করে হরিদ্বার থেকে তীর্থযাত্রীদের আহমেদাবাদে ফেরানোর জন্য।একইভাবে, কোটায় কোচিংয়ের জন্য যাওয়া বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোর পক্ষ থেকে রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।কিন্তু পরিযায়ি শ্রমিকদের ফেরানোর প্রসঙ্গ উঠলেই এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ নেমে আসে। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই স্বীকার করেছে যে কেরালা একাই দেশের ৬৮% আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়েছে, যেগুলি লকডাউন চলাকালীন দেশের ৫০% শ্রমিকের বাসস্থান । খাদ্য এবং রেশনের ক্ষেত্রেও একটি অনুরূপ ধারা লক্ষনীয়। কিন্তু, তবুও কেন্দ্রীয় সরকার প্রবলভাবে পরিযায়ি শ্রমিকদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার বিরোধিতা করছে।
শ্রেণী যুদ্ধ কোনও উদ্ভাবন নয়। সরকারের একের পর এক জনবরোধী, আগ্রাসী অর্থনৈতিক নীতির কারণে বৈষম্য, দারিদ্র, বেকারত্ব তীব্রতর হয়েছে যা এই শ্রেনী যুদ্ধের বহমানতারই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয় তাহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবেই। অভুক্ত,অসহায়, ও অপ্রতুল বাসস্থানের দ্বারা বিপর্যস্ত পরিযায়ি শ্রমিকদের জুটেছে খালি পুলিশের ভারী বুটের আঘাত।সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় বিবৃত সাম্যের অধিকার অর্থাৎ আইনের চোখে সবাই সমান বা সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুসারে জীবনের নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও দেশের মধ্যে চলাচলের অধিকার এদের কাছে অর্থহীন। বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ, কাজ হারানোর কারণে ন্যূনতম নগদ সহায়তা এবং তাদের বাড়িতে ফিরে আসার জন্য ব্যবস্থা করা পরিযায়ি শ্রমিকের প্রতি কোন সহানুভূতির আচরণ নয়, বরং অর্থনীতিতে তাদের অবদানের জন্য এটা তাদের প্রাপ্য এবং উচ্চতর সংক্রমণের চ্যালেঞ্জকে ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক একটি ব্যবস্থা।