Dwarka highway scam

হদিস দিল সিএজি রিপোর্টঃ সড়ক যোজনায় ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারি

কৃষ্ণায়ন ঘোষ

সম্প্রতি জাতীয় সড়ক ও মহাসড়ক প্রকল্পের খরচ সংক্রান্ত যে রিপোর্ট কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া (সিএজি) প্রকাশ করেছে তাতে আর একবার মোদি সরকারের দুর্নীতির দিকটি বেআব্রু হয়েছে। রিপোর্টে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও আর্থিক তছরুপের হদিস মিলেছে। এর মধ্যে একদিকে যেমন আছে দিল্লী–দ্বারকা মহাসড়ক নির্মাণে ১৩ গুণ অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের মত দুর্নীতি, তেমনি আছে হাইওয়ে টোল প্লাজাগুলিতে ব্যাপক অব্যবস্থা ও আর্থিক কারচুপির মত দিকগুলিও।

‘ভারতমালা পরিযোজনা’ মোদি সরকার ঘোষণা করে ২০১৫ সালে। পরিকল্পনা ছিল ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মোট ২৬০০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণ করা। এই প্রকল্পের আওতায় ছিল বেশ কিছু ইকনমিক করিডোর, অন্তর্বর্তী করিডোর, ফিডার রুট, উপকূলবর্তী ও বন্দরমুখী সড়ক নির্মাণ এবং বিভিন্ন জাতীয় সড়কগুলির কার্যকারিতা ও মান উন্নত করা। পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড (পিআইবি), ২০১৭ সালের জুন মাসে ভারতমালা প্রকল্পের প্রস্তাব দিলে সেই বছরই অক্টোবর মাসে তার অনুমোদন দেয় ক্যাবিনেট কমিটি অন ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স (সিসিইএ)। এই ভারতমালা পরিযোজনা ফেজ–১ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল দিল্লী-দ্বারকা মহাসড়ক নির্মান।

উদ্দেশ্য?

১৪ নং জাতীয় সড়কে দিল্লী–গুরুগ্রাম এর মধ্যে যান চলাচলের চাপ কমানো। কথা ছিল ৬ লেন বিশিষ্ট ২৯.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটার পিছু ১৮.২০ কোটি টাকা খরচ করা হবে, যার অনুমোদন দিয়েছিল সিসিইএ। পরবর্তিতে ন্যাশনাল হাইওয়ে আথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এনএইচএআই) এর অনুমোদনের পর সেই খরচের পরিমান বেড়ে দাঁড়ায় মোট ৭২৮৭.২৯ কোটি টাকা, যার জন্য সিসিইএ’র কোন অনুমোদনই ছিল না। শুধু তাই নয়, এই ৬ লেনের মহাসড়কের পাশাপাশি ৮ লেন বিশিষ্ট এলিভেটেড করিডোর বানানোয় কোন অনুমোদন দেয়নি সিসিইএ।

এনএইচএআই টেন্ডার ডাকার আগে যে খরচ এর অনুমান করেছিল, তার পরিমানও ছিল সিসিইএ অনুমোদন করা খরচের ১১ গুন। এনএইচএআই'র হিসাব অনুযায়ী খরচ হওয়ার কথা ছিল কিলোমিটার প্রতি ২০৬.৩৯ কোটি টাকার কাছাকাছি। টেন্ডার ডাকার পরে সেই খরচ দাঁড়ায় কিলোমিটার পিছু ১৮১.৯৪ কোটি টাকা, যা এনএইচএআই এর আনুমানিক খরচের থেকে প্রায় ১২ শতাংশ কম। এর পরে কিলোমিটার প্রতি খরচ কিভাবে ২৫০.৭৭ কোটিতে গিয়ে পৌঁছালো তার কোনো সদুত্তর মেলে নি, এমনকি ভারত সরকার এই ব্যাপক খরচে রাশ টানার কোন প্রচেষ্টাও করেনি।

স্বভাবতই এখানে প্রশ্ন আসে এই সিদ্ধান্ত একক ভাবে এনএইচএআই নিতে পারে কিনা। স্বাভাবিক উত্তর হল ‘না’। যেখানে সমগ্র প্রকল্পটি সিসিইএ’র পরিকল্পনা উপর ভিত্তি করে সেখানে প্রাথমিক অনুমোদনও তাদের থাকতেই হবে, কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সেই নিয়মের তোয়াক্কা করা হয় নি। এখানেই শেষ নয়, রেকর্ড বলছে দৈনিক গড়ে ২,৩২,৯৫৯ টি যান চলাচলের কথা মাথায় রেখে ঐ ৬ লেন বিশিষ্ট মহাসড়ক বানানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সিসিইএ তরফে। পরে ২০২২ সালে অতিরিক্ত যে পঞ্চান্ন হাজার যান পরিবহনের ভিত্তিতে ঐ ৮ লেনের ৮.৭৬ কিলোমিটার এলিভেটেড করিডোরের কথা কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক ঘোষণা করে, রিপোর্টে তার কোন উদ্ধৃতিই ছিল না। এই অতিরিক্ত যানের হিসাব ঠিক কিসের ভিত্তিতে, তারও কোথাও কোনো উল্লেখ নেই।

প্রসঙ্গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে টেন্ডার ডাকা হয় সরকারের তরফে। সেই টেন্ডারে মোট ৪ টি ভাগে দুটি কম্পানি লারসেন অ্যান্ড টুব্রো এবং জে কুমার ইনফ্রাপ্রজেক্টস এই সড়ক বানানোর বরাত পায়। ২০২২ সালের কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের ঘোষণার পর বিতর্কিত ৮ লেন বিশিষ্ট এলিভেটেড করিডোরটি বানানোর বরাত পায় লারসেন অ্যান্ড টুব্রো কম্পানি। একটু পিছনের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে লারসেন অ্যান্ড টুব্রো’র কর্ণধার এস এন সুব্রমনিয়ন প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব সামাজিক মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রসংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বক্তব্য রাখেন। তার ঠিক পরেই, ২০২২ এ পূর্ব পরিকল্পনাহীন এই ৮.৭৬ কিলোমিটার এলিভেটেড করিডোর বানানোর বরাত পাওয়া আবারো বিজেপি – কর্পোরেট আঁতাতের বিষয়টাই উস্কে দেয়। সাধারণ মানুষের ট্যাক্স এর টাকা লুঠ করে কর্পোরেটের অতিরিক্ত মুনাফার পথ করে দেওয়ার নগ্ন প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে।

শুধু দিল্লী-দ্বারকা মহাসড়ক নির্মানেই যে এই আর্থিক অস্বচ্ছতা এমনটা নয়। জাতীয় সড়কগুলির উপর যে টোল প্লাজাগুলি এনএইচএআই এর তত্ত্বাবধানে চলে, সেগুলিতেও অব্যবস্থা ও আর্থিক তছরুপ ভয়াবহ।

delhi dwarka

সিএজি নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতের ৫ টি রাজ্যের মোট ৪১ টি টোল প্লাজায় অডিট করে। সেখান থেকে যা তথ্য উঠে আসে তা এক কথায় সরকারী অপদার্থতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রমাণ করে। কেবলমাত্র ৫ টি টোল প্লাজায় এন এইচ ফি অ্যামেন্ডমেন্ট রুল ২০১৩ সঠিক ভাবে কার্যকরী না হওয়ায় সাধারণ মানুষকে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১৩২.০৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ফি বহন করতে হয়েছে, যা সরকার সরাসরি লুঠ করেছে সাধারণ মানুষের থেকে।

এন এইচ ফি অ্যামেন্ডমেন্ট রুল ২০১৩ তে এন এইচ ফি অ্যামেন্ডমেন্ট রুল ২০০৮ এর বেশ কিছু পরিবর্তন হয়। যেমন ২০০৮ এর অ্যামেন্ডমেন্ট রুল অনুযায়ী প্রতি বছর টোল প্লাজাগুলি ৩ শতাংশ (সিম্পল ইন্টারেস্টে) অবধি ফি বৃদ্ধি করতে পারত। ২০১৩ সালের ফি অ্যামেন্ডমেন্ট রুলে সেই নিয়মের পরিবর্তন করে বলা হয় যে সমস্ত জাতীয় সড়ক, ৪ লেন থেকে উন্নত করে ৬ লেনের করা হবে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট টোল প্লাজাগুলিতে ফি ৭৫ শতাংশের বেশি নেওয়া যাবে না, কাজ চলাকালীন কোনভাবেই ফি বাড়ানো বা কমানো যাবে না এবং প্রকল্প শেষ হওয়া মাত্রই আবার পুরানো হারে টোল ফি আদায় করা হবে। দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই টোল ফি ৭৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে সড়কের উন্নয়নের কাজ শুরু হওয়ার অনেক পরে। এছাড়াও টোল ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে সড়কের কাজ চলাকালীন।

মাত্র ৩ বছরের অডিটে শুধু ৫ টি টোল প্লাজার আর্থিক তছরুপের যদি এহেন নমুনা হয় তাহলে সহজেই বলা যায় সারা দেশের এনএইচএআই অধীনস্থ ৮৮১ টি টোল প্লাজায় এই চুরির পরিমান কতটা হতে পারে।

এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। রিপোর্ট বলছে, এন এইচ ফি দ্বিতীয় অ্যামেন্ডমেন্ট রুল ২০১১ কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়।

কি বলছে সেই রুল? ১৯৫৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পরে তৈরি কোন পাকা ব্রিজের জন্যই কেবল মাত্র টোল ফি আদায় করা যাবে। অথছ দেখা গেছে ১৯৫৪ সালে তামিলনাড়ুর পারানুরে নির্মিত একটি ৬৩০ মিটারের ব্রিজের জন্য এনএইচএআই টোল আদায় করে আসছে বছরের পর বছর। শুধু তাই নয়, ৬৩০ মিটার এর ব্রিজের জন্য টোল ফি আদায় হয়েছে ৬.৩ কিলমিটারের হারে। ২০১৭ থেকে ২০২১ অবধি অবৈধ এই টোল ফি সংগ্রহের পরিমান ২২.১০ কোটি টাকা।

তবে শুধুমাত্র অতিরিক্ত টোল আদায়ই নয়, বহু ক্ষেত্রে ২০০৮ বা ২০১৩ সালের এনএইচ ফি অ্যামেন্ডমেন্ট রুল প্রয়োগ করতেও ব্যর্থ হয়েছে ভারত সরকার। যার ফল হিসাবে বহু টাকার লোকসানও হয়েছে সরকারের। পুরো বিষয়টি যে এক বিরাট অব্যবস্থার প্রতিরূপ তা বলার অবকাশ রাখে না।

১০ আগস্ট সিএজি কেন্দ্রীয় সরকারের এই ব্যাপক দুর্নীতির পর্দাফাঁস করার পরে পরেই স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর গালভরা ভাষণ সারা দেশ শুনেছে। ভারত অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হতে চলেছে তার ভুয়ো আশ্বাসও তারা প্রত্যক্ষ করেছে। শুধু শোনে নি দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটিও শব্দ, সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য কোন প্রচেষ্টার কথা। সাধারণের অর্থ লুঠ করে কর্পোরেট-দের পকেট ভরার যে কাজ বিজেপি সরকার করে চলেছে তা মানবসমাজের পরিপন্থী একথা বলতে কোন দ্বিধা থাকে না। ধান্দার ধনতন্ত্রের চরিত্র এটাই।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন