বাজেট ২০২৪ – ভোটের বাজেট করতে চেয়েও হল না - ঈশিতা মুখার্জী

সামনে লোকসভা নির্বাচন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পেশ করেছে ভোট-অন-অ্যাকাউন্ট বাজেট সংসদের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম ৫৮ মিনিটের ভাষণে। ভোটের দিকে তাকিয়ে এই বাজেট হলেও কেন সরকার জনমোহিনী করতে পারলেন না এই বাজেটকে ? খটকা এখানেই। বাজেট পেশের মাত্র এক দিন আগে এক বছরের আর্থিক সমীক্ষা পেশ না করে গত দশ বছরের এক অর্থনীতির খতিয়ান দিয়েছে সরকার। সেখানেও দেশের অর্থনীতিকে যতই রঙ্গীন করে দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন সরকার, পুরোপুরি তাও পারল না কেন? জনকল্যাণে দেশের জন্য দেশপ্রেমিক সাজলেও বাজেট দেখে তা মনে হওয়ার কোন কারণ নেই। মুখে সরকার দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলে বর্ণনা দিয়েছে। আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়ে অনেক বড়াই করলেও সরকার তার নিজের তথ্যেই এ কথা অস্বীকার করতে পারেনি যে মাথা পিছু আয়ের নিরিখে ১৩৭ টি দেশের নীচে। এ ছাড়াও মৌলিক ক্ষেত্রগুলিতে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমছে। ২০১৯ সাল থেকে একটানা ২০২৩ সাল পর্যন্ত্য গড় আর্থিক বৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩.৫%। এই তথ্য আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের। বেসরকারী বিনিয়োগ কমেছে। বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে। শিল্পে অগ্রগতি নেই। শিল্পে শ্রমজীবী মানুষ বেশির ভাগ অসংগঠিত, ইনফরম্যাল। কৃষিতে বেশির ভাগ কাজ করছে মহিলারা। কোন মহিলারা ? যে বাড়ির পুরুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গেছে। শ্রমজীবীদের মধ্যে বেশির ভাগ স্বনিযুক্ত। রয়েছে এ দেশে রেকর্ড বেকারত্ব। এই দেশে ভোটের বাজেট থেকেও কি মানুষ কিছু জনকল্যাণের মুখের বুলি আশা করতে পারেন না?


না, মানুষের আশা রাখতে পারলেন না অর্থমন্ত্রী। সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয়ের প্রস্তাব নেই কেন এই বাজেটে? কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ দপ্তরে বরাদ্দ বাড়ল না। প্রধানমন্ত্রী কৃষি যোজনা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা , এমন কি রেকর্ড বেকারত্বের মুখে মনরেগার বরাদ্দ বাড়ল না। এই প্রকল্পে গত বছরেই বাজেট বরাদ্দ খরচ হয় নি; তাই গত বছর যা খরচ হয়েছে সেই তুলনায় বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেটে দেখালেও তা আদৌ বৃদ্ধি নয়। ভোট সামনে, তাও পাড়লেন না প্রতিশ্রুতি দিতে? সরকার আজ এতটাই দেউলিয়া। প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে-মিল যা প্রধানমন্ত্রী পোষণ নামে গত ২০২৩-২৪ সালের বাজেট পেশের সময়ে পেশ করে হাততালি কুড়িয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী সেই প্রকল্পে গত বছর যা বরাদ্দ ছিল তার চেয়ে কম খরচ হয়েছে; আর তার চেয়ে একটু বেশি করে বরাদ্দ দেখালেও আসলে বছর বছর এই প্রকল্পগুলিতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ কমে গেছে। সরকার কি করেই বা দায়ভার নেবে? জনকল্যাণমুখী কাজ থেকে সরকার ধীরে ধীরে নয়, ২০১৪ সালের পর থেকে দ্রুত সরে গেছে। বেশির ভাগ প্রকল্পে যেমন উজালা গ্যাস প্রকল্প, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প- এগুলিতে সরকার নিজের ব্যয় কমিয়ে আসলে প্রকল্পগুলি বেসরকারী মালিকের হাতে তুলে দিয়েছে। তাই সরকার প্রকৃতই জনকল্যাণখাতে তার দায়িত্ব কমিয়ে দিয়েছে মোদী জমানায়। তাই ভোটের আগেও মুখে মনোমোহিনী কথা বললেও জনমোহিনী বাজেট করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।

মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার কিছুই নেই এই বাজেটে। কিন্তু বিপদ হল বাজেট এখানেই থেমে নেই। বাজেট দেশের সাধারণ মানুষের পকেট কেটে অতিধনী কর্পোরেটদের পকেট ভরছে, এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে বাজেট। সরকারের রাজস্ব আয় দেখলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশের কর ব্যবস্থা সাধারণ গরিব মানুষের বিরুদ্ধে।মোট রাজস্ব আয়ে পণ্য পরিষেবা করের অংশের চেয়ে কম কর্পোরেটের করের অংশ। সাধারণ মানুষ যে পরিমাণ পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য, অতি ধনী কর্পোরেটদের আয়ের উপর সেই পরিমাণ কর বসে নি এবং এই ব্যবস্থা একই রকম রেখে দিয়েছে এই বছর। খাদ্য ভরতুকি গত এক বছরে ৬০,৪৭০ কোটি টাকা কমে গেছে।অর্থাৎ “বড়লোকের ঢাক তৈরি গরিব লোকের চামড়ায়” -এই রীতি নীতি অব্যহত রইল এই বাজেটেও।নোটবন্দীর পর থেকেই সোজাসুজি ভাবে গরিব মানুষের উপর আক্রমণ অব্যহত রয়েছে। এই ব্যবস্থা নিয়ে কোন কৈফিয়ত দিলেন না কেন অর্থমন্ত্রী? এই ব্যবস্থাকে ভোলানোর জন্য অবতারণা করলেন মন্দিরের প্রসঙ্গ, অমৃতকাল, কর্তব্যকালের প্রসঙ্গ। গত বছরের সাধারণ গরিব মানুষের জন্য ঘোষিত প্রকল্পগুলি নিয়ে এত বিজ্ঞাপন হয়েছিল। তা কেমন চলেছে এক বছরে তার খতিয়ান দেওয়ার কোন দায় ছিল না অর্থমন্ত্রীর? ভোটের আগেও দায় থাকে না খতিয়ান দেওয়ার নির্বাচিত সরকারের? তফশিলি জাতি উপজাতি দের দপ্তরে বরাদ্দ, প্রকল্পের অবস্থান কেমন হল? বরাদ্দ তো বাড়ল না। কিন্তু প্রকল্পগুলি কেমন চলছে বাজেট বক্তৃতায় বললেন না কেন অর্থমন্ত্রী? এই ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনজাতিগোষ্ঠী নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেন নি অর্থমন্ত্রী। বলেছেন সব জাতপাত নিয়ে ২০৪৭ সালে “বিকশিত ভারত” তৈরি করবে এই সরকার!


বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে দেশের অর্থনীতি নিয়ে বাজেটের আগে পেশ করা দেশের অর্থনীতির খতিয়ানে। পিছিয়ে পড়া মানুষজনকে নিয়ে দেশের আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব হবে কি? এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই এই দুই নথিতেই। বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলি তাদের নিজেদের দেশের অর্থনীতির উপর দেওয়াল তুলে বিশ্বায়নের বিপরীতে হাঁটতে পারে বলে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে আর্থিক খতিয়ানে। জলবায়ু সঙ্কট নিয়ে বিশ্বে প্রতিশ্রুতি দিলেও সে নিয়ে বাজেটে কোন কথা বলা নেই। বরং বাজেটের আগে পেশ করা নথিতে স্পষ্ট বলা আছে যে দেশে শক্তি বা এনার্জি নিয়ে বেশি ভাবলে আর্থিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বিশ্বের বৈঠকে কথা দেওয়া আছে বলে সৌর শক্তির উল্লেখ করা হয়েছে বাজেটে। এই বাবদ বিশেষ বরাদ্দ বা প্রকল্প কিছুই নেই।
বাজেটের শুরুতে যা বললেন অর্থমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির ভাষণে কিছুদিন আগেই তা শোনা গিয়েছিল। বাজেট করা হয়েছে নাকি চারটি গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে। প্রথম গোষ্ঠী হল দরিদ্র। এরপর রয়েছে যুব সম্প্রদায়, মহিলা, কৃষক। এ কি ধরণের জনবিন্যাসের ভাগ? মাত্র কিছুদিন আগেই সরকার ঘোষণা করে জানাল যে দেশে বিভিন্ন আঙ্গিকের বিচারে দেশে দরিদ্রের সংখ্যা কমে গেছে। এতই যদি কমে গিয়ে থাকে তাহলে বাজেটে দরিদ্রদের কথা সবচেয়ে আগে কেন চলে এল? বিভিন্ন অর্থনীতিবিদেরা ওই পরিমাপের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সরকার অবিচল। সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী বড়াই করে বলেই গেছেন যে দরিদ্রের সংখ্যা এ দেশে কমেছে।এ তথ্য যে সত্যি নয় তা কি তাঁরা জানেন না? বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে দেশের স্থান বছর বছর পিছিয়ে যাচ্ছে, এ কথা তো দেশের মানুষের কাছে জানা। অনাহার বাড়বে, দারিদ্র্য কমবে, এমন কথা কি কেউ শুনেছে? তাই সরকার ভোটের দিকে তাকিয়ে দরিদ্র মানুষের উল্লেখ মাত্র করেছে এই বাজেটে। যুবদের কথা তো ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে বলতেই হল বাজেটে। রেকর্ড বেকারত্ব, শিক্ষায় সরকারী ব্যয়বরাদ্দ কমে যাচ্ছে, অথচ জনবিন্যাসের নিরিখে দেশে যুবসম্প্রদায়ের সংখ্যাই বেশি অন্যদের তুলনায়।যুবদের সঙ্কট মোচনের জন্য বাজেট কিছু না বললেও তাদের কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন অর্থমন্ত্রী।


সরকার এখনো মহিলাদের মানব সম্পদের অংশ অর্থাৎ দেশ গঠনের অংশ হিসেবে মনে না করে ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবেই মনে করে, তা আরেকবার বোঝা গেল। গতকয়েকদিন আগেই সরকারী তথ্য জানিয়েছে পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সমীক্ষায় যে কৃষিকাজের অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগ মহিলা। এতে নাকি মহিলাদের কশমতায়ণ হয়েছে! দরিদ্র পরিবারের মহিলারা যে কোন কাজে যে কোন মজুরিতে কাজ করে সংসার নির্বাহ করছেন বর্তমান ভারতে। কৃষিকাজ করলেও কৃষি মজুরির হার কমে গেছে ক্রমাগত। কৃষিক্ষেত্রে আয় কমছে, সে নিয়ে তো কোন বাক্য ব্যয় করলেন না তিনি! মহিলাদের জন্য কত বরাদ্দ হল, তার জন্য রয়েছে জেন্ডার বাজেটে খতিয়ান। এই বছরের বাজেটে দেখা যায় যে মোট বাজেট বরাদ্দে মহিলাদের জন্য বরাদ্দ অর্থ যা জেন্ডার বাজেট বলা হয় তা ৪% থেকে কমে ০.০৬% এ নেমে গেছে। কন্যাশিশুদের জন্য যে সঞ্চয় প্রকল্পের কথা গত বাজেটে ছিল, তার তো কোন উল্লেখ নেই। নারী নির্যাতন এত বেড়ে যাওয়ার পরও নির্ভয়া এবং মিশন শক্তির বরাদ্দ খরচ হল না ; বরাদ্দ বাড়ানোও হল না। এই বাজেট তো আদৌ মহিলাদের উপর গুরুত্ব দেয় নি।


ধারাবাহিক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের জেরে কৃষকদের কথা বলা আছে বাজেটে ভোটের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এখানেও শুধু উল্লেখই রয়েছে।সারের ভর্তুকি কমে গেছে বছর বছর। কৃষিমজুরি কমে গেছে , কিন্তু এ নিয়ে বাজেটে কথা নেই। চাষের খরচ বাড়ছে, কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছে-বাজেট মুখে কৃষকদের কথা উল্লেখ করলেও, বাজেটে ের প্রতিফলন নেই।
চেষ্টা করেও জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন একটি সরকার, ধর্মের আবেগের উপর নির্ভর করা একটি সরকার, বিরোধী স্বর দাবিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র রোধী একটি সরকার বহুদিন সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই তারা চেষ্টা করলেও আর “ভোটের বাজেট” করতে পারে না।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন