Crony Capital Cover 2025

পুঁজিবাদ সম্পর্কে এক স্থায়ী মিথ্যাপ্রচার

প্রভাত পট্টনায়েক 

বিশ্ব পুঁজিবাদের সমর্থক অর্থনীতিবিদদের দ্বারা পুঁজিবাদ সম্পর্কে বহুরকম ‘জনশ্রুতি’ তৈরি হয়েছে। ডেভিড রিকার্ডো দ্বারা প্রচারিত এমনই এক ‘জনশ্রুতি’ দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে। রিকার্ডো প্রাথমিকভাবে যন্ত্রপাতি/মেশিনারী প্রবর্তনের উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। সেই সময়কার শ্রমিক সংগঠনগুলির তরফে যে যুক্তি দেওয়া হত যে যন্ত্রপাতির কারণে বেকারত্ব সৃষ্টি হয়- তিনি তা খারিজ করেছিলেন। তবে, তার ‘প্রিন্সিপলস’ বইয়ের তৃতীয় সংস্করণে ‘মেশিনারি সম্পর্কে’ নামে একটি অধ্যায় যোগ করেন, যেখানে তিনি শ্রমিক সংগঠনগুলির বক্তব্যের সঙ্গে একমত হন যে যন্ত্রপাতির প্রবর্তন বেকারত্ব সৃষ্টি করে। কিন্তু এরপর তিনি যুক্তি দেন যেহেতু যন্ত্রপাতির ব্যবহার মুনাফার হার বাড়ায় এবং তার ফলে পুঁজির সঞ্চয় ও বৃদ্ধির হার এমনকি কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হারও বৃদ্ধি পায় তাই সময় যত এগোবে এ ব্যবস্থা আগের তুলনায় আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।

মার্কস তাঁর ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব’ (থিওরি অফ সারপ্লাস ভ্যাল্যু) গ্রন্থে রিকার্ডোর ঐ দাবির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এ দাবি একাধিক কারণে ত্রুটিপূর্ণ। প্রথমত, রিকার্ডোর আলোচনার সবটাই এককালীন যন্ত্রপাতি প্রবর্তনের উপর ভিত্তি করে ব্যখ্যা দেয়। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া- এক পর্যায়ের যন্ত্রপাতি প্রবর্তনের পরই আরেকটি এবং তারপর আরও একটি আসে। তাই, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে মুনাফার হার, পুঁজি সঞ্চয় ও কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে তা হলেও যন্ত্রীকরণের সুবাদে সৃষ্ট বেকারত্ব একদিন পুরোপুরি নিঃশেষিত হবে এমন সোনালী দিন মরীচিকার মত ক্রমাগত পিছোতেই থাকে।

দ্বিতীয়ত, রিকার্ডোর যুক্তি সেইস’র সুত্রের (Say’s Law) উপর ভিত্তি করে উদ্ভাবিত। এর অর্থ সামগ্রিক চাহিদার কোনো সমস্যাই নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে এর মানে হবে সমস্ত সঞ্চয় (যা অব্যবহৃত মুনাফার সমান, কারণ সমস্ত মজুরিই খরচ হয়ে যায় বলে ধরা হয়েছে) বিনিয়োগে রূপান্তরিত হয়। বিনিয়োগ কখনই বাজারের বৃদ্ধি দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে না। সম্পদ ধারণের অন্য কোনো রূপ নেই, অর্থাৎ অর্থ কখনই সম্পদ ধারণের মাধ্যম নয়। এ এক সম্পূর্ণ অবাস্তব ধারণা, যুক্তির বিচারে যা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

যদি আমরা স্বীকারও করে নিই যে বাজারের বৃদ্ধিই বিনিয়োগের নিয়ন্ত্রক তাহলেও এটুকু স্পষ্ট যে যন্ত্রপাতি প্রবর্তনের কারণে মজুরি খাত থেকে মুনাফার দিকে সম্পদের গতির ক্রমাগত বৃদ্ধি ‘পুঁজি সঞ্চয়ের হার কমিয়ে দেবে’। যেহেতু যন্ত্রপাতি প্রবর্তনের সঙ্গেই বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় তাই শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়লেও মজুরি বাড়ে না। এতে মজুরি থেকে মুনাফার দিকে সম্পদের পুনর্বণ্টন ঘটে। মজুরি প্রায় সম্পূর্ণ অথচ মুনাফার একটি ক্ষুদ্র অংশই খরচ হচ্ছে তাই এ ধরণের পুনর্বণ্টনে মোট আয়ের তুলনায় খরচের অনুপাত কমে যায় যা অতি-উৎপাদনের প্রবণতা সৃষ্টি করে। পুঁজি সঞ্চয়ের হারও কমে।

ফলে রিকার্ডোর দাবিকে নস্যাৎ করেই বলা যায় যন্ত্রপাতি প্রবর্তন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমিয়েই দেয়। অল্প কিছু সময় যাবত কোনও এক স্বতন্ত্র কারণে পুঁজি সঞ্চয়ের হার বাড়তেই পারে। যদি সেই একই সময়ে নতুন যন্ত্রপাতির প্রবর্তন না হলে যদি দেখা যায় বেকারত্বের মাত্রা কমছে তাহলেও মনে রাখতে হবে ঐ বেকারত্ব হ্রাস যন্ত্রপাতি প্রবর্তনের সুবাদে স্বয়ংক্রিয় কায়দায় ঘটল এমনটা বলা চলে না। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সময়ের সঙ্গে যন্ত্রপাতির প্রবর্তন যে বেকারত্ব সৃষ্টি করে তা যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজেই কখনো কাটিয়ে উঠবে- এমন কোনো যুক্তি নেই।

তবে রিকার্ডোর ঐ ধারণা পুঁজিবাদের এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে গৃহীত হয়েছে যে প্রাথমিকভাবে পুঁজিবাদ যতই দুঃখকষ্ট সৃষ্টি করুক না কেন শেষ পর্যন্ত এতে সবারই সমৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু এ ধারণা আদৌ সত্য নয়। আমরা দেখেছি যে প্রাথমিক পর্যায়ের দুর্ভোগ নিজে থেকে কখনই কমে না। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার মধ্যে এমন কিছু নেই যা ঐ প্রাথমিক দুঃখের নিবারণ করে।

এবার প্রশ্ন ওঠে পুঁজিবাদের জন্ম ও তার মূল ঘাঁটি পশ্চিম ইউরোপে মানুষের জীবনযাত্রার মান প্রাথমিক পুঁজিবাদী যুগের তুলনায় তাহলে উন্নত হল কীভাবে? এমন পর্যবেক্ষণকে কী করে সেই অর্থনৈতিক তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় যা বলে যে পুঁজিবাদ সৃষ্ট প্রাথমিক পর্যায়ের দুর্ভোগ সময়ের সঙ্গে কমার বদলে বেড়ে চলে?

পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে যুক্ত দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঐ আপাত ধাঁধার ব্যাখ্যা দেয়। প্রথমটি হল, ইউরোপ থেকে কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলগুলিতে ব্যাপক আকারে জনসংখ্যার অভিবাসন ঘটেছে। এগুলি প্রকৃত অর্থে ‘বসতি উপনিবেশ’ ছিল যাদের চরিত্র ‘বিজিত উপনিবেশ’গুলির (যেমন ভারত, ইন্দোনেশিয়া বা ইন্দোচীন) তুলনায় আলাদা। ‘বসতি উপনিবেশ’গুলিতে অভিবাসীরা আদিবাসীদের জমি দখল করে। সেখানেই নিজেরা চাষাবাদ ইত্যাদি করে তারা আগের অবস্থার তুলনায় বেশি আয় অর্জন করে যা ইউরোপে শ্রমিকদের ‘সংরক্ষিত মজুরি’কে (ন্যূনতম মজুরি) বাড়িয়ে দেয়। এরই সুবাদে তাদের নিজেদের দেশে কর্মসংস্থান ও মজুরির হার দুইই বেড়ে যায় যা যন্ত্রীকরণের নেতিবাচক প্রভাবকে প্রশমিত করে। ইউরোপ থেকে অভিবাসনের মাত্রা জনসংখ্যার তুলনায় বিশাল ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ‘দীর্ঘ উনিশ শতক’ ধরে আনুমানিক পাঁচ কোটি মানুষ ইউরোপ থেকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিল। শিল্প বিপ্লব ঘটে ব্রিটেনে, যেখানে প্রথম শিল্পকারখানার কাজে যন্ত্রপাতির আবির্ভাব হয়। প্রতি বছর চলতে থাকা ঐ অভিবাসনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে প্রাকৃতিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রায় অর্ধেকই দেশ ছেড়ে চলে যায়।

এত দীর্ঘ সময় ধরে এত বড় মাত্রার অভিবাসন শ্রমের বাজারে এক অভাব তৈরি করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোনও অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা না, কার্যত নিজেদের দেশের বেকারদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়াই যন্ত্রপাতির প্রবর্তনে সৃষ্ট প্রাথমিক বেকারত্বটি সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে কমে যাওয়ার আসল কারণ।

দ্বিতীয় উপাদন হল ‘বিজিত উপনিবেশ’গুলিতে শিল্পপণ্যের রপ্তানি যা সেইসব দেশের নিজস্ব শিল্পকে ধ্বংস করে। এর ফলে যন্ত্রপাতির প্রবর্তনে সৃষ্ট বেকারত্ব কেবল অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি- এর একটি বড় অংশ সেই সকল বিজিত উপনিবেশগুলিতে প্রভাব ফেলে। জমতে থাকা সেই বেকারত্ব আজও বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধের (গ্লোবাল সাউথ)-র বিশাল সংরক্ষিত শ্রম (লেবর রিজার্ভ) হিসাবে রয়েছে। একে উন্নত দেশসমুহের শিল্প পুঁজিবাদের যন্ত্রীকরণের ফল হিসাবে সাধারণত বিবেচনা করা হয় না। উন্নত দেশগুলির অভ্যন্তরে সৃষ্ট বেকারত্বের দিকেই বরং কিছুটা বাড়তি নজর দেওয়া হয়- যা ঐ অভিবাসনের মাধ্যমে কমেছিল। তাই আমরা মনে করি সময়ের সঙ্গে পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার সুবাদেই ঐ বেকারত্ব দূর হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে পুঁজিবাদের এমন কোনো অভ্যন্তরীণ প্রভাবই নেই।

এ সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির উপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য সংস্থা দৈববাণীর মতো করে প্রচার করছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নির্বিঘ্নে পুঁজিবাদ অনুসরণ করা হলে সেখানেও বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূর হবে। এ দাবির সমর্থনে পশ্চিম ইউরোপের উদাহরণ দেওয়া হয়। কিন্তু এ হল পুঁজিবাদী তত্ত্ব ও ইতিহাস- উভয়েরই এক সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা।

প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশের ন্যায় ভারতীয়রা ঐ সত্য খুব ভালোভাবেই জানতেন। দেশের উন্নয়নের জন্য বাধাহীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদলে তাঁরা এক নিয়ন্ত্রণমূলক (dirigiste) ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সে ব্যবস্থার মধ্যে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য যথাযোগ্য সুরক্ষাও চেয়েছিলেন। ভারী শিল্পসমুহে জোর দেওয়ার পাশাপাশি মহলানবিশ’রা ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রস্তাবে একটি অতিরিক্ত উপাদানকে যুক্ত করেছিলেন। কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পক্ষেত্রকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ভোগ্যপণ্যের উপলব্ধতাকে তাঁরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।

মহলানবিশ’দের যুগে ঐ একই সময়ে দক্ষিণ গোলার্ধের আরেক বৃহৎ ও জনবহুল দেশ চীনও ‘দু পায়ে হাঁটা’-র (walking on two legs) ন্যায় প্রায় সদৃশ একটি আর্থিক ধারণার জোরে বিকশিত হচ্ছিল। উপনিবেশিক ও আধা-উপনিবেশিক সময় থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বেকারত্ব ও দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে তারা ঐ পথে এগোয়।

অত্যন্ত দুঃখের যে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোচনা আজ এমনই অনুর্বর স্তরে পৌঁছেছে যে দুশো বছরের পুরনো পুঁজিবাদ সম্পর্কিত জনশ্রুতি’কেও বারংবার ব্যবহার করা হচ্ছে। দক্ষিণ গোলার্ধে দারিদ্র্য হ্রাস সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যা দাবির মাধ্যমে সেসব জনশ্রুতিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টাও হচ্ছে। যত দ্রুত আমরা এই সকল মিথ্যাকে পরিত্যাগ করব ততই মঙ্গল।

 

মূল প্রবন্ধটি পিপলস ডেমোক্রেসি’তে ০২ - ০৮ জুন, ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত

ভাষান্তর- অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন