পর্ব - ৬
বঞ্চনার পাহাড় ঠেলে
● ● ● ● ● ● ● ● ● ● ● ● ● ● ●
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ও পশ্চিমবঙ্গ নিবন্ধে বঞ্চনার ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী এবং অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র। তিনি বলেছিলেন,‘‘১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত ছিল। স্বাধীন ভারতের সংবিধানে সেই আর্থিক ধারাগুলির প্রায় ভোল না ফিরিয়েই যুক্ত করা হলো।’’
পশ্চিমবঙ্গে একটি অঙ্গরাজ্যে সরকার পরিচালনা করেছে বামফ্রন্ট। এরাজ্যে সঙ্কটের বিশেষ কারণও ছিল যার সঙ্গে ভারতের অন্য রাজ্যগুলিকে মেলানো যায় না। যার একটি শরণার্থী সমস্যা। সহায়তার বদলে এরাজ্যকে কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। যে কোনও সরকারেরই আয়ের তিনটি উৎস- রাজস্ব সংগ্রহ, ঋণ গ্রহণ এবং মুদ্রাস্ফীতি। শেষেরটি রাজ্য সরকারের হাতে একেবারেই নেই। ঋণ নেওয়ার অধিকার সীমিত। রাজস্ব সংগ্রহেও রাজ্যগুলি মুখ্যত নির্ভরশীল ছিল বিক্রয়করের ওপর। এখন বিক্রয়করের বদলে বেশিরভাগ পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি। পেট্রোল-ডিজেল যদিও জিএসটি’র বাইরে। বামফ্রন্ট সরকারের মেয়াদে বিক্রয়কর এবং পরে তার বদলে মূল্যযুক্ত কর চালু ছিল। কিন্তু কর বাবদ আদায়ের বড় জায়গা হলো আয়কর, বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির লভ্যাংশের ওপর কর, বা মূলধন বৃদ্ধি কর। এই ক্ষেত্রগুলিতে করের হার ঠিক করা এবং সংগ্রহের একচ্ছত্র অধিকার হাতে রেখেছে কেন্দ্র। পাঁচ বছর অন্তর গঠন করা হয় নতুন একেকটি অর্থ কমিশন। আয়কর বা অন্তঃশুল্ক বাবদ কর থেকে আদায় মোট রাজস্বের কতটুকু ভাগ সব রাজ্যগুলি পাবে সুপারিশ করে এই কমিশন। অথচ কমিশনের সুপারিশও অনুসরণ করেনি একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৮৪-তে ওই নিবন্ধ লেখার সময় মিত্র দেখিয়েছিলেন আয়কর থেকে রাজ্যগুলিকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত দেওয়ার সুপারিশ একাধিক অর্থ কমিশন করলেও তা মানা হয়নি।উদারনীতির পর্বে রাজ্যগুলির সঙ্কট আরও বেড়েছে। শুল্ক কমিয়েছে কেন্দ্র আর আয়ের উৎস কমেছে রাজ্যগুলির। বেতন কমিশন চালুর ক্ষেত্রে আর্থিক দায়ভার নেওয়ার প্রতিশ্রুতি পালন করা হয়নি। ফলে বড় দায়ভার চেপেছে রাজ্যেরই ওপর। একের এক কেন্দ্র প্রকল্প ঘোষণা করেছে। সেগুলিকে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্প। আসলে রাজ্যের ঘাড়ে জনকল্যাণ মূলক এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আয়ের উৎস কম হলেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, রাস্তাঘাটের মতো জনজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি রাজ্যকেই করতে হয়।
দেশ স্বাধীন হয়েছে, দ্বিখন্ডিত হয়েছে দেশ। পশ্চিমবঙ্গের আত্মপ্রকাশও এই সময়েই। শরণার্থীদের স্রোত পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে। দেশভাগ ছিন্নমূল করে দিয়েছে তাঁদের। অন্য যে প্রদেশটিতে শরণার্থীর স্রোত দেখা গিয়েছে তা হলো পাঞ্জাব। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শরণার্থীরা গিয়েছিলেন পাঞ্জাবে। শরণার্থীদের পুনর্বাসনে বিপুল বঞ্চনা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলার ওপর।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/02/IMG_20210216_112709.jpg)
সাংবাদিক রণজিত রায় লিখেছিলেন ‘দ্য অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’।
পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনার খতিয়ান ধরে রেখেছিলেন তিনি। সংসদে পেশ হওয়া রিপোর্টের উল্লেখ করে দেখিয়েছিলেন পাঞ্জাবে শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে চাষের জমি, দোকানঘর। অথচ পশ্চিমবঙ্গে ঠিক উলটো। ১৯৪৭ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য কেন্দ্রের সরকারের মাথাপিছু ব্যয় যত ছিল তার পাঁচভাগের একভাগও এরাজ্যের জন্য বরাদ্দ হয়নি।এরাজ্যকে শিল্পে পিছিয়ে দিয়েছে ১৯৫৬ থেকে চালু মাশুল সমীকরণ নীতি। কেবল পশ্চিমবঙ্গই নয় পূর্ব ভারতের শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা নষ্ট হয়েছে এই নীতিতে। ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে।
অশোক মিত্র লিখছেন, ‘‘রানীগঞ্জ থেকে রেলে চাপিয়ে কয়লা আনা যায় না দুর্গাপুরে, অত কম দূরত্বের জন্য ওয়াগন দিতে রাজি নয় রেল কর্তৃপক্ষ। ট্রাকে চাপিয়ে কয়লা আনতে হয়, মাশুল বেশি পড়ে, পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত শিল্পস্থানগুলিতে কয়লার ব্যবহারে অতএব খরচ অপেক্ষাকৃত বেশি।’’
অথচ পশ্চিমবঙ্গের কয়লা দূর-দূরান্তে চলে যায় অথচ এই রাজ্যেই দাম বেশি। অন্য রাজ্যে কম। মাশুল সমীকরণ নীতিতে সারা দেশেই লোহা ও ইস্পাতের দাম এক। তিনি লিখছেন,‘‘যন্ত্রপাতি তৈরি করার কারখানা যদি খুলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে সেই কারখানা খোলার বাড়তি আকর্ষণ নেই। দেশের যে কোনও অঞ্চলেই খোলা যেতে পারে, দাম এক পড়বে, কিংবা বরং পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে একটু কমই পড়বে, ভৌগলিক সুবিধা কেন্দ্রীয় ফতোয়া দিয়ে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।’’
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/02/IMG_20210216_112830.jpg)
উদারনীতি চালু হওয়ার পর মাশুল সমীকরণ এবং লাইসেন্স দেওয়ার নীতি রদ করা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিট বন্ধও করে দেওয়া হতে থাকে। রাজ্যের অন্যতম উৎপাদন ক্ষেত্র চটকল। পেট্রোলিয়াম লবির সুবিধা করে দিতে সরকারি কাজে চটের বস্তার ব্যবহার সমানে কমানো হয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে এই বঞ্চনার সঙ্গে লড়ে রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনা তৈরি করতে হয়েছে বামপন্থীদের। তীব্র বঞ্চনার মধ্যে এগতে হয়েছে বামফ্রন্ট সরকারকে। কেন্দ্রে যারা বঞ্চনার নীতির শরিক এরাজ্যে বিরোধী আসনে বসে তারাই রাজ্যকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী করে গিয়েছে বামফ্রন্ট সরকারকে। শিল্প নিয়ে আলোচনা হলেই শুনতে পাবেন এরাই বলছে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের জন্য এরাজ্যে আসেনি শিল্প। এই চরম মিথ্যাকে ফাঁস করে দেওয়া কেবল রাজনৈতিক কারণে জরুরি তা নয়, রাজ্যের জন্যও তা প্রয়োজন।