বিকল্প ও উন্নততর ভাবনা (পঞ্চায়েত: গ্রামের সরকার ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো’) - শুদ্ধস্বত্ব গুপ্ত

৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার

পর্ব ৩

পঞ্চায়েত: গ্রামের সরকার ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো’


গোড়ার দিন থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল গ্রামাঞ্চলে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ছাড়া বামফ্রন্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রথম ভিত্তি ছিল ভূমিসংস্কারই। আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের ভিত্তিই ছিল এই পদক্ষেপ। কিন্তু তার সঙ্গে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠারও দরকার ছিল।

লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল উন্নয়নে মানুষকে যুক্ত করার। বামপন্থী আন্দোলনের কাছে তার মানে ছিল দু’টি। এক, মেহনতী মানুষ যুক্ত হবেন পরিকল্পনায়। যুক্ত হবেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে। দুই, আমলাতন্ত্র এবং গ্রামের প্রতিপত্তিশালীরা নীতি ঠিক করে দেবেন না। গ্রামের সরকার চালাবেন গ্রামের মানুষই। রাজনৈতিক লক্ষ্যটি সূচনার পর্বেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। বলে দিয়েছিলেন যে কেবল রাইটার্স বিল্ডিং থেকে চলবে না সরকার। গ্রাম এবং শহরে মেহনতী সাধারণ মানুষই সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করবেন। পঞ্চায়েত সেই শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিকেই স্পষ্ট করেছে। এ কাজ সহজ ছিল না। গ্রামে প্রতিপত্তিবান শ্রেণিগুলি সে কাজে বাধা দেবে জানা ছিল। বাধা এসেছে বিভিন্ন সময়। ফলে বিকেন্দ্রীকরণের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে শ্রেণি সংগ্রামের প্রশ্ন।



ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পঞ্চায়েতের সাফল্য ছাড়া ভূমিসংস্কারের সাফল্য রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। কোন গ্রামে কত জমি খাস হয়েছে, আর কতটা করা সম্ভব, ঠিক কাদের কাছে সেই জমি যাওয়া জরুরি- মহাকরণ থেকে এমন খুঁটিনাটি জানা সম্ভব ছিল না। এখনও নয়। কিন্তু তৃণমূল সরকারের সময়ে গ্রামের সরকারকে ঠুঁটো করে দেওয়া হয়েছে। সে কারণেই ভোটের আগে স্লোগান দিতে হচ্ছে দুয়ারে সরকার। বিকেন্দ্রীকরণ কেবল গ্রামেই হয়েছে এমন নয়। হয়েছে শহর এলাকাতেও। এখন যেমন চলছে, মেয়াদ অনুযায়ী ভোট না করে ‘প্রশাসক’ পদে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে সরকারি আধিকারিকদের।

সাংবাদিক অঞ্জন বসু লিখছেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ১৯৭৬-৭৭ সালের গ্রামবাংলা আর ওই সরকার বিদায় নেওয়ার সময় ২০১১ সালের গ্রামবাংলাকে যে মেলানো যায় না, তার বদল ঘটেছে অনেক, নতুন প্রজন্মের মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারছেন কতটা? এই যে গ্রাম বাংলায় এত কাজ হচ্ছে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে, পঞ্চায়েতকে নিয়ে চলছে চারদিকে এত হইচই, তা যে বামফ্রন্ট সরকার আসার আগে ছিলই না, তাও বা কত মানুষ মনে রেখেছেন?... পাঁচ বছর অন্তর অন্তর লোকসভা, বিধানসভার মতো নিয়মিত পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে, শহরে শহরে হচ্ছে পৌরসভার ভোট- তাও তো আগে এমন ছিল না।’’ (‘বাংলায় বামেরা, রাজপথে ও রাজ্যপাটে- ১৯৭৭ থেকে ২০১১’) কারা চালাতেন পঞ্চায়েত? ১৯৭৮ সালে হয় প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন। তারপর ১৯৭৯-তে একটি সমীক্ষা হয়। দেখা যায় যে শ্রমজীবী কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর, বর্গাদার, গ্রামীণ কারিগর বা শিক্ষকদের মতো খেটে খাওয়া অংশ থেকেই নির্বাচিত ৮০ শতাংশের বেশি। শ্রমজীবী কৃষকদের মধ্যে আবার ৭১ শতাংশই হলেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক।

এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে পঞ্চায়েতের গঠনে শ্রেণিচরিত্র বামপন্থী আন্দোলনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হয়েছে। আত্মসমালোচনা করতে কসুর করেননি বামপন্থী নেতৃত্ব। ২০১৫-তে সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৪ তম সম্মেলন থেকে গৃহীত বামফ্রন্ট সরকারের পর্যলোচনা দলিলে বলা হলো: ‘‘কিছু কিছু জায়গায় শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির বদলে সংকীর্ণ দলীয় মানসিকতার বিস্তার, স্বজনপোষণ এবং কম হলেও দুর্নীতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়িয়েছে।’’ ত্রুটি নিশ্চয় ছিল। তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল আন্তরিকতা। বামফ্রন্ট সরকার পঞ্চায়েতের দায়িত্বের পরিধি সমানে বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। পরিচালনায় সক্ষমতা আনতে বাজেট থেকে সরাসরি বরাদ্দ হতো পঞ্চায়েতে। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ- এই তিন স্তরের মাধ্যমে সরকারের ৩৫ শতাংশ টাকা খরচ হতো। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের নীতিতে গ্রাম পঞ্চায়েতের নিচেও উন্নয়ন পরিকল্পনা নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল। ১৯৯২ সালে চালু হয় গ্রাম সংসদ। নির্বাচিত পঞ্চায়েত তো বটেই, গ্রামের অন্যরাও যাতে অংশ নিতে পরেন। সেই সঙ্গে চালু হয় পঞ্চায়েতে সংরক্ষণও। মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতে ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ চালু করে বামফ্রন্টই। সারা দেশে নজির এই সিদ্ধান্তেও। পরে মহিলাদের জন্য ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ কার্যকর করা হয়। তফসিলি জাতি এবং আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণ ছিলই। সপ্তম বামফ্রন্টের সময় অন্য অনগ্রসর অংশ (ওবিসি) সংরক্ষণ চালু হয়। মনে হতে পারে এমন তো সারা দেশেই হয়। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার যখন একাজ শুরু করেছে, বা বিস্তার করছে তখনও দেশে সংবিধানের সংশোধন হয়নি। এমনকি গ্রাম সংসদ চালু হওয়ার পর হয় সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনী। ১৯৮৯ সালে কলকাতায় পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের পঞ্চায়েতীরাজ সম্মেলনের উদ্বোধন করতে আসেন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী। এই কংগ্রেস নেতাকে স্বীকার করতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সারা দেশের মডেল।


এখন আমফানে ধরা পড়ে গিয়েছে দুর্নীতির দৌরাত্ম্য, জনরোষের মুখে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে তৃণমূলের নেতাদের। জনতা ঘিরে রাখছেন পঞ্চায়েতের দপ্তর, ক্ষতিপূরণের ন্যায্য দাবি আদায়ে। পরিস্থিতি এতই সঙ্গিন যে সংবিধান সম্মত হিসাব পরীক্ষক প্রতিষ্ঠান দেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের নজরদারি ঠেকাতে হাইকোর্টে লড়ে যাচ্ছে রাজ্যের সরকার। বামফ্রন্টের সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় গণউদ্যোগ জড়ো করার হাতিয়ার হয়েছে নির্বাচিত পঞ্চায়েত এবং পৌরসভা। বিকেন্দ্রীকরণের ফল বোঝা গিয়েছিল ১৯৭৮’র বিধ্বংসী বন্যা মোকাবিলায়। তারপরও প্রতি বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন মানুষের পাশে থাকতে পেরেছে পঞ্চায়েত। বন্যা মোকাবিলায় মরণপণ লড়াই চলছে, এমন একটি পর্বে তৃণমূলনেত্রী, সে সময়ে বিরোধী নেত্রীও, ‘ম্যানমেড বন্যার’ তত্ত্ব দিয়েছিলেন। জনতাকে ক্ষমতা দেওয়া আর নীতির অংশীদার করার এমন অবজ্ঞা ধরা পড়ছে আজকে গ্রামের দিকে তাকালে।



শেয়ার করুন

উত্তর দিন