বিকল্পের লক্ষ্যে : শান্তনু দে ...

১২ ডিসেম্বর,২০২০ শনি বার

কেরালা পারে, বাংলা পারে না

গোটা দেশে এই প্রথম, ১৬টি কৃষিপণ্যের ন্যূনতম দাম ঘোষণা।

কেরালা পারে। বাংলা পারে না। দেশ পারে না।

উৎপাদন খরচের সঙ্গে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ জুড়ে সবজি, ফল, কন্দজাতীয় ফসল সহ ষোলটি কৃষিপণ্যের ন্যূনতম দাম ঘোষণা করেছে কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সরকার। বাজারে ফসলের দামের অস্থিরতা থেকে কৃষককে বাঁচাতেই এই পরিকল্পিত পদক্ষেপ। ফসলের দাম পডলে কৃষকদের মধ্যে বাড়ে অভাবী বিক্রি। কমদামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন কৃষকরা। অনেক সময় চাষের খরচটুকু পর্যন্ত ওঠে না। ঋণের জালে জড়িয়ে শেষে আত্মহত্যা। এই বিপন্নতা থেকে তাঁদের রক্ষা করতেই পিনারাই বিজয়ন সরকারের এই উদ্যোগ।

কেরালা পারে, বাংলা পারেনা, দেশ পারে না....


এই মুহূর্তে, কেন্দ্রের ঘোষণায় প্রতি কুইন্ট্যাল ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ১,৮৬৮ টাকা। আর একই দেশের মধ্য কেরালায় তা ২,৬৩০ টাকা।

কেন্দ্র যখন কৃষিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চাইছে, কৃষকের জন্য জারি করেছে মৃত্যু পরোয়ানা, যখন অবাধ বাজারে অসহায় কৃষক, তখন কেরালা কৃষকদের নিরাপত্তায় তৈরি করছে ফার্মাস ওয়েলফেয়ার ফান্ড বোর্ড।

এক বামপন্থী বিকল্প। দেশের মধ্যে এই প্রথম।

আর এতে থাকছে কৃষকদের জন্য ষাট বছর অতিক্রম করার পর পেনশনের ব্যবস্থা। যাঁরা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত, তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, কিংবা বিয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা এবং দুর্ঘটনা, বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ। কোনও কৃষক তাঁর দেয় অংশ পাঁচ বছর দেওয়ার পরে মারা গেলে, তাঁর পরিবার পাবে সেই পেনশন। স্বাস্থ্যের কারণে কোনও কৃষক আর চাষ করতে না পারলে, ৬০-বছর পর্যন্ত তিনি পাবেন পেনশন। কৃষি যাঁদের অন্তত তিন বছরের জন্য আয়ের উৎস, তাঁরা এই বোর্ডে অনায়াসে নাম নথিভূক্ত করতে পারবেন। ১৮-৫৫ বছরের কৃষককে পাঁচ সেন্ট (এক সেন্ট মানে এক একরের একশভাগের একভাগ) ১৫ একর পর্যন্ত নিজের জমি বা লিজের জমি থাকলেই হবে।

গোটা দেশে এই প্রথম কেরালা, ১৬টি কৃষিপণ্যের ন্যূনতম দাম ঘোষণা।
ছবি : The Hindu


বাংলা পারে না। দেশ পারে না। কেরালা পারে।

কেন্দ্রের কৃষি কৃষক-বিরোধী তিনটি কৃষি আইন রাজ্যে রূপায়ন করবে না কেরালা। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

অন্যদিকে, মোদীর ছ’বছর আগেই ‘কৃষিপণ্যের বাজারে বৃহৎ পুঁজির’ লক্ষ্যে আইন বদল করেছেন মমতা। আজ ভোটের মুখে মমতা ‘কৃষকদরদী’ সাজতে মায়াকান্না জুড়লেও, ‘ঘটনা হল, মাঠে ফসল থাকাকালীনই বেসরকারি সংস্থা যাতে চাষিদের কাছ থেকে তা কিনে নিতে পারে, সে জন্য ২০১৪ সালে আইন পাশ করেছে তৃণমূল সরকার। খুলে দিয়েছে কৃষিপণ্যের বাজারে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশের পথ। ২০১৭ সালে একটি সংশোধনী এনে কৃষিপণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য এবং বিপণনও বৈধ করা হয়।’

চুক্তি চাষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেরালা ব্যবহার করতে চাইছে কুদুম্বাশ্রী-র মতো বিকল্প। কর্পোরেট আগ্রাসন মোকাবিলায় সমবায় উদ্যোগ। ইতিমধ্যেই সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলির নজরকাডা সাফল্যের মডেল তৈরি করেছে কেরালা, স্থানীয় কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পান, তার জন্য যারা সহায়তা করছে।



মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী কুদুম্বাশ্রী নেটওয়ার্কে রয়েছে ৪৪ লক্ষ সদস্য, রয়েছে ২.৯ লক্ষ মহল্লা কমিটি। কোভিডের সময় স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ১,১২৫টি কমিউনিটি কিচেন চালিয়েছে এই কুদুম্বাশ্রী। অভাবী মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে ২০ টাকায় খাবার।

বিজ্ঞান-ভিত্তিক কৃষিকাজের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকীকরণের মধ্যে দিয়ে কৃষির বৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে কেরালা। নিয়েছে ৩,৮৬০ কোটি টাকার সুবিকশা কেরলম কর্মসূচী, যা আসলে কোভিড-উত্তর পুনরুদ্ধার প্যাকেজের মূল উপাদান। লক্ষ্য কৃষি, প্রাণীসম্পদ বিকাশ, মাছচাষ, দুগ্ধ উৎপাদনকে জডিয়ে খাদ্য উৎপাদনের আরও প্রসার।

কেরালা পারে। বাংলা পারে না। দেশ পারে না।

দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি কেরালায়। ন্যূনতম মজুরি দিনে ৬০০ টাকা।

ভূবনেশ্বরে মঞ্চেশ্বর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে একজন ওস্তাগর যেখানে মাসে পান ছ’হাজার টাকা, মানে দিনে ২০০ টাকা, কেরালায় সেখানে একজন অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ৭০০ টাকা। আর ছুতোর, রাজমিস্ত্রির মতো দক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ১,০০০ টাকার ওপরে। তিরুবনন্তপুরমে একজন ছুতোরের মজুরি মধ্য প্রদেশের ভোপালের চেয়ে তিন-গুণ বেশি।

কিংবা উত্তর প্রদেশের বারানসী, অথবা গুজরাটের কোটার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। সুরাটে একজন হীরে শ্রমিকের দিনে মজুরি মেরেকেটে ৩০০-৪০০ টাকা।

পশ্চিমবঙ্গে একজন অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি দিনে ৩২৯ টাকা, আর দক্ষ শ্রমিকের ৩৯৮ টাকা।



কেন বাংলায় কাজ না পেয়ে শ্রমিক বোঝাই একের পর এক ট্রেন কেরালায় যায়, তা নবান্নের কাছেও স্পষ্ট। যদিও কেরালা তাঁদের ‘পরিযায়ী’ শ্রমিক হিসেবে দেখে না। দেখে অতিথি-শ্রমিক হিসেবে।

এই কেরালাতেই প্রথম, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কল্যাণকর প্রকল্প। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ‘আওয়াজ’, যা সম্প্রতি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। ভাষা-ভিত্তিক শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহ করে সেখানে তাঁদের সাহায্যের জন্য পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট ভাষার দক্ষ স্বেচ্ছাসেবকদের। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য রয়েছে ‘আপনা ঘর’ প্রকল্প।

কেরালা পারে। বাংলা পারে না। দেশ পারে না।

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কল্যাণকর প্রকল্প। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ‘আওয়াজ’,প্রকল্প উদ্বোধন করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী কে কে শৈল্যজা


কেরালায় রয়েছেন প্রায় ৪০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের সঙ্গে প্রতি বছর নতুন করে যোগ দেন ২ লক্ষ ৪০ হাজার শ্রমিক। ২০১৬’তে এক সমীক্ষায় এই তথ্য জানিয়েছে গুলাটি ইনস্টিটিউট অব ফিনান্স অ্যান্ড ট্যাক্সেশন। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের বছরে মিলিত আয় ২৫,০০০ কোটি টাকা। যার তিনভাগের দু’ভাগ তাঁরা পাঠান নিজেদের রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার এবং উত্তর প্রদেশে।

গত ছ’বছরে কেরালার ন্যূনতম মজুরি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। সাড়ে তিনশ’ টাকা থেকে ৭০০ টাকা।

কেরালা পারে। বাংলা পারে না। দেশ পারে না।



"*""*""*""*""*""*""*""*""*""*""*"

""*""*""*""*""*""*""*""*""*""*""*


ধারাবাহিক চলবে ....

আগামী পর্বের বিষয় : বিহারে আসলে জয়ী আমজনতার ইস্যু ....







শেয়ার করুন

উত্তর দিন