বিকল্পের লক্ষ্যে - শান্তনু দে ...

১১ ডিসেম্বর ২০২০, শুক্রবার

কেরালা, বিকল্পের বাতিঘর

করোনা মোকাবিলায় কেরালার সাফল্য কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

কেরালার এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি। কেরালার সাফল্যের নেপথ্যে আসলে এক বামপন্থী বিকল্প। এই ভারতে কেরালাই একমাত্র রাজ্য, যারা উন্নয়নের নয়া উদার পথের বিপরীতে হাঁটতে চাইছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে করে চলেছে বিকল্পের অনুশীলন।

সংবিধানে রাজ্যের হাতে সীমিত ক্ষমতা। তার উপর ১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি চালুর পর থেকে কোনও রাজ্যের পক্ষে বিকল্প অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলা খুবই কঠিন। কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য না করার মনোভাব, ঋণের সীমা ছাঁটাই করা, জিএসটি রূপায়নে লোকসানের জন্য ক্ষতিপূরণে বিলম্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ব্যাহত হচ্ছে কেরালার অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তবু রাজ্যের বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ সুনিশ্চিত করে চলেছে। যার সুফল পৌছে যাচ্ছে প্রত্যেকের কাছে।



নয়া উদার-সাম্প্রদায়িক জমানার বিপরীতে কেরালা দেখিয়ে চলেছে এক বিকল্প মডেল। ঐক্য-সংহতির মিশেলে এক জনমুখী নীতি, যাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে। বেসরকারিকরণের মোকাবিলার সঙ্গে জোর দেওয়া হচ্ছে জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, সরকারি ক্ষেত্র এবং সমবায়ের উপর। বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন, তার ক্ষমতায়নই কেরালার বিকল্প মডেলের হাতিয়ার। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যা রাজ্যের উন্নয়নের নেপথ্যে, তা হলো সমবায় প্রতিষ্ঠান। সহযোগিতা ও সমবায়ই হলো কেরালার শক্তি। কেরালার স্বাধীনতা সংগ্রামের সোনালী উত্তরাধিকার। এইসব প্রতিষ্ঠানের উপর রয়েছে মানুষের আস্থা। আজ এই প্রতিষ্ঠানগুলিই গ্রামীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মেরুদন্ড। এই সরকারের অন্যতম সাফল্য হলো কেরালা ব্যাঙ্ক তৈরি করে সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও শক্তিশালী করা। যা হতে চলেছে রাজ্যের বৃহত্তম ব্যাঙ্কিং নেটওয়ার্ক।

গত চার বছর একের পর এক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হয়েছে কেরালাকে। ২০১৭: অক্ষি ঘূর্ণিঝড়। ২০১৮: নিপা ভাইরাস— সংক্রমণ দেখা দেয় মূলত কেরলের দু’টি জেলায়। আক্রান্ত উনিশ জনের মধ্যে সতেরো জনকেই বাঁচানো যায়নি। তবে সংক্রমণকেও আর ছড়াতে দেওয়া হয়নি। দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রাতারাতি যোগাযোগ করার। সেদিন সদ্য আবিষ্কৃত অ্যান্টিবডির সাহায্যে হারানো সম্ভব হয় নিপাকে। এই কাজ কোনও কড়া লকডাউনে বাস্তবায়িত হয়নি। হয়েছিল মানুষকে বুঝিয়ে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে। মানুষের সমর্থনে। ওই বছরই রাজ্যে বিধ্বংসী বন্যা। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। যার ক্ষত এখনও পুরো শুকোয়নি। ২০১৯: আবার বন্যা। শেষে ২০২০: কোভিড।



আর এই সমস্ত সঙ্কটে সরকার ছিল মানুষের পাশে। আর মানুষ, সরকারের সঙ্গে। কেরালা ভরসা রেখেছিল সরকারি সংস্থা আর মানুষের অংশগ্রহণের উপর। সরকার দেখায় দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার ও ত্রাণের কাজে এক ব্যতিক্রমী সক্ষমতা। দ্রুততার সঙ্গে পরিকল্পনা। সঙ্কট মোকাবিলায় জনমুখী পদক্ষেপ। বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন এত নিখুঁতভাবে তা করেছে যে প্রতিটি সঙ্কটই পরিণত হয়েছে সম্ভাবনায়। যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের হলমার্ক।

কেরালার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক ভালো, কেউই তা অস্বীকার করতে পারবেন না। নীতি আয়োগের স্বাস্থ্য সূচকে কেরালা রাজ্যগুলির মধ্যে একেবারে শীর্ষে। আসলে কয়েকদশক ধরে কেরালায় তৈরি হয়েছে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আরদ্রান মিশনের মাধ্যমে এই সরকারের সম্মিলিত প্রয়াস একে আধুনিক করেছে। আরও সম্প্রসারণ করেছে।

Kerala Health Minister KK Shailaja is among the most recognised faces of 2020


ছাঁটাই, আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় কোভিড ও লকডাউন সত্ত্বেও সাড়ে ৩ কোটি জনসংখ্যার কেরালা রেগায় তৈরি করেছে ১ কোটি ৩২ লক্ষ শ্রমদিবস। এর মধ্যে ১ কোটি ২৬ লক্ষ গ্রামে। ৫ লক্ষ ৩৩ হাজার শহরে। এই সময়ে রেগাকে যুক্ত করেছে উৎপাদন ক্ষেত্রের সঙ্গে। পরিখা খনন, সেচ, মাছচাষ ও নির্মাণে। একটি বাড়ি থেকে এখন একজনের বেশি আবেদন করতে পারেন জব কার্ডের জন্য (মাথরুভূমি, ২০ জুলাই)।

জোর দেওয়া হচ্ছে সরকারি সংস্থার ওপর। গত ইউডিএফ সরকারের সময় মিলিত লোকসানের পরিমাণ ছিল ২১৩ কোটি টাকা। বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রথম দু’বছরেই লোকসান কাটিয়ে মুনাফার পরিমান দাঁড়ায় ১০৬.৯১ কোটি টাকা।

ওয়েলফেয়ার পেনশন দেওয়া হয় রাজ্যের ৫৮.৫ লক্ষ মানুষকে। পেনশনের টাকা ৬০০ টাকা থেকে দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩০০ টাকা। জানুয়ারি থেকে তা আরও বাড়িয়ে করা হবে ১৫০০ টাকা। এই খাতে এখনও পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়েছে ২৩,৪০৯ কোটি টাকা। যেখানে আগের ইউডিএফ সরকার করেছিল ৯,২৭০ কোটি টাকা। নিরাশ্রয়দের জন্য রয়েছে আবাসন প্রকল্প। মে মাস পর্যন্ত ২,১৯,১৫৪টি বাড়ি তৈরি করে তুলে দেওয়া হয়েছে নিরাশ্রয় মানুষের হাতে।

ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসের সাম্প্রতিকতম হিসেবে সাক্ষরতার হারে কেরালা আবারও শীর্ষে। সাক্ষরতার হার ৯৬.২ শতাংশ। দ্বিতীয় দিল্লি, ৮৮.৭ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ ৮০.৫ শতাংশ।

কেরালাই প্রথম, সমস্ত সরকারি স্কুলে এখন হাইটেক ক্লাসরুম। রাজ্যের ১৬,০৩০টি স্কুলে এখন ৩ লক্ষের ডিজিটাল সামগ্রী। ল্যাপটপ, মালটিমিডিয়া প্রজেক্টর, এলইডি টিভি এবং ১২ হাজারের বেশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ। সমস্ত ক্লাসরুম আন্তর্জাতিক মানের। রয়েছে হাইটেক আইডি-ল্যাব। প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলে অন্তত একটি স্মার্ট ক্লাসরুম। ডিজিটাল শিক্ষার জন্য ১,৮৩,৪০০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ।

মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের কথায়, একটি বামপন্থী বিকল্প। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য শিক্ষার কেরালা মডেল। সমস্ত শিশুর কাছে আধুনিক শিক্ষার সমান সুযোগ।

ক্লাবকে টাকা না। পুরোহিত ভাতা, কিংবা ইমাম ভাতা নয়। এক হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী রয়েছে, এমন স্কুলকে পরিকাঠামো উন্নয়নে ৩ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা। আর সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত স্কুলের জন্য এক কোটি টাকা। এই কাজের দায়িত্বে কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড টেকনোলজি ফর এডুকেশন (কেআইটিই)। আর্থিক সহায়তায় কেরালা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বোর্ড (কেআইআইএফবি)।



কেরালাই একমাত্র রাজ্য, যেখানে এক বিপরীত প্রবণতা: গত তিন বছরে ৫ লক্ষ নতুন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়েছে সরকারি স্কুলে। একসময় সরকারি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে ছিল আলোচনা। কিন্তু গত ক’বছরে আধুনিক ব্যবস্থাসহ সেগুলিকে উৎকর্ষ কেন্দ্রে উন্নীত করায় এখন বদলে গিয়েছে আলোচনা, বাড়ছে মানুষের আগ্রহ।

ধারাবাহিক চলবে....

আগামী পর্বের বিষয় : কেরালা পারে, বাংলা পারে না।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন