Adani 2

আদানিঃ জালিয়াতি, তছরুপ ও সরকারী সমর্থন জুটিয়ে নেওয়ার এক অভূতপূর্ব কাহিনী (২য় পর্ব)

নীলোৎপল বসু

ইউপিএ সরকার আদানি গোষ্ঠীর ২০০ কোটি টাকার জরিমানা নির্ধারণ করেছিল, তখন ২০১২ সাল। কেন? কারণ মুন্দ্রা বন্দর এলাকার উত্তরাংশের (নর্থ পোর্ট) জমি দখল করে সেজ নির্মাণ করতে গিয়ে তারা ঐ এলাকার স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে দিয়েছিল। মোদীর নেতৃত্বে তৎকালীন গুজরাট সরকার তখনও আদানির পাশে দাঁড়িয়ে যায়- প্রমাণ হয় প্রকৃতির ধ্বংস মেনে নিতে পারলেও তিনি বন্ধুর ক্ষতি মেনে নিতে রাজী নন।

প্রধানমন্ত্রীর আসনে মোদী বসেন ২০১৪ সালে, বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে তার ভূমিকা সেই থেকেই নতুন ইতিহাস নির্মাণ করতে শুরু করে। মোদী’কে বিজেপি নিজেদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী বলে চিহ্নিত করলে তখনই আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দাম একধাক্কায় ৬৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০০১ সালে তাদের বার্ষিক আয় (টার্নওভার) ছিল ৩৭৪১ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪ সালে সেই আয় বেড়ে ৭৫,৬৫৯ কোটিতে পৌঁছে যায়।

মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী অবধি মোদীর উত্থানে কারোর যদি বাড়তি আগ্রহ থাকে তবে একথাও নিশ্চিত এই গোটা পর্ব জুড়ে আদানি-মোদী’র সহযোগীতার প্রসঙ্গটিও তার নজর এড়িয়ে যেতে পারবে না।

মোদী আদানির স্বার্থরক্ষা করেছেন নানাভাবে। প্রথমেই যে দিকে নজর দিতে হয় তা হল শিল্পস্থাপনে পরিবেশ রক্ষার যাবতীয় বিধিনিষেধের কারণে আদানিকে আগে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মোদী সেইসব বাধা উড়িয়ে দিয়েছেন। মুন্দ্রা প্রকল্পের জরিমানা খারিজ হয়ে যায়। ছত্তিশগড়ে আদানিদের কয়লা খনি প্রকল্পে সেখানাকার স্থানীয় আদিবাসীদের পুনর্বাসনের প্রসঙ্গে যতটুকু সরকারী বাধা ছিল সেইসবও অচিরেই নস্যাৎ হয়ে যায়।

এর পরেই রাষ্ট্রায়ত্ব আর্থিক সংস্থাকে দিয়ে আদানি গোষ্ঠীর হাতে পয়সার যোগানটুকু নিশ্চিত করার কাজটি সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে প্রথম বলির পাঁঠা হয়েছিল এসবিআই (স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া)। মোদী শাসন তাদের বাধ্য করে ক্যুইন্সল্যান্ডে আদানিদের কয়লা খনি প্রকল্প উপলক্ষে ১ বিলিয়ন ডলারের মৌ (চুক্তি) সাক্ষর করতে। ঐ চুক্তির বলে আদানিরা ক্যুইন্সল্যান্ডে কয়লাখনি, রেললাইন ও একটি বন্দরের বরাত পেয়ে যায়। অনেকেই আশংকা প্রকাশ করেছিলেন এই প্রকল্পের ফলে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের পরিবেশে কুপ্রভাব পড়বে। সেই আশংকা থেকেই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থাগুলি আদানিদের সাথে ঋণ সংক্রান্ত কোনওরকম চুক্তিতে রাজী ছিল না। শেষ অবধি প্রকল্পটির বিরোধিতায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন বিরোধিতা হয় যে গোটা পরিকল্পনাই খারিজ হয়ে যায়। এসবিআই’র সাথে চুক্তিটিরও সলিল সমাধি ঘটে।

সেন্ট্রাল বোর্ড অফ অফ ইন্ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের অধীনে কাজ করে ডিরেক্টরেট অফ রেভিন্যু ইন্টেলিজেন্স বা ডিআরআই। তারা অনুসধান করে জানায় আদানি গোষ্ঠী বিদেশ থেকে আমদানি করা মূলধনী বিনিয়োগের বাজারদর বাড়িয়ে (ওভার ভ্যালুয়েশন) দেখাচ্ছে। ২০১৩ সালে ডিআরআই’র পেশ করা প্রতিবেদনে ছিল আদানিরা বিনিয়োগের নাম করে প্রায় ২৩২২.৭৫ কোটি টাকা স্রেফ মেরে দিয়েছে। ক্ষমতায় এসেই মোদী সরকার সেই প্রতিবেদনটিকে কবরে পাঠিয়ে দেয়।

এখনই অধৈর্য হবেন না! আদানিদের বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ সংক্রান্ত মূল অভিযোগটির উল্লেখ এখনও বাকি রয়েছে। সেই অভিযোগ আদানির কর্মদক্ষতার পরিচয় দেয় না, তুলে ধরে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত নজরদারির কাজে নিয়ামক সংস্থাগুলির অনেক কিছু জানা সত্বেও হাত গুটিয়ে বসে থাকার কাহিনী। নিয়ামক সংস্থা কারা? সেবি (সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া) এবং কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স। এরা অনেক আগেই জানিয়েছিল আদানিদের ব্যবসায় কারচুপির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এমনই প্রখ্যাত একজন হলেন বিনোদ আদানি। এরই অধীনে মরিশাসে ৩৮টি ভুয়ো কোম্পানি (বাজারের ভাষায় যাদের শেল কোম্পানি বলে) সক্রিয় থেকেছে- এধরণের কোম্পানিগুলি আদানিদের শেয়ার কেনা ব্যাতিত অন্য কোথাও একটি পয়সাও বিনিয়োগ করেনি, এদের বেশিরভাগেরই ব্যবসা সংক্রান্ত সঠিক কাগজপত্রটুকুও নেই, এমনকি একাধিক কোম্পানির ঠিকানা অবধি এক। শুধু মরিশাসই নয়, সাইপ্রাস, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সিঙ্গাপুর ও ক্যারিবিয়ান দ্বিপপুঞ্জেও একইরকম একাধিক কোম্পানির হদিশ মিলেছে। আসলে এইসব ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমেই আদানিরা নিজেদের ব্যবসাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাজারে হাজির করত। সহজ কথায় একে শেয়ারে কারচুপি (স্টক মার্কেট ম্যানিপুলেশন) বলে।

কর্পোরেটরা ব্যবসা খাতিরে অনেক কিছুই করে থাকেন! তাহলে সবার থেকে আলাদা করে আদানিদের প্রসঙ্গে এতো কথা বলার কারণ কি? এরা ব্যবসার খাতিরে পুঁজির জন্য একের পর এক বিরাট অংকের ঋণ নেন, কিন্তু কিছুতেই একটি পয়সাও চুকিয়ে উঠতে পারেন না! ঋণ পেতে বাজারের কিছু নিয়ম রয়েছে। এধরণের আর্থিক লেনদেনে কারেন্ট রেশিও হিসাব করেই ঋণ গ্রাহ্য হয়। আরও আছে, তাকে পিই রেশিও বলে। পিই মানে প্রাইস টু আর্নিংস রেশিও। সোজা কোথায় কোনও একটি স্টকের শেয়ারের দামের সাথে শেয়ার প্রতি আয়ের অনুপাত। আদানি গোষ্ঠীর ৭টি কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিতেই সেই পিই রেশিওর অবস্থা তথৈবচ- একেরও কম। পাবলিক সংস্থার তকমা ধরে রাখতে গেলেও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, দেখা যাচ্ছে পাবলিক বলে-টলে এরা প্রায় গোটা ব্যবসাটাই নিজেদের পরিবারের সদস্যদের নামে করে রেখেছেন। এই কারনেই একটি সংস্থা থেকে আরেকটিতে লগ্নী করলেই হয় না, নিজেদেরই টাকা এক ঘটি থেকে আরেক ঘটিতে ঢেলে আদানিরা যাকিছু করেছেন শেয়ার বাজারের নিয়ম অনুযায়ী সেই কাজ গর্হিত অপরাধ, একেই ইন্সাইডার ট্রেডিং বলে। বিনিয়োগকারী নিজের বিচারবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে টাকা খাটালে অপরাধের কিছু না, কিন্তু বাইরের বিনিয়োগকারী পরিচিতি দেখিয়ে আসলে নিজেরাই নিজেদের শেয়ার বার বার কেনাবেচা করে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে নেওয়া কার্যত জালিয়াতি। আদানিরা সেটাই করেছেন।  এর সবটাই হয়েছে বহির্দেশিয় বিনিয়োগের নামে (অফশোর ইনভেস্টমেন্ট)- সেবি অন্তত এক দশক ধরে আদানিদের ব্যবসায় বিনিয়োগের খতিয়ান রেখেছে, সেই থেকেই এসব বোঝা যাচ্ছে। বাইরের দেশ থেকে যারা আদানির ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিল তাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট রয়েছে – এরা প্রায় সকলেই আর কোথাও বিনিয়োগ করেনি- করে না। নিজেদের মূলধনের প্রায় ৯০ শতাংশই এরা আদানিদের হাতে তুলে দিয়েছে। দুনিয়ার কোথাও এমন হয় না। আর্থিক বিনিয়োগের প্রসঙ্গে আদানিদের জালিয়াতি মূলক কর্মকাণ্ড এমন বিরাট চেহারা নিয়েছে যে আদানিদের জালিয়াত বলতে কোনও বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় না। অথচ তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বলতে প্রায় কিছুই নেওয়া হয়নি- কারণ স্পষ্ট! কিছু না করতে উচ্চ মহলের চাপ রয়েছে।

দুনিয়াজুড়ে উগ্র-দক্ষিণপন্থার উত্থান

আজকের পৃথিবীতে দক্ষিণপন্থার অনুকূলে বিরাট রাজনৈতিক শক্তিধর বলতে কাদের বুঝতে হবে? বরিস জনসন, নাইজেল ফারাজ, ডোনাল্ড ট্রাম্প, জাইর বলসেনারো কিংবা রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান- এরাই তো উগ্র দক্ষিণপন্থার মুখ। প্রশ্ন হল যে সমস্ত দেশে এই মুখগুলি নিজেদের প্রবল শক্তিধর রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরতে পেরেছেন অতীতে সেই দেশের মাটিতেই আধিপত্যকামী রাজনীতিকে অচ্ছুত মনে করা হত, একনায়কদের প্রতি তাচ্ছিল্যের সাথে মস্করা ছুঁড়ে দেওয়া হত। তাহলে আজ সেইসব দেশে এমন পরিবর্তন হচ্ছে কেন? দুনিয়াজুড়ে পুঁজিবাদের শিরদাঁড়া হিসাবে যারা এতবছর চালিয়ে এসেছেন তাদেরই আমরা টেকনোক্র্যাট বলে চিনি। সেই টেকনোক্র্যাটরা হঠাৎ করে এমন ভাঁড়দের সামনে পরাজয় স্বীকার করে ময়দান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন কেন?

আসলে দুনিয়াজুড়েই পুঁজিবাদের চরিত্রে বদল ঘটেছে। একটা সময় অবধি (নব্বই’র দশক থেকে ২০০০ সাল) পুঁজিবাদের প্রয়োজন ছিল এমন রাষ্ট্রনেতাদের যারা সাধারণভাবে কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন টেকনোক্র্যাট হবেন, এদেরই ভরসায় আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি কর্পোরেট শাসনের অধীনে নিজেকে সংহত করেছে। বাস্তববোধযুক্ত রাজনীতির নাম করে যুক্তিনিষ্ঠ রাষ্ট্রকাঠামোর দাবী ছিল কর্পোরেট পুঁজিরই। এখন সেই সংহত পুঁজির জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। যেহেতু কর্পোরেট পুঁজি নিজেকে অভিজাতসুলভ একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেছে তাই অন্য কোথাও কোনোরকম বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থা তার সহ্য হচ্ছে না।

আজকের দুনিয়ায় লুটেরা পুঁজির পক্ষে অন্যতম তাত্ত্বিক মস্তিস্ক হিসাবে সক্রিয় ব্যক্তির নাম স্টিভ ব্যনন। তিনি বলেছেন কর্পোরেট পুঁজির এগিয়ে চলার জন্য এতদিন ধরে চলে যাবতীয় প্রশাসনিক কাঠামোকেই ভেঙ্গে ফেলা দরকার। তার ব্যখ্যায় আজকের পুঁজি ধ্বংসের বিনিময়ে মুনাফা লুটে নেয়, তাই সার্বিক ধ্বংসই কাম্য। দুনিয়াজুড়ে পুঁজিপতিরা তাই ধ্বংসলীলা চালাতে উদ্যত। প্রতিটি ধ্বংস পুঁজির পক্ষে, মুনাফার পক্ষে বাড়তি সুবিধা যুগিয়ে দিচ্ছে- আজকের পুঁজিবাদ ধ্বংস ছাড়া এক ইঞ্চি এগোতে পারে না।

আজকের পুঁজিবাদ জনগণের উপরে দুটি বিষয়ে জবরদস্তি চালায়। একটি নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল, আরেকটি হল পথভ্রষ্ট করে দিতে যাবতীয় কায়দা। একদিকে জনগণকে ছাল ছাড়িয়ে নেওয়ার মতো করে লুট করা চলতে থাকে, ঠিক তখনই অন্য কোনও দিকে নজর ঘুরিয়ে দিতে জোর প্রচার চালানো হয়। জনগণের মনে বিরাট বিরাট ধনী (বিলিওনেয়ার)দের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তাকেই জনগণের মধ্যেকার কোনও একটি ছোট অংশের প্রতি ঘৃণায় রূপান্তর করিয়ে দেওয়া চলে। জনরোষের শিকার হন তাদেরই অন্তর্ভুক্ত কোনও একটি গোষ্ঠী- যেন তারাই সব সমস্যার জন্য দায়ী। ১৯৩০’র দশকে যে প্রবল আর্থিক মন্দা তৈরি হয়েছিল তারই অনুসারী হয়ে এবারেও লোকঠকানো শুরু হয়েছে। ফারাক শুদু এটুকুই যে পুঁজিবাদ একসময় নিজের জোরেই যা কিছু নির্মাণ করেছিল আজকের লুটেরা পুঁজি সেইসবকিছুকেই নিশানা করছে, ধ্বংস করছে।

কর্পোরেট পুঁজির প্রধান চরিত্র গোষ্ঠীগত। সেই গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির সুত্রে নির্মিত। এই বন্দোবস্তের সবসময় লক্ষ্য থাকে কোথায়, কোন দেশে বাড়তি কর ছাড় পাওয়া যাবে। বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারীরাই লগ্নী পুঁজিকে সেই সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেয়। এইসব রাজনৈতিক ব্যাক্তিরাই সবসময় দেশের সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গে প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি করেন। এরাই আবার জাতীয় সম্পদগুলি নিঃশব্দে বেচে দেন। চরিত্রগত বৈপরীত্বের এটুকু মজা অন্তত তারা জনগণকে উপহার হিসাবে বিনামূল্যেই দেন।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন