জেলার কথা - বীরভূম : গৌতম ঘোষ

বীরভূম জেলার লোকসভার দুটি আসনের ভোট (পূর্ব বর্ধমান জেলার তিনটি বিধানসভা যুক্ত) কোন পথে?

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন স্বাধীনতার পর নির্বাচনগুলির থেকে আলাদাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ কেন?

যে সংবিধানের নির্দেশে এই নির্বাচন সেই সংবিধানের গণতান্ত্রিক উপাদান গুলি রক্ষা পাবে, না ফ্যাসিবাদী উপাদাগুলি প্রতিষ্ঠা পাবে- সেইটি এই নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ইসু। আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকারের নয়া ফ্যাসিবাদী প্রচেষ্টা এই বিষয়টি পরিষ্কার করেছে যে ,এই সংবিধান রক্ষা করে তাদের সরকার পরিচালনার কোনো পরিকল্পনা নেই। ১৯২৫ সালে গঠিত আরএসএসের হিন্দু রাষ্ট্রের যে দাবি ছিল তাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলছে। সাম্প্রদায়িক কর্পোরেটের নীতি হচ্ছে ধর্মের ব্যক্তিগত আবেগকে রাজনীতিকরণ করেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে কর্পোরেটকে অবাধ লুট করতে সাহায্য করা। ইলেক্টোরাল বন্ডের উঁকি মারার মধ্যে দিয়েই বিজেপি সরকারের প্রতিষ্ঠান গুলি কাজে লাগিয়ে নিজের দলের দুর্নীতিকে আইনসিদ্ধ করার অপচেষ্টা ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বীরভূম জেলার দুটি লোকসভা আসনে( বোলপুর লোকসভার তিনটি বিধানসভার আসন পূর্ব বর্ধমান জেলার সাথে যুক্ত) ভোট উপরোক্ত বিষয়গুলিকে সামনে রেখে নির্বাচনের মুখ্য প্রচার সংঘটিত হবে।

This image has an empty alt attribute; its file name is deucha-2.jpg

ক) মহম্মদবাজার ব্লকে ডেউচা-পাচামী খোলা মুখ খনির প্রকল্প কার স্বার্থে ? আদানি গোষ্ঠীর? হাজার হাজার আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গরীব মানুষেরা বাস্তুচ্যুত হবে এই প্রকল্পে। পরিবেশের কথা যদি ধরা যায় ,তাহলে তার খারাপ প্রভাব সারা জেলা জুড়েই পড়বে, ওই ব্লক সহ আশেপাশের এলাকায় মাটির তলার জলের সংকট তৈরি হবে। নদীগুলো শুকিয়ে যাবে।

এলাকার আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষ একত্রে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন।

এই আন্দোলনকে নানাভাবে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ভাঙ্গার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ,বেশ কয়েকটি এন জি ও এবং পুলিশ প্রশাসন কে ব্যবহার করে। বামপন্থী দলগুলো এই আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে প্রথম দিন থেকেই আছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলো তার ফল পেয়েছে। বাকি দল দুটি পুলিশ প্রশাসনের নেতৃত্বে কিছু অসাধু পাথর ব্যবসায়ীর সাহায্যে ভোট করেছে।

এই প্রকল্প বাতিলের দাবিতে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বাম- কংগ্রেসের পক্ষে মানুষ একত্রিত হচ্ছেন।

খ) নদীগুলি থেকে প্রশাসনের সহায়তায় বেআইনি বালি তোলার মধ্য দিয়ে নদীর গতিপথের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক গতির পরিবর্তনের ফলে চাষবাসের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এটা বন্ধ করতে হলে তৃণমূল বিজেপির সরকারকে উচ্ছেদ করতে হবে।

This image has an empty alt attribute; its file name is deucha-1-1024x766.jpg

গ) রামপুরহাট মহকুমায় পাথর শিল্পে বেআইনি ডিসিআর (প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে) ব্যবহার করে ব্যাপক লুট চলছে। সেই টাকার ভাগ যাচ্ছে তৃনমূল কংগ্রেসের ও বিজেপি নেতাদের কাছে।এই দূর্নীতি বন্ধ করতে হলে বর্তমান সরকারের পরিবর্তন করতেই হবে।

ঘ) সেচ ব্যবস্থার কোন নতুন পরিকল্পনা নেই- পুরনো ব্যবস্থাগুলিও নষ্ট করা হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, সারের দাম বৃদ্ধি, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষকরা ব্যাপক সংকটের মুখে এবং ঋনের জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন। পাট্টা জমি ও বর্গা জমি থেকে উৎখাত করতে জমির দালালরা তৃণমূল কংগ্রেসের সহায়তায় দুষ্কৃতিরাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। এর পরিবর্তন সম্ভব বিজেপি-তৃণমূল অশুভ আঁতাতে পরিচালিত সরকারকে উচ্ছেদ করে চাষের জন্য সেচের উন্নততর সঠিক সংস্কার এবং সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে।

ঙ) শিক্ষিত যুবক যুবতীর কোনো চাকরি নেই। কেন্দ্র এবং রাজ্যের দুই শাসকেরই এ বিষয়ে কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেই ।রাজ্যে যে কিঞ্চিৎ চাকরি হয়েছে, তাও যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ।স্বাভাবিকভাবেই বেশি বঞ্চিত হয়েছে এসসি,এসটি, ওবিসি ভুক্ত গরীব অংশের বেকার যুবক যুবতীরা।

চ) বিজেপি তৃণমূলের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে জেলায় চলছে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অপচেষ্টা ই ডি, সি বি আই, সি আই ডি, পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে অনৈতিকভাবে দলবদলের কাজে।

ছ) সমবায় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে বিভিন্ন বেসরকারি ফিনান্সিয়াল এজেন্সির মাধ্যমে গরিব মহিলা ও পুরুষদের ঋণে জর্জরিত করা হচ্ছে। সমবায় ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করে, সম্প্রসারিত করেই বেসরকারি এজেন্সির এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে তাই এই শাসক কে উচ্ছেদ করতে হবে। সার বীজ ইত্যাদিতে কালোবাজারি রুখতে সঠিক সময় সঠিক দামে তা সমবায়ের মাধ্যমেই সরবরাহ করতে হবে। অসাধু দালাল চক্রের উৎখাত করে সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম পাওয়া নিশ্চিত করা সম্ভব।

বীরভূম জেলার অধিবাসীদের জাতিগত ও মূল বৃত্তিগত অবস্থা দেখলেই বোঝা যাবে এই জেলার উন্নয়নের অভিমুখ প্রাথমিক পর্যায়ে কি হওয়া প্রয়োজন। এই জেলায় ১১ টি বিধানসভা আসন ও দুটি লোকসভা আসন। বোলপুর লোকসভা আসনের মধ্যে পূর্ব বর্ধমান জেলার তিনটি বিধানসভা আসনও আছে।

এই জেলার অধিবাসীদের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু অংশের মানুষের বিন্যাস- তফসিলি জাতির অংশ ২৩.৫% আদিবাসী মানুষের সংখ্যা ৫.৮% ধর্মীয় সংখ্যালঘু অংশের মানুষ ৩৭.০৫ শতাংশ ।প্রধান কাজের মানুষের ১৪.৩৯ শতাংশ চাষী এবং ক্ষেতমজুর ২৬.৩৩ শতাংশ । বছরে ছমাসের নিচে কাজ পান এই ধরনের কর্মী মোট কর্মীর ৩২ শতাংশ ।

স্বাভাবিকভাবেই এই নির্বাচনে আমাদের অন্যতম ইস্যু

১) আমাদের রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দুর্নীতিকে সামনে রেখে কেন্দ্রের সরকার ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প বন্ধ করতে চাইছে-হাজার হাজার বেকার যুবক-যুবতী জীবিকার সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা বিভিন্ন কাজ করতে যেতে বাধ্য হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াই এই দুই সরকারের নকল যুদ্ধে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

২) শিক্ষার অধিকার আইন কে সামনে রেখে গরিব মানুষের বাড়ির ছেলেমেয়েরা যাতে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাথমিক উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়, এসএসকে, এম এস কে খোলা হয়েছিল এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষার মান রক্ষা ও উন্নততর করার নিয়মিত প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল বিগত বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করতে এই প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করার জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার চেষ্টা করে চলেছে। NEPর মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণ, অবৈজ্ঞানিক সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের এই নির্দিষ্ট পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জনগনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

৩) আয়ুষ্মান ও স্বাস্থ্য সাথীর নামে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তুলে দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার। এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে।

সর্বোপরি আমাদের জেলা আউল বাউল এর দেশ এখানে জাত ধর্মের সমন্বয়ের ধারা সারা দেশকে পথ দেখিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সম্প্রীতি, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, আন্তর্জাতিকতার বার্তা ঐতিহ্য বহন করছে বীরভূম জেলা, আমাদের রাজ্য ও ভারতবর্ষ। সারা দেশের সাথে আমাদের জেলায় বিজেপি- তৃণমূল পরস্পরের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যেরএই ধারাকে ভাঙতে চেষ্টা করছে। তার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান এই জেলার জনগণ যাতে নিতে পারেন সেই আবেদন নিয়েই বাম- কংগ্রেসের প্রার্থীরা মানুষের কাছে যাচ্ছেন। জনগণের ইতিবাচক সাড়া প্রার্থীদের লড়াই কে শক্তিশালী করছে। জনগণ তৈরি হচ্ছেন সন্ত্রাস মোকাবিলা করেই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের মতের প্রতিফলন ঘটাতে। রামনবমীকে সামনে রেখে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিযোগিতা মূলক তান্ডব, সাধারণ ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিরক্ত ও শঙ্কিত করেছে।

Red Flag CPIM

শেয়ার করুন

উত্তর দিন