Stalin The Way He Defined

স্তালিন যা বলেছিলেন

সৌভিক ঘোষ

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার পথে একাধিক পরস্পর বিরোধী বিপ্লবপন্থাকে একজায়গায় নিয়ে আসে। নিজস্ব বৈশিষ্ট অনুযায়ী সেই সকল গোষ্ঠীর প্রত্যেকটি অংশই নিজেদের উপলব্ধিকে মুক্তিসংগ্রামের প্রধান উপায় মনে করত। মোটের উপরে এদের তিনটি দল হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক পক্ষ দেশের মাটিতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকদের বহুবিধ লড়াই আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে নেতৃত্বের ভূমিকায় নিজেদের উন্নীত করেছিলেন। এদের মধ্যেকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের রাজনীতিতে উৎসাহ হারিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় পক্ষে ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে যারা বিদেশ থেকে উপযুক্ত সাহায্যের প্রত্যাশায় দেশান্তরী ছিলেন, এদেরই একটি অংশ তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেছিলেন। এই দুই পক্ষ ছাড়াও আরেক দল ছিলেন যারা সশস্ত্র বিপ্লবের পথে এগিয়ে অশেষ যন্ত্রণা, নিপীড়ন সহ্য করে ব্রিটিশ জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় উপলব্ধি করেছিলেন মুক্তির প্রকৃত পথ কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা।

এহেন তিন প্রধান এবং অন্যান্য প্রবণতার ছোট বড় গোষ্ঠীগুলি একসাথে মিলে ভারতে সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এগিয়েছে। একসাথে মিলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে তাদের মধ্যেকার বিবিধ মতভেদ মিটে গেছিল এমন না। আজকের দিনে যেকোনো কমিউনিস্ট পার্টিকে জানা-বোঝার জন্য যেভাবে তাদের পার্টি কর্মসূচিকে ব্যবহার করা হয় তেমন কোনও সাধারণ বোঝাপড়া নির্ধারিত হতে আরও বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। ইতিহাস বলছে এহেন বোঝাপড়া চুড়ান্ত করার পথে পার্টির মধ্যে বহু মতামত, চিন্তা-ভাবনা একে অন্যের সাথে গুরুতর বিতর্কে জড়িয়েছিল।

সেই সকল বিতর্কের মূল কয়েকটি প্রশ্নে অনেক চেষ্টা করেও কমিউনিস্ট সুলভ ‘চিন্তার ঐক্য’ গড়ে উঠছিল না, ফলে ‘কাজের ঐক্য’-এ পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে উঠছিল। দেশের স্বাধীনতার পরেও সে বিতর্ক চলেছে। ইতিমধ্যে ভ্রান্ত লাইনের দায়ে সাধারণ সম্পাদক পূরণ চাঁদ যোশী’কে প্রথমে শো কজ করা হল, দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে তাকে সরেও যেতে হল। তেলেঙ্গানায় কৃষকদের সশস্ত্র লড়াইতে পার্টির ভূমিকাকে কেন্দ্র করে মূল বিতর্কগুলি সামনে আসে। দেশে বিপ্লব সমাধা করার জন্য সঠিক রণকৌশল কি হবে এধরণের আরও কয়েকটি বিষয়ও ছিল। পরের সাধারণ সম্পাদক বি টি রণদিভে দায়িত্ব নিয়েই আগেকার যাবতীয় কিছু আবর্জনার সরানোর মতো করে বাদ দিতে ব্যস্ত হলেন। কিছুদিন সেভাবে চলার পরে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিলে রণদিভে’কেও সরতে হল। ইতিমধ্যে কমিনফর্মের তরফে প্রকাশিত পত্রিকা ফর আ লাস্টিং পিস, ফর আ পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত হয়েছিল ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি সঠিক পথে চলছে না।

এ সময়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি রাজেশ্বর রাও’কে সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়। ততদিনে পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়েছে, গ্রেপ্তার, ধর-পাকড় চলছে। দমন-নিপীড়নের সেই পরিস্থিতির মধ্যেই নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যের একান্ত জরুরী প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে তৎকালীন পার্টি নেতৃত্বের তরফে কয়েকজন গোপনে রাশিয়ায় পৌঁছলেন।

এরা কারা? রাজেশ্বর রাও, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, অজয় ঘোষ ও এম বাসবপুন্নাইয়া।

পার্টি উপলব্ধি করেছিল রাষ্ট্রচরিত্র, বিপ্লবের স্তর, সংগ্রামের পথে কে শত্রু আর কারা বন্ধু এসব প্রশ্নে বিভিন্ন অবস্থানের ফারাক মিটে যাবে যদি অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত পরামর্শ মেলে। ৪৩’ সাল থেকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আর নেই, প্রকাশ্যে কোনও আলোচনার সুযোগও নেই। তাই একজনের কাছেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল।

তিনি জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্তালিন।

ভারতের প্রতিনিধি দলের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বের আলোচনা হয়েছিল দুটি পর্যায়ে। প্রথম আলোচনায় সোভিয়েতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জি এম ম্যালেনকভ, এম এ সুসলভ, পি এফ ইয়ুদিন এবং ভি জি গ্রিগোরিয়ান। এ বৈঠকের তারিখ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১।

ঐ আলোচনায় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে চলা তৎকালীন বিতর্ক নিছক কয়েকটি প্রায়োগিক বিষয়কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রচরিত্র, দেশী-বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে পার্টির ভূমিকা এবং দেশের মাটিতে বিপ্লব সম্পন্ন করতে উপযুক্ত রণকৌশল কী হবে এমন কয়েকটি গুরুতর মতাদর্শগত প্রসঙ্গও ছিল। চীনে বিপ্লবী রণকৌশলের সাফল্যকে সামনে রেখে ভারতের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পন্থা নির্ধারণের প্রশ্ন ওঠে। দেশভাগকে কেন্দ্র করে জাতিগত অধিকারের প্রশ্নে কমিউনিস্টদের অবস্থানও নানা দিক থেকে আলোচিত, সমালোচিত হয়েছে। এমন বিভিন্ন প্রশ্নে যেভাবে নানা মতামত, বোঝাপড়া ও অবস্থান গড়ে উঠেছে তাতে ক্রমশ পার্টির মধ্যে বিভাজনের বিপদ তৈরি হচ্ছিল। যেভাবেই হোক সে বিভাজন আটকানোই ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। অনেক বিপ্লবীর প্রাণ, ত্যাগ, তিতিক্ষা, রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে যে পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে এক রাখাই ছিল চ্যালেঞ্জ।

ভারতে পার্টির অভ্যন্তরে যথাবিহিত বিতর্কের পরেও যখন কিছুতেই সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা গেল না তখন তারা স্তালিনের সামনে উপস্থিত হলেন।

স্তালিনই কেন?

আমাদের দেশে জনজীবনের বৈচিত্র, পার্থক্য এসব বোধহয় একমাত্র আমাদের দেশেরই বৈশিষ্ট বলে অনেকে ধরে নেন। ভারতে বৈচিত্রের অনন্যতা রয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তেমনটা যে শুধু আমাদের দেশেই রয়েছে এমন না। রাশিয়ায় ছোট বড় বহু জনজাতিগুলির অধিকার ইত্যাদিকে যে কিছুতেই বৃহৎ রুশ জাতির মুক্তির আকাংখার নিচে চাপা দেওয়া চলবে না, তেমনটা হলে যে বিপ্লবের সাফল্য অধরা থেকে যাবে অনেক আগেই লেনিন সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন। মাথা ঝিমঝিম করা এমন জটিল সমস্যার সমাধান করবেন কে? ঐ সময় সংশ্লিষ্ট সমস্যার প্রসঙ্গে প্রাভদায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের দিকে চোখ যায় তাঁর, লেনিন বুঝতে পারেন তার খোঁজাখুঁজি শেষ হয়েছে। ‘এক চমৎকার জর্জিয়ান’-কে আবিষ্কার করার কথা চিঠি লিখে জানান ম্যাক্সিম গোর্কি’কে। ইতিহাস বলে স্তালিন যে শুধু রুশ দেশে ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর সমস্যাকে সমাধান করেছিলেন তাই না, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে জাতিগত সমস্যার মোকাবিলায় একটি সাধারণ তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার নির্মাণও তারই কৃতিত্ব। ‘জাতি’ বলতে কমিউনিস্টরা আজও মূলত যা বোঝেন তাও স্তালিনেরই সুত্রায়ন।

তাই স্তালিন।

প্রথম বৈঠকের পাঁচদিন পরে, ১৯৫১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি স্তালিনের সাথে আলোচনা হয়েছিল।

ভারতের প্রতিনিধিরা লিখিতভাবে স্তালিনের কাছে বিতর্কের মূল প্রশ্নগুলি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ভারতে বিপ্লবের চরিত্র কেমন হবে, সমাজতান্ত্রিক নাকি গণতান্ত্রিক?

ভারতীয় বিপ্লব কি চীনের পথ অনুসরণ করবে?

তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকে সারা দেশে সাধারণ রণকৌশল বিবেচনা করা কতদূর উচিত হবে?

এধরণের প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই প্রাথমিক জটিলতা ছিল। স্তালিন প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছিলেন। তবে জিনোভিয়েভের নেতৃত্বে কমিন্টার্ন যেভাবে উত্তর দিত সেভাবে না, এখানেই ঐ আলোচনার গুরুত্ব ঐতিহাসিক। স্তালিন শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁর উত্তর দেওয়ার ভিত্তি ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। দুনিয়ার একটি অংশে বিপ্লব সফল হয়েছে বলেই সেখানকার নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাকে অন্যদের জন্য সাফল্য লাভের সাধারণ সুত্র হিসাবে বিবেচনা করা যে ভ্রান্ত তা তিনি স্পষ্ট করেছিলেন। সফল বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে নিজেদের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে যাচাই করে নিতে হয়- এই ছিল তাঁর পরামর্শ।

তিনি বলেছিলেন ভারতে বিপ্লবের প্রাথমিক স্তর অবশ্যই জনগণতান্ত্রিক (পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রেভোলিউশন), আর তাই জমির প্রশ্নকে সবার আগে সমাধান করতে হবে, অর্থাৎ জমিদারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ। চীন সেই প্রাথমিক কর্তব্য সমাধা করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে গেছে, তাই চীনের এগোনোর পথ ও ভারতের পথ কিছুতেই এক হতে পারে না। কৃষিবিপ্লব থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই অবধি প্রতিটি বিষয়ে স্তালিনের পরামর্শে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। ভারতে কমিউনিস্টরা যাবতীয় লড়াই একসাথে, এক ময়দানে লড়তে নেমেছিলেন। বিপ্লবের লক্ষ্যে এই মুহূর্তের কাজ ও পরের কাজের মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখা হয়নি। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকে ভারতে বিপ্লবের স্তর’কে সমাজতান্ত্রিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। স্তালিন এ ভ্রান্তি চিহ্নিত করে বলেন এভাবে লড়াই করলে প্রতিটি ময়দানে শত্রুশিবিরের গোষ্ঠীসমূহ একজোট হয়ে যাবে, তাতে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই করতে গিয়ে জাতীয় বুর্জোয়াদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা সঠিক না, কৃষিবিপ্লবের কাজ সমাধা করতে বড় চাষিদের (বৃহৎ জমির মালিক) নিশানা করা উচিত না, এতে শত্রু শিবিরে শক্তির যোগান দেওয়া হয়। লক্ষ্য হবে প্রতিটি নির্দিষ্ট লড়াইতে প্রধান শত্রুকে জনসাধারণের বিরুদ্ধে ‘একা’ (আইসোলেট) করে দেওয়া, এই উদ্দেশ্যেই কমিউনিস্টরা ফ্রন্ট গড়ে লড়াই চালান। ফ্রন্ট মানে শুধু পার্টি না, শত্রুর মুখোমুখি জনসাধারণের সর্ববৃহৎ ঐক্য। প্রত্যেক নির্দিষ্ট সংগ্রামে মূল শত্রুকে চিহ্নিত করতে হয়, তাঁর বিরুদ্ধে নিজেদের একজোট করার পাশাপাশি মিত্র, এমনকি দোলাচলে থাকা অংশকেও মিত্র হিসাবে টেনে আনতে হয়। এটাই সাফল্যের পূর্বশর্ত।

জাতীয় বুর্জোয়া বলতে কি বোঝায় সেই নিয়ে ভারতে কমিউনিস্টদের মধ্যে গুরুতর বিতর্ক ছিল। মাঝারি পুঁজির মালিকদেরই জাতীয় বুর্জোয়া বলে ধরে নেওয়া হত।

স্তালিন ব্যখ্যা দিলেন, ব্রিটিশ পুঁজির হাতে ভারতের সম্পদ লুট হচ্ছে। ভারতীয় পুঁজিপতিদের মধ্যে কেউ কি এমন কিছু করছে? অর্থাৎ তারা কি বিদেশের সম্পদ লুট করে নিজেদের দেশে চালান করছে? ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের লুটের বিরুদ্ধে যে বুর্জোয়া নিজেদের দেশের স্বার্থে স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করে তাকেই জাতীয় বুর্জোয়া ধরতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শিবিরকে এদেশের মাটিতে কার্যত ‘একা’ করে দিতে হবে, তারা যেন জনসাধারণের কোন অংশকে নিজেদের সঙ্গী না বানাতে পারে। ভারতে পরিচালিত ব্রিটিশ ব্যংকের পুঁজিকে কমিউনিস্টরা ‘আমলা পুঁজি’ (ব্যুরোক্র্যাটিক ক্যাপিটাল) হিসাবে বিবেচনা করতেন। স্তালিন বুঝিয়ে দিলেন ব্যুরোক্র্যাটিক ক্যাপিটাল না ওটি হল শিল্প পুঁজি আর বেনিয়া পুঁজির সম্মিলিত রূপ। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইতে বৃহৎ পুঁজিপতিদের বেশিরভাগকেই (স্তালিনের কথা অনুযায়ী ১০ ভাগের মধ্যে ৯ ভাগ) কাজে লাগানো যায়, কাজে লাগানো উচিত। জাতীয় বুর্জোয়া সম্পর্কে নিজেদের ভ্রান্ত বোঝাপড়া সংশোধন করলেই তেমনটা করা যায়। ঐ মুহূর্তে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সাথে বৃহৎ বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইকে একাকার করে দেওয়ার অর্থ হবে বিরোধী শিবিরকে অহেতুক শক্তিশালী করে দেওয়া। তিনি উল্লেখ করেছিলেন- সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে সাফল্য লাভের পরে বৃহৎ বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করতে হবে, কিন্তু তা ভবিষ্যতের কাজ এখনকার না। তৎকালীন পরিস্থিতিতে ভারতের কমিউনিস্টদের মধ্যে এহেন বোঝাপড়ায় বিশেষ ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। যাবতীয় যুদ্ধ একবারে সমাধা করতে চাওয়ায় দুঃসাহসী পরাক্রম থাকতেই পারে, কিন্তু তাতে বাস্তবের জমিতে কোনও কাজের কাজ হয় না- এই ছিল স্তালিনের বক্তব্যের মূল কথা।

ভারতের তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রে কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম যেমন নতুন ইতিহাস নির্মাণ করেছিল তেমনই কমিউনিস্টদের মধ্যে এক বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছিল। পার্টির মধ্যে একাংশ মনে করতেন এ লড়াই হল পার্টিজান সংগ্রাম। একে চীনের সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে তুলনা করে সারা দেশেই অভিন্ন রণকৌশল হিসাবে প্রয়োগ করার দাবীও সামনে এসেছিল। এহেন দাবীর মূল কথা ছিল কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রামের উপরে ভর করেই দেশে বিপ্লব সমাধা হতে পারে, শহরাঞ্চলে শ্রমিক-মজদুরদের আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত করতে অহেতুক সময় নষ্ট করার দরকার নেই। সশস্ত্র লড়াইয়ের সাথে পার্টিজান সংগ্রামের পার্থক্য চিহ্নিত করলেন স্তালিন। তাঁর বক্তব্য ছিল- চীনে সশস্ত্র সংগ্রামের বিজয় অর্জিত হয়েছে ঘাঁটি এলাকাগুলিকে সুরক্ষিত রাখার মধ্যে দিয়ে। কুয়োমিনতাং বিরোধী যুদ্ধের শুরুর দিকে লাল ফৌজের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তখনই তারা নিজেদের দেশের উত্তরাংশে ঘাঁটি এলাকাকে প্রসারিত করতে শুরু করে। এহেন সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা গেল কারণ সেদেশে লাল ফৌজ মাঞ্চুরিয়া সহ আশেপাশের কয়েকটি এলাকায় নিজেদের ঘাঁটি এলাকাকে বিস্তৃত করতে পেরেছিল, এবং ঐ সকল এলাকায় জাপান ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের চাইতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শক্তির প্রভাব বেশি ছিল। চীনের নির্দিষ্ট ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছিল। ভারতের ভূগোলে তেমন বাস্তবতা নেই। তৎকালীন চীন ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক কিছু সাদৃশ্য থাকলেও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাও এক নয়। নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে পার্লামেন্ট গঠন থেকে আধুনিক কলকারখানা ইত্যাদি তৎকালীন চীনে নেই। তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রে সশস্ত্র সংগ্রামের সাফল্যকে সারা দেশে প্রয়োগ করার মতো বাস্তব পরিস্থিতি এবং শক্তিশালী পার্টি সংগঠন যে নেই একথা ভারতের প্রতিনিধিরাও স্বীকার করেন।

স্তালিন বলেন- সশস্ত্র সংগ্রাম মানেই পার্টিজান সংগ্রাম না। পার্টিজান সংগ্রাম অবশ্যই দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে যদি তারা দেশের কৃষকদের সামনে সশস্ত্র সংগ্রামের কর্মসূচি রাখেন তাহলে কি তারা জানতে চাইবেন না যে শহরের কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিক-মজদুররা এই লড়াইতে কি করবেন? যদি তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলা হয় শহরে কিছুই হবে না তাহলে তারা ভালোই বুঝবেন এ হল বড় বুলির আড়ালে সমস্ত দায় তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার পন্থা। তাই প্রয়োজন কৃষকদের লড়াইয়ের সাথে শ্রমিকদের সংগ্রামকে এক জায়গায় নিয়ে আসা, এক লক্ষ্যে পরিচালিত করা, জনসাধারণের সর্ববৃহৎ অংশের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করা। একাজ কঠিন সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটাই কমিউনিস্টদের সম্পন্ন করতে হয়। তাই শ্রমিকদের সংগ্রামকে বাদ দিয়ে পার্টিজান যুদ্ধ গড়ে তোলা যায় না। একথার জবাবে এস এ ডাঙ্গে স্বীকার করে নেন তারা চীনের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে পার্টিজান যুদ্ধের নাম করে ভারতের মাটিতে ঠিক তেমনটাই করতে চাইছিলেন। স্তালিন মজা করে বলেন- মাও এমন কথাবার্তা শুনলে রীতিমত বিরক্ত হবেন। তিনি রাশিয়ার অভিজ্ঞতার কথাও তাদের স্মরণ করিয়ে দেন। রাশিয়ায় সেনাবাহিনীর সমর্থন পাওয়া গেছিল কারণ জমির দাবী ছিল অন্যতম দাবী। শান্তি, রুটি ও জমি- এই তিন দাবী সেদেশের কৃষক, শ্রমিক সহ জনসাধারণের মূল দাবীগুলিকে একসুত্রে বেঁধে ফেলে, তাই সাফল্য আসে। চীনের পরিস্থিতিতে লাল ফৌজের পক্ষে শহরাঞ্চলের শ্রমিকদের নিজেদের সংগ্রামে সেভাবে একাত্ম করে নেওয়া সম্ভব হয়নি, ঘাঁটি এলাকার রণকৌশলের জন্যই তেমনটা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনা তাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা, ঘাঁটি এলাকা প্রসারিত না করা গেলে সেখানকার পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত বলেও স্তালিন মন্তব্য করেন। বিপ্লবের চীনা পন্থাটি চীনের জন্যই সঠিক, ‘দ্য চাইনিজ ওয়ে ওয়াজ গুড ফর চায়না’- এই ছিল তাঁর স্পষ্ট কথা।

পরের প্রশ্ন ছিল চিয়াং কাই শেক’কে যেভাবে চীনের কমিউনিস্টরা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের হাতের পুতুল হিসাবে ব্যখ্যা করেছিলেন ভারতে তৎকালীন নেহরু সরকারকে সেভাবেই বিবেচনা করা চলে কি?

স্তালিনের উত্তর, কুয়োমিনতাং সরকারের প্রধান হিসাবে চিয়াং কাই শেক যতক্ষণ চীনের মাটিতে রয়েছেন ততক্ষণ অবধি তাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতের পুতুল বলতে তিনি রাজী নন। যে মুহূর্তে চিয়াং কাই শেক ফর্মোসায় পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন তখন থেকে তাকে পুতুলই বলা সঠিক। নেহেরু সরকার সম্পর্কেও তিনি একই মন্তব্য করেন। তিনি উল্লেখ করেন তৎকালীন ভারতের সর্বত্র আদৌ গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি তাই এমন রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া উচিত না। কোনও একটি কারখানায় শ্রমিকদের হরতাল, ধর্মঘট সফল হওয়ার মানে এমন না যে সর্বত্র সেই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। যদি তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন সাধারণ ধর্মঘট সফল হবে। দেশজুড়ে এধরণের ব্যপক সাধারণ ধর্মঘট সফল হলে জনমানসে ধাক্কা লাগে, বিপ্লবী পরিস্থিতি সামনে আসে, তখন পার্টিজান সংগ্রাম সফলভাবে পরিচালিত হলে তবে তাকে বলা যায় রাজনৈতিক সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপ। তেলেঙ্গানার অভিজ্ঞতাকে অযথা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো কিংবা পার্টির সাংগঠনিক শক্তিকে বাড়িয়ে বিবেচনা করার মতো ভ্রান্তি সম্পর্কে স্তালিনের পরামর্শে ভারতের প্রতিনিধিরা সহমত হন। প্রত্যেকেই মেনে নেন দেশের বাস্তবতা অনুযায়ীই রণকৌশল নির্ধারণ করে এগোতে হবে।

পার্টির মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা করার সময় কতদূর এগোনো চলে?

সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই সিদ্ধান্ত- এই ছিল স্তালিনের সোজা উত্তর। তিনি উল্লেখ করেন আলোচনার সময় যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর বাইরে ছিলেন তাদেরও গৃহীত সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করতে একইভাবে সক্রিয় হতে হয় কেননা কমিউনিস্ট পার্টিতে একটিই সিদ্ধান্ত হয়। যে কোনও প্রশ্নে অন্তহীন আলোচনা পার্টি ক্যাডার ও জনসাধারণকে দ্বিধাগ্রস্থ করে তোলে। ১৯০৩ থেকে ১৯১২ সাল অবধি বলশেভিক পার্টিতে নিরবিচ্ছিন্ন আলোচনা হয়েছিল, এর উদ্দেশ্য ছিল পার্টির মধ্যে থেকে মেনশেভিকদের চিহ্নিত করে বাইরে বের করে দেওয়া। পার্টির ঐক্যকে মজবুত করার জন্য সে কাজ জরুরী ছিল, সে কাজ সম্পন্ন করেই ১৯১৭’র বিপ্লবে সাফল্য এসেছে। ১৯১৭’র পরে ট্রটস্কি অযথা কিছু আলোচনার দাবী তুললেন। পার্টির মধ্যে সেই দাবী সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পেলে তিনি প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন আলোচনা হচ্ছে না কারণ পার্টি নাকি সত্য গোপন করতে চায়। আমরা পুনরায় আলোচনা শুরু করলাম এবং ট্রটস্কি’রা পরাস্থ হলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে ঐ আলোচনার পর্বে গোটা পার্টি একদিকে ছিল, আরেকদিকে ছিল ট্রটস্কি ও তার ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। মতাদর্শগত বোঝাপড়ায় যে পার্টি ঐক্যবদ্ধ তাকে অহেতুক আলোচনায় সময় নষ্ট করতে হয় না। এধরণের আলোচনা চলাকালীন নিজেদের মতামতকে প্রকাশ্যে প্রচার করাও সঠিক না।

স্তালিনের সেই পরামর্শ আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

এই আলোচনা চলেছিল তিন ঘন্টারও বেশি।

শেষদিকের মিনিটস থেকে দেখা যায় কথোপকথনের সময় স্তালিন জানতে চাইছেন পার্টির বাইরে থাকা সমর্থক, দরদীদের কীভাবে পার্টির কাজে ব্যবহার করা হয়। এমন প্রশ্ন করেছিলেন কেন?

এর কারণ দুটি।

প্রথম কারণটি সরাসরি সাংগঠনিক। আলোচনার সময় রাজেশ্বর রাও এবং এস এ ডাঙ্গে জানান ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক, দরদীদের কোনও সংগঠিত চেহারা নেই। পার্টি কেবলমাত্র সদস্যদের মাধ্যমেই নিজের কাজ পরিচালনা করে। স্তালিন জানান সমর্থকদের সংগঠিত চেহারায় পরিচালনা করা হলে পার্টি সদস্যদের জন্য জরুরী যাবতীয় শিক্ষা, চর্চা ও অভ্যাসগুলির মধ্যে ন্যুনতম কয়েকটি পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগেই রপ্ত করে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। এ কারণেই তারা রাশিয়ায় ক্যান্ডিডেট মেম্বরশিপের মাধ্যমে পার্টি সদস্যপদ অর্জনের পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। একথাও স্মরণ করিয়ে দেন নিছক কলেবরে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য যেন তেন প্রকারেণ নতুন সদস্যপদ বিলিয়ে দেওয়া কমিউনিস্ট পার্টির জন্য কোনও কাজের কথা না। তাই সমর্থক, দরদীদের মধ্যে থেকে উপযুক্ত কমরেড বেছে নেওয়ার সময় জরুরী গুণাবলী যাচাই করে নিতে হয়। কমিউনিস্ট পার্টিতে সদস্যদের সময়োপযোগী রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ ও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে দক্ষ দুইই হতে হবে।

দ্বিতীয় কারণটি রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক উপলব্ধি। অবশ্য এ উপলব্ধি লেনিনের থেকেই শেখা। রাশিয়ায় বিপ্লব সফল হলেও ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে কমিউনিস্টরা বিপ্লব সংগঠিত করতে সফল হলেন না। জার্মানিতে রোজা লুক্সেমবার্গেরা সাড়া জাগানো প্রচেষ্টার পরেও ব্যর্থ হলেন। কিন্তু কেন? স্তালিন এর কারণ অনুসন্ধানে অন্যদের চাইতে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার সময় তিনি সেই রহস্যের সন্ধান দিয়ে গেছেন। কখন, কোন পরিস্থিতিতে পার্টিজান সংগ্রাম শুরু করা যায়? এই প্রসঙ্গে বলার সময় তাঁর বক্তব্য ছিল- উন্নত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন কোনও দেশে রাশিয়ার মতো করে পার্টিজান যুদ্ধ পরিচালনা করা নিরর্থক। আধুনিক কল-কারখানায় সমৃদ্ধ শহরাঞ্চল প্রধান এলাকা, সুবিস্তৃত রেলপথ, সড়ক ও যোগাযোগের উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে এমন দেশে পার্টিজানরা সহজেই চিহ্নিত হয়ে যাবেন, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবেন দ্রুত। এমন পরিস্থিতিতে জনসাধারণকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে হয়, যাতে শাসকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাটুকু উপলব্ধি করতে পারে। তখন আর কোনও হিরোর অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না, নায়কোচিত দায়িত্ব পালনে তারা নিজেরাই নিজেদের সমর্থ বলে উপলব্ধি করবেন। এ দায়িত্ব কমিউনিস্টদেরই। এমন হলে শান্ত-অবসন্ন পরিস্থিতির বদল ঘটবে, তখন শাসকের বিরুদ্ধে নিছক ছোট ঘটনার অভিঘাতও জনসাধারণের উপর বিরাট প্রভাব তৈরি করবে। এমন বিদ্রোহের পরিস্থিতিই সার্বিক গৃহযুদ্ধের ভ্রূণ। সে অবস্থাকেই পার্টিজান যুদ্ধে রূপান্তরিত করতে হবে।

কিন্তু সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন শ্রমিক, কৃষক সহ জনসাধারণের ব্যপক অংশ এমনকি সমাজে বিশিষ্ট হিসাবে সুপরিচিতি রয়েছে (সহজ কথায় আমরা যাদের বুদ্ধিজীবী বলি) এমন ব্যক্তিবর্গকেও সংগ্রামের ময়দানে টেনে আনা। আর তাই কমিউনিস্টদের সক্রিয় হতে হবে যাতে সময় এলে জনসাধারণের ব্যপক অংশ একে অন্যের সংগ্রামে কার্যকরীরূপে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাশিয়ায় শীতপ্রাসাদ দখল করেছিলেন শ্রমিকরাই, কিন্তু তারা সাধারণ অর্থে শ্রমিক ছিলেন না। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়েছিল, লেনিনগ্রাদে তারা ওয়ার্কার্স গার্ড হিসাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গ্রামের কৃষকরা সেই লড়াইকে সমর্থন করেছিলেন কারণ লড়াইটি শ্রমিকরা লড়েছিলেন, মনে রাখতে হবে কৃষকরা জনসাধারণের মধ্যে শ্রমিকশ্রেনিকেই সবচেয়ে ভরসা করেন। তাই একদিকে কৃষকদের অভ্যুত্থান আরেকদিকে শ্রমিকদের যুদ্ধ এদুটি লড়াইকে একজায়গায় না আনা অবধি পার্টিযান যুদ্ধ শুরু করা যায় না, যাবে না। শাসকের ফাঁদে পা দিয়ে উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই পার্টিজান যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে পরিণতি কেমন হয় তা বোঝাতে স্তালিন ইন্দোনেশিয়ার ঘটনার উল্লেখ করেন।

বিশ্ব-কমিউনিস্ট আন্দোলনে স্তালিনের তিনটি বিশিষ্ট অবদান প্রসঙ্গে বিগত বছরগুলিতে আমরা বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। বলশেভিক পার্টির ২০-তম কংগ্রেসে নিকিতা ক্রুশ্চভ যে অসভ্যতা শুরু করেন আজকের পৃথিবীতেও তার রেশ কাটেনি। এখনো স্তালিনের সমালোচনার জন্য সাম্রাজ্যবাদী উচ্ছিষ্টের দাক্ষিণ্যে প্রকাশিত বইপত্রকেই প্রাইমারি সোর্স হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, প্রচার করা হচ্ছে। এমন জঘন্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ইংরেজি ভাষায় বেশ কিছু প্রামান্য গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও বাংলায় উৎপল দত্তের ‘প্রতিবিপ্লব’ বইটির পরে গবেষণামূলক ও উল্লেখযোগ্য কাজ আর হয়নি।

স্তালিনের সাথে ভারতের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সেই আলোচনা দুতরফ থেকেই দীর্ঘকাল অবধি গোপন রাখা হয়েছিল। রাশিয়ার জাতীয় লেখ্যাগারের (স্টেট আর্কাইভ) অন্তর্ভুক্ত সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ক তথ্যভান্ডারেই বৈঠকের মিনিটস্‌ পড়েছিল। রাশিয়ান ভাষায় সে আলোচনা লিখে রেখেছিলেন ভি জি গ্রিগোরিয়ান, ৪ঠা ফেব্রুয়ারির বৈঠকেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেই ডকুমেন্ট ইংরেজিতে তর্জমা করেন গ্যারি গোল্ডবার্গ। আমরা সেই ইংরেজি তর্জমাকেই প্রধান তথ্যসুত্র হিসাবে ব্যবহার করেছি।

তবু প্রশ্ন উঠতে পারে ১৯৫১ সালের বৈঠক, ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের মূল বিষয় হিসাবে বেছে নেওয়া হল কেন?

এমন সিদ্ধান্তের কারণ একটাই। স্তালিনের প্রসঙ্গ কেবল ইতিহাসের বিষয় না। কমিউনিস্ট রাজনীতির চর্চায় আন্দোলন, লড়াই, সংগ্রাম পরিচালনায় বিদ্রোহ, বিপ্লব কোনও তাত্ত্বিক প্রসঙ্গ না, জীবন্ত সমস্যা।

বিপ্লব গাছের ফল নয়, তাকে পছন্দসই গাছের ডাল থেকে পেড়ে নেওয়া যায় না। তেমনই কোনও অতিমানবিক হিরোর আবির্ভাব না হওয়া অবধি বিপ্লব হবে না এমন ধারনাও কার্যত বিচ্যুতি। ভারতে বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি অন্য দেশের অনুকরণে হবে না কিন্তু সে লক্ষ্যে এগোতে গেলে কিছু আবশ্যিক পূর্বশর্ত রয়েছে, সেসব কিছুকে এড়িয়ে গিয়ে ‘বিপ্লব হবে’ কিংবা ‘বিপ্লব হবে না’ দুটি মনোভাবই আসলে ভ্রান্তি। দুটি ভ্রান্তির বিরুদ্ধেই স্তালিন সতর্ক থাকতে শিখিয়েছেন।

ইতিহাসের বাঁক-মোড় বিশেষ বিশেষ সময়ে অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি করে। সেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটে না, ঘটবে না। এটাই মার্কসের শিক্ষা। একে মাথায় রেখেই লেনিন ইতিহাসকে পিছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তাকে চেনার জন্য কমিউনিস্টদের উপযুক্ত হতে হবে। সেই উপলব্ধিতে ফাঁকি থাকলে হয় রেলের ইঞ্জিন নিজের কামরাগুলিকে লাইনের উপরে ফেলে রেখে নিজেই এগিয়ে যেতে চায় আর নয়তো অচল কামরার মতো যা কিছু সত্যিই আলাদা করে দেওয়া উচিত তাকেও পিছন থেকে ঠেলে এগোতে গিয়ে বৃথা পরিশ্রমে নিজেই বিকল হয়ে পড়ে। কোন কামরা কীভাবে এগিয়ে চলে, কোনটি কিছুতেই চলতে পারে না সেসব জানতে হয়।

মতাদর্শ, রাজনীতি ও সংগঠন এই তিন উপাদানকে কীভাবে মেলাতে হয় তা শিখতে হয়।

তাই স্তালিন।

আর তাই জন্মদিবসে এই প্রতিবেদন নিছক স্মরণ নয়, চর্চা।

 
ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

শেয়ার করুন

উত্তর দিন