প্রভাত পট্টনায়েক
আমরা যখন স্বনির্ভরতার কথা বলি তখন মনে রাখতে হয় আসলে কার স্বনির্ভর হয়ে ওঠার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। স্বনির্ভর হতে হবে একটি দেশ’কে, একটি রাষ্ট্র’কে। সুতরাং রাষ্ট্র, দেশ বলতে কি বোঝায় সে প্রসঙ্গ ব্যাতিরেকে আলোচনা চলে না। রাষ্ট্র বলতে আমাদের বোঝাপড়া কেমন তাকে মাথায় রাখতে হবে। তবেই উপলব্ধি করা যাবে সেই রাষ্ট্র বা দেশ কিভাবে বিশ্বায়িত পুঁজির মুখোমুখি হয়েছে অথবা সেই দেশের উপরে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে লগ্নী পুঁজিকে কতদুর কসরত করতে হয়েছে। এমন হতেই পারে সেই নির্দিষ্ট দেশ বা রাষ্ট্র নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতার কার্যকরী বদল ঘটনাতে চায়, তারা গরীব জনতার উন্নতিসাধনে সংকল্পবদ্ধ। এমনও হতে পারে সেই কর্মসূচির সার্থক রুপায়নে জাতীয় সরকার দেশের ধনী অংশের উপরে বাড়তি কর চাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে নয়া উদার অর্থনীতি কিভাএব সক্রিয় হয়? আজকের পৃথিবীতে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পুঁজির চলাচল অবাধ ও সুগম। যে মুহূর্তে বড়লোক, ধনী ইত্যাদি অংশের উপরে কোনও সরকার বাড়তি কর চাপানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখনই বাজারে বিনিয়োগ হওয়া লগ্নী পুঁজি সেদেশের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র পাড়ি দেয়। নয়া উদারবাদী বন্দোবস্তই এমন হওয়ার সুযোগ সুনিশ্চিত করেছে। এই কারণেই নয়া উদারবাদি জমানায় ক্ষমতাসীন সরকারের যত সদিচ্ছাই থাকুক না কেন, বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজির না-পসন্দ কোনও সিদ্ধান্তই নিজেদের দেশে কার্যকর করতে পারে না। জনসাধারণের উন্নতিসাধনে তাদের যাই অঙ্গীকার থাকুক না কেন, সদা সর্বদা লগ্নী পুঁজি ও তার বিনিয়োগকারীদের মন যুগিয়ে না চলে জাতীয় সরকারগুলির অন্য কিছুই করার নেই। তা না হলেই লগ্নী বাজার ছেড়ে চলে যাবে। কোনও দেশ যেখানে ইতিমধ্যেই নয়া উদারবাদ জাঁকিয়ে বসেছে সেইসব রাষ্ট্রে যদি কখনো বামপন্থী রাজনৈতিক দলও সরকারে আসীন হয় তখনও খুব বেশি কিছু রদবদল হওয়ার আশা করা উচিত না। গরীব, দুর্দশাগ্রস্থ জনসাধারণের জন্য কার্যকরী কোনও পদক্ষেপ গ্রহণে, কিংবা সংকটের পাঁকে ডুবতে থাকার ক্রমাবনতি ঠেকাতে সেইসব বামপন্থী রাজনীতির যত সদিচ্ছাই থাকুক না কেন, কার্যত অন্যান্য সরকারের তুলনায় খুব একটা আলাদা কিছু করার সুযোগই থাকে না। কারন নয়া উদারবাদ এমন যেকোনো বিকল্প পথ গ্রহণের আইনানুগ প্রতিবন্ধকতাকে ইতিমধ্যেই চাপিয়ে রাখে, গোটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডটাই কার্যত একরকম ঘেরাটোপের ভিতরে আবর্তিত হয়। গ্রিসের সিরিজা সরকারকেই উদাহরণ হিসাবে বেছে নেওয়া যায়। সিরিজা জোট সরকার ঘোষিতরূপে বামপন্থী কর্মসূচির প্রচার চালিয়েছিল, নির্বাচনের আগে তারা একথাও বলে যে আর্থিক সংকটের মোকাবিলায় তারা পূর্বতন সরকারের ন্যায় জনবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে কার্যক্ষেত্রে কি ঘটল?
সিরিজা সরকার গ্রীসকে লগ্নী পুঁজির দাপটের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি কেননা সেরকম কিছু করতে গেলে গ্রীসকে কার্যত আন্তর্জাতিক বাজার থেকে মুছে দেওয়া হত। এর ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসতো। বিশ্বায়িত পুঁজি বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হয় বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজি জাতি রাষ্ট্রগুলিকে নিজেদের কর্তৃত্বের দখলে রাখতে নানা কায়দা-কানুনের আশ্রয় নেয়। এই জালে প্রায় সব দেশই কমবেশি জড়িয়ে রয়েছে। জিডিপি’র হিসাব কষে এমনভাবে দেখানো হয় যাতে মনে হতে পারে কোনও একটি বা দুটি দেশে অবস্থার উন্নতি ঘটছে, জনসাধারণ আগের তুলনায় ভালো অবস্থায় পৌঁছেছেন। আসলে এগুলি সবই লগ্নী পুঁজির নিজস্ব কায়দা। জিডিপি যে কায়দায় হিসাব করা হয় তার গড়াতেই গলদ রয়েছে, তার প্রভাবে কোনও দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রকৃত চিত্র কিছুতেই উপলব্ধি করা সম্ভব না। আরেকদিকে ইতিমধ্যে লগ্নী পুঁজির জালে জড়িয়ে পড়ার কারণে বিবিধ বাধানিষেধ ও শর্তাধীন সাহায্যের বেষ্টনীতে আটকে পড়ার অবস্থা। ছোট-বড় বিভিন্ন দেশই সেই জালে আটকে রয়েছে। এই ব্যবস্থা আসলে একধরণের সাঁড়াশি আক্রমণের কায়দায় পরিচালিত হয়। একদিকে সম্পদ, সম্পত্তি ক্রমাগত গুটিকয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, অন্যদিকে খেটে খাওয়া মজুদুর জনসাধারণ ক্রময়াগত তলিয়ে যেতে থাকেন। প্রতিবারের সংকট থেকে মুক্তি পেতে গরীব মানুষের উপরেই বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, ফলে পরবর্তী সংকট হয় আরও ভয়াবহ। পুঁজির সঞ্চালনা, বিনিয়োগ ইত্যাদি প্রসঙ্গে রীতিমত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম না করা অবধি সেই সংকট থেকে উদ্ধার হওয়ার কোনও উপায়ই নেই। কিন্তু এহেন যাবতীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সার্বিক বাধার পাঁচিল তুলেই নয়া উদারবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ যাই হোক না কেন তাতে খুব একটা কিছু আসে যায় না। এই কারণেই নয়া উদারবাদী বন্দোবস্তের মধ্যে থেকে বিকল্প কিছু প্রতিষ্ঠা করার ভাবনাকে আমি কার্যত সময় নষ্ট বলে চিহ্নিত করি। তাই স্বনির্ভরতা বলতে আমাদের স্বানির্ভর রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই উপলব্ধি করতে হবে। এমন রাষ্ট্র যা বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজির জাল ছিড়ে বেরিয়ে আসবে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি যাবতীয় বিষয়েই তাকে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নির্মাণ করতে হবে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে নিয়মের বিরুদ্ধাচারন করতে গেলে তার ফলাফল খুবই ভয়ানক হবে, তখন পূর্বতন সংকট নতুন চেহারায় আরও ভয়াবহ আকার নেবে।
যদি আমরা প্রকৃত অর্থে স্বনির্ভর হওয়ার বিষয়ে মনযোগী হই তবে সর্বাগ্রে স্বনির্ভর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রথমত পুঁজির মর্জিমাফিক যখন ইচ্ছা দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র বিনিয়োগের পথটি বন্ধ করতে হবে। এমনটা করতে গেলেই প্রাথমিকভাবে বেশ কিছুটা লগ্নী পালানোর উদ্দেশ্যে সফল হবে যার প্রভাবে দেশের বাজেটে বাণিজ্য ঘাটতি (ট্রেড ডেফিজিট) ও আয়-ব্যায়ের হিসাবে ঘাটতি (ইনকাম অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স ডেফিজিট) দেখা দেবে। অতএব শুধু পুঁজির সঞ্ছরন নিয়ন্ত্রণ করলেই চলবে এমনটা না, তার পাশপাশি নিজেদের আমদানি-রপ্তানির পরিকল্পনাতেও উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখক্তে হবে। কিছু ভ্রান্ত ধারণা একেবারে পরিত্যাগ করতে হবে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা আকশকুসম কল্পনা, আজকের পর্যায়ে তা কার্যত অসম্ভব। যে ব্যবস্থায় এমনিতেই জনকল্যাণের সাধারণ পন্থাগুলিও অবৈধ সেই নয়া উদার অর্থনীতি এখন সংকটগ্রস্থ অবস্থায় রয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের উপরে দুর্দশার বোঝা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। এই মুহূর্তে যদি মনে হয় রপ্তানির খাতে উন্নতিসাধনের বড় বেশি সুযোগ নেই তাহলে আয়-ব্যয়ের হিসাবটি কড়া হাতে পরিচালিত হতে হবে। এর মানে যাবতীয় বিনিয়োগের প্রত্যাশা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না, এমন অবস্থায় বিনিয়োগ টেনে আনতে বেশ কিছু ছাড়ও দেওয়া চলে। যে সমস্ত দেশ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে তারা প্রত্যেকেই নিজেদের জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলি কমিয়ে এনেছে, অথবা একেবারেই বাতিল করে দেওয়ার কথা ভাবছে। বিকল্প হিসাবে সেইসব প্রকল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মজুরির গড় হার বাড়িয়ে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের মোকাবিলা করা যেতে পারে। সহজ কথায় জনস্বার্থবাহী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহকে কার্যকরী করতে হবে। সমস্যা এড়িয়ে অথবা ফাঁক খুঁজে খুঁজে বিকল্পের সন্ধান করার বদলে গোটা ব্যবস্থাটিকেইক বাতিল করে দেওয়ার প্রয়োজন।
কারোর মনে হতে পারে এহেন কার্যকরী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে সরকারের ভাঁড়ারে যে বাড়তি অর্থের যোগান দরকার হবে তা কোথা থেকে কিভাবে আসবে। এহেন সমস্যার সমাধানে একেবারেই সাধারণ হিসাবের ভিত্তিতে আমি যেটুকু নির্ধারণ করতে পেরেছি তা সবার বিবেচনার জন্য পেশ করতে চাইব। আমাদের দেশের সংবিধানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনীতি করার বিষয়ে মৌলিক অধিকারের কথা উল্লিখিত রয়েছে। অর্থনীতিক অধিকারকে মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে বিবেচনা করা হয়নি, যদিও এখন বুঝতে অসুবিধা নেই তেমন কিছু থাকা জরুরী ছিল। আজকের অবস্থায় যদি আমরা ন্যুনতম পাঁচটি বুনিয়াদী অর্থনৈতিক অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে কতদুর অর্থের প্রয়োজন হবে? পাঁচটি ক্ষেত্র কি কি? খাদ্য বিষয়ক অধিকার (রাইট টু ফুড), কর্মসংস্থানের অধিকার (রাইট টু এমপ্লয়মেন্ট) এবং যদি কাজের সুযোগ দেওয়া না যায় তবে বিধিবদ্ধ ন্যুনতম মজুরি যা সার্বিকভাবে প্রযোজ্য হবে (বেকারভাতার সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে গড় মজুরির হিসাবেই একে নির্ধারণ করতে হবে), জনগণের অর্থে ভর্তুকি প্রাপ্ত অন্তত উচ্চমাধ্যমিক স্তর অবধি বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার (রাইট টু ফ্রি অ্যান্ড পাবলিকলি ফান্ডেড হায়ার সেকেন্ডারি এডুকেশন), জনগণের অর্থে ভর্তুকি প্রাপ্ত জনস্বাস্থ্য পরিষেবা (রাইট টু ফ্রি অ্যান্ড পাবলিকলি ফান্ডেড হেলথ কেয়ার) এবং ন্যুনতম মাসিক ৩০০০ টাকা মূল্যের (বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী) বার্ধক্যকালীন পেনশন (রাইট টু লিভিং ওল্ড এজ পেনশন, নট কন্ট্রিবিউটরি)। এই পাঁচটি অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে ভারত সরকারের যে পরিমাণ অর্থের সংস্থান প্রয়োজন তা দেশের মোট জিডিপি’র মাত্র ১০ শতাংশ ব্যয়েই মিটে যায়। জিডিপি’র দশ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করতে আয়ের পরিমাণ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে এমনও না। আপাতত জিডিপি’র বৃদ্ধি ৭ শতাংশ হলেই চলবে। এই বৃদ্ধি (অ্যাডিশনাল রিসোর্স মবিলাইজেশন) কিভাবে হবে? দেশের জনগণের সর্বোচ্চ ১ শতাংশের উপরে (সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলি) দুটি বাড়তি কর চাপালেই এই সমস্যা মিটে যায়। একটি সম্পত্তি করের হার বৃদ্ধি, আরেকটি হল উত্তরাধিকারসুত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ক্ষেত্রে সম্পদ কর। সম্পত্তি কর বাড়ালেই ধনী পরিবারগুলি নিজেদের আত্মীয়-পরিজনদের নামে সম্পত্তি ভাগ করতে শুরু করবে, তাই উত্তরাধিকার বাবদ প্রাপ্য সম্পত্তিতে কর চাপানো ছাড়া উপায় হবে না। এহেন কর বৃদ্ধি খুব বেশি বাড়াতে হবে এমনও না। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কর ৩০ শতাংশ হলেই চলবে, অর্থাৎ কেউ যদি একশো টাকার সম্পত্তি পায় তাকে সরকারে হাতে কর বাবদ তিরিশ টাকা দিতে হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, আমেরিকার শেষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় এলিজাবেথ ওয়ারেন কিংবা বার্নি স্যান্ডার্স’রা এর চাইতে অনেক বেশি চড়া হারে সম্পত্তি কর আদায়ের দাবী তুলেছিলেন, সেই দাবী কেবল ধনীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সার্বিক জনসাধারণকেই তার আওতায় নিয়ে আসতে চাওয়া হয়েছিল। জাপানে এই মুহূর্তে সম্পত্তি করের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ, সুতরাং আমাদের দাবিসমুহ অসম্ভব গোছের কিছু আদৌ এমন না। এই মুহূর্তে দেশের স্বনির্ভরতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আসলে যা প্রয়োজন তা হল ক্ষমতাসীন সরকারে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা এবং তাকে বাস্তবায়িত করতে বামপন্থীদের নিরন্তর আন্দোলন ও সংগ্রাম।
৭ই অক্টোবর কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে ভাষণ
ওয়েবডেস্কের পক্ষে ভাষান্তর সৌভিক ঘোষ