Neoliberalism

ফরেস্ট কনসার্ভেশন অ্যাক্ট সংশোধনী বিল

উদারিকরণ, কেন্দ্রীভবন এবং ক্রমবর্ধ্বমান আক্রমণ

বৃন্দা কারাত

কেন্দ্রের শাসক দল সংসদে বিরোধীদের কন্ঠরোধ করিয়ে একতরফা ভাবে বিনা বিতর্কেই একের পর এক সরকারি বিল পাশ করানোর চেষ্টা করে চলেছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি পদক্ষেপ হল’ ফরেস্ট কনসার্ভেশন অ্যাক্টের উপর সংশোধনী বিল। এই বিল সংসদে আনার পরেই বিষ্ময়জনকভাবে সেটিকে সরকারের তরফে রাজ্যসভা ও লোকসভার কিছু সাংসদদের নিয়ে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হল’। যেখানে ইতিমধ্যেই একটি সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি রয়েছে পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের সকল বিষয়ের জন্য, সরকার সেটিকে এড়িয়ে যেতে চাইছে কেন? সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান কংগ্রেসের নেতা জয়রাম রমেশ সঠিকভাবেই এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে এটিকে নজিরবিহীন এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির কাজের এক্তিয়ারের প্রতি অসম্মান বলে ব্যাক্ত করেছেন।

এই সংশোধনী বিল আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় পরিবেশ বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের তরফ থেকে ২০০৩ সালের ফরেস্ট কনজার্ভশন রুলে বিবিধ সংশোধনীর মাধ্যমে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে গ্রাম সভার তরফ থেকে তাদের সংশ্লিষ্ট বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রকল্পে অনুমতি প্রদান করা বা না করার সাংবিধানিক এবং আইনি অধিকার খর্ব করা হয়েছে, বনভূমির চরিত্র বদলের নিয়মকানুন কে আরো শিথিল করা হয়েছে, বনভূমির সংরক্ষণের নামে তার বেসরকারিকারণের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে আরো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বনাঞ্চলের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির অধিকার খর্ব করে। তদুপরি সংশোধিত রুলসের মাধ্যমে বনভূমি বৃদ্ধি/ সবুজায়নের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে ব্যবসায়িক স্বার্থে বেসরকারি বাগিচা নির্মাণকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

সিপিআই(এম)-র তরফে এই সকল সংশোধনীর বিরোধীতা করে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে মন্ত্রী শ্রী ভূপিন্দর যাদবকে। রাজ্যসভার সাংসদ, সিপিআই(এম)-র এলামারাম করিম রাজ্যসভার বিধিসম্মত একটি মোশন আনেন এই সকল নতুন রুলস বাতিল করার জন্য। সেই মোশন যদি বা গৃহীত হল’ বিতর্কের জন্য, সেই মোশনের উপর আলোচনা কে কোনো না কোনো ছুতোয় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে সরকারের তরফে এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট রুলসে সংশোধনী আনা হয়েছে। এই সকল পদক্ষেপ নতুন এই সংশোধনীর সাথে সামগ্রিকভাবে দেখলে বোঝা যায় যে মোদী সরকারের ‘ইজ অফ ডুইং বিজনেস’ নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এগুলি করা হচ্ছে।

এই সাম্প্রতিক সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসী এবং পরম্পরাগতভাবে বনবাসী মানুষের অধিকারসমূহের উপর আরেক দফা আক্রমণ করা হল’ এবং ভারতকে আইiনগতভাবে কার্বন নিঃসরণের অবাস্তব একটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে বাধ্য হতে হল’ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধে একপেশে একটি পদ্ধতির মাধ্যমে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে শধুমাত্র বনসৃজনে জোর দেওয়া হল’ যেখানে উন্নয়নের নামে বৃহৎ সকল বনখন্ড বেসরকারি কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়াই উদ্দেশ্য। বনের অধিকার আইনের প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধাচরণ করে এই সংশোধনী বিল এবং শুধুমাত্র এই কারণেই বিলটিকে গোড়াতেই বাতিল করে দেওয়া উচিত ছিল’।

কাদের ‘অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা’ ?

বিলটির ভূমিকা পর্বেই ‘আর্থিক প্রয়োজন’ শব্দবন্ধটি’র উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে ‘সংরক্ষণের এবং বনাঞ্চল পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে, বনাঞ্চলের সাংস্কৃতিক এবং পরম্পরাগত মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সাথে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা না বাড়ানোর সাযুয্যের উপায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন’। এক্ষেত্রে কার বা কাদের অর্থনীতিক প্রয়োজনের কথা বলা হচ্ছে? এটাই এই বিলের মূল বিষয়। ‘অর্থনৈতিক প্রয়োজনের’ নামে এই প্রস্তাবিত সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার বনসংরক্ষণ আইনের আওতা থেকে আরো বেশি বনাঞ্চল ও বিভিন্ন প্রকল্পকে ছাড় দিতে চাইছে। এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে রাজ্যসভায় সরকারপ্রদত্ত একটি উত্তরে জানা যাচ্ছে যে ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২.৫৩ লক্ষ হেক্টর বনভূমির চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য। এই বিলের মাধ্যমে বনভূমি ধ্বংসের উপরোক্ত প্রক্রিয়াকেই বিধিসম্মত করতে চাওয়া হচ্ছে।

বনের অধিকার আইন এবং তফশিল্ভুক্ত অঞ্চলে পঞ্চায়েতের অধিকার আইনকে উহ্য রাখা

বনাঞ্চলে পরম্পরাগতভাবে বসবাসকারী মানুষ এবং উপজাতিভুক্ত মানুষের প্রতিষ্ঠিত অধিকারসমূহের সুরক্ষার্থে যে সকল আইন এবং সাংবিধানিক রক্ষাকবচ রয়েছে, সেগুলিকে একবারের জন্যেও উল্লেখ করা হয়নি এই বিলে। বিলের ভূমিকাপর্বে বলা হয়েছে ‘বনবাসী মানুষের বনাঞ্চল ভিত্তিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির’ কথা কিন্তু সংশোধনী বিলের মূল অংশে এসবের কোনো উল্লেখই নেই। কাজেই এই সকল কথার আড়ালে আদতে আর্থসামাজিক এবং জীবিকার উন্নতির স্বপক্ষে যে সকল আইন রয়েছে, সেগুলিকেই লঙ্ঘন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ছাড়ের মাধ্যমে উদারীকরণ

এই বিলে যে ছাড় দেওয়া হচ্ছে তার অর্থ হল’ বিভিন্ন প্রকল্পকে পরিবেশ প্রভাব সমীক্ষা, বনের অধিকার আইন, তফশিল্ভুক্ত অঞ্চলে পঞ্চায়েতের অধিকার আইন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন (২০০৬ এর সংশোধনী সহ) সমূহের থেকে ছাড় দেওয়া, যেখানে বনাঞ্চলে যে কোনো শিল্পবানিজ্যের প্রকল্প রূপায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গ্রাম সভার অনুমোদনকে অলঙ্ঘনীয় বলা হয়েছে।

এই বিলের ১(ক) নং ধারার (১) এবং (২) নং উপধারায় বিশদে বলা হয়েছে কোন কোন ধরণের বনভূমি এবং কী ধরণের প্রকল্পকে উপরোক্ত ছাড়ের আওতায় রাখা হয়েছে। ১ নং উপধারায় ১৯৯৬ সালের আগে শুরু হওয়া সকল প্রকল্প, যা নাকি বনভূমির চরিত্রবদল করেছিল’, তাদের সকলকে এই ছাড়ের আওতায় আনা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এই পদক্ষেপ কে ঠিক মনে হতে পারে কারণ তা বহুকাল আগেই শুরু হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলিকে বৈধতা প্রদান করছে। কিন্তু আসলে বনের অধিকার আইন পাশ হয়ে যাওয়ার পরে এই সকল বনভূমিই সেই আইনের আওতায় চলে আসে এবং আদিবাসী ও অন্যান্য বনবাসী মানুষের স্বার্থরক্ষার স্বপক্ষে কাজ করে। এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে এই সকল অধিকারকে ১৯৯৬ সালের আগের প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে মান্যতাই দেওয়া হয়নি। এই সংশোধনী বিল বনাঞ্চলের সংজ্ঞা বদলে দিয়ে এই সকল প্রকল্পকে পাকাপাকি ভাবেই বনের অধিকার আইন এবং বন সংরক্ষণ আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যেতে চায়। বিভিন্ন প্রকল্পগুলিকে এই সকল আইনের আওতার বাইরে নিয়ে গেলে সেই সকল বনভূমির চরিত্র যে কোনো সময় ইচ্ছামত বদলে দেওয়া যাবে, সেই বদলের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কোনোরকম সম্মতি ছাড়াই।

২ নং ধারায় বিভিন্ন ধরণের জমিকে ছাড়ের আওতায় রাখা হয়েছে যার ফলে সমগ্র বনভূমির এক বৃহদংশকেই উপরোক্ত আইনপ্রদত্ত সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারের তরফে আদিবাসী এবং অন্যান্য পরমম্পরাগতভাবে বনবাসী মানুষের এই বনভূমির উপর সকল অধিকার কে খর্ব করার চেষ্টা করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার অবধি অঞ্চলকে বনসংরক্ষণ আইনের সুরক্ষার থেকে এই ছাড়ের আওতায় আনা হচ্ছে। একাধিক পরিবেশবিদের তরফ থেকে হিসেব করে দেখা হয়েছে যে এই ছাড়ের আওতায় আসতে চলেছে প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জমি যা কীনা সামগ্রিকভাবে সেই সকল অঞ্চল যার বড় অংশই বনভূমি, তার প্রায় ৪০ শতাংশ। এই ছাড় দেওয়া হয়েছে ‘জাতীয়স্বার্থে কৌশলগতকারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প’ অথবা ‘প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত’ কিংবা ‘জনহিতকারী প্রকল্প’কে। এই ধরণের লম্বা চওড়া শব্দবন্ধের ফলে যে কোনো বনাঞ্চলকেই ছাড়ের আওতায় আনা সম্ভব। তদুপরি ‘জাতীয় স্বার্থ’ বা ‘জনহিতকারী’ শব্দগুলি নির্দিষ্টভাবে সরকারি মালিকানার কথা বোঝায় না বরং কর্পোরেট মালিকানাধীন বেসরকারি সংস্থাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। বনসংরক্ষণ আইন থেকে এই সকল ছাড় আসলে জাতীয়স্বার্থে অতি গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্র, বিশেষতঃ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে বেসরকারি পুঁজির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার নীতিরই পরিপূরক পদক্ষেপ। বেসরকারি পুঁজিকে উৎসাহ প্রদান করার উদ্দেশ্যেই এই সকল পদক্ষেপ।  এর ফলে প্রত্যক্ষভাবে আদিবাসী এবং অন্যান্য বনবাসী মানুষের জীবন জীবিকার অধিকার খর্ব করা হবে বনের অধিকার আইন এবং বন সংরক্ষণ আইন কে সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে।

এই ছাড়ের আওতায় ‘বৃক্ষ, বাগিচা অথবা বনসৃজন যা কিনা নথিভুক্ত সরকারি জমিতে হয়নি’ কে নিয়ে আসা হয়েছে যার ফলে ব্যাক্তিমালিকানাধীন বনভূমিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীকরণ

এই বিলের মাধ্যমে রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতা কে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আত্মসাৎ করা হচ্ছে যার ফলে উপরোক্ত সকল ছাড় পাওয়া সম্ভব হবে রাজ্যকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ম মেনে, এমন কী গাছ কাটা এবং তার পরিপূরক বনসৃজনের ক্ষেত্রেও।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভবন আবারো করা হচ্ছে মূল আইনের ২ নং ধারায় প্রস্তাবিত আরেকটি সংশোধনীর মাধ্যমে। এটি কার্যকরী হতে চলেছে ‘বনাঞ্চলের নিঃসংরক্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞা অথবা বনভূমির অন্যান্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার’-র আইনি প্রয়োগে। এই সংশোধনী বিলের মাধ্যমে ‘বনভূমির অন্যান্য ব্যবহার’ এর ক্ষেত্রে ছাড়ের তালিকা আরো বাড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতি-পর্যটন, বেসরকারি উদ্যোগে জঙ্গলে সাফারি অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো পদক্ষেপকেই ছাড়ের আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার উপরোক্ত ২ নং ধারায় সংশোধনীর মাধ্যমে খনিজ অনুসন্ধান, উত্তোলনের মতই আরো বহু উদ্যোগকেই ‘অন্যান্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার’ এর আওতায় এনে বনের অধিকার আইন বা বন্ সংরক্ষণ আইনের থেকে ছাড় দিতে পারে এবং সেই ছাড়ের শর্তসমুহ নির্ধারণ করতে পারে।

কাজেই, এই সকল ছাড় যে বনাঞ্চলের ক্ষতিসাধন করবে তাই নয়, এই সকল সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সেই ক্ষমতা থাকবে যার বলে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের অনুমোদন ছাড়াই আরো বেশি করে ছাড় দেওয়া সম্ভব হবে কেন্দ্রেরই নির্দিষ্ট শর্তাবলীর ভিত্তিতে। সংরক্ষণের আইনকে শিথিল করা এবং এই বিষয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটানো এই সংশোধনী বিলের দুটি লক্ষ্য।

সরকারের ধাপ্পাবাজি

কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই সংশোধনী বিলের মাধ্যমে যেখানে বনাঞ্চলের পরিবেশগত নিরাপত্তা বিঘ্ন করে ছাড়ের পরিমাণ বিপুল ভাবে বৃদ্ধি করা হচ্ছে, বনভূমির চরিত্র বদল কে আইনি মান্যতা প্রদান করা হচ্ছে এবং উপজাতি সমূহের অধিকারকে আঘাত করা হচ্ছে, সেই বিলকে পাশ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কিনা ভারত সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসম্মত অবদানের নাম করে! যে বিলের উদ্দেশ্যই হল’ একগুচ্ছ প্রকল্পকে বনাঞ্চলের সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইনের আওতার বাইরে নিয়ে আসা, যে বিল পাশ হলে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আরো বেশি করে বনভূমি’র চরিত্র বদলে উৎসাহ দেওয়া হবে, সেই বিল কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধে ভারত সরকারের উপর ন্যস্ত জাতীয় অবদানের লক্ষ্যমাত্রা পুরণের সাথে সাযুয্যপূর্ণ হতে পারে?  এই বিলের ভূমিকা পর্ব এবং বিলের মূল অংশ পরস্পরবিরোধী।

আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত সরকারের উপর জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে ন্যস্ত দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সংশোধনী বিলের ভূমিকা পর্বে যাতে সরকার পরবর্তী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তার এই দায়িত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করতে পারে। বিলের ভূমিকা পর্বে সরকার নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক স্তরে তার উপর ধার্য হওয়া লক্ষ্যমাত্রার কথা, যেমন ‘অতিরিক্ত ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডায়ক্সাইডের সমতুল্য বিকল্প কার্বন সিঙ্ক গড়া’ এবং ‘২০৩০ সালের মধ্যে সামগ্রিক ভূখন্ডের এক তৃতীয়াংশ বনাঞ্চলের ও বনসৃজনের আওতায় নিয়ে আসা’ । এই লক্ষ্যমাত্রা কি অর্জন করা সম্ভব এই সকল ছাড়ের মাধ্যমে?

ভারতের বন জরীপের ২০২১ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে সামগ্রিক ভূখন্ডের মাত্র ২১.৭ শতাংশ বনাঞ্চল এবং ২.৯ শতাংশ ভূখন্ড বৃক্ষ আচ্ছাদনের আওতায় রয়েছে যা সব মিলিয়ে মোট ২৪.৭ শতাংশ হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই ২৪.৭ শতাংশ’ও আদতে চা বাগান, ফল বাগিচা এবং মরুভূমির কিছুটা গাছপালা কে হিসেবের মধ্যে ধরে তবে পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ সত্যিকারের বনভূমির পরিমাণ এই ২৪.৭ শতাংশের চেয়েও কম। কিন্তু, সরকারী হিসেব মেনে নিলেও আরো কতখানি জমির প্রয়োজন বৃক্ষরোপনের জন্য যার ফলে কার্বন সিঙ্কের উপরোক্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে?

ভারত সরকারের ‘গ্রীন মিশনের’ এস্টিমেটস কমিটি তাদের ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের রিপোর্টে জানিয়েছে যে ‘আমাদের কার্বন সঞ্চয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আরো ৩ কোটি হেক্টর বনভূমির প্রয়োজন’। এই রিপোর্টে অবশ্য এ কথা বলা হয়নি যে ঠিক কোথা থেকে এই পরিমাণ জমির ব্যবস্থা করা হবে। বনসৃজনের বেশিরভাগ কর্মসূচীই গ্রহণ করা হচ্ছে আদিবাসী এবং উপজাতিভুক্ত মানুষের জমিতে। এই সকল মানুষের অধিকারকে সুরক্ষিত করার পরিবর্তে তাদেরই জমি বলপূর্বক হরণ করা হচ্ছে নতুন করে বৃক্ষরোপনের জন্য।

২০২১ সালের বন সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী সামগ্রিক বনাঞ্চলের ৬০% এবং অতি গভীর অরণ্যের ৭৩% দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব এবং মধ্যভারতের ২১৮ টি উপজাতি/ আদিবাসী অধ্যুষিত জেলায় অবস্থিত। এই সব অঞ্চল দেশের সংবিধানের ৫ এবং ৬ নং তফশীল প্রদত্ত বিশেষ অধিকারের আওতায় আসে। এই সব জেলার মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার খনিজ এবং জল সম্পদেও সমৃদ্ধ। কাজেই খনি, বিদ্যুৎ এববং সেচ প্রকল্পে এই সকল অঞ্চলের জমির ব্যাপকভাবে চরিত্র বদল ঘটে যায়। এতদসত্ত্বেও এই সকল অঞ্চলে সামগ্রিকভাবে বনাঞ্চলের কিছুটা বৃদ্ধি ঘটেছিল যদিও তা নথিবদ্ধ বনাঞ্চলের আওতার বাইরে ঘটে। এটি আবারও বনভূমি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উপজাতি/আদিবাসী সম্প্রদায়ের অংশীদারিত্ব এবং তাদের অধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষার গুরুত্ব বোঝায়। তা সত্ত্বেও সরকার এর বিপরীত দিকে চলতে ইচ্ছুক।

সংক্ষেপে বলতে গেলে এই বিল একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ, যার মাধ্যমেঃ

১। বনাঞ্চলের সংজ্ঞা এমনভাবে পরিবর্তন করা হবে যাতে সেই বনাঞ্চলের এক বৃহদংশকেই বন সংরক্ষণ আইন এবং বনের অধিকার আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে আসা যায় (এই বিল পাশ করানোর আগেই কেন্দ্রীয় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের তরফ থেকে রাজ্যগুলির সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির সাথে সকল “ডীমড ফরেস্ট ক্যাটেগরি”র পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হয়েছে);

২। বনাঞ্চলের শাসনব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা যার ফলে শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটবে বনদপ্তরের আমলাতন্ত্র, জঙ্গল মাফিয়া এবং কর্পোরেটের হাতে; ৩। বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যেটুকু গনতন্ত্রীকরণ সম্ভব হয়েছে, বনের অধিকার আইন, তফশিলভুক্ত অঞ্চলে পঞ্চায়েতের অধিকার আইন এবং গ্রাম সভার ক্ষমতাকে খর্ব করে সেটুকুকেও ধ্বংস করা। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আদিবাসী/ উপজাতিভুক্ত মানুষের অধিকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন সংরক্ষণ আইনের এই সংশোধনী বিল সরকারের অস্ত্রাগারের আরেকটি হাতিয়ার এই যুদ্ধে এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই এখন এক অবশ্যকর্তব্য।

  • মূল লেখাটি পিপলস ডেমোক্র্যাসিতে প্রকাশিত

ভাষান্তরঃ বাবিন ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন