গনশক্তি পত্রিকার ৫৭-তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ‘দক্ষিণপন্থার বিপদ ও তার প্রতিরোধ’ বিষয়ে কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আলোচনা সভা আয়োজিত হয়। আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিটব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাট। কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে গনশক্তি এগিয়ে চলেছে পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তীর তরফে সেই কথা বলে সভার কাজ শুরু হয়। সভাপতির আসনে ছিলেন কমরেড বিমান বসু।
প্রকাশ কারাট বলেন সারা পৃথিবীতেই অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটছে। দক্ষিণপন্থা মানবসমাজের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য। ইতিহাসের নির্দিষ্ট বাঁক-মোড়ের মুখোমুখি তার রূপ বদলে অতি-দক্ষিণপন্থা সক্রিয় হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালি ও জার্মানিতে সেই অতি-দক্ষিণপন্থার একটি সুনির্দিষ্ট রূপ দেখা যায়। আজকের পৃথিবীতে নয়া-নাৎসিবাদ বলে যা কিছু চলছে সেইসব রাজনীতি কার্যত সেই ধারারই কিছুটা সময়োপযোগী চেহারা।
গোটা পৃথিবীতেই আজকের দিনে অতি-দক্ষিণপন্থা শক্তি সঞ্চয় করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এই ঘটনার আগে সেইসব দেশে ক্ষমতাসীন হয়েছে নয়া-উদারবাদ। সেই ব্যবস্থা সংকটে পড়েছে, সংকট সমাধানে আরও বেশি করে অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে সমাধানের বদলে সংকট আরও গভীরে পৌঁছে গেছে। সংকটে জর্জরিত হয়েছেন মেহনতি জনসাধারণ। আক্রান্ত হয়েছে অর্জিত মানবাধিকার, আক্রান্ত হয়েছে শ্রমিকের অধিকারও। সমাধানের অযোগ্য সংকটের সম্মুখীন হয়েই নয়া-উদারবাদ ক্রমশ অতি-দক্ষিণপন্থার দিকে সরে গেছে। নয়া-উদারবাদই আজকের পৃথিবীতে অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জন্ম দিয়েছে, তাকে আসরে নামিয়েছে।
এই অতি-দক্ষিণপন্থার বিভিন্ন দেশে নির্দিষ্ট চেহারা যেমন রয়েছে, তেমনই এর তিনটি সাধারণ বৈশিষ্টও দেখা যায়। প্রত্যেক জায়গাতেই এরা মূলত দেশের অভ্যন্তরে জনসাধারণের একটি অংশকে নিজেদের শত্রু বলে চিহ্নিত করে। দেশের যাবতীয় দুর্দশার জন্য সেই অংশের মানুষজনেদেরই দায়ী করে এবং আক্রমণ নামিয়ে আনে। আমাদের দেশেও আরএসএস-বিজেপি তেমনই করছে। ভারতে অতি-দক্ষিণপন্থার আক্রমনের লক্ষ্য হল ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। এই রাজনীতি জাতিয়তাবাদী স্লোগান দেয়, জনসাধারণের চেতনাস্থিত জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের প্রভাবিত করে। এই জাতীয়তাবাদ মূলত জনগণের সংখ্যাগুরু অংশের জাতিগত, ধর্মীয়, সংস্কৃতিগত পরিচয়কে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জে জাতিয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল তার থেকে আরএসএস-বিজেপি’র জাতিয়তাবাদের মৌলিক ফারাক এটাই। এর জোরেই তারা দাবী করে আমাদের দেশে হিন্দুরাই প্রকৃত ভারতীয়, বাকিরা সকলেই বহিরাগত। আসলে বহিরাগত বলে চিহ্নিত করে আক্রমনের পক্ষে যুক্তি হাজির করে, সমর্থনের আবহাওয়া তৈরি করে। তৃতীয় বৈশিষ্টটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, আজকের পৃথিবীতে অতি-দক্ষিণপন্থা নয়া-উদারবাদ জনিত দুর্দশার প্রসঙ্গে একটিও কথা বলে না। নয়া-উদারবাদের দরুন জনসাধারণের উপরে যা যা নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়েছে কার্যত এরা সেগুলিকে সমর্থন যুগিয়ে চলে এবং তারই বিনিময়ে আন্তর্জাতিক লগ্নী-পুঁজির থেকে নিজেদের ক্ষমতাসীন রাখতে জরুরী সমর্থন আদায় করে নেয়। সেই সমর্থনই এদের বিরাট আর্থিক সামর্থ্যের পিছনের কারণ। আমাদের দেশে একেই আমরা কর্পোরেট-কমিউনাল আঁতাত বলে অভিহিত করছি।
এর বিরুদ্ধে জনসাধারণের ব্যপকতম সক্রিয় প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। কিন্তু সেই কাজ সম্পন্ন করতে গেলে জরুরী হল দুটি পরস্পর নির্ভর কর্মসূচি। প্রথমটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিরোধে মতাদর্শগত প্রচার আন্দোলন, দ্বিতীয়টি জনজীবনের প্রতিটি জ্বলন্ত ইস্যুতে জনসাধারণের ব্যাপকতম অংশের সর্বোচ্চ সমাবেশের মাধ্যমে সক্রিয় সংগ্রামের পরিচালনা। দুটি কর্মসূচিই আমাদের কর্তব্য। এর একটিকে আরেকটি কাজের থেকে পৃথক হিসাবে বিবেচনার কিংবা সাধনের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন ভুল হলে হয় জনসাধারণের প্রতিরোধ নির্মাণের কাজ ব্যহত হবে, নয়তো আধিপত্যবাদী অতি-দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্য গড়ে উঠবে না। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে কর্পোরেট পুঁজির সমর্থন রয়েছে। মিডিয়াতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে আরএসএস-বিজেপি’র সাফল্যের কারণ সেটাই।
পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ছিলেন এদিনের সভায় শেষ বক্তা। তিনি বলেন, দক্ষিণপন্থার এই বাড়ন্ত এক রকম, আর সরাসরি বিচারব্যবস্থায় সেটা প্রয়োগ, আরেক বিষয়। আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস আরএসএসের আরেক মুখোশ হিসাবেই সক্রিয়, সেই মুখোশ ছিঁড়ে ফেলাই আমাদের কাজ। তৃনমূল কংগ্রেস এবং আরএসএস-বিজেপি জানে বামপন্থীদের কর্মসূচিতে আজ অথবা কাল সেই পর্দা ফাঁস হবেই। আর তাই হামলা, আক্রমণ, মিথ্যা মামলা। এমনকি মিডিয়ার সাহায্যে রাম-বাম প্রচারও সেই উদ্দেশ্যেই। আমাদের সামনে আগামী পঞ্চায়েত ভোট অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ, সেই চ্যালেঞ্জ আমরা স্বীকার করেই লড়াই সংগ্রামের রাস্তায় আছি, থাকবো।
রাজ্যের প্রেক্ষিতে বলতে গিয়ে তিনি এহেন ‘দোসর’-দের কথা বলেছেন, উল্লেখ করেছেন মুখ আর হাজারটা মুখোশের কথা। গণশক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে, সেই গণস্রোতেই ফিরতে হযেছে শুভেন্দু অধিকারী’কে সেকথাও স্পষ্ট করেন তিনি।
এদিনের সভায় আলোচনার সারাংশ তিনটি কথায় শেষ হতে পারে-
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সারাংশ আমাদের শেখায় দক্ষিণপন্থা মানুষ বাঁচালে, 'জেল ফেরত' লুলা ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি হতেন না।
ভয়,বিপদ সব আছে, তবু আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে ভারতের শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনসাধারণ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় যারাই লড়াই-সংগ্রামের ময়দানে রয়েছেন তাদের ঐক্যই মানুষের লড়াই জিতে নেওয়ার অন্যতম শর্ত।
পশ্চিমবঙ্গে সেই লড়াই তৃনমূল-বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধেই, আর তাই এই রাজ্যে বামপন্থীদের দায়িত্ব তাই কিছুটা বাড়তি।
বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলায় গনশক্তির সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী যা বলে নিজের কথা শেষ করেছেন, গণতান্ত্রিক চেতনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সঞ্জাত পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজকে সেই কথা মনে রাখতেই হবে- ‘রাস্তায় যখন রক্ত, পোশাক সাদা রাখাটা অপরাধ’।