ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
ইতিহাস ও একা একজন।
মিখাইল গর্বাচেভ।
ধান নয়, ভাঙ্গা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর তাই দুনিয়ার প্রথম শ্রমিকরাষ্ট্রের ভাঙ্গন রোখার দায়ে-দুষ্ট’দের উদ্দেশ্যে বিষাদগীতটুকু চিৎকার করে না হোক ধীরে হলেও স্পষ্ট করতেই হয়। এও এক ঐতিহ্য- উত্তরাধিকার হিসাবে যা বহমান।
শ্রেণীযুদ্ধ সম্পর্কিত তত্ত্ব কিভাবে কাজে প্রয়োগ করা হবে সেই নিয়ে স্তালিনের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে আর কেউ একচুল এগোনোর সাহস পান নি। অর্থনীতির বদলে ম্যানেজমেন্টশাস্ত্র প্রয়োগের শুরু নিকিতা খ্রুশ্চভের সময় থেকেই। পৃথিবী থেকে যে আকাশ দেখতে পাওয়া যায় সেখানে প্রথম মানুষ পাঠানোর মতো পণ্য এবং পণ্য নয় এমন যাবতীয় কিছুর ক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ গুলিয়ে ফেলার প্রসঙ্গে সোভিয়েতই প্রথম উদাহরণ তৈরি করে। মানবকল্যানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোৎকৃষ্ট প্রয়োগ, হানাদার লুঠেরা’কে রুখে দিতে উপযুক্ত সমরসজ্জার বন্দোবস্ত, আধুনিকতম শিক্ষানীতি প্রবর্তনের গৌরব যেমন তাদের রয়েছে, তেমনই সবশেষে এসে মেহনতি মানুষের সাথে বেইমানির খতিয়ানেও তাদের ভূমিকা নজীরবিহীন।
তাই একা গর্বাচেভ নয়, পেরেস্ত্রইকার ইতিহাসকে বিবেচনা করতে হয় আরও আগে থেকে। এখানেই ইতিহাসের বস্তুনির্ভরতা, অমৃতভাণ্ডই হোক আর বিষবৃক্ষই হোক দুয়েরই শিকড় থাকে। আবার ইতিহাসনির্দিস্ট ভূমিকা পালনে কোনও ব্যক্তির আচরণকেও নিক্তি মেপেই বিচার করতে হয়- তা নাহলে সমাজবিকাশের প্রশ্নে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের পার্টিকুলারিটিকে অস্বীকার করতে হয়।
সিপিএসইউ’র ২০তম কংগ্রেস। দুনিয়ার সামনে সভা ডেকে প্রমান করা শুরু হল জোসেফ স্তালিন কতটা খারাপ ছিলেন। গর্বাচেভ তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সেই নিস্তালিকরণ প্রক্রিয়ার পক্ষে প্রচারের দায়িত্ব সামলেছিলেন। যুবক গর্বাচেভকে শ্রমিকরাষ্ট্র ‘রেড ব্যানার অফ লেবার’ পুরষ্কার দেয়। ৯০’র দশকে সেই মানুষটাই যখন পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে নিজেই নিজেকে খারিজ করলেন এবং তারও পরে কমিউনিস্ট পার্টিকেই বেআইনি ঘোষণা করলেন তখন বোঝা গেল সোভিয়েতে কমিউনিস্টরা এমন একজনকে সর্বোচ্চ দায়িত্বে বসিয়েছিলেন মেহনতি জনগণ সম্পর্কে যার চেতনায় ‘লভ’ থাকুক আর নাই থাকুক অন্তত ‘লেবর’টুকুও পুরোটাই ‘লস্ট’।
উদারনীতির পণ্ডিতেরা চোখের চশমা এঁটে বলতে পারেন ততদিনে যে বদ্ধাবস্থা গড়ে উঠেছিল আর কিছুই করা যেত না। মজার কথা তাতে শেষ হয়ে যায় না, আসলে এই যে ‘আর কিছুই করার ছিল না’- এ যে সমাজ ব্যবস্থার স্টেডি স্টেট থিওরি! তাই যদি হবে তাহলে তো মার্কস বৃথাই লিখে গেলেন “দার্শনিকেরা জগতকে শুধু ব্যখ্যাই করে গেলেন, আসল কাজ হল এর পরিবর্তন সাধন”। আসলে এসব কথা ভুলে না গেলে মুক্ত বাজারে দর মেলে না, খাওয়ার থালায় পিৎজা এসে হাজির হয় না। আন্তর্জাতিক লগ্নী পূঁজির ধান্দাবাজ সহায়তা ব্যতিরেকেই একটা দেশ কিভাবে টিকে থাকবে গোটা পৃথিবীর মেহনতি জনগণের সামনে সেই বিকল্পের পথ দেখানোই ছিল দায়িত্ব, কর্তব্য। সেই কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলেই গর্বাচেভ আজও আলোচনার বিষয়, মারা গেছেন বলে আদৌ নয়। কমিউনিস্টদের মূল্যায়ন করতে হয় মৃত্যুর পরে, ‘রেনিগেড’ ও ‘লিক্যুইডেটর’দেরও তাই।
তাই জো বাইডেন যতই তাকে ‘শীতল যুদ্ধ সমাপনের নায়ক’ বলুন না কেন, আসলে গর্বাচভ যা করেছিলেন তাকে শত্রুর সমীপে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। এহেন আত্মসমর্পণের কৌশল (যাতে শুধু নিজে বা নিজের বাহিনীকেই নয়, দুনিয়া বদলের গোটা স্বপ্নটিকেই সমাধি দেওয়া হয়) তিনি নিকিতা খ্রুশ্চভের থেকেই শিখেছিলেন নাকি আরও পরে তার বিশেষ বন্ধু সিনিয়র জর্জ বুশের থেকে সেই নিয়েই বিতর্কের অবকাশ রয়ে গেল। বাকি যা কিছু তার সমাধান তিনি বেঁচে থাকতে নিজেই যুগিয়ে গেছেন। তার আবিষ্কৃত ‘গ্লাসনস্ত’ কার্যত ‘ব্রাহ্মনের বেশে শত্রু এসে হাজির হয়েছে’ জেনেও তারই হাতে নিজের সুরক্ষার ‘কবচ-কুণ্ডল’ ন্যস্ত করার ফিকির। মহাভারতে ইন্দ্রের সামনে অঙ্গরাজ কর্ণের তবু অঙ্গীকার রক্ষার গরিমাটুকু ছিল- পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসাবে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার সময় গর্বাচেভ কোন শপথ বাক্য পাঠ করেছিলেন আজ অন্তত সেই নিয়ে আর কোনও সংশয় নেই। রইল বাকি ‘পেরেস্ত্রইকা’। নিজের দুই ঊরু (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি এবং লেনিনের বিপ্লবী উত্তরাধিকার) চুরমার হওয়ার পরেও দুর্যোধন যেমন অশ্বত্থামা’কে সেনাপতি পদে নির্বাচিত করেছিলেন এবং তারই ফলে পাঁচটি নিরপরাধ শিশুর মাথা কাটা যায় তেমনই বন্দোবস্তের রুশী নাম ‘পেরেস্ত্রইকা’। একদিকে ডলার সাম্রাজ্যের ধাক্কায় বেসামাল, আরেকদিকে বাইরে থেকে যখন কিছুতেই লেনিন-স্তালিনের পার্টিকে ভেঙ্গে দেওয়া যাচ্ছে না তখন সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য ‘আরও বেশি গণতন্ত্র’র নামাবলি গায়ে চাপিয়ে যিনি বিশ্বরাজনীতির সেন্ট্রাল স্টেজে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই গর্বাচেভ।
তবে কি সবশেষে তিনি একাই?
এবং তার সামনে একটা গোটা ইতিহাস?
না, নিশ্চয়ই নয়। ১৯৯১ সালের ২৯ আগস্ট কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণার সাথে সাথেই ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার তৎকালীন উপলব্ধিতেই (এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান) যদি পৃথিবীতে মানবসমাজের শেষ রূপান্তর চিহ্নিত হত তাহলে এই প্রতিবেদন লিখতেই হতো না।
যদি তখনই দুনিয়া বদলে দেওয়া স্বপ্নের মৃত্যু ঘটত তবে গর্বাচেভের মৃত্যুও আদৌ কোনও খবর হত না।
কিন্তু মিখাইল গর্বাচেভের মৃত্যু আজও একটি বড় খবর।
তিনি যেটুকু যা করতে পেরেছিলেন সেই কৃতিত্বে তার মৃত্যু কোনও খবর নয়।
গর্বাচেভ যা কিছু করতে পারতেন এবং যার কোনকিছুই তিনি করেননি, ব্যর্থ হয়েছেন- সেই কারনেই তার মৃত্যু খবর।
ইতিহাসে মিখাইল গর্বাচেভের ভূমিকা এটুকুই।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া