kakababu 2022 2

কাকাবাবু, বৈপ্লবিক প্রেরণার উৎস

মানবেশ চৌধুরি

রণনীতিগত প্রশ্নে তখন পার্টি নামে ভাগ না হলেও, সব কিছুই ভাগ হয়ে গিয়েছে। বিপ্লবী অংশে আছেন অজস্র কমরেড এবং পার্টি প্রকাশনালয়। একদিন প্রকাশনা ভবনের সমস্ত সাথিরা মিলে ঠিক করলেন, এবার কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের জন্মদিন পালন করা খুব জরুরি। কিন্তু কাকাবাবুর জন্ম কোন সালে, কোন তারিখ তা কেউ জানতেন না। কারণ, কাকাবাবু এ প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে দিতেন না। যাইহোক, বাইরের আত্মগোপনে থাকা নেতৃত্বের মাধ্যমে কারাবন্দি নেতৃত্বকে তাঁরা প্রস্তাবটা দিলেন। বলাবাহুল্য কাকাবাবুও তখন কারাবন্দি। সেখানে বন্দি-নেতৃত্ব তাঁকে এই প্রস্তাব জানালে তিনি তীব্র আপত্তি করলেন। অনেক জোরাজুরির পর শেষে রাজি হলেন। কিন্তু সমস্যা হলো জন্ম তারিখটি নিয়ে। তাঁর শুধু মনে আছে, জন্মদিন ১৮৮৯ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সোমবার।

পুরোনো পঞ্জিকা ঘেঁটে জানা গেল, তা ৫ই আগস্ট।

বিপুল সারা পড়ে গেল। দেশ বিদেশ থেকে বার্তা আসা শুরু হলো। তার মধ্যে ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড রজনী পাম দত্তের বার্তার কিয়দংশ– ‘… From the very earliest days Muzaffar Ahmad has symbolized for all of us in the International Communist Movement the noblest expression of the Indian working class and the Indian communist movement. He has through all these years faithfully upheld the banner of Marxism-Leninism. He has faced very attack of enemy and prolonged sentences of imprisonment without flinching... Honor to Muzaffar Ahmad…’

kakababu 1

কাকাবাবুর জন্মদিন ১৯৬৩ সালের ৫ই আগস্ট প্রথম পালিত হলো। সকালে দমদম সেন্ট্রাল জেলে বিরাট মিছিল পৌঁছালো। কারাবন্দি কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে মাল্যার্পণ করা হলো। বিকালে অন্য কোনও হল না পাওয়ায়, রামমোহন লাইব্রেরিতে ভেতরে–বাইরে ভীড়ে ঠাসা সভা অনুষ্ঠিত হলো। কলকাতা শুধু নয়, বাইরের জেলা থেকেও পার্টি ও গণসংগঠনের অনেক সাথি উপস্থিত হয়ে ছিলেন। 

সেই থেকে শুরু হলো কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের জন্মদিবস পালন।

কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সম্পর্কে কয়েকটি কথা।

জন্মঃ ৫ই আগস্ট, ১৮৮৯ সাল। জন্মস্থানঃ নোয়াখালি জেলার সন্দীপ মহকুমার অন্তর্গত মুসাপুর গ্রাম। পিতাঃ খ্যাতনাম মোক্তার জনাব মনসুর আলী, মাতাঃ চুনা বিবি।

বাবা প্রখ্যাত মোক্তার হলেও অভাবী ছিলেন।!পরিবারে অভাব থাকার জন্য খুবই কষ্টের মধ্যে তাঁর জীবন শুরু হলো। তারমধ্যেই লেখাপড়া ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। নানা ঘাটে তাঁর জীবন তরী ঠেকে ঠেকে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় এসে ভেড়ে। সেই সময় থেকে সাহিত্য পত্রিকার ও পত্রিকা সংগঠনের যুক্ত হলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে অংশ নিতে থাকেন। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে যে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, তার প্রতিবাদ-মিছিলে অংশ গ্রহন করেন। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, উদ্দীপ্ত মজদুরদের দ্বারা তখন দেশজুড়ে অনেক শ্রমিক ধর্মঘট হতে থাকে। তাঁর মনের মধ্যে শ্রমজীবিদের প্রতি পক্ষপাত সৃষ্টি হতে থাকে।

তখনই তিনি বেশ ভালো মানের সাহিত্যকর্মে পারঙ্গম হয়ে উঠেছেন। শুধু সাহিত্য চর্চা করলে তিনি বড় মাপের সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারতেন। তাঁর রচনাগুলি পাঠ করলেই তা বোঝা যায়। ১৯১৯ সালে তাঁর মনের মধ্যে এ নিয়ে বিপুল আলোড়োন সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি স্থির করেন, তাঁর জীবনের পেশা হবে রাজনীতি, সাহিত্য চর্চা নয়।

সমসময়ে সামরিক বিভাগ থেকে কবি নজরুল ইসলাম ফিরে এলে, তাঁর সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ, অর্ধ-সাপ্তাহিক ধুমকেতু, লাঙল ও গণবানী পত্রিকা প্রকাশে উভয়ে বিরাট ভূমিকা পালন করেন।

১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর, তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। ১৯২০–’২১ সালে তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কেন্দ্রের (Communist International) কেন্দ্র মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

kakababu 2

বোম্বে, মাদ্রাজ, লাহোরে তাঁর মতো যাঁরা সোভিয়েত বিপ্লব ও ভারতে এ বিষয়ে কী করা যায় নিয়ে চিন্তা করছিলেন, তাঁরাও ঐ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ঐ কেন্দ্র তাঁদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেয়।

ঐ সময় কলকাতায় খুব অসুবিধার মধ্য দিয়ে যে কয়েকটা পুস্তক মস্কো থেকে এসে পৌঁছাতো, তা প্রবল অর্থকৃচ্ছতার মধ্যেও তিনি কেনেন।

১৯২২ সালের শেষ দিকে কলকাতায় কমরেড আব্দুল হালিমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। কমরেড হালিম ছিলেন কাকাবাবুর ভাষায় বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার পথিকৃত। সারা জীবন কমরেড হালিম কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে নিষ্ঠ থেকেছেন, তা তাঁর জীবনেতিহাস পাঠ করলে জানা যায়।

১৯২২ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পক্ষে কমরেড এম এন রায়, কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে একইসঙ্গে প্রকাশ্যে ও গোপনে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কথা বলে চিঠি দেন।

১৯২৩ সালে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।

ব্রিটিশ রাজ সোভিয়েত বিপ্লব সম্পর্কে খুবই ভীত ছিল। তার কোন রকম প্রভাব যাতে ভারতে না আসে তার জন্য, খুবই সতর্ক ছিল।

এদিকে তাসখন্দে ভারতের কমিঊনিস্ট পার্টি গঠনের আগে কয়েকজন মুহাজীর (আত্মনির্বাসিত) এবং ২০২০–’২১ সালে দলে দলে হিজিরতকারী বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ার, আফগানিস্তান ও নানা অতীব কষ্টকর পথ পেরিয়ে প্রথমে তাসখন্দে, তারপর মস্কোতে গিয়ে পোঁছান। সেখানে কমিউনস্ট বিশ্ববীক্ষা ও কমিউনিস্ট কাজের ধারা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহন করে, তাঁরা ভারতে ফিরে এসে  কমিউনিস্ট পার্টির কাজের ধারা অনুযায়ী কাজ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তাঁরা যে তাসখন্দ গিয়েছিলেন, তার থেকে আরও দুর্গম পথে ফিরে আসতে গিয়ে, পথের কষ্টে অর্ধেক কমরেড মারা যান। মৃতবৎ অবস্থায় যাঁরা ফিরে আসেন, তাঁরা ব্রিটিশরাজের সৈন্যদের দ্বারা আটককৃত হন। তাঁদেরকে পেশোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় আটক করা হয়। দফায় দফায় ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ঐ একই নামের মামলায়, অনেক কমরেডকে যুক্ত করে কারাবন্দি করা হয়।

ঐ সময় ১৯২৩ সালে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকেও ঐ মামলায় যুক্ত করা হয়। কিন্তু তা ফলবতি হয় নি।

কিন্তু ১৯২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী হিসাবে তাকে আটক করা হয়। তাঁর সঙ্গী ছিলেন এস এ ডাঙ্গে, শওকত ওসমানি ও নলিনী গুপ্ত। বিচারে তাঁদের চার বছর স্বশ্রম কারাদণ্ড হয়। উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলী জেলে থাকাকালীন কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ উৎকট ধরনের যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরোতে থাকে। শরীরের ওজন কমে হয় মাত্র ৪৮ পাউণ্ড (২৩কিলো)। ব্রিটিশ সরকার ভয় পেয়ে যায়। তাঁকে আলমোড়া পাহাড়ে নিয়ে যায়।

স্বাস্থ্য মোটামুটি চলার মতো হলে, তিনি ১৯২৫ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর অনুপস্থিতির সময়ে লেবার স্বরাজ পার্টি গঠিত হয়। তিনি এসে তার হাল ধরেন। পর্যায়ক্রমে তার নাম বদলে হয়, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টি।

এই সময়কালে বর্ধমান, হাওড়া, হুগলী, যশোহর, কুমিল্যা, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ, মেদিনীপুর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলায় তিনি সংগঠনের কাজে পরিক্রমা করেন।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টি গড়ে ওঠে। সেজন্য তাঁকে রাজ্যের বাইরেও যেতে হয়। যুগপৎ কমিউনিস্ট পার্টির জন্যও দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় তাঁকে।

১৯২৮ সালে যখন কলকাতার এলবার্ট হলে (কফিহাউস) সারা ভারতের ওয়ার্কার্স এন্ড পেজেন্টস পার্টির সম্মেলন হয়, তখন তার অবসরে কমিউনিস্ট পার্টিরও সর্বভারতীয় সভা করে, বোঝা পড়া ঠিক করে নেওয়া হয়।

১৯২৯ সালের ২০শে মার্চ, কলকাতা থেকে মিরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার হন ৩২ জন।

বন্দিরা ঠিক করেন, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাঁরা বিবৃতি দেবেন। তার মধ্যে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-এর বিবৃতি সব থেকে মূল্যবান। এই বিবৃতিগুলি ইতিহাসের উপাদান হয়ে গিয়েছে। যখন তাঁদের  বিবৃতিগুলি পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল, তাতে সারা দেশে আলোড়ণ সৃষ্টি হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের কার্যধারা সম্পর্কে উৎসাহ সৃষ্টি হয়। পার্টি প্রসারে তা সহায়ক হয়। পরে কমরেড সুবোধ রায়ের সম্পাদনায় পুস্তকাকারে এই বিবৃতিগুলি প্রকাশিত হয়– Communist Challenge to the Imperialism from the Dock নাম দিয়ে।     

১৯৩৬ সালে তাঁর সাজার মেয়াদ শেষ হবার পরেও তাঁকে বৎসরাধিক মেদিনীপুরের সুতাহাটাতে অন্তরিণ করে রাখা হয়।

এই অবস্থাতেও তিনি কৃষক সমিতির কাজ চালিয়ে যান।  এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা গড়ে তুলবার উদ্যোগ নেন।

বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়রে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। তিনি সম্মেলনের সভাপতি পরিষদের অন্যতম সভাপতি হিসাবে যে লিখিত ভাষণ দিয়েছিলেন, তা এক দিগদর্শণ স্বরূপ। তখন প্রতি বছর প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। ঐ সম্মেলন গুলিতেও তিনি লিখিত ভাষণ পাঠ করতেন। এসব পড়লে বোঝা যাবে, কত নিবিড়ভাবে তিনি কৃষক জীবন ও কৃষক সমাজকে বুঝতেন।

মনে রাখতে হবে, ১৯৩৪ সাল থেকে পার্টি নিষিদ্ধ। ১৯৪২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত। তার মধ্যেই ঐ কাজগুলি চলতে থাকে।

১৯৩৬ সালে সারাভারত কৃষক সভার প্রথম সম্মেলনের সময় (লক্ষ্ণৌ- ১১ এপ্রিল) তিনি কারাবন্দি। কিন্তু পরের সম্মেলনগুলিতে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি সংগঠনের সহ সভাপতির পদে বৃত ছিলেন।

১৯৩৭ সাল থেকে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা বিপ্লবীরা কারা মুক্ত হয়ে, তাদের আচরিত পথ যে ভুল তা বুঝতে পেরে, বিপুল সংখ্যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। যাঁরা কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হতেন, তাঁদের কাউকে কাউকে তিনি শ্রমিক ফ্রন্টে আর কাউকে কাউকে কৃষক ফ্রণ্টে নিয়োগ করতেন। বেশীরভাগ কারামুক্ত বিপ্লবীদের স্বাভাবিক কারণেই তাঁর সঙ্গে পত্র মারফৎ যোগাযোগ করতে হতো। এই যোগাযোগের পরে হয় তিনি নিজে যেতেন বা অন্যান্য নেতৃত্বকারী কমরেডদের পাঠাতেন। যেমন, আমাদের অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বিপ্লবীরা যোগাযোগ করলে, তিনি বঙ্কিম মুখার্জীকে পাঠান। বিভূতি গুহকে আহ্বায়ক করে তিনজনের একটি পার্টি প্রস্তুতি কমিটি তৈরি হয়। সেটা ১৯৩৮ সাল। কিছুদিন পরে বিভূতি গুহকে কলকাতায় পার্টির প্রাদেশিক দপ্তরে নিয়ে গেলে, সুশীল সেন সম্পাদক হন। ঐ সময় বঙ্কিম মুখার্জী দিনাজপুর শহর, লালপুর ডাঙা ও প্রাণসাগর – এই তিনটি জায়গায় জনসভা করেন। ঐ বছরেরই শেষে বা ১৯৩৯ সালের প্রথম দিকে ফুলবাড়ি থানার লালপুর ডাঙায় দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতির প্রথম সম্মেলন হয়। তাতে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ, বঙ্কিম মুখার্জী প্রমুখ রাজ্য নেতারা এসেছিলেন।

পার্টি নিষিদ্ধ থাকা কালীন সময়েই ১৯৩৯ সালে কলকাতায় তাঁরই মূল উদ্যোগে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি গড়ে ওঠে।

১৯৪০ সালে তাঁকে কলকাতা থেকে বহিস্কার করলেও, তিনি কলকাতাতেই আত্মগোপন করে থেকে যান। তখন তাঁর নামকরণ হয়– কাকাবাবু। যেন তিনি একটি একান্নবর্তি পরিবারের কর্তা!

ব্রিটিশ রাজ সৃষ্ট মহামন্বতরের সময়— ত্রাণ, পুনর্গঠণ, মজুত উদ্ধার, মহামারি প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজগুলি ঠিক ঠিক ভাবে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী যাতে সম্পন্ন হয়, তার জন্য তিনি সজাগ সতর্ক থেকে সমগ্র পার্টিকে পরিচালনা করেছেন।

১৯৪৩ সালে বাংলার ও দেশের অন্যান্য স্থানের বিপন্ন মানুষের চিকিৎসা ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছে জন্য দেবার গঠিত হয় পিপলস রিলিফ কমিটি। মূল উদ্যোক্তা কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ।

একেবারে দুস্থ কমরেডদের জন্য তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠলো ১৯৪৪-’৪৫ সালে রেড এইড কিওর হোম। যক্ষ্মারোগ আক্রান্ত কবি সুকান্ত ভট্টাযার্যের এখানে চিকিৎসা হয়। হঠাৎ শুনতে পেলেন, কবি জীবীত নেই। কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে দীর্ঘদিন তাঁর খোঁজ নিতে পারেননি। কবির মৃত্যুর পরে তিনি একেবারে ভেঙে পড়ে লিখলেন– আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। এই নিবন্ধটি পড়লে তাঁর দরদি মনের পরিচয় পেয়ে, সবারই মন আর্দ্র হয়ে পরবে।

কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ যেমন নবযুগ, লাগল, ধুমকেতু, গণবানী পত্রিকা প্রথম জীবনে প্রকাশ করেছেন প্রত্যক্ষভাবে বা সঙ্গী হিসাবে, সে রকমই পাক্ষিক গণশক্তি, জনযুদ্ধ, দৈনিক স্বাধিনতা, দৈনিক গণশক্তি, সাপ্তাহিক দেশহিতৈষী ও মাসিক নন্দন পত্রিকার প্রকাশে তাঁর ছিল বিরাট ভূমিকা। মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি মাসিক নন্দন-এর সভাপতি ছিলেন।

কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ছিলেন সুলেখক। তাঁর গদ্যের সুনাম অনেকেই করেছেন। যাঁরা পড়তে শুরু করেন, তাঁরা মাঝপথে ছেদ দিতে পারেন না– এমনই সে গদ্যের সম্মোহন। প্রখ্যাত লেখক শিবরাম চক্রবর্তি তাঁর গদ্য নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা হোক— এই সুপারিশ করেছিলেন। বৃদ্ধাবস্থায় এমনকী কারাবন্দি অবস্থায়, লেখায় কোন ভুল না থাকে, সে বিষয়ে সদা সতর্ক থেকে, তিনি নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা এবং আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি– নামে দু’টি মৌলিক আকর গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ও ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৪৮ সালেই পার্টি আবার নিষিদ্ধ হলো। কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ আবার হলেন কারাবন্দি।

১৯৫১-’৫২ সালে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় তাঁকে আবার কারারুদ্ধ করা হলো। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ১৯৬৪ সালে আবার।

Mujaffar Ahmad

১৯৫১ সালে পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার সম সময়েই, পার্টিতে সংশোধনবাদ জাঁকিয়ে বসে। প্রকৃত কমিউনিস্টদের ওপর শ্রেণী শত্রু, সরকার ও পার্টির ঐ অংশ থেকে আক্রমন নেমে আসে। পার্টি যাতে সংশোধনবাদের গাড্ডায় না পরে, তার জন্য মূল ভূমিকা নেন কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। সে রকমই, ১৯৬৭ সাল থেকে পার্টির ওপর সংকীর্ণবাদীদের আক্রমণ শুরু হয়। তখন তাদের হাত থেকেও পার্টিকে রক্ষা করার মূল ভূমিকা গ্রহন করেন তিনি। আন্তর্জাতিকতাবাদ, মার্কসবাদী বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও মাতাদর্শের প্রতি ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান ও বিশ্বাস। এই বিশ্বাস তাঁকে সমস্ত ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করেছে এবং সমস্ত ধরণের কষ্ট সহ্য করার শক্তি জুগিয়েছে। নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেবার প্রেরণা দিয়েছে।

তাঁর জীবনের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল, তাঁর চলৎশক্তি থাকা পর্যন্ত তিনি কোনও দিন বিশ্রাম নেননি।

তাঁর চরিত্রের আরও একটা বৈশিষ্ট ছিল, নারীদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত। নারীদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার সামাজিক বৈষম্য তাঁকে বিশেষভাবে বিচলিত করতো। এই বৈষম্য নিরসনে মার্কসবাদী চিন্তাধারাই যে সর্বাপেক্ষা শ্রেয়– তা তিনি বিশ্লষণ করে দেখিয়েছেন।

কমরেড মুজফ্ফ‌র আহ্‌মদের জীবনাদর্শ আমাদের কাছে সর্বদাই বৈপ্লবিক প্রেরণার উৎস। তাঁর আরাদ্ধ পথে, তাঁর আদর্শের পথে আমরা দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবো– এই হোক আমাদের শপথ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন